Sunday, September 23, 2018

Passionate Fashionista

প্যাশনেট ফ্যাশনিস্তা
বেশ কিছুদিন ধরে জিহান তার রুম থেকে কম বের হয়। দিনে তিনবার নিয়ম করে বুয়া ট্রে ভর্তি খাবার দিয়ে যায়। আমেনা বুয়া অনেক বছর ধরেই ওদের বাসায় আছে। সম্ভবত তার মা যখন ছোট ছিল, তখন সে এসেছিল এ বাসায়। দুপুরের খাবার দেয়ার সময় আমেনা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। ট্রে যেরকম ছিল, সেরকমই আছে, এক দানা খাবারও খায়নি মেয়েটা।

হঠাত করেই সায়েম সাহেব চলে গেলেন হার্ট এটাক করে । বয়স ছিল মাত্র ৪৩। সেই শোক সহ্য করতে না পেরে মাস দুয়েক পরে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে জিহান এর মাও তার পাশের কবরে নিজের জায়গা নিয়ে নেন। একমাত্র মেয়ে জিহান হঠাত করে সম্পূর্ণ এতিম হয়ে গেল মাত্র ১৬ বছর বয়সে।

ম্যানেজার জলিল সাহেব খুব সৎ। তিনিই একক হাতে সায়েম সাহেব এর ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এইচ আর মারফত বেতনের যে টাকাটা আসে, তার থেকে এক পয়সাও বেশি নেন না। প্রতিদিন একবার আসেন বাচ্চা মেয়েটার খবর নিতে। বেশির ভাগ সময় তাকে জানানো হয় "আফা ঘুমায়"। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার অফিসের দিকে রউনা দেন।

উনিও পুরনো লোক। সায়েম সাহেব এর পিতা কাইউম সাহেব তাকে চাকরী দেন তার ফ্যাক্টরি তে প্রায় ২০ বছর আগে। জিহান কে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন, নিজের সন্তানের মতই তাকে ভালবাসেন তিনি। উনি নিজের জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছেন জিহান এর দেখা শোনা করাকে। অন্তত মেয়েটা যেন কখনো টাকা পয়সার অভাবে না পড়ে, সেটা দেখা তার পবিত্র দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করেন।

জোরে জোরে আইফোনের রিংটোন বাজছে। জিহান ফোন হাতে নিতে নিতেই কল কেটে গেল। আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় বুকের উপর ফেলে রাখা বং টা সরিয়ে ফোন আনলক করলো ও। ৪৩ টা মিস কল! ঘরের মধ্যে ক্রিস্টাল মেথ এর উগ্র গন্ধ। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছে ও ব্লু মেথ, যা কিনা এতদিন শুধু টিভি সিরিজেই দেখে এসেছে। সেরকম এক নেশায় আছে ও গত ৭২ ঘন্টা। খুধা তৃষ্ণা কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না এক্টুও। মাম্মা আর ড্যাডির কথাও একবারও মনে পড়ছে না।

কল লিস্ট চেক করে অবাক হল সে। ও নিজেই ২০-৩০ টা কল করেছে। কাকে কল করলো এ আশংকায় আশংকিত হবার আগেই বুঝলো যে ও আসলে ড্যাড কেই কল করে যাচ্ছিল, আর প্রতিবার ড্যাড এর ভয়েস মেইলে যাচ্ছিল কলগুলো। আধা নেশা আধা সচেতন অবস্থায় আবার কল দিল ও ড্যাড কেঃ

"আমি সায়েম রহমান বলছি। যদি আপনি কোন কিছু বিক্রি করার জন ফোন করে থাকেন, তাহলে মুড়ি খান। আর যদি আপনি আমার পরিচিত কেউ হন, তাহলে আপনি জানবেন আমাকে কখন ফোন করলে পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ"।

হায়! এত পরিচিত হয়েও ড্যাড কে আর কখনোই ফোন করে পাব না, ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে এল জিহান এর। আবার ডায়াল করলো একই নাম্বারে, শুধু বাবার গলা আবার শোনার জন্য।

মা একদম পছন্দ করতো না ওর মডেলিং এর নেশা, কিন্ত ড্যাড খুব উৎসাহ দিত। প্রথম যেদিন র‍্যাম্প মডেলিং করে সবার মন জয় করে নিয়েছিল ও, তখন সবচেয়ে জোরে তালি দিয়েছিল ওর বাবা। মা রাগ করে আসেইনি দেখতে। নিজেও মডেল ছিলেন জিশান। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে হয় ফ্যাশান ডিজাইনার নইলে আর্কিটেক্ট হবে। মডেলিং এ আসবে তা কখনোই চাইতেন না।

