Wednesday, April 25, 2018

জানালার পাশে


রাত বাজে ৩ টা।

একটার পর একটা গাড়ী চলে যাচ্ছে ধূলোর ঝড় উড়িয়ে। গাড়ীর জোরালো শব্দ বার বার রাতের সুনশান নীরবতা কে বিঘ্নিত করছে। জানালা টা নামিয়ে দিবে ভাবছে নীল, কিন্তু আবার বাতাস টাও মন্দ লাগছে না।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে গান। খুব কম ভলিউমে, কান পাতলে শোনা যায় লিরিকসঃ
The cars hiss by my window,
Like the waves down on the beach)

রাত ১ টার পর থেকে একটা অদ্ভত সময় শুরু হয়। বেশিরভাগ মানুষ ১ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সময়টা ঘুমিয়ে উপভোগ করে। নাইট শিফট এর কর্মীদের কথা অবশ্য আলাদা।

নীল এর ৯-৫ চাকরী। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়, কিন্তু তাও রাতে বেশি ঘুমায় না। বহুদিনের অভ্যাস।

(একই লাইন আবার রিপিট হচ্ছেঃ
The cars hiss by my window,
Like the waves down on the beach)

কাছেই রকি বিচ। ঢেউ এর মৃদুমন্দ ঝংকার এর সাথে প্রিয় শিল্পীর সংগীত। Blues ধাচের গান।
স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে মিরিন। অনেক্ষন ধরে গাড়ীর ইঞ্জিন নিস্তব্ধ। গাড়ীর সব বাতি নেভানো, শুধু স্টেরিও তে চলছে গান। নীল তাকিয়ে আছে মিরিন এর দিকে। মেয়েটা একদম হাতের নাগালের মদ্ধ্যে, কিন্ত তবু কেন জানি বহুদুরে।

(গানের পরের লাইন বাজছেঃ
I got this girl beside me
But she's out of reach )

নীল এর মনে পড়ে যায় উদ্দাম ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ দেশেই। ছোটবেলা থেকেই গ্রেকো রোমান কুস্তিগীড় এর প্যাঁচের মত করে দৃঢ় আলিংগনে জড়িয়ে ধরেছিল সে পশ্চিমা জীবন কে। তাকে দেখলেও সহজে মানুষ বুঝতো না যে তার পূর্বপুরুষ রা এসেছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গরিব দেশটি থেকে। সে জীবনেও দেখেনি পা দিয়ে কাউকে বেশিক্ষণের জন্য ফুটবল খেলতে।

মায়ের ভাষা সে ভুলেই যেত, যদি না প্রতিদিন দেশ থেকে ফোন রিসিভ করতে হত। মা একবার কল করলে আর ছাড়তেই চেত না।

এরকমই একদিন ম্যাকডোনাল্ডস এ বসে মায়ের সাথে কথা বলছিল নীল। তাকে খাবার দিচ্ছিল একটি পূর্বদেশীয় ছিপছিপে তরুণী। ফোনে মশগুল থাকায় ভাল করে খেয়াল ও করেনি কি বলছিল তাকে মেয়েটি। সে মায়ের দীর্ঘ আলাপ থেকে মুক্তির পথ খুজছিল। মা ঘুরে ফিরে খালি একটা কথাই বলছিল।

"কোর্স শেষ করে দেশে আয়, বিয়ে কর। আমরা নাতি নাতনীর চেহারা দেখি"। কিন্ত প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ হু ছাড়া কিছুই বলতো না নীল। আদতে তার দেশে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিল না। অন্তত সেদিনের আগ পর্যন্ত।
হঠাত সে শুনলো একটা তরুণী তার কানের কাছে এসে বলছে "ভাইয়া, বার্গার এর সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস আর কোক নিবেন?"

থতমত খেয়ে ফোন থেকে মাথা তুল্লো নীল। প্রথম বারের মত ভাল করে খেয়াল করলো সে তার সার্ভার কে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেল নীল। ততক্ষনে হতোদ্যম হয়ে চলে গিয়েছে তরুণী। যে কাজ জীবনেও করে নি, সেদিন সেটাই করেছিল নীল। পকেট থেকে এক টুকরা আকাশী রঙ এর কাগজ বের করে তাতে লিখে দিয়েছিল নিজের ফোন নাম্বার। দৌড়ে গিয়ে সেই সার্ভার এর হাতে কাগজটি গুঁজে দিয়ে দেখেছিল তার লাল নীল হওয়া মুখ। কল মি মেইবি? বলে ফিরে গিয়েছিল বার্গার এর কাছে।

বর্তমানে ফিরে এল নীল।
মিরিন এর হাত স্টিয়ারিং এ, কিন্তু গাড়ী চলছে না। ঘুমাচ্ছে ও।
"ঘুমাক। বহুদিন বিশ্রাম পায়নি ও। চায়ও নি। তবে তাতে কিছু আসে যায় না"।
(ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে যাচ্ছে গিটার এর করুণ সুর)

