Sunday, July 22, 2018

Love the Blues

আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী জেমস এর একটি গান আছে, যার নাম "গিটার কাঁদতে জানে"। বাস্তবিকই, গিটার কাঁদতে জানে, এবং পারে শ্রোতাদের কাঁদাতে। হ্যা, আমি ব্লুজ সংগীত এর কথা বলছি। 

আমি মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই গান শুনে আসছি। শুরু করেছিলাম বনি এম, এবা দিয়ে। সেখান থেকে হেভি মেটাল, হার্ড রক, পপ, ক্লাসিক রক পার হয়ে তারপর সাইকাডেলিক রক, প্রগ্রেসিভ রক, ডেথ মেটাল এসবে গিয়ে একটা ব্রেক নেই। হঠাত ব্লুজ আর জ্যাজ ভাল লাগা শুরু করে। 

প্রথম যখন গ্যারি মুর এর "স্টিল গট দ্যা ব্লুজ" শুনেছিলাম, তখনো অনুধাবন করতে পারিনি ব্লুজ এর শক্তি। বি বি কিং শোনার পর থেকে জীবন পালটে যায়। মেটালিকা মেগাডেথ স্যাভাটাজ মরবিড এঞ্জেল এর শ্রোতা একজন থ্রিল ইজ গন শুনে চোখের পানি মুছে--এই দৃশ্য আমি আমার অবাস্তবতম স্বপ্নেও ভাবিনি! ২০১৫ সালে যখন বি বি কিং মারা যান, আমি সারাদিন নিস্তব্ধ ছিলাম। আমার জীবদ্দশায় বেশ কিছু প্রিয় শিল্পী পরলোক গমন করেন, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ ব্যাপারগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। 

আসলে ব্লুজ বলতে কি বোঝায়, তা কাউকে লিখে, কিংবা বলে বলে বোঝানো কঠিন। যদি আপনি যথেষ্ঠ পরিমাণে ব্লুজ শুনেন, তাহলে বুঝতে পারবেন উহা কি বস্তু। আমি এইটুকু বুঝি যে প্রতিটি ব্লুজ গানের মাঝে লুকিয়ে আছে "ব্লু", অর্থাৎ বেদনা। বেদনার রঙ নীল, এটি কে না জানে?  

হালের জনপ্রিয় নেটফ্লিক্স সিরিজ "লিউক কেইজ"। কাহিনীর উপজীব্য হচ্ছে একজন বুলেটপ্রুফ হিরো লিউক, যে কিনা কালো অধ্যুষিত হার্লেম অঞ্চলে থাকে। এই সিরিজটি ব্লুজ ভক্তদের জন্য খুব আনন্দদায়ক। কৃশকায়, বিশালদেহী নায়ক যখন ভিলেনদের কিলিয়ে ভর্তা বানায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্লুজ বাজতে থাকে। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। যাই হোক, এই লেখা শেষ করবো আমার প্রিয়, এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ব্লুজ একক এর লিংক দিয়েঃ

https://youtu.be/4fk2prKnYnI


Thursday, July 19, 2018

২৪ ঘন্টা

২৪ ঘন্টা

আজকে দিনটি অন্যরকম ছিল সব দিক দিয়েই। সকালে এলার্ম এর শব্দটা কেন জানি শুনিনি। অনেকদিন ধরেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার প্রয়োজনীয়তাটি নেই, কিন্তু তারপরেও কেন জানি মোবাইলের ৬ঃ৩০র এলার্ম টা বন্ধ করা হয়নি।

যখন ঘুম ভাংলো, তখন বাইরে ঝকঝকে রোদ, ঘড়িতে বাজে ৯ টা। "আম্মা নাস্তা দাও" বলতে গিয়েও বলতে পারলো না তানভির, কথা গুলো মুখের কাছে এসে আটলে গেল। মনে পড়লো, এই ডাকে সাড়া দেয়ার মানুষটি চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে আরো তিন হাজার ছয়শো ষাতষট্টি দিন আগে।

তবে অন্যদিনের মত মন খারাপ হল না, কারণ আজ আর ঘুম থেকে উঠে ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করা লাগছে না, পাশের রেস্তোরাঁ থেকে প্লেটে করে নাস্তা দিয়ে গিয়েছে আরও আধ ঘন্টা আগেই। রশিদ মিয়া কে বলা আছে, সে জানালা দিয়ে কিভাবে জানি প্লেট টা ঢুকিয়ে টেবিলে রেখে দেয়।