এসব ভাবতে ভাবতে মিসড কল এর লিস্ট এ চোখ গেল জিহান এর। চম্পা খালা ফোন দিয়েছে ২০ বার। হঠাত মনে পড়ে গেল সব। আজ বিকেলেই তার একটা ফটোশুট আছে। চম্পা খালা তার হেয়ার ড্রেসার ও ফ্যাশান কন্সালটেন্ট, প্রতিবার মডেলিং এসাইনমেন্ট এর আগে অন্তত একবার হলেও চম্পা খালার কাছে ওর যেতেই হবে। ও যা করে সেটা হচ্ছে কাজ কনফার্ম হলে সেই দিন তারিখ খালাকে জানিয়ে রাখে, আর খালা সময়মত তাকে ফোন করে মনে করিয়ে দেয়।

কল লিস্ট ভাল করে খেয়াল করে দেখলো যে ১৮ টা কলই পুরনো; আজকে মাত্র দুইবার ফোন দিয়েছে খালা। চম্পা খালা আর তার মা সমসাময়িক ছিলেন । দুইজনের বয়স কাছাকাছি, এবং দুইজনেরই একসাথে মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে উত্থান ও পতন। বিয়ের পর পরই মডেলিং ছেড়ে দেন মা।

জিহান এর সব মডেল বন্ধুরা আরো কম বয়সী ও আধুনিক ফ্যাশনিস্তা দের কাছে যায়, চম্পা খালার মত পুরনোরা তাদের কাছে বাতিল। উনার কাছে যাওয়া নিয়ে তাকে কম টিপ্পনী সহ্য করতে হয়নি। খালাকে জিহান এর বন্ধুর মতই লাগে। খালা তার মুখের দিকে তাকিয়েই বলতে পারেন কি চলছে। তা সে পিম্পলের যন্ত্রণাই হোক, আর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনই হোক।

মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ড্রাগস এর উপরেই আছে ও। বন্ধুরা এক এক করে সরে পড়েছে। মডেলিং এজেন্সী থেকেও কল আসা কমতে কমতে শুন্যের কোঠায়। পড়াশোনা আরো আগেই লাটে উঠেছে। শুধু খালার সাথেই মাঝে মাঝে কথা হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ও ঘর থেকে বের হয়ে এল। ডুপ্লেক্স বাসার নিচতলায় সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, ডাইনিং আর লিভিং রুম। উপরে সবার বেডরুম।

নিচে এসে খুব অবাক হয়ে জিহান দেখলো সোফায় চম্পা খালা বসে আছে। জিহান কে দেখে বলে উঠলেন "এতক্ষনে আসার সময় হল?"
জিহান প্রত্যুত্তরে বল্লো "আরে তুমি এসেছ আমাকে তো কেউ জানায়নি! একটু আগে আমেনা বুয়া আমার রুমে এসেছিল, সেও তো কিছু বলে নাই।"
"কি জানি! ও হয়তো আমাকে খেয়াল করে নাই" বলে জিহান এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল ও।
"শুন, আজকে না তোর মডেলিং শুট? আয় তোর চুল ঠিক করে দেই"
"চল তাইলে তোমার স্টুডিও তে"
"স্টুডিওতে যাওয়া লাগবে না, এখানেই সাজিয়ে দিচ্ছি"
পরের এক ঘন্টা কোন দিক দিয়ে গেল জিহান টেরই পেল না। চম্পা খালার হাতে যেন যাদু। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতেই পারলো না জিহান। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো খালাকে।
"অনেক ধন্যবাদ তোমাকে খালা। You are the best"
"আরে ধুর পাগলী, এ আর এমন কি"
"শুন, তোর সাথে খুব জরুরী কথা আছে"
"কি?"
"আমি আর তোর হেয়ার স্টাইলিস্ট থাকতে চাই না। তুই এর পর থেকে তপন এর কাছে যাবি"
"এহ, ছি! ওই চ্যাংড়া ছেলের কাছে আমি কেন যাব?"
"না, আমি ছুটি চাই। আর কাজই করবো না। আর তোরও সময় এসেছে নতুন নতুন স্টাইল জানার আর শেখার"
এ কথা শুনেই জিহান এর দু'চোখ ছলছল করতে লাগলো। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দিল চম্পা।
"শুন, ইমো হইস না। আমি আমার বাবার কাছে চলে যাব। তুই ভাল থাকিস। আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা কর, নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিবি। ড্রাগস ছেড়ে দিবি। পড়ালেখা করে অনেক বড় হবি, যাতে আমি গর্ব করে বলতে পারি এই মেয়েটা আমাকে খালা ডাকতো, কিন্তু আমরা বন্ধুর মত ছিলাম"।

