Tuesday, December 29, 2020

হ্যামিলনের বাশীওয়ালা, ২০২০

হ্যামিলনের বাশিওয়ালার কথা মনে আছে? বাঁশির শব্দ শুনে একে একে ঘর থেকে সব ইঁদুর বের হয়ে এসেছিল, তার পিছে পিছে মন্ত্রমুগ্ধের মত মিছিল করে এগিয়ে গিয়েছিল মৃত্যু যাত্রায়। পরবর্তীতে একইভাবে সে ঐ শহরের সব বাচ্চাদেরকেও নিয়ে গিয়েছিল মন্ত্রমুগ্ধ করে। সে বাচ্চারাও আর ফিরেনি।

করোনা, বা কোভিদ ১৯ যেন এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। সারা বছর জুড়ে শুনলাম শুধু মানুষের মৃত্য আর অসুস্থতার সংবাদ।

আমি খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে পড়েছি ক্লাস ফাইভ থেকে
এসএসসি পর্যন্ত। স্কুল জীবনের বন্ধু মেহেদী গতকাল রাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
মেহেদী খুব হাসিখুশী ছেলে ছিল। সব সময় ওর মুখে এক টুকরো হাসি ঝুলে থাকতো।

আমাদের এস এস সি পরীক্ষার সিট পড়েছিল বাড্ডা আলাতুন্নেসা স্কুলে। পরীক্ষা দিতে দিতে মাঝে মাঝে পিঠ ঘুরিয়ে পেছনের সিটে তাকালেই দেখতাম গভীর মনোযোগে লিখে যাচ্ছে ও। কিন্তু মুখের সেই এক চিলতে কৌতুকপূর্ণ হাসিটা কখনো মুছে যেত না। হ্যা, মেহেদী আমার পেছনে বসেই পরীক্ষা দিয়েছিল। স্কুলে ওর রোল নাম্বার ছিল ৭, আমাদের এসএসসির সিটগুলোও ক্লাস টেনের রোল নম্বর অনুসারেই সাজানো হয়েছিল।

পরীক্ষার পর সেও আমার মতই নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিছুদিন পরে শুনি মেহেদীর আব্বা মারা গিয়েছে। এরপর শুনি ও কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রকম গুজব আর ছোট খাট সংবাদ শুনেছি মেহেদীর ব্যাপারে। তারপর বহু বছর ওর আর কোন খোজ পাইনি।

২০১৫ সালে, ফেসবুকের মাধ্যমে আবার যোগাযোগ হল। কিন্তু কথা হোত না কখনোই। এমনকি ওর ফেসবুক প্রোফাইলেও যাওয়া হয়নি কখনো তেমন একটা। আজ তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে প্রোফাইলে গেলাম ছেলেবেলার বন্ধুটিকে খুঁজে পাওয়ার আশায়, এবং পেয়েও গেলাম পুরনো কিছু ছবিতে।

প্রোফাইল জুড়ে তার ফুটফুটে দু'টি শিশুর ছবি। কি যে একটা কষ্ট বুকের মাঝে আটকে যাচ্ছে, কতটাই না কষ্টে আছে ওর পরিবার, আমি হয়তো তার ১ ভাগও বুঝতে পারছি না।

ওর সাথে মেসেঞ্জারে শেষ কথোপকথন হচ্ছে ওর ফোন নাম্বার নেয়া। তবে আমি সে নাম্বারে কল দেইনি। কল না দিয়ে আমি লিখেছি "এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে, আগামীকাল ফোন দিব"।

সেই আগামীকাল আর আসেনি। ফোন নম্বর ইনবক্সেই থেকে গিয়েছে। কখনোই আর সে নাম্বারে কল করা হবে না।

আমাদের কারও হাতে আসলে কোন সময় নেই। সময় যে নেই, সে কথাটাও আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না। এটাই সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার।

আমার শশুড় (যাকে আমরা আদর করে বাপু ডাকতাম) মারা গেলেন ৭ দিন আগে, ২২ তারিখে। উনাকে নোয়াখালীতে, উনার পৈত্রিক নিবাসে কবর দিয়ে আসলাম তিন দিন আগে।

ঢাকায় ফেরার পর থেকে আমি নিজেও অসুস্থতার কবলে পড়েছি। মন দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। চোখের পানিতে জড়ানো এই লেখাটির তার বড় প্রমাণ।

বাপুর মৃত্যুর ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। উনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল ১৯ ডিসেম্বর, শনিবার। সারাদিন উনি উনার দুই বেয়াই এর সাথে খেলা দেখলেন, সবাইকে মাতিয়ে রাখলেন স্বভাবসুলভ হাসি ঠাট্টায়। এরপর এক সময় নিজের রুমে চলে গেলেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য।
উনি ঘুমাচ্ছেন ভেবে উনার কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম।

হঠাত কি মনে করে আবার উনার রুমে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি উনি বসে আছেন, তখনো ঘুমাননি।

বিদায় নিলাম।

উনি হাসিমুখে আমাকে বিদায় দিলেন, আর বললেন "তোমাকে দেখলে খুব ভাল লাগে। আবার এসো।"

তখনও যদি জানতাম যে আর দেখা হবে না, তাহলে সেদিন আর বাসায় ফিরতাম না।

এই একই অভিশপ্ত সপ্তাহের মাঝে শুনলাম বন্ধু মুবিরের বাবার মৃত্যুসংবাদ। ও হোয়াটসেপে প্রথমে দোয়ার জন্য বল্লো; আংকেলকে আইসিউতে নিয়ে যাচ্ছে, সে সংবাদ দিল। এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই উনার মৃত্যুসংবাদ দিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, আংকেলসহ ওর পরিবারের অনেকেই করোনা আক্রান্ত, কিন্তু ও নিজে দেশের বাইরে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থ ও দীর্ঘ জীবন দান করুক।

আমীন।

No comments: