Monday, December 23, 2019

Beirut Diary 10

বৈরুতে বনবাসঃ পর্ব ১০

জন্মদিন ব্যাপারটা আসলে দুঃখের একটি ঘটনা। প্রতিটি জন্মদিন আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে জীবন থেকে আরেকটি বছর চলে গেল। তবে যে যাই বলুক না কেন, আমি সেই শিশুকাল থেকেই এই দিনটি কোন না কোন ভাবে উদযাপন করে আসছি। একেক বছর একেক রকম উদযাপন, কিন্তু একটি ব্যাপার সব সময়ই একই থেকেছে, যেটা হচ্ছে পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবের সরব উপস্থিতি।

তবে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসটি ছিল ভিন্ন। সেবার আমি ছিলাম পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধব থেকে শত শত মাইল দূরে। জন্মদিনে কি করবো, কিভাবে পালন করবো সেটা নিয়ে খুব দোটানায় ছিলাম। আগে থেকে চিন্তা করে রেখেছিলাম যে দিনটি কে যেভাবেই হোক, স্পেশাল বানাতেই হবে।

সৌভাগ্যজনক ভাবে সেদিনটি ছিল রবিবার। অর্থাৎ অফিস ছুটি।

বাংলাদেশে সারা জীবন দেখে এসেছি শুক্র শনি ছুটি। ছোট থাকতে কিছুদিনের জন্য বৃহস্পতিবার অর্ধ দিবস ছুটিও দেখেছি। কিন্তু শুক্রবার কখনই ছুটি ছাড়া থাকিনি। বৈরুতে প্রথম কয়েক সপ্তাহ শুক্রবার অফিস করতে খুব অদ্ভুত লাগতো। পরে অবশ্য অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে আবার রবিবার অফিস যেতে হচ্ছে না, এ ব্যাপারটাতেও মজা পেতাম।

 এই পর্যন্ত হেটে গিয়েছিলাম

ঠিক করলাম জন্মদিনে সারাদিন কাটাবো সাগর পাড়ে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত যেমন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেরকমই ভূমধ্যসাগরও লেবাননের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে অতপ্রোত ভাবে জড়িত। বৈরুত শহর থেকে সমুদ্র দেখতে হলে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে রাউশে (Raouche) নামক একটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় যাওয়া। এই এলাকাটিকে খুব সহজেই সে শহরের গুলশান বনানী বলে চালিয়ে দেয়া যায়। সুউচ্চ এপার্ট্মেন্ট, দামী দামী রেস্তোরাঁ এবং সমুদ্রতটের কারণে উইকেন্ডে সেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা দেখা যেত।


এরকম পানি শুধু সেন্ট মার্টিনে দেখেছি এর পর


অন্য যেকোন দিনের মত সেদিনও সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। মোবাইল হাতে নিয়েই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভানুধ্যায়ীদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা পড়ে মন ভাল হয়ে গেল। বাছা বাছা কিছু বার্তার উত্তর দিয়ে নাস্তা সারলাম একটি ডবল ডিমের চিজ টমেটো ওমলেট আর কফি দিয়ে।


বের হয়ে কিছুক্ষণ শেয়ার্ড ট্যাক্সি খোজার বৃথা চেষ্টা করলেম। কোন একাকী যাত্রী সেদিন রাউশের দিকে যাচ্ছিল না। একজন ট্যাক্সি চালক আমাকে উপদেশ দিলেন কোন একটি গাড়ীকে রিজার্ভ করে নিয়ে যেতে। অগত্যা তাই করলাম। বেশ মোটা অংকের ভাড়া গুণতে হলো, কারণ জায়গাটা ডেকওয়ানেহ/সালুমে থেকে বেশ খানিকটা দূরে।


রাস্তা ফাকাই ছিল সেদিন। আমার জন্য বিশেষ দিন হলেও বৈরুতবাসীর জন্য সেদিনটি ছিল অন্য যেকোন রবিবারের মতই। আমাকে ট্যাক্সি চালক একেবারে সমুদ্রের পাড়েই নামিয়ে দিলেন। ভাড়া চুকিয়ে হেটে হেটে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রতটের দিকে।


সেদিনের আবহাওয়া ছিল খুবই চমৎকার। ঝিরি ঝিরি বাতাস ছিল, কিন্তু ঠান্ডা পড়া শুরু হয়নি তখনো। শীতবস্ত্র ছাড়াই সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বিচের সামনে দেখলাম অনেকেই সাঁতারের পোশাক পড়ে পানিতে নেমে যাচ্ছে। নিজে কেন অতিরিক্ত পোশাক সাথে করে আনিনি সেকথা মনে করে বেশ দুঃখ পেয়েছিলাম সেদিন।


আমার সাথে ছিল একটি সনি পয়েন্ট এন্ড শ্যুট ডিজিটাল ক্যামেরা। আজকাল আর এসব ক্যামেরা তেমন কেউ ব্যবহার করে না, কিন্তু সেসময় ছবি তোলার জন্য মোবাইল অপ্রতুল ছিল আর সবাই ডিএসএলআর জাতীয় ক্যামেরা বহন করতে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো না, তেমনি ওরকম জটিল ক্যামেরা ব্যবহার করার মত জ্ঞানও খুব কম মানুষেরই ছিল।


রাউশে জায়গাটা পিজিয়ন রক (কবুতরের পাথর) নামেই বেশি পরিচিত। জায়গাটা রক অফ রাউশে নামেও পরিচিত। বৈরুতের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে দু'টি সুবিশাল পাথরের ভিত্তি পাহারাদারের মত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে; ভূমধ্যসাগরের তীরে। এটি স্থানীয় এবং পর্যটক--সবার কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি জায়গা।


গ্রীক মিথোলজিতেও রাউশের বড় ভূমিকা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে রাউশে হচ্ছে একটি বড় সামুদ্রিক দানবের অংশবিশেষ, যাকে হত্যা করেছিলেন গ্রীক বীর পারসিউস; এন্ড্রোমিডা কে বাচানোর জন্য। দানবটা পাথর হয়ে গিয়েছে কারণ পারসিউস মেডুসার মাথা দিয়ে এই পাথরের উপর আঘাত করেছিল। আর মেডুসার চোখের দিকে তাকালে যে পাথর হয়ে যেতে হয়, সে গল্প মোটামুটি সবারই জানা।

ট্যাক্সি থেকে যে জায়গায় নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে কবুতর প্রস্তরের কাছে যেতে হলে বেশ খানিকটা জায়গা নামতে হয়। নামার রাস্তাটা বেশ দূর্গম ছিল। বেখেয়ালে হাটলে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙ্গার সমূহ সম্ভাবনা। খুব সাবধানে, আস্তে আস্তে নামলাম।


খুব একটা কষ্ট হয়নি, কারণ পুরো এলাকাটা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার। চারপাশে মুগ্ধতা নিয়ে তাকাতে তাকাতে, ধীরে সুস্থেই নেমেছি পুরোটা পথ।

আমার হাতে সময়ের অভাব ছিল না। সাথে আর কেউ না থাকায় কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না সামনে আগানোর কিংবা পেছনে যাওয়ার। যেতে যেতে ক্লিকিং চলছিলো অবিরাম। সাথে একটা মোবাইল থাকলেও সেটা একবারের জন্যেও বের করার প্রয়োজন বোধ করিনি।

বৈরুত আমার দেখা সবচেয়ে ব্য্যবহুল জায়গাগুলোর মধ্যে একটি; অন্তত মোবাইল ব্যবহারের খরচের দিক দিয়ে। সেখানে প্রতি মিনিট কথা বলার জন্য গুনতে হতো ৩৮ সেন্ট, এবং হ্যা, এটি ইউএস ডলারের সেন্ট। অর্থাৎ টাকার বর্তমান মূল্য মান হিসেব করলে (১ ডলারে = ৮৬ টাকা) প্রতি মিনিট কথা বলার জন্য খরচ হয় প্রায় ৩৪ টাকার মত! অথচ, সেই যুগেই বাংলাদেশে কল রেট নেমে এসেছিল মিনিট প্রতি এক টাকারও কমে।


লেবাননে এটা আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল। সব জায়গায় সকল মূল্য তালিকা মার্কিন ডলারে দেয়া থাকতো। যদিও "লেবানিজ পাউন্ড" বলে একটি জিনিস পাওয়া যেত সেই দেশে, কিন্তু মূদ্রাস্ফীতির কারণে সেই পাউন্ড এর তেমন কোন দামই ছিল না। ঐ যুগে এক ডলারের পরিবর্তে হাজার খানিক এলবিপি (LBP = Lebanese Pound) পাওয়া যেত, যা বর্তমানে দেড় হাজারেরও বেশি। প্রথম প্রথম আমি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি একেবারেই।

একদিন হোম ডেলিভারী দিতে আসা এক ব্যক্তি কে এক হাজার পাউন্ডের একটি নোট টিপস হিসেবে দিয়ে বেশ প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। কিন্তু দেখলাম লোকটির মুখে বিরক্তি এবং আহত আহত ভাব। ইংরেজী জানে না বিধায় সে আমাকে মনের ভাব বোঝাতে পারেনি, কিন্তু পরে আমি বুঝেছিলাম যে এক হাজার পাউন্ড আসলে তেমন কোন টাকাই না। এরপর অন্ত দু'তিন হাজার পাউন্ডের কমে কখনো কাউকে টিপ্স দেইনি।

ডাকাতমূলক কলরেটের পাশাপাশি ইন্টার্নেট ব্যবহারের খরচও অমানবিক লেভেলে ছিল। এখন যেভাবে ইন্টার্নেট ব্যবহার করি, সেই সময় তা করতে গেলে পকেটের সব টাকা তো শেষ হোতই, আর বাকি খরচ চালানোর জন্য জিনিসপত্রও বিক্রী করা লাগতো।

সেসময় মোবাইলের চেয়েও আমার কাছে প্রিয় ছিল আমার আইপড টাচ ডিভাইসটি। এপল কোম্পানী আইফোন রিলিজ করার আগে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্যাজেটসমূহের মাঝে ছিল আউপড ও আইম্যাক কম্পিউটার।

আমার আইপডটি ছিল টাচ মডেল এর। গান শোনার পাশাপাশি এতে ছবি আর ভিডিও দেখার ব্যবস্থাও ছিল। মনে আছে, সেদিনের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ একাকী সংগীত সূধা উপভোগ করেছি। "উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার" শুনতে শুনতে বেশ আবেগী হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু আবার একাকীত্ব টাকেও উপভোগ করেছি ইচ্ছেমতই।

সকাল দশটার দিকে পৌছিয়েছিলাম রাউশে তে। হেটে তীরে নামতে নামতে দুই ঘন্টা লেগে গেল প্রায়। নিরবিচ্ছিন্নভাবে নামলে আরো কম সময় লাগতো অবশ্যই।

তটে নেমে একটি রেস্তোরাঁ আবিষ্কার করলাম। সেটির নাম "বে রক রেস্তোরাঁ"। গ্রিলড প্রণ অর্ডার দিয়ে বসে বসে অনেক্ষন সমুদ্র আর পায়রার পাথরের অসামান্য ভিউ উপভোগ করলাম। খাবারটি আসার পর বেশ মজা করে খেলাম। বড় বড় গ্রিল করা চিংড়ী মাছের সাথে লেবুর রস আর সাদা সস মিশুয়ে খেতে অসাধারণ লেগেছিল।


একা একা খাচ্ছিলাম দেখে সামনের টেবিলের দুই তরুণী আমার দিকে করুণা মিশ্রিত বিদ্রুপের হাসি দিচ্ছিল। এই প্রসংগে খুব একটা আলোকপাত করা হয়নি এ পর্যন্ত, তবে লেবানিজ তরুণীরা দেখতে খুবই সুন্দর। তারা এতটাই সুসজ্জিত থাকতো সব সময়, যে তাদের দেখে আমার নিজের মাঝেও পোষাক সংক্রান্ত সচেতনতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল সেই দুই মাসে। এমন কি আমার অফিসের কলিগেরাও প্রতিদিন সকালে এমনই সাজ দিয়ে আসতো যেন মনে হোত কোন পার্টিতে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে ছেলে অপেক্ষা মেয়ের সংখ্যাই ছিল বেশী!