জিহান বুঝলো না এত কথা কেন বলছে খালা। এর মধ্যেই খালা বিদায় নিয়ে চলে গেল, আর জিহান তাড়াতাড়ি বের হয়ে ড্রাইভার কে ডাক দিল। ঘর থেকে বের হতে হতে খেয়াল করলো আমেনা বুয়া ঘুমাচ্ছে এক কোণায়।

সেদিনের মডেলিং শুট খুব ভাল হল। সবাই অনেক প্রসংশা করলো। নতুন একটা প্রোডাক্ট এর লঞ্চিং অনুষ্ঠান ছিল। ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই এসেছিল। অনুষ্ঠানের শেষে ককটেল পার্টি। সবার হাতে চকচকে গ্লাস। জিহান ও এক গ্লাস শেম্পেইন নিল।

খেয়াল করলো ও, দূর থেকে লম্বা, হ্যান্ডসাম ধরণের একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করলো জিহান।

"কি, তপনদা, কেমন হল আমার আজকের পারফরম্যান্স?"
"অসাধারন! সম্ভবত তোমার ক্যারিয়ার এর সেরা কাজ।
যাহ! কি যে বলেন না!
না আসলেই। বিশেষ করে তোমার হেয়ার স্টাইল। আজকে একদম অন্যরকম লাগছে।
হ্যা, মাত্রই চম্পা খালার কাছ থেকে সেজে আসলাম। উনি আমার বাসায় এসে আমাকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
চম্পা মানে চম্পা ফার্নান্দেজ? সেই এংলো মহিলা?
হ্যা, উনিই তো আমার হেয়ার স্টাইলিস্ট!"

তপন তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। জিহান বলেই যাচ্ছে "খালা রিটায়ার করবে বলেছে। এরপর থেকে আপনার কাছে যেতে বলেছে। আপনার শিডিউল কবে ফ্রি বলবেন? চম্পা খালা বলেছে তার বাবার কাছে থাকবে এখন থেকে"।
"তুমি মনে হয় একটু বেশি পান করে ফেলেছ।বাসায় চলে যাও" -- একটু রূঢ় ভাবেই বল্লো তপন।

জিহান কিছু বোঝার আগেই হনহন করে হেটে তপন চলে গেল সামনে থেকে। কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে গেল জিহান।ফোর পয়েন্টস হোটেল থেকে বেরিয়ে ড্রাইভার কে ফোন দিল। ড্রাইভার জানালো রাস্তার অপর পাশে নিউজ পেপার স্ট্যান্ড এর সামনে গাড়ী রেখেছে।

ড্রাইভার কে কিছু বাছা বাছা গালি দিতে দিতে রাস্তা পেরুলো জিহান। পেপার স্ট্যান্ড এর সামনে এসে গাড়ীতে উঠলো।রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম।বসে বসে বোরড হতে হতে কি মনে করে যেন ডিএক্টিভেট করা ফেসবুক আইডি আবার চালু করলো ও। ২০০-৩০০ নোটিফিকেশান, ৫০০ মেসেজ ও অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট কে পাত্তা না দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ও টাইপ করলো "চম্পা ফার্নান্দেজ"

হোম পেজে গিয়েই দেখলো "Remembering Champa Fernandez".
৩ মাস আগের ডেট। ছোট একটা আপডেট।
"আমাদের প্রিয় চম্পা আপা আজ সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে তার প্রয়াত পিতার পাশে কবর দেয়া হয়েছে।"

মুখে মেকাপ, চোখে আই শ্যাডো, চুলে সুন্দর করে খোপা করা, পেডিকিউর মেনিকিউর করা হাত ও পা। ভয়ে আতংকে অসাড় হয়ে আসতে লাগলো ওর সকল বোধ বুদ্ধি। ড্রাইভার কিছু বোঝার আগেই গাড়ীর দরজা খুলে বের হয়ে গেল জিহান। চৌরাস্তার মাঝখান থেকে চম্পা খালা আর ওর বাবা মাকে দেখতে পেল। তিনজনই হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে, সবার পরনে সাদা পোশাক। চোখে মুখে প্রশান্তির ছাপ, কিন্তু আবার কেমন যেন একটা বেদনাও ফুটে উঠেছে।

ওদের দিকে এক অমোঘ আকর্ষণে এগিয়ে গেল জিহান। ঠিক সেই মূহুর্তে এক বেপরোয়া পাঠাও বাইক রাইডার ধেয়ে আসছিল রাস্তার ওপর দিক থেকে ...
(শেষ)