আজ মেনুতে পরটা ভাজি। ভাজি খেতে খেতে হঠাত আবিষ্কার করলো ভেতরে লুকিয়ে আছে ২/৩ টূকরো কলিজা গুর্দা। ও যারপরনাই বিস্মিত হল, কিন্তু সে ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নিয়েই খেয়ে নিল। এই কলিজার জন্য বাড়তি কোন বিল দিতে হবে না ওর, কারণ সে জানে এটি তার প্রতি রেস্তোরাঁ মালিক কলিমুদ্দিন এর ব্যখাতিত স্নেহের বহিঃপ্রকাশ। তবে এর আগে অল্প স্বল্প মাংসের হাড্ডি আর ঝোল পেলেও আস্ত কলিজার টুকরা এই প্রথম।

খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে গিয়ে কল থেকেই পানি পেল তানভির। এ আরেক বিস্ময়! এ সময়ে কলে পানি থাকে না বললেই চলে, প্রতিদিন বালতি থেকে জমানো পানি মগ দিয়ে তুলে তুলে প্রাতকৃত্য সারতে হয় তাকে। আজকে সেই ঝামেলা পোহাতে হল না একদমই।

আলনায় ঝোলানো শার্টখানা দেখে একটু অবাক হল সে।

"আরে এই শার্ট কোত্থেকে আসলো?"

কয়দিন আগে আব্বার পুরনো জিনিসপত্র ঘাটতে গিয়ে এই শার্টটি পেয়েছিল ও। হালকা সবুজ রঙ এর শার্টখানা দেখেই মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা। আম্মা সেদিন এই শার্ট টা বের করে রেখেছিল আব্বার জন্য। নাইট শিফটের ডিউটিতে যাওয়ার সময় এটা পড়বে। কোন এক বিচিত্র কারণে আব্বার মেজাজ সেদিন খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। কথা কথায় রেগে যাচ্ছিল। সবুজ শার্ট দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, আর মায়ের সাথে চরম রাগারাগি করে কালো শার্ট খানা গায়ে চড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।

শার্ট হাতে নিয়ে পুরো দৃশ্যটা তার চোখে ভেসে উঠলো, যেন গতকালের ঘটনা। তখন তার বয়স ছিল ১১। সেই রাতে মদ্যপ ট্রাক ড্রাইভার কালো শার্ট পরা হাসিখুশি, আত্নভোলা মানুষটাকে দেখতে পায়নি। চার চাকার দানবটাকে আব্বার অপুষ্টিতে ভোগা রোগা শরীরের উপর দিয়ে স্টিম রোলারের মত চালিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। কাজটা স্টিম রোলারের মত হলেও ট্রাকের স্পিড ছিল বৈদ্যুতিক ট্রেন এর মত।

যাক, দুঃখের কথা মনে করে লাভ নাই। রঙচটা জিন্স এর সাথে সবুজ শার্ট পরে বাসা থেকে বের হল তানভির। হঠাত টের পেল, বুক পকেটটা কেমন ভারী ভারী লাগে। পকেটে হাত দিয়ে পাচশো টাকার চকচকে চারটি নোট পেল। এ যেন মেঘ না চাইতে জল!

নিজের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানিব্যাগ টা খুলে সযত্নে টাকাগুলো রেখে দিল সে। এ যেন স্বর্গ থেকে আশির্বাদ এর মত। ছেড়া ময়লা দুই আর পাঁচ টাকার নোটগুলোর পাশে চারটি চকচকে নোট একেবারেই মানালো না।

অনেকদিন পর জুলিয়া কে ফোন করলো তানভির। ফোন কানে রাখার প্রয়োজনবোধ করলো না সে। কখনোই সে এক রিং এ ফোন ধরে না। আরো সুষ্পষ্ট করে বলতে গেলে, প্রায় কখনোই ফোনটা ধরেনা সে। গত ছয় মাস ধরে এরকম চলছে।

শেষ দেখা হয়েছে কবে মনে পড়ছে না তানভির এর। তবে সে দেখা হওয়াটাও মজার ছিল। জুলিয়া ওকে দেখেই বলে উঠলোঃ

"একদিনও কি আমার আগে আসতে পারো না? কি নিয়ে তুমি এত ব্যস্ত?"

