Monday, November 11, 2019

Rainbow Rising

সেদিন রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে যেতে হঠাত খুব খিদে পেল। যাচ্ছিলাম একটা মিটিং এ। দেখলাম মিটিং শুরু হতে তখনো ৪৫ মিনিটের মত বাকি। ঢুকে পড়লাম একটা রেস্তোরাঁয়। খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি, তখন স্পিকারে বেজে উঠলো খুবই চমৎকার একটি গানের সুর।

আগে কখনো শুনিনি এই গানটি, কিন্তু কম্পোজিশানটা খুব ভালো লাগলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চালু করলাম "soundhound" appটি। এক মিনিট ধরে এপ কে গানটি শুনালাম, সে শুনে বলে দিল যে এই গানটির নাম "Happens To The Heart" আর গায়কের নাম Leonard Cohen।

এই তথ্যের সাথে সাথে এপ আমাকে গানের লিরিক্স ও ইউটিউবের লিংকও দিয়ে দিলো। বাসায় এসেই গানটিকে youtube to mp3 converter এর মাধ্যমে mp3 তে রুপান্তর করে নিলাম। তারপর লিরিক্স এডিটর দিয়ে গানের সাথে লিরিক্স embed করে দিয়ে ফোনে ও Fiio lossless প্লেয়ারে লোড করে ফেললাম। তারপর আমার Marshall হেডফোন দিয়ে শান্তিমত গানটি উপভোগ করতে লাগলাম।

রিওয়াইন্ড ২৩ বছর।

এস এস সি পরীক্ষায় পাশ করে নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়েছি মাত্র।সায়েন্স গ্রুপ টু তে। শুরু থেকেই কুইজ পরীক্ষা, ল্যাব ও পড়ালেখার প্রচন্ড চাপ। পাশাপাশি কম্পিউটার ক্লাবে ডস শিখছিলাম, আর সাথে চেস ক্লাবেও এক্টিভ ছিলাম। সুযোগ পেলেই লাইব্রেরী তে বসে যেতাম আগ্রহোদ্দীপক কোন বই পড়ার উদ্দেশ্যে। এসবের পাশাপাশি গান বাজনার দিকেও ঝোক গেল--মূলত আমার দুই মামার কারণে।

ছোট মামার কাছ থেকে ধার নেয়া স্করপিয়ন্স এর ব্ল্যাকআউট এলবামের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের হার্ড রক মিউজিকে হাতেখড়ি হলো। তখনো কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। শখ ছিল গিটার বাজানো শেখার, কিন্তু সময় সুযোগ হল না। তবে থেমে রইলো না গান শোনা।

ইয়োরোপ এর ফাইনাল কাউন্টডাউন, মেটালিকার হারভেস্টার অফ সরো, ডিওর হলি ডাইভার, বিটলস এর শি লাভস ইউ, ডোরস এর হু ডু ইউ লাভ নাউ, ডিপ পার্পল এর ওমান ফ্রম টোকিও, উরিয়াহ হিপ এর জুলাই মর্ণিং সহ আরো অসংখ্য গান শুনতে শুনতে অন্য এক জগতে চলে গেলাম শীঘ্রই।

সেসময় ছিল না কোন ইন্টার্নেট কিংবা মোবাইল। ঢাকায় ২/৩টি মিউজিক রেকর্ডিং শপ ছিল, যার মধ্যে "রেইনবো" এর সংগ্রহ ছিল সবচেয়ে বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় । দোকানটি ছিল এলিফ্যান্ট রোডে।সেসময় গান শোনার উপায় ছিল মূলত দু'টি--ব্ল্যাংক ক্যাসেটে গান রেকর্ড করিয়ে, কিংবা নতুন ক্যাসেট কিনে। সেসময় নতুন ক্যাসেট খুব একটা সহজলভ্য ছিল না, আর দামও কম ছিল না। তাই রেইনবোই ছিল আমাদের ভরসা।

কলেজ ছুটি হয়ে প্র্যাক্টিকাল ক্লাশ শেষ করতে করতে বিকেল হয়ে যেত। তারপর ছুটতাম কবির ভাই এর রেইনবো তে। রেইনবোর শ্লোগান ছিল "Rainbow--Where Music Never Stops"। আদতেই তাই ছিল। সারাক্ষণই ওখানে গান বাজতো; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।

কবির ভাই ছিলেন রেইনবোর অন্যতম মালিক। তবে উনাকে দেখে দোকান মালিকের মত মনে হোত না কখনোই। অসম্ভব বন্ধুভাবাপন্ন এই মানুষটি সবাইকে আপন করে নিতেন মিউজিক সম্পর্কে উনার অগাথ জ্ঞান এবং সুন্দর, নির্মল হাসির মাধ্যমে। উনার লম্বা দাড়ী এবং ভারী কাঁচের চশমা দেখে মনে হোত উনি বুঝি বি জিস ব্যান্ড এর কোন সদস্য। উনার কাছে শুনতাম অনেক মজার মজার কাহিনী। কিভাবে ডিপ পার্পল ব্যান্ড তৈরি হলো, কিভাবে ব্যান্ড ভেঙ্গে রেইনবো নামের আরেকটি চমকপ্রদ ব্যান্ড আসলো, এবং কিভাবে জো স্যাট্রিয়ানি একবার পার্পল এর গিটারিস্ট হয়ে গেলেন, সেসব গল্প।এছাড়াও বলতেন দেশীয় শিল্পীদের কথা। আইয়ুব বাচ্চু ও ওয়ারফেইজের সদস্যদের খুব প্রশংসা করতেন।

রেইনবো তে দু'টি সেকশান ছিল। এক পাশে সকল লং প্লে (এলপি) গুলো সাজানো ছিল শেলফের মধ্যে। সেখানে ২/৩ জন রেকর্ডিস্ট থাকতেন। এই জায়গাটাকে আমরা বলতাম "এলপি সেকশান"। অন্য রুমটি ছিল রিসেপশানের মত। সেখানে কবির ভাই ও তার মাঝে মাঝে তার বিজনেস পার্টনার মুরাদ ভাই বসতেন।

কবির ভাই এর পাশাপাশি রেকর্ডিস্ট দের সাথেও আমাদের ভালো একটি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মুকুল ভাই ও সোহেল ভাই এর কাজ ছিল মূলত দুইটি। উনারা এলপি থেকে বিশেষ মেশিনের মাধ্যমে গানগুলো কনভার্ট করে ক্যাসেটে রেকর্ডিং করে দিতেন। পরবর্তী তে সিডি থেকেও রেকর্ডিং শুরু হয় রেইনবো তে। অন্য কাজটি ছিল ক্যাসেটের ভেতরে একটি রঙ্গীন কাগজে সিরিয়ালি সবগুলো গান ও আর্টিস্টের নাম লিখে দেয়া। আরো হয়তো অন্য কোন কাজ করতেন উনারা; কিন্তু আমাদের চোখে এই দু'টোই ধরা পড়তো।

আমি, আমার কাজিন এবং আরেকজন কমন বন্ধু--আমরা তিনজন মূলত একসাথে যেতাম ওখানে, এবং একেক জন একেকটি ব্যান্ড এর গান রেকর্ডিং করাতাম, আর পরে ক্যাসেট পাল্টাপাল্টি করে শুনতাম। দোকানে থাকাকালিন সময়টাকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করে নিতাম। কিছুটা সময় কবির ভাই এর সাথে গল্প করে, আর বাকি সময়টা এলপি সেকশানে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন এলপির কভার দেখে দেখে আর মুকুল ভাই সোহেল ভাই দের সাথে গল্প করে কেটে যেত। মাঝে মাঝে আমরা এলপির স্লিভ থেকে খাতায় লিরিক্স কপি করে রাখতাম, আর আমি কখনো কখনো কোন ব্যান্ড এর লোগো ্পছন্দ হয়ে গেলে সেটার ছবি এঁকে রাখতাম। পরে নিজে নিজে বাসায় প্র্যাক্টিস করতাম। সেসময় আমি বেশ কিছু ব্যান্ডের লোগো হুবহু কপি করা শিখে গিয়েছিলাম।

ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট কেনার জন্য স্টেডিয়াম মার্কেটে যেতাম। পুরো ব্যাপারটার মাঝে ছিল অপরিসীম আনন্দ আর উত্তেজনা। অনেক কষ্টে, তিল তিল করে টাকা জমিয়ে হয়তো বা মাসে একটি বা দুইটি ক্যাসেট রেকর্ডিং করানোর মত অর্থ সঞ্চয় করতে পারতাম। সনি হাই ফাই, টিডিকে কিংবা ক্রোমিয়াম ক্যাসেট গুলো হাতে নিলে মনে হত বিশ্ব জয় করে ফেলেছি।
টাকা জমানোর বুদ্ধিগুলো কখনো কখনো ছিল সরল, কখনো কখনো বক্র; কিন্ত দিনের শেষের, বাসার পুরনো হয়ে যাওয়া স্টেরিও কিংবা ওয়াকম্যানের ইয়ারফোনে যখন বেজে উঠতো এনালগ সুরের ঝংকার, তখন মনে হোত Life is beautiful.

কলেজ পাশ করার পরেও বেশ কিছুদিন নিয়মিত যাতায়াত ছিল রেইনবো তে। তারপর একসময় এল এমপিথ্রি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে খুব সহজেই পিসিতে গান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়ে গেলো। পিসির স্পিকারও বাসার স্টেরিও থেকে উন্নত সাউন্ড প্রদান করতো। সেকারণে ধীরে ধীরে ক্যাসেটের কদর কমতে লাগলো, আর রেইনবোর ব্যবসাও গুটিয়ে যেতে লাগলো। স্বস্তা এবং পাইরেটেড সিডি এসে ব্যাপারটাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিল।

এর মধ্যে ন্যাপস্টার সহ অন্যান্য ফাইল শেয়ারিং প্রযুক্তি এসে ক্যাসেট, কিংবা সিডি রেকর্ডিং এর ব্যাপারটাকে মোটামুটি অপাংক্তেয় বানিয়ে দিলো। তারপরেও রেইনবো টিকে রইলো, কারণ সেখানে যে গানের সংগ্রহ আছে, সেটা এমনকি ইন্টার্নেট থেকেও পাওয়া যায় না।

ফাস্ট ফরওয়ার্ড ২৩ বছর পর। রেইনবোতে গেলাম, দেখা হলো মুকুল ভাই এর সাথে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। স্মরণ করলাম পুরনো সে সব দিনের কথা। সেখানে এখন আর কোন এলপি নেই, আছে শুধুই সিডি।

দেখতে দেখতে কোন দিক দিয়ে একটি ঘন্টা চলে গেলো, টেরই পেলাম না।হঠাত মনে পড়লো, এই দোকানে প্রথমবার পদার্পন করেছিলাম ২৩ বছর আগে!



সময় উড়ে যায়!



No comments: