Monday, November 11, 2019

Rainbow Rising

সেদিন রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে যেতে হঠাত খুব খিদে পেল। যাচ্ছিলাম একটা মিটিং এ। দেখলাম মিটিং শুরু হতে তখনো ৪৫ মিনিটের মত বাকি। ঢুকে পড়লাম একটা রেস্তোরাঁয়। খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি, তখন স্পিকারে বেজে উঠলো খুবই চমৎকার একটি গানের সুর।

আগে কখনো শুনিনি এই গানটি, কিন্তু কম্পোজিশানটা খুব ভালো লাগলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চালু করলাম "soundhound" appটি। এক মিনিট ধরে এপ কে গানটি শুনালাম, সে শুনে বলে দিল যে এই গানটির নাম "Happens To The Heart" আর গায়কের নাম Leonard Cohen।

এই তথ্যের সাথে সাথে এপ আমাকে গানের লিরিক্স ও ইউটিউবের লিংকও দিয়ে দিলো। বাসায় এসেই গানটিকে youtube to mp3 converter এর মাধ্যমে mp3 তে রুপান্তর করে নিলাম। তারপর লিরিক্স এডিটর দিয়ে গানের সাথে লিরিক্স embed করে দিয়ে ফোনে ও Fiio lossless প্লেয়ারে লোড করে ফেললাম। তারপর আমার Marshall হেডফোন দিয়ে শান্তিমত গানটি উপভোগ করতে লাগলাম।

রিওয়াইন্ড ২৩ বছর।

এস এস সি পরীক্ষায় পাশ করে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি মাত্র।সায়েন্স গ্রুপ টু তে। শুরু থেকেই কুইজ পরীক্ষা, ল্যাব ও পড়ালেখার প্রচন্ড চাপ। পাশাপাশি কম্পিউটার ক্লাবে ডস শিখছিলাম, আর সাথে চেস ক্লাবেও এক্টিভ ছিলাম। সুযোগ পেলেই লাইব্রেরী তে বসে যেতাম আগ্রহোদ্দীপক কোন বই পড়ার উদ্দেশ্যে। এসবের পাশাপাশি গান বাজনার দিকেও ঝোক গেল--মূলত আমার দুই মামার কারণে।

ছোট মামার কাছ থেকে ধার নেয়া স্করপিয়ন্স এর ব্ল্যাকআউট এলবামের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের হার্ড রক মিউজিকে হাতেখড়ি হলো। তখনো কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। শখ ছিল গিটার বাজানো শেখার, কিন্তু সময় সুযোগ হল না। তবে থেমে রইলো না গান শোনা।

ইয়োরোপ এর ফাইনাল কাউন্টডাউন, মেটালিকার হারভেস্টার অফ সরো, ডিওর হলি ডাইভার, বিটলস এর শি লাভস ইউ, ডোরস এর হু ডু ইউ লাভ নাউ, ডিপ পার্পল এর ওমান ফ্রম টোকিও, উরিয়াহ হিপ এর জুলাই মর্ণিং সহ আরো অসংখ্য গান শুনতে শুনতে অন্য এক জগতে চলে গেলাম শীঘ্রই।

সেসময় ছিল না কোন ইন্টার্নেট কিংবা মোবাইল। ঢাকায় ২/৩টি মিউজিক রেকর্ডিং শপ ছিল, যার মধ্যে "রেইনবো" এর সংগ্রহ ছিল সবচেয়ে বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় । দোকানটি ছিল এলিফ্যান্ট রোডে।সেসময় গান শোনার উপায় ছিল মূলত দু'টি--ব্ল্যাংক ক্যাসেটে গান রেকর্ড করিয়ে, কিংবা নতুন ক্যাসেট কিনে। সেসময় নতুন ক্যাসেট খুব একটা সহজলভ্য ছিল না, আর দামও কম ছিল না। তাই রেইনবোই ছিল আমাদের ভরসা।

কলেজ ছুটি হয়ে প্র্যাক্টিকাল ক্লাশ শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে যেত। তারপর ছুটতাম কবির ভাই এর রেইনবো তে। রেইনবোর শ্লোগান ছিল "Rainbow--Where Music Never Stops"। আদতেই তাই ছিল। সারাক্ষণই ওখানে গান বাজতো; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।

কবির ভাই ছিলেন রেইনবোর অন্যতম মালিক। তবে উনাকে দেখে দোকান মালিকের মত মনে হোত না কখনোই। অসম্ভব বন্ধুভাবাপন্ন এই মানুষটি সবাইকে আপন করে নিতেন মিউজিক সম্পর্কে উনার অগাথ জ্ঞান এবং সুন্দর, নির্মল হাসির মাধ্যমে। উনার লম্বা দাড়ী এবং ভারী কাঁচের চশমা দেখে মনে হোত উনি বুঝি বি জিস ব্যান্ড এর কোন সদস্য। উনার কাছে শুনতাম অনেক মজার মজার কাহিনী। কিভাবে ডিপ পার্পল ব্যান্ড তৈরি হলো, কিভাবে ব্যান্ড ভেঙ্গে রেইনবো নামের আরেকটি চমকপ্রদ ব্যান্ড আসলো, এবং কিভাবে জো স্যাট্রিয়ানি একবার পার্পল এর গিটারিস্ট হয়ে গেলেন, সেসব গল্প।এছাড়াও বলতেন দেশীয় শিল্পীদের কথা। আইয়ুব বাচ্চু ও ওয়ারফেইজের সদস্যদের খুব প্রশংসা করতেন।

রেইনবো তে দু'টি সেকশান ছিল। এক পাশে সকল লং প্লে (এলপি) গুলো সাজানো ছিল শেলফের মধ্যে। সেখানে ২/৩ জন রেকর্ডিস্ট থাকতেন। এই জায়গাটাকে আমরা বলতাম "এলপি সেকশান"। অন্য রুমটি ছিল রিসেপশানের মত। সেখানে কবির ভাই ও তার মাঝে মাঝে তার বিজনেস পার্টনার মুরাদ ভাই বসতেন।

কবির ভাই এর পাশাপাশি রেকর্ডিস্ট দের সাথেও আমাদের ভালো একটি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মুকুল ভাই ও সোহেল ভাই এর কাজ ছিল মূলত দুইটি। উনারা এলপি থেকে বিশেষ মেশিনের মাধ্যমে গানগুলো কনভার্ট করে ক্যাসেটে রেকর্ডিং করে দিতেন। পরবর্তী তে সিডি থেকেও রেকর্ডিং শুরু হয় রেইনবো তে। অন্য কাজটি ছিল ক্যাসেটের ভেতরে একটি রঙ্গীন কাগজে সিরিয়ালি সবগুলো গান ও আর্টিস্টের নাম লিখে দেয়া। আরো হয়তো অন্য কোন কাজ করতেন উনারা; কিন্তু আমাদের চোখে এই দু'টোই ধরা পড়তো।

আমি, আমার কাজিন এবং আরেকজন কমন বন্ধু--আমরা তিনজন মূলত একসাথে যেতাম ওখানে, এবং একেক জন একেকটি ব্যান্ড এর গান রেকর্ডিং করাতাম, আর পরে ক্যাসেট পাল্টাপাল্টি করে শুনতাম। দোকানে থাকাকালিন সময়টাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করে নিতাম। কিছুটা সময় কবির ভাই এর সাথে গল্প করে, আর বাকি সময়টা এলপি সেকশানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন এলপির কভার দেখে দেখে আর মুকুল ভাই সোহেল ভাই দের সাথে গল্প করে কেটে যেত। মাঝে মাঝে আমরা এলপির স্লিভ থেকে খাতায় লিরিক্স কপি করে রাখতাম, আর আমি কখনো কখনো কোন ব্যান্ড এর লোগো ্পছন্দ হয়ে গেলে সেটার ছবি এঁকে রাখতাম। পরে নিজে নিজে বাসায় প্র্যাক্টিস করতাম। সেসময় আমি বেশ কিছু ব্যান্ডের লোগো হুবহু কপি করা শিখে গিয়েছিলাম।

ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট কেনার জন্য স্টেডিয়াম মার্কেটে যেতাম। পুরো ব্যাপারটার মাঝে ছিল অপরিসীম আনন্দ আর উত্তেজনা। অনেক কষ্টে, তিল তিল করে টাকা জমিয়ে হয়তো বা মাসে একটি বা দুইটি ক্যাসেট রেকর্ডিং করানোর মত অর্থ সঞ্চয় করতে পারতাম। সনি হাই ফাই, টিডিকে কিংবা ক্রোমিয়াম ক্যাসেট গুলো হাতে নিলে মনে হত বিশ্ব জয় করে ফেলেছি।
টাকা জমানোর বুদ্ধিগুলো কখনো কখনো ছিল সরল, কখনো কখনো বক্র; কিন্ত দিনের শেষের, বাসার পুরনো হয়ে যাওয়া স্টেরিও কিংবা ওয়াকম্যানের ইয়ারফোনে যখন বেজে উঠতো এনালগ সুরের ঝংকার, তখন মনে হোত Life is beautiful.

কলেজ পাশ করার পরেও বেশ কিছুদিন নিয়মিত যাতায়াত ছিল রেইনবো তে। তারপর একসময় এল এমপিথ্রি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে খুব সহজেই পিসিতে গান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়ে গেলো। পিসির স্পিকারও বাসার স্টেরিও থেকে উন্নত সাউন্ড প্রদান করতো। সেকারণে ধীরে ধীরে ক্যাসেটের কদর কমতে লাগলো, আর রেইনবোর ব্যবসাও গুটিয়ে যেতে লাগলো। স্বস্তা এবং পাইরেটেড সিডি এসে ব্যাপারটাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিল।

এর মধ্যে ন্যাপস্টার সহ অন্যান্য ফাইল শেয়ারিং প্রযুক্তি এসে ক্যাসেট, কিংবা সিডি রেকর্ডিং এর ব্যাপারটাকে মোটামুটি অপাংক্তেয় বানিয়ে দিলো। তারপরেও রেইনবো টিকে রইলো, কারণ সেখানে যে গানের সংগ্রহ আছে, সেটা এমনকি ইন্টার্নেট থেকেও পাওয়া যায় না।

ফাস্ট ফরওয়ার্ড ২৩ বছর পর। রেইনবোতে গেলাম, দেখা হলো মুকুল ভাই এর সাথে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। স্মরণ করলাম পুরনো সে সব দিনের কথা। সেখানে এখন আর কোন এলপি নেই, আছে শুধুই সিডি।

দেখতে দেখতে কোন দিক দিয়ে একটি ঘন্টা চলে গেলো, টেরই পেলাম না।হঠাত মনে পড়লো, এই দোকানে প্রথমবার পদার্পন করেছিলাম ২৩ বছর আগে!



সময় উড়ে যায়!



Wednesday, November 06, 2019

ট্যাগোর সাহেব এবং একজন আমি

র‍্যান্ডম স্মৃতিচারণা -১

সময়টা ২০০৬-০৭ এর দিকে। তখন ভারতবর্ষে এয়ারটেল নামক মোবাইল ফোন কোম্পানীটি বেশ নাম করেছে। কেবল টিভিতে তাদের বিবিধ সুযোগ সুবিধার বিজ্ঞাপন দেখে এদেশী ভোক্তাদেরও চাহিদা ও আকাঙ্খা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেসম সম্পূর্ণ নতুন একটি সেবা বেশ প্রচার পায়।

কারিগরী পরিভাষায় সেবাটির নাম "কলার টিউনস/কলার রিং ব্যাক টোন" সার্ভিস; সংক্ষেপে সি আর বি টি (CRBT).  তবে সবাই এটাকে "হ্যালো টিউন্স" নামেই চিনতো, কারণ এয়ারটেলের সার্ভিসটির ব্র্যান্ড নাম সেটাই ছিল। বেশ কিছু মজার মজার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তারা সেই সেবাটির প্রচারণা চালাচ্ছিল। অল্প সময়েই তারা অনেক গ্রাহক পেয়ে যায়।

সেসময় আমি দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি মোবাইল অপারেটরের ভ্যাস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতাম। আমার উপর দায়িত্ব এলো এই সার্ভিসটি লঞ্চ করার। প্রায় তিন মাসের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং কলিগ বন্ধুদের অপরিসীম সহযোগিতায় লঞ্চ হয়েছিল আমাদের "আমার টিউন্স" সার্ভিস।

সার্ভিসটি আসলে কি? যখন একজন মোবাইল গ্রাহক (ধরা যাক সে "ক") অন্য আরেকজন মোবাইল গ্রাহক কে ফোন দেয় (ধরা যাক সে "খ"), তখন ক, যতক্ষন পর্যন্ত না খ ফোনটি রিসিভ করছে, ততক্ষন একটি "রিং ব্যাক টোন" শুনতে পান, যা "টুট টুট" ধরণের একটি শব্দ। সাধারণত ৩০ থেকে ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যেই রিং ব্যাজ টোন বাজার পর কলটি "মিসড কল" হয়ে যায়। কলার টিউন্স বা হ্যালো টিউন্স সার্ভিসটি মূলত এই জেনেরিক টুট টুট শব্দটির পরিবর্তে যেকোন গান বা সাউন্ড ক্লিপ বাজায় গ্রাহকের জন্য।

অল্পদিনেই সার্ভিসটি খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।বন্ধু তাহসান এর "বিন্দু আমি" গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল বাংলালিংক এর "আমার টিউন্স" সার্ভিসের জিঙ্গেল হিসেবে। সেই জিংগেল এবং বিজ্ঞাপনটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল অল্প সময়েই। বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে তাহসান নিজেই ছিল।

এসময় অর্ণবের একটি কনসার্ট দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে নতুন পুরনো, শোনা, না শোনা অনেকগুলো চমৎকার গান শোনার চমৎকার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম। বনানীর একটি রুফটপ রেস্তোরায় এই শোটি হয়েছিল। খুব বেশি দর্শক ছিল না; স্বল্প দর্শকের কারণে অর্ণবও বেশ রিলাক্সড ছিলেন। ব্রেক টাইমে ভদ্রলোক আউটডোর এরিয়াতে ধুম্রপান করতে গেলে আমি আর আমার স্ত্রী গিয়ে তার সাথে কিছুক্ষন গল্প স্বল্প করার সুযোগ পাই। সাথে সেলফি তোলার সূবর্ণ সুযোগটিও হাতছাড়া করি নাই।

বেশ কিছু গান শেষ করার পর অর্ণব বেশ মারফতি টাইপের একটা গান বাজালো। গানটা আগে শুনেছি শুনেছি বলে মনে হলেও ঠিক চিনতে পারলাম না। তবে লাইনগুলো মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।

কিছুদিন পর দেখলাম কলার টিউন হিসেবে সেই গানটা সেট করা যায়। সেট করে রাখলাম। অনেকেই ফোন দেয়, আমি দেরী করে ফোন ধরি। শুনুক সবাই সুন্দর গানটি। এর মাঝে একদিন আমার ছোটবেলার এক বন্ধু ফোন দিল। সেও টেলিকমেই জব করে, কিন্তু ভিন্ন কোম্পানীতে। সে আবার বেশ সংস্কৃতিমণা এবং সুশীল প্রকৃতির। সে কোন বন্ধুর সাথে তুই তোকারি করে না।

কথোপকথনটি ছিল এরকমঃ

"কিরে বন্ধু, খবর কি?
এইতো ভাল। তোমার খবর কি?
আছি ভালোই। তা তুমি হঠাত এরকম রোমান্টিক হয়ে গেলা কেম্নে?
মানে?
কলার টিউন্স এ রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে রাখসো!
এ! আমি তো অর্ণব এর গান দিসি!
আরে ব্যাটা, ঐটা তো রবীন্দ্র সংগীত। অর্ণব কভার করসে।

আমার তো তখন পুরাই আক্কেল গুড়ুম। এতক্ষণে বুঝলাম যে কেন "মাঝে মাঝে তব পাই" গানটিকে এত পরিচিত লাগছিল। তড়িঘড়ি করে টিউন পরিবর্তন করে মেটালিকার "ফর হুম দ্যা বেল টোলস" দিয়ে দিলাম। আর যাই হোক, মানুষ আমাকে ট্যাগোরপ্রেমী হিসেবে চিনবে, এ আমি ভাবতেই পারি না।


Good old days

#ishtiaq_radical




Monday, November 04, 2019

ইরিকারাহা

"ইরিকারাহা"



"রিকি! রিকি! শুনতে পাচ্ছো?"