আমি বে রক রেস্তোরাঁয় বসে দুই তরুণীকে আমার সর্বাপেক্ষা কিউট, নারী হন্তারক হাসিখানা উপহার দিলাম---দু'জনের একজন কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল বলে মনে হলো। বেশ কিছুক্ষণ তারা নিজেদের মধ্যে কানাকানি করলো। আমিও খাওয়ার ফাকে ফাকে সেই তরুণীর গালের লাল আভা উপভোগ করতে রইলাম। আশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল মেয়েটি, কিন্তু আমি নিজের "গাড়ল বাংগালী" ইমেজ কে ধ্বংস করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। বিল পরিশোধ করে উঠে গেলাম, এবং শেষ পর্যায়ের হাঁটা শুরু করলাম।

এবার চলে এলাম একেবারে পিজিয়ন রকের সামনে। এখানে বেশ কিছু চমৎকার ছবি তুল্লাম। এক পর্যায়ে কবিতাও লিখতে ইচ্ছে করছিল।


এক সময় বের হয়ে এলাম সেখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম রাউশের শহুরে অংশতে, যা কিনা প্লাজা নামে পরিচিত। সেখানে ডাংকিন ডোনাটস থেকে দু'টি ডোনাট ও এক কাপ কফি অর্ডার দিলাম। খাবার নিয়ে বসে ভাবতে লাগলাম, এরকম একাকী জন্মদিন কি আর কখনও পার করতে হবে?

ফোনের কল লিস্ট চেক করে দেখলাম যে না, সেদিন কোন কলই আসেনি। একটু দুঃখ পেলাম। ভেবেছিলাম অন্তত বাসা থেকে কেউ না কেউ তো ফোন করবেই। তারপর টাইম জোন এর কথা মনে পড়লো।

বিষন্নতা পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়ার আগে তিতকুটে কফিখানা শেষ করছিলাম। এক সময় সন্ধ্যা নামলো, উঠে দাঁড়ালাম...

(চলবে)