-------------------------------------------------


পূর্ণিমার চাঁদের মাঝে একটি বিশেষ ধরণের মাদকতা রয়েছে। মাঝরাতে যখন গোল হয়ে চাঁদখানা মাথার উপর উঠে থাকে, তখন অন্য কোন কিছুর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব সমুদ্রের পানির উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে, সেটাকে দূর থেকে একটি লম্বা অট্টালিকার মত দেখা যায়। পানির কম্পনের সাথে সাথে সেই অপরুপ আলোও কাঁপতে থাকে, এবং মনে হয় যেন সরু হতে থাকা সেই প্রতিবিম্ব ধরে সাঁতরে চলে যাওয়া যাবে চাঁদে।

পূর্ণিমা মানেই মিরিন থাকবে চন্দ্রাহত। পাশে বসে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা, কিন্তু চোখ থাকবে আকাশের দিকে। নীল প্রথম প্রথম অবাক হত, কিন্তু পরে ব্যাপারটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।

থেমে থাকা গাড়ী তে বসে মিরিন এর দিকে অপলক দৃষ্টিতে আরো কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো নীল। আবার ফিরে গেল সে অতীতে।

ম্যাক এ লাঞ্চ করার পর বেশ কিছুদিন চলে গিয়েছে। সেদিনের পাগলামি আচরণ এর কথা মনে পড়লে নীল এর ফর্সা মুখে লাল বেগুনী রঙ ফুটে উঠে। সেদিন ভার্সিটি ডর্মে আড্ডা মারতে মারতে হঠাত আনমনা হয়ে সেদিনের কথা ভাবছিল নীল। স্প্যানিশ বান্ধবী মারিয়া ওর মুখের সামনে জোরে তুড়ি বাজানোর পর তার সম্বিত ফিরলো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কি হচ্ছে বোঝার আগেই মারিয়া উধাও, দূর থেকে ক্যাটওয়াক দেখা আর "idiota!" ডাক শোনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।

আবার ডুবে গেল সে দিবাস্বপ্নে। নিরীহ মেয়েটি অনেক লজ্জা পেয়েছিল সেদিন! ওর হাতে মোটামুটি জোর করেই তার নাম্বার টা ধরিয়ে দিয়েছিল নীল, কিন্ত মেয়েটি মাথা তার দিকে একবারো তাকায়নি।

কাগজ টা নিয়েছিল সে। ছিঁড়ে ফেলে দেয়নি, মুঠোবন্ধ করে রেখেছে।তার নামটিও জানা হয় নি সেদিন । নীল যখন গট গট করে বেরিয়ে যাচ্ছিল রেস্তোরা থেকে, সে একবারো ফিরে তাকায়নি। তাকালে দেখতে পেত তার পিঠের ওপর স্থির হয়ে আছে এক জোড়া মায়াবী, প্রায় আদ্র চোখ।

ডর্ম থেকে বেরিয়ে ক্লাশে গেল নীল। ক্লাশেও খুব একটা মনোযোগ দিতে পারলো না সেদিন। ক্লাশ শেষে খেয়াল করলো দূর থেকে মারিয়া ওকে দেখছে। হয়তো ভাবছে সে এগিয়ে গিয়ে সরি বলবে। তবে নীল এর মন সেদিন অন্যদিকে ছিল। বিস্মিত হয়ে ক্লাস এর সেরা সুন্দরী খেয়াল করলো তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে গটগট করে বেরিয়ে গেল পূর্বদেশীয় হ্যান্ডসাম ছেলেটি। অস্ফুটে আবার বলে উঠলো সে "ইডিওটা!"।

ভার্সিটি সংলগ্ন পার্কে চলে গেল নীল। ও নিজেও জানে না কিভাবে কিভাবে সে পাথরের তৈরি বেঞ্চ এর সামনে চলে এল। ক্লাশ রুম থেকে এখানে আসা পর্যন্ত পথটির কোন স্মৃতি তার নেই। খালি মনে পড়ছে মেয়েটির লাল হলুদ ইউনিফর্মের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান নীল রঙ এর কানের দুল এর কথা।

পার্কের নিস্তব্ধতা কে ভেঙ্গে দিয়ে একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এল, বেজে উঠলো লাস্ট রিসোর্ট গানের প্রথম পংক্তি দ্বয়ঃ
"Cut my life into pieces
This is my last resort"

অচেনা কন্ঠ, কিন্তু শুনেই নীল বুঝলো সেই রেস্টুরেন্ট ললনা ফোন করেছে। ১০ মিনিট এর সংক্ষিপ্ত আলাপ। সেখান থেকে কফি শপে দেখা। প্রতি সপ্তাহের রুটিন প্রতিদিনের রুটিনে যেতে বেশিদিন লাগেনি। একই শহরে থাকতো দু'জনে, তবে বিপরীত প্রান্তে।

দুইজনের মধ্যে তেমন কোন মিল ছিল না। নীল ছিল অনেক সরব, মিরিন ছিল লাজুক। নীল থাকতো আসরের মধ্যমণি হয়ে, আর মিরিন এর একমাত্র সঙ্গী ছিল তার পোষা জ্যাক রাসেল টেরিয়ার কুকুরটি। আদর করে তাকে সে ডাকতো "বু" বলে।নীল ছিল অবস্থাপন্ন পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান, আর মিরিন ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা ভরসার প্রতীক।