ডাকটা যেন অনেক দূর থেকে আসছে। কান খাড়া করে শুনেও রিকি বুঝতে পারলো না বার্তাটি কোন ফ্রিকোয়েন্সী তে আসছে। সে তার কপোট্রন থেকে রেডিও সিগ্নালিং ডিভাইসটিতে নির্দেশ পাঠালো সিগনালটিকে আরো ভালো ভাবে টিউন করার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে সিগনালটি পরিষ্কার হল। সে বুঝতে পারলো, ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে তার বন্ধু এরেবাস তাকে খুজছে।

রিখি একজন "গোর্মে ২৯" সিরিজের রাঁধুনি রোবট। প্রথম রাঁধুনি রোবটটির নাম ছিল রামসি। রামসি স্টেক ভালো রান্না করতে পারলেও ভারতীয় কোন ডিশ রান্না করতে গেলেই ভজভট পাকিয়ে ফেলতো।ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্ধ ভোক্তাদের মুহুর্মুহু অভিযোগে সিরিজটি বাতিল করতে বাধ্য হয় এপ্সিলন কর্প।

পরবর্তী কালে একে একে রামসি ২,৩,৪ করে করে ২৫ নম্বর পর্যন্ত রোবট বানিয়েও এপসিলন কর্পোরেশন তাদের মনের মত রাঁধুনি রোবটটি খুজে পেল না। তারপর রিকির বর্তমান বস প্রফেসর শ্যাঙ্কেন আর তার স্ত্রী মায়রেন শেলীন এ প্রজেক্টে যোগ দিয়ে একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ মডেল তৈরি করতে সমর্থ হন।

তাদের কাজে খুশী হয়ে এপসিলনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শ্যাঙ্কেন কে বলেন সিরিজটির একটি নতুন নাম দিতে। তার দৃষ্টিতে রামসি নামটা কুফা ব্যাতিত কিছুই না!

অল্প সময়ের মধ্যে গোর্মে ২৬ এর জন্ম হল।গোর্মে ২৯ রিলিজ হবার পর সমগ্র মানব জাতির রান্না করার প্রয়োজনীয়তা উবে গেলো। একটি গোর্মে রোবট রন্ধন কাজে এতই পারদর্শী যে সে একাই হাজার দশেক লোকের দৈনিক খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারতো।

এপসিলন কর্প এর জন্য সেদিনটি ছিল বিশেষ সম্মানের। এপ্সিলন এর ব্র্যান্ড এর রঙ অনুযায়ী সেদিনটি আজো পালন করা হয় লাল রঙ এর সাজসজ্জার মাধ্যমে। দিবসটি "ইরিকারাহা দিবস" নামে পরিচিত। রোবটদের প্রোগ্রামিং ভাষা চিকিভ এ ইরিকারাহা শব্দটির মানে রক্তিম শুভেচ্ছা।

১৬ সেপ্টেম্বর, ৩০৪২ সাল। জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধাণ নির্বাহী বার্জিলিয়াস ঘোষণা দিলেনঃ

"আমরা পেরেছি!
আমরা পেরেছি মানুষ কে সকল কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে।
আমাদের রোবটেরা এখন সুদূর প্লুটোর রেসিপি থেকে শুরু করে প্রাচীন মিসরীয় ও মেসোপটেমিয় রেসেপিতেও খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে।
আপ্নারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে আমাদের অন্যান্য সিরিজের রোবটগণ গল্প ও কবিতা লেখা, আগুন নেভানো, গ্রহাণুপুঞ্জ ধবংস করা, ট্রেনের টিকেট চেকিং, ব্যাংকের ক্যাশিয়ার এর কাজ সহ যেকোন কাযে আরো আগে থেকেই পারদর্শী। আপনাদের উদ্দেশ্যে আমার চ্যালেঞ্জ, সারাদিন চিন্তা করে একটি কাজ খুজে বের করেন, যা আমাদের রোবট করতে পারবে না।"

এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, "আপনাদের রোবট কি ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে পারে?"