Saturday, December 14, 2019

দাদার গল্প ৩

পচানব্বুই বছর কি কেউ বাচে? আপনাদের পরিচিত কেউ কি এতদিন বেঁচেছে? আমার খুব ভাবতে ভাল লাগে যে একদিন মানুষ বিভিন্ন রোগ শোক আর জরা কে জয় করবে--সবার আয়ু বেড়ে যাবে, আর প্রিয়জনেরা একজন আরেকজনের সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারবে আরও বেশিদিন ধরে।
আমার দাদা বেঁচে থাকলে ২০১৯ সালে উনি ৯৫ বছরে পা দিতেন। উনার জন্মদিনটি কারও জানা নেই। সার্টিফিকেটে একটা দিন দেয়া আছে, কিন্তু সেটা সম্ভবত সঠিক নয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, একজন পচানব্বই বছর বয়সি মানুষ কিভাবে দুনিয়াটাকে দেখবেন। একজন সুস্থ, সবল ও প্রাণবন্ত পচানব্বই বছর বয়সী দাদার জন্য মনটা আনচান করে। পরমুহূর্তে মনে পড়ে, আমার জন্মের ৯ বছর আগেই তো দাদা হারিয়ে গেছেন। তখন উনার বয়স ছিল ৪৭; আমার এখনের বয়সের চেয়ে ৮ বছর বেশি। আমি না হয় দাদা কে পাইনি, কিন্তু আমার আব্বা, চাচারা এবং ফুফুরা যে পিতৃহীন হলেন ছোটকালে, সেটার কষ্টটা নিশ্চয়ই আরো অনেক বেশি কষ্টের ছিল। ছোট চাচা ও ছোট ফুফু তখন নেহায়েত শিশু; বড় চাচা মাত্র পাশ করে চাকুরীতে ঢুকেছেন, আর আমার বাবা মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন দাদা, দাদী এবং উনাদের পরিবার। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবন। উনার ছোট ভাইও থাকতেন সেখানে।
বিএ পাশ করে যোগ দিয়েছিলেন কাস্টমস বিভাগে। উনি ছিলেন সাতকুচিয়া গ্রাম থেকে বিএ পাশ করা প্রথম ব্যক্তি। কিন্তু সে চাকরীতে বেশিদিন টিকতে পারেননি তিনি।
অধস্তন এক কর্মচারী ঘুষ গ্রহণ করেছেন জানতে পেরে উনি বিশেষ ভাবে ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। পরে উনাকেও ঘুষ সাধা হলে রাগান্বিত হয়ে চাকরী ছেড়ে দেন। অন্য অধিদপ্তরে যাওয়ার প্রস্তাবও নাকচ করে দেন সরাসরি।
এই চাকুরী ছাড়ার পর ঢাকাস্থ আরমানিটোলা স্কুলে শিক্ষকতার জন্য ট্রেনিং নিতে থাকেন। এর মাঝেই উনাকে শিক্ষকতা করার প্রস্তাব দেয় স্কুল কতৃপক্ষ। একই সাথে ট্রেনিং এবং টিচিং এর এক অনবদ্য বিন্যাসে চলতে থাকে উনার চাকুরী জীবন।
উনি M.Ed করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Education and Research (IER) থেকে, এবং পরবর্তীতে State College of Colorado, United States থেকে ১৯৬৭ সালে Ed. D ডিগ্রী পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং সেসময় থেকেই পরিবারসহ বাস করতে থাকেন ফুলার রোড এর বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে।
১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। সকাল ১০-১১ টার মত বাজে। নাস্তা খেয়ে সবাই যে যার মত কাজে ব্যস্ত। দাদা পেপার পড়ছিলেন। ততদিনে সবাই বুঝে গিয়েছে যে আমাদের বিজয় আসন্ন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে পাকবাহিনী ও প্রশাসনের নাস্তানাবুদ হবার টুকরো টুকরো সংবাদ। সেদিনের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এই খবরটিঃ
"DACCA, Pakistan, dec. 14- The entire regional government of East Pakistan resigned today, dissociating itself from further actions from the central administration of President Agha Mohammad Yahya Khan in the country's West.
Dr. A.M.Malik, Governor of East Pakistan, wrote the draft of the resignation letter for his cabinet to President yahya Khan with a shaking ballpoint pen on a scrap of office paper as Indian MIG-21's destroyed his official residence, Government House. "