কৈফিয়ত দেয়ার আগেই থামিয়ে দিল ওকে জুলিয়া। মোবাইল এর কল লিস্ট বের করে দেখালো।

"দেখেছ কাকে কল করছি গত ২০ মিনিট ধরে?"
"হ্যাঁ, আমাকে। কিন্তু আমার নাম V. Tanvir নামে সেইভ করেছ কেন?"
"করেছি কারণ আমি আরেকটা তানভির কে চিনি। সে হচ্ছে তানভির, জাস্ট তানভির। আর তুমি হচ্ছ ভেদাইম্মা তানভির। তাই ভি তানভির নামে সেইভ করেছি"।

অন্যমনষ্ক অবস্থায় হঠাত খেয়াল করলো তানভির যে কল রিসিভ করেছে জুলিয়া, আর ৩০ সেকেন্ড চলেও গিয়েছে। তাড়াতাড়ি মোবাইল কানে দিল সে।

"কি ভাই, ফোন দিয়ে কথা বল না কেন? সমস্যা কি?
কিছু না। কখনো তো একবারে ধর না।
তাই বলে রিসিভার কানে রাখবে না?
আচ্ছা ক্ষমা চাই, ক্ষমা।
ক্ষমা চাইলে হবে না, খাওয়াতে হবে।
আমি রাজি। কোথায় খাবে?
তুমি তো জানই কই খেতে চাই।
ইয়ে মানে, ভেদাইম্মার সাথে লাঞ্চ করলে তোমার মান ইজ্জত যাবে না?
Dude, don't push your luck. Don't be late"

আমারি হোটেল এর রুফটপ। সন্ধ্যায় বেশি জমে। তবে আজ দুপুরেও খুব ভাল লাগলো।

প্রথম বারের মত বুকে সাহস নিয়ে বিল দিতে চাইলো তানভির, কিন্তু অন্য সব দিনের মত আজকেও ওর চকচকে নোটগুলো ইগ্নোর করে নিজের প্লাটিনাম কার্ডটি এগিয়ে দিল জুলিয়া।

"আমি আসলে তোমার কল ধরবো ভাবি নাই। হঠাত কি মনে হল, রিসিভ করলাম। এতদিন পর ফোন করলে?
ইয়ে না, মানে, ব্যস্ত থাকি অনেক।
আমি বলেছি না আমার কাছে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স এর গল্প না করতে?
হুম। ওকে, মনে থাকবে!
এইসব বাদ দাও। আমাকে সময় দাও। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে। তোমার র‍্যান্ডম আচরণের কারনে বলতে পারি না।"

তানভির আর কিছু বল্ল না। নিস্তব্ধতা অনেক সময় অনেক কিছু অনেক ভাল ভাবে প্রকাশ করতে পারে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাসায় ফেরার পালা। ওকে মহাখালী টিএন্ডটি কলোনীর মাঠের পাশে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল জুলিয়া।একটু সামনেই ওদের বাসা।

গোধুলী বেলার এই সময়টা খুব তার খুব প্রিয়। মাঠে বাচ্চারা দাপাদাপি করে ফুটবল খেলছে। সবাইকে বাচ্চা বলাটা ঠিকও হচ্ছে না। কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেরাও খেলছে। বেশ সুসংহত ভাবে খেলা হচ্ছে। দু'টি দলের আবার জার্সি ও আছে দেখা যায়। একজন তাগড়া ধরণের রেফারী ও দেখা যাচ্ছে।

সারাদিনের কথা চিন্তা করতে করতে হেটে যেতে লাগলো সে। এরকম সুপ্রসন্ন ভাগ্য ওর অনেকদিনের মাঝে আসেনি। চায়ের দোকানে তিনশো টাকা বাকি পড়ে গিয়েছে, আজ সেটাও শোধ করে দিবে ও।

হঠাত জোরালো বাশীর শব্দ শুনতে পেল তানভির। খেলা শেষ হল বোধহয়। এরকম লম্বা বাশী তো খেলা শেষ না হলে বাজানো হয় না। বাঁশী শুনতে শুনতে মন্ত্রমুগ্ধ তানভির খেয়াল করলো না ছুটে আসা প্রাইভেট কার এর বিকট হর্ণ ধ্বনী।

এরপর শুধু আধার আর আধার।এই সব না, সব কিছুই বাদ দিতে হল।