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন বার্জিলিয়াস। উত্তরে বললেন "আপনি চাইলে সে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করে নিজে গেমের ভেতরে ঢুকে গিয়ে খেলে দেখাবে"।

"আমি নিজে ঢুকতে পারবো, ক্যান্ডি ক্রাশের ভেতরে?"
"ইয়ে মানে, আপনার নিজের ঢোকার কি দরকার? সেই প্রযুক্তি তো কবেই পুরনো হয়ে গিয়েছে। প্রোগেমার ৬৬ রোবট আপনার হয়ে এই কাজটি করে দিবে"

তরুণ সেই সাংবাদিকটি খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না। আস্তে আস্তে বল্লো "নিজে করতে না পারলে মজা কোথায়?"।

বার্জিলিয়াস সেটি খেয়াল করলেন না। চলে গেলেন পরের প্রশ্নে।

রিকি বার্জিলিয়াস এর সেই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও ক্লিপটি অনেকবার দেখেছে। রোবটদের ইতিহাস তার প্রিয় বিষয়। যখন রান্না করা লাগে না, তখন অবসর সময়ে বসে বসে সে ইতিহাস চর্চা করে। এই সময়টা সে তার কপোট্রন কে কর্ভাসের সাথে সংযুক্ত করে নেয়। কর্ভাস হচ্ছে কেন্দ্রীয় তথ্যসম্ভার। যেকোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে সব রোবট কর্ভাস এর খোজ করে।

মাঝে মাঝে রিকি শাফল মোডে পুরনো ভিডিও দেখতে থাকে।

আজ হঠাত তার প্রিয় একটি ভিডিও চলে আসে। এক সাথে দু'টি রুমের দৃশ্য। এক রুমে বেশ মোটা মোটা অনেকগুলো লোক। সবার পরনে জল্পাই সবুজ রঙ এর আর্মি পোষাক। অর্ধেক মানুষ ঘুমে, বাকিরাও চরম বিরক্ত। তাদের মধ্যে নেতাগোছের একজন হঠাত বলে উঠলেন

"আবাল গুলার আবলামি শেষ হইসে?"
২/৩ মিনিট পর একজন জানালো "না স্যার, মাত্র শুরু হইলো"।
"যত্তসব বালছাল", বলে নেতা স্ক্রিণের দিকে নজর দিলেম।

স্ক্রিণে আরেকটি রুমের দৃশ্য। ওখানে হলুদ পোষাকের বিপ্লবী দল। শুশ্রুমন্ডিত একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ এই দলটির নেতা। তিনিও ঝিমাচ্ছেন আর একটি বড় স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোটে একটি বেঢপ আকৃতির হাভানা চুরুট এবং মাথায় একটি টুপি। সেই ব্যক্তিটি কি বলছেন তার কিছুই শোনা যাচ্ছে না, শুধু সেন্সর হুওয়ার টুট টুট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

হঠাত এই দুই রুম সরে গিয়ে সেই বড় স্ক্রিণটি ফুটে উঠলো। দেখা গেলো ২টি রোবট দাঁড়িয়ে একজন আরেকজন কে আঘাত করছে। যুদ্ধের দুই পক্ষের প্রতীক হিসেবে একটি রোবটের রঙ জল্পাই সবুজ, আর আরেকটির রঙ হলুদ। ওয়ার সিমুলেটর ৫.১১ এর নিয়ম অনুসারে শুধুমাত্র শলার ঝাড়ু কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

দু'টি রোবট একজন আরেকজন কে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে আঘাত করছে। স্ক্রিণে লেখা উঠছে

"ডিফেন্ডার রোবট ড্যামেজ লেভেল ১১২%

রেবেল রোবট ড্যামেজ লেভেল ১১১.৯%"

কিছুক্ষণ পর ভিডিওটি শেষ হল একটি বার্তার মাধ্যমে।

"৩১৫২ সালে ষষ্ঠ বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়নি। ১০ বছর অপেক্ষা করার পরেও ফল না আসায় ক্লান্ত ও বিষন্ন হয়ে পারষ্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে দুই পক্ষই চলে গিয়েছিল ইরিকারাহা দিবস পালন করতে।

হঠাত রিকির সংবিত ফিরে এল। প্রফেসর এবং তার মিসেস এর লাঞ্চ সার্ভ করার সময় হয়ে গিয়েছে। এরেবাস কে একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা পাঠিয়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে এগুলো রিকি। রান্নাঘরে ওভেন, ফ্রিজ, চুলা সহ সকল আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। কিন্তু রিকি গত এক শতাব্দীর মধ্যে এগুলো ব্যবহার করেনি। রোবটদের রান্নার জন্য এগুলো কিছুই লাগে না। সে এবার মেনু সাজানো শুরু করেঃ

এসপারাগাস সুপ

রাশিয়ান সালাদ

হায়দ্রাবাদী দম বিরিয়ানী

বন মোরগের রোস্ট

তিতির পাখির ডিম ভুনা

কচি ভেড়ার স্টেক আর ম্যাশড পটেটো

ভায়োলেট ওয়াইন

চিজকেক আইসক্রিম

ভারতীয় বংশদ্ভুত প্রফেসর শ্যাঙ্কেন এর বিরিয়ানী খুবই পছন্দ। তার স্ত্রী মায়রেন এর অবশ্য স্টেক জাতীয় খাবার বেশি পছন্দ। সাথে তারা ভায়োলেট ওয়াইন পছন্দ করে, যা হজম সহায়ক।

অল্প সময়ের মধ্যেই সব রেডি করে ফেল্লো রিকি। এবার অপেক্ষার পালা। প্রায় ঘন্টাখানিক অপেক্ষা করে রিকি আবার টেবিল পরিষ্কার করে ফেল্লো। আজও উনারা এলেন না, ভাবতে ভাবতে রিকি তার পার্সোনাল চার্জিং স্টেশানে ঢুকে গেলো। এই স্টেশনের মাধ্যমে তার ব্যাটারিটি ৯,৯৯৯ বার চার্জ দেয়া যাবে।

প্রায় একশো বছর আগে ইরিকারাহা দিবস পালন করতে গিয়েছিলেন প্রফেসর এবং তার স্ত্রী।

কর্ভাস এর সার্ভার থেকে ঠিক সেই মুহূর্তেই ইরিকারাহা দিবস সংক্রান্ত ভিডিওটি চলতে শুরু করেঃ

"এপ্সিলন গ্রুপ মানব জাতিকে সকল কাজকর্ম থেকে মুক্তি দেয়। এ উপলক্ষ কে উদযাপন করার জন্য জন্ম নেয় ইরিকারাহা দিবসের। প্রতি বছরই লক্ষ লক্ষ মানুষ লাল পোষাক পরে জমায়েত হয় সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে; দিবসটিকে পূর্ণ মর্যাদায় পালন করার উদ্দেশ্য।

তবে মজার বিষয়, প্রতি বছরই একদল মানুষ ইরিকাহারা কে প্রাচীণ জাপানি রীতি হারাকিরির সাথে গুলিয়ে ফেলতে লাগে। প্রথমে এক হাজার, তারপর এক লক্ষ, এরকম করে করে কোটি কোটি মানুষ নিজেদেরকে এই দিনটিতে রক্তাক্ত করে ফেলতে শুরু করে। এভাবে আস্তে আস্তে সৌর জগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবী থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স নামক প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

অসংখ্য গণকবর তৈরি হয়, যাদের প্রতিটির উপরেই লেখা থাকে "এই মানুষটি শেষ পর্যন্ত একটি কাজ নিজে করতে পেরেছিলেন"।

এ সকল হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা অনেকেই রেখে যায় অগাথ সম্পত্তি আর তাদের ব্যক্তিগত রোবট সমূহ। শোনা যায়, সেই রোবটদের অনেকেই, বিশেষ করে ৩০ মডেল এর আগের মডেলের রোবটগুলো এখনও নিষ্ঠার সাথে তাদের গৃহস্থালী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে--শুধুমাত্র এই আশায়, যে তাদের মনিবেরা কোন একদিন আবার ফিরে আসবে।

অবুঝ রোবট গুলো খুবই কিউট।

#ishtiaq_radical

Image: Google