দেশে নিউইয়র্ক টাইমস পাওয়া যেত না, কিন্তু অন্য, দেশী পত্রিকা ঠিকই পাওয়া যেত। এরকমই কোন হেডলাইন পড়ে হয়তো দাদার মুখে ফুটে উঠিছিল এক চিলতে মিষ্টি হাসি। আবার ক্ষনিকের বিষন্নতাও হয়তো তাকে গ্রাস করেছিল। আব্বার কাছে শুনেছি, আগের দিন রাতে উনি কেন জানি উনার সব সন্তান কে আদর করছিলেন ঘুমের মধ্যে। হয়ত মনে মনে জানা হয়ে গিয়েছিল দাদার; এই আদর আর কখনোই দিতে পারবেন না সন্তানদের।
আব্বা টের পেয়েছিলেন, কিন্তু ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলেন। দাদার মত কড়া মেজাজের মানুষের কাছ থেকে এধরণের কোমল আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এই আদর এতটাই ভিন্ন ছিল যে আজও আব্বাকে সেদিনের কথা জিজ্ঞেস করলে উনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
দাদাকে সেদিন সকালে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করে নিয়ে যায়, এবং সেদিনই উনাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। বাসা থেকে বের হবার আগে উনাকে রেডি হবার সুযোগ দেয়া হয়, এবং উনি ফর্মাল পোষাক পড়েই বাসা থেকে বের হন।
পাকবাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর আত্নসমর্পণ করে--আমরা জয়ী হই। অবসান হয় দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। তারও প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে দাদার লাশ খুজে পাওয়া যায় রায়েরবাজার বদ্ধ্যভূমিতে।
সেসময়ের একটা খুব অদ্ভুৎ ছবি আছে আমার পরিবারের কাছে। ছবিটা আমার হাতে নেই এই মুহুর্তে; থাকলে হয়তো শেয়ার করতাম। মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে কোন ছবি ছিলই না। আমি হয়তো মনে মনে দৃশ্যটা কল্পনা করে নিয়েছিলাম।
দাদার কংকালের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সন্তানেরা। গায়ের কাপড় আর হাতের ঘড়ি দেখে উনাকে সনাক্ত করতে হয়েছিল, কারণ লাশ পচে গলে গিয়েছিল ততদিনে। ভাইদের মুখে খুব করুণ একটা চাহনি, কিন্তু ছবি তোলা হচ্ছে তাদের, সে ব্যাপারেও তারা সচেতন। সম্ভবত লাশের দায়িত্ব নেয়ার জন্য এই ছবিটা তোলা বাধ্যতামূলক ছিল।
শিশু অবস্থায় এই ছবিটা আমি একদিন দেখে ফেলি। যখন আমি অবাক হয়ে ছবিটা হাতে নিয়ে দেখছিলাম, তখন আমাকে জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। কে সরিয়েছিল, সেটা আমার মনে নেই একদমই। চাচা ফুফুদের কেউই হবেন। দাদী ও হতে পারেন। আবার এই ঘটনাটি আমার শিশুমনের কল্পনাও হতে পারে। আমি এখনো নিশ্চিত নই এ ব্যাপারে।
কিন্তু সেই ছবি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছে চির জীবনের জন্য। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই সেই করুণ চাহনি। আমার বাবা ও তাদের ভাইদের। বাবার কাছেই বিস্তারিত শুনেছিলাম সেদিনের কথা। কিভাবে উনারা দাদাকে ওখান থেকে নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশের কবরস্থানে দাফন করেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবরের পাশেই দাদার কবর।
এরকম কত দূঃখের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেশের মানুষের মাঝে। বাবার জন্য দুঃখ করতে করতে কত সন্তান বড় হয়ে দাদা নানাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাদের এই কষ্টগুলো কখনো চলে যাবে না।
সেরকম, কখনোই মুছে যাবে না এই রাজাকারদের ঘৃণ্য কাজের চিহ্নগুলো। তাদেরকে "শহীদ" বলে ডাকলেও তাদের অপকর্মের ওজন একটুও কমবে না।
ইহজগতে না হলেও পরজগতে তারা ঠিকই তাদের কৃতকর্মের ফল পাবেন।
আজ আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবি ডঃ সিরাজুল হক খান এর প্রয়াণদিবস। আপনারা সবাই দয়া করে উনার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দু'আ করবেন। সাথে অন্য সকল শহীদদের জন্যেও।

Sunday, December 08, 2019

Beirut Diary 9

জীবন একেক জায়গায় একেক রকম। সেরকম, আমার কাছে মনে হয় আকাশও একেক দেশে একেক রকম। ঢাকা শহরের মেঘলা মেঘলা আকাশে দুপুর বারোটার সময় যেমন সন্ধ্যা রাতের মত লাগে, সেরকম অপার্থিব উপলব্ধি আর কোনও দেশে পাওয়া যাবে না, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

বৈরুতের আকাশটাও অন্যরকম ছিল। সব সময় একই ধরণের, শান্ত শিষ্ট মেঘ। গর্জায় না, বৃষ্টি নামায় না, আবার রোদকেও আটকে দেয় সুযোগমত।

ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া খুব উপভোগ করেছিলাম দুইটি মাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সেই সাগর পাড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি মাত্র দুই তিন বারের মত।



আসলে আমি তখন খুব বড় ধরণের বিষন্নতায় ভুগতাম। অফিসের বৈরি পরিবেশ, ভাষাগত সমস্যা ও প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে থাকা--এই তিন মিলিয়ে দিনগুলো খুব একটা ভালো যেত না। তবে উইকেন্ডে ঘুরাঘুরি করে সময়টা ভালোই কেটে যেত।

ভাষার সমস্যা নিয়ে একটু বলি। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এসে বিদেশীরা অনেক সমস্যায় ভোগে। কিন্তু লেবাননে সমস্যা আরও অনেক বেশি প্রকট। যদিও বা কেউ ইংরেজী জানে, সে তার সেই জ্ঞান প্রকাশ করে না সহজে।

একবার ট্যাক্সি তে করে অফিসে যাচ্ছি। হঠাত ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে আরবীতে কি জানি বলা শুরু করলো। ইশারা ইঙ্গিতে বোঝালাম যে আমি আরবী জানি না। তখন সে ফরাসী ভাষায় কথা শুরু করলো, যা আমার কাছে আরো বেশি দুর্বোধ্য। মাথা নেড়ে অপারগতা প্রকাশ করায় সে বেশ বিরক্তির সাথে ইংরেজী তে জিজ্ঞেস করলো "আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি কোথায় নামবে। তুমি আরবী জানো না?" আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। সে তারপর বল্লো "ফ্রেঞ্চ?", আমি সেটাতেও না বলাতে সে বেশ উগ্রভাবেই বললো "তুমি আরবী জানো না, ফ্রেঞ্চ জানো না, তাইলে কোন দুঃখে তুমি এখানে? (what the hell you are doing here?)।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলে রাখি, লেবানন এর জাতীয় ভাষা আরবী, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজী--অর্থাৎ ইংরেজীর স্থান সবার শেষে। ওদের আরবীও একটু ভিন্ন প্রকৃতির, ওরা একটি বিশেষ বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে, যা সৌদি আরব, মিসর কিংবা আরব আমিরাত এর আরব দের আরবী থেকে অনেকটাই অন্যরকম।

আমি সেদিন বেশ দুঃখই পেয়েছিলাম। অফিসেও একই সমস্যার মুখোমুখি হতাম। দেশের কর্পোরেট অফিসগুলোতে একটি অলিখিত নিয়ম আছে; সেটা হচ্ছে কোন মিটিং এ বিদেশী কোন ব্যক্তি থাকলে সেখানে নিজ ভাষায় কথা বলা দোষণীয়। আমি নিজে এটা খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। বিভিন্ন টেলিকমে কাজ করার সুবাদে প্রচুর বিদেশী কন্সাল্ট্যান্টদের সাথে কাজ করতে হোত। আমি কখনই তাদের সামনে বাংলায় কথা বলতাম না; ব্যাপারটাকে আমার কাছে খুবই রুঢ় মনে হোত।

কিন্তু লেবাননে আমার আরব কলিগরা এ ব্যাপারটাকে একেবারে ধর্তব্যে নিতেন না। সারাদিনই তারা তাদের ভাষায় কথা বলে যেত, আর খুব প্রয়োজন না পড়লে আমার সাথে কথাই বলতো না। আমাকে আসলে তারা কলিগ হিসেবে মেনে নিতেই পারেনি; তারা আমাকে দেখতো ভুঁইফোড় কনসালট্যান্ট হিসেবে, যে কিনা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে দৈবক্রমে তাদের উপর ছড়ি ঘোরাতে এসেছে।

মজার বিষয় হল, খোদ রাজধানী শহরেও ইংরেজী জানা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শপিং মলে গিয়ে বিপদে পড়েছি প্রায়শই; শেলফে সকল পণ্যের লেবেল আরবীতে থাকতো, আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বুঝতো না। একবার লবণ কিনতে গিয়ে এই বিপদে পড়েছিলাম। "সল্ট" শব্দটা তারা কেউ কোনদিন শুনেছে বলে মনে হয়নি। পরে আমি নিজেই হাতড়ে হাতড়ে খুজে বের করেছিলাম লবণের ডিব্বা।

উইকেন্ডের ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রেও খুব বেশি দুরের কোন জায়গায় যেতাম না। দুই মাসের সফরে অনেকটা সময় কাটিয়েছি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আর বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরে ঘুরে দোকানপাট দেখে আর বিবিন্ন রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়া করে।

লেবানিজদের জীবন যাত্রায় খাবার ও ফ্যাশান দুইটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়টায় আমার তেমন কোন আগ্রহ না থাকলেও খাবারের ব্যাপারে আমি বেশ উৎসাহী ছিলাম। প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন ধরণের খাবার খেতাম। এর মাঝে কয়েকটি বিশেষ আইটেম বেশি ভালো লেগে গিয়েছিল, যা বারবার খেয়েছি।

তবে একই রেস্তোরাঁয় দুই তিন বারের বেশি যাওয়া হয়নি। একবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে খুব অস্থির লাগা শুরু করলো। নেমে পড়লাম রাস্তায়। অনেক টেনশন। কাউকেই চিনি না, রাস্তা ঘাটও খুব একটা ভাল করে চিনি না। বেশিদূর যাই না কোনদিন, কারণ পথ হারালে কায়কে যে জিজ্ঞেস করে ফিরে আসবো, সেই উপায়ও নেই।

তারপরেও সেদিন বেশ দূরে চলে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত খেয়াল করলাম রাত প্রায় ৯টার মত বাজে, আর বেশ খিদাও লেগেছে।

বৈরুত ঠিক "রাতের শহর" নয়। রাত ৮-৯ এর মধ্যে বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। উইকেন্ড ছাড়া অন্যান্য দিনে রেস্তোরাঁগুলিও খুব বেশিক্ষণ খোলা থাকে না। একটি শর্মার দোকান চোখে পড়লো। নাম "হাওয়া চিকেন"।

যদিও শর্মার ভ্যুতপত্তি তুরষ্ক তে, কিন্তু লেবানিজ শর্মাও বেশ বিখ্যাত। কোন এক বিচিত্র কারণে এক মাস পেরিয়ে গেলেও বৈরুতে আমার শর্মা খাওয়া হয়নি তখন পর্যন্ত।

দোকানে ঢুকে ইংরেজী তে বললাম যে আমি শর্মা চাই, দাম কত? দোকানী শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমারও জিদ চেপে গিয়েছিল সেদিন। আমি নানান রকম অঙ্গভংগী করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার মনের ইচ্ছা। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না, আর আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখন দেবদূতের মত আবির্ভূত হলেন একজন লম্বা, একহারা গড়নের ভদ্রলোক। মাথায় চকচকে টাক আর বুদ্ধিদীপ্ত হাসির কল্যানে উনাকে কিছুটা মমি সিনেমার ভিলেন এর মত লাগছিল।

উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কোন সাহায্য লাগবে কি না। আমি বললাম যে একটি শর্মা কেনার চেষ্টা করছি। উনি জিজ্ঞেস করলেন যে কি ধরণের শর্মা লাগবে আমার? এখানে চিকেন, ল্যাম্ব আর চিকেন লিভার এর শর্মা পাওয়া যায়।

আমি দু'টো শর্মা নিলাম। একটা সকালের নাস্তার জন্য, আর একটা রাতের খাবার। চিকেন এবং চিকেন লিভার। বাসায় ফিরলাম দ্রুত। শর্মা দু'টো দেখতে ছিল বেশ সরেস, আর কলিজাযুক্ত শর্মাটি মুখে দিয়েই মনে হল যেন বেহেশতী খাবার খাচ্ছি।



ঢাকায় বহু বনেদি রেস্তোরাঁয় শর্মা খেয়েছি। অন্যান্য দেশেও খেয়েছি। কিন্তু সেদিনের সেই কলিজা শর্মার স্বাদ আমি জীবনেও ভুলবো না।

হ্যা, অবশ্যই আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, কিন্তু শর্মাটিও ছিল স্বাদে অতুলনীয়। কলিজার পাশাপাশি সেটাতে ছিল বিশেষ একধরণের সস, যা ওরা টক দই, কিছু ভেষজ মসল্লা, শৈবাল ও সব্জী মিশিয়ে বানায়। শর্মার রুটিটাও ছিল জিভে জল আনার মত।

(চলবে)