মিরিন বেশি কিছু বলতো না, মুখ টিপে হাসতো খালি, আর শুনতো নীল এর শিশুদের মত হাত নেড়ে নেড়ে বলা মিষ্টী কথা গুলি। নীল প্রায়ই অভিযোগ করতো "তুমি এত কম কথা বল কেন?"। মিরিন বলেছিল "আমি লিখতে পারি, বলতে পারি না"।

দেখা হওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় দেশ থেকে এল জরুরী তলব, সাত দিনের নোটিশে নীল ফিরে গেলে দেশে--অসুস্থ্য মা কে দেখতে। পৌছে গিয়ে পেল বড় বড় কিছু সারপ্রাইজ। দ্বিতয় দিনে নীল এর মেইল বক্সে এল হাতে লিখা নীল খামের চিঠি। কাগজ টি সাদা, হাল্কা ল্য্যাভেন্ডার পারফিউম এর সুগন্ধ মাখা। সেখানে গোটা গোটা হাতে নীল কালিতে লিখা একটি কবিতা, যা নীল এর জীবন কে ওলট পালট করে দেয় নিমিষে।

"উষার আকাশের নব উদিত তারার আভাসে আঁঁচও করিনি,
একদিন.....
হৃদয়মম উচ্ছলিয়া প্রনয় গাঁথা রচিব।
এমন প্রেমোন্মত্তে সিক্ত হবো।
সদাই বিমোহিত হয় অবারিত মন....
আমার ছায়াপথ কেনো
পুরোটাই তোমায় আচ্ছন্ন!
আমার আকাশপটে কেনো
কেবলি তুমিই!
পূর্ণিমাতিথিতে সাগরের জলরাশির উন্মাদনার মতো,
একদিন......
পুরোটাই আমি কেনো তোমায় সঁপে দেবো!
তবে.....
সব প্রাপ্তিযোগে পূর্ণতা আসে না !
শুধু হয় মুগ্ধতার সলিলসমাধি।
তাই......
পূর্ণতা নয়!
মুগ্ধতার রঙধনুতে প্রোজ্জ্বল হোক
আমার সরোবর।
ঠিক তেমনি করে,
একদিন.....
এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে
মিলিয়ে যাবো অমানিশার কালান্তরে।"

এক নিমিষে পড়ে ফেল্লো নীল। তারপর আবার। কমপক্ষে ২০-৩০ বার পড়লো চিঠিখানা। কিন্তু আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো সে, ভাবলো চিঠির উত্তরে চিঠিই দিতে হবে। হাতে তুলে নিল কাগজ কলম, কিন্তু দুই লাইন এর বেশি আগালো না। তখনো সে বোঝেনি যে মিরিন এর চিঠির চেয়েও বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল ওর জন্য।

অসুস্থ্য মা পরের দিন তার হাত ধরে একটি অনুরোধ করলেন।
----------------------------------

মিরিন এর মনের মাঝে চলছে ঝড় ঝঞ্ঝা। উত্তাল সাগরের ঢেউ এর মত একেক পর এক চিন্তা আছড়ে পড়ছে মনের মাঝে।বু কে সিরিয়াস বকা দিয়েছে ও। প্রতিদিনের মত কাজ থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ওর কোলে ঝাপিয়ে পড়েছিল আদুরে ডাক দিতে দিতে, কিন্তু জীবনেও যা করিনে মিরিন আজ তা করে ফেলেছে নির্দ্বিধায়--ঝটকা দিয়ে বু কে ফেলে দিয়েছে কোল থেকে। আহত ও ব্যাথিত মানব সন্তানের মত মায়াকাড়া দৃষ্টিতে বু তাকিয়ে ছিল মিরিন এর দিকে। দুঃখ ও অভিমানের মিশ্রণে বোবা কান্না কেঁদেছিল বেশ কিছুক্ষণ।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে মৃদু সুরে কান্ট্রি সং)
("Me and you and a dog named boo
Travellin' and livin' off the land")

প্রবাস জীবনের প্রায় শুরু থেকেই বু তার বেস্ট ফ্রেন্ড। ক্লাশ শেষে একদিন হেটে বাসায় ফেরার সময় একটা পেট শপ এর সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মিরিন। অতিকায় কৃশকায় ছেলেটাকে সে শুধুই মনে রেখেছে "পেট শপ বয়" হিসেবে। এর আগে কখনোই সে দেখেনি এত লম্বা কোন মানুষ। বেহায়ার মত চেয়ে ছিল ছেলেটির দিকে, কোন রকম ভালবাসা কিংবা ভাল লাগার অনুভব নিয়ে নয়, বড়ং বোবা কৌতুহল থেকে।

"Yo girl, whassup? What'cha lookin at?" শুনে সম্বিত ফিরেছিল ওর।
ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে পেট শপ বয়েজ এর গান
(Every time I see you something happens to me
Like a chain reaction between you and me
My heart starts missing a beat
My heart starts missing a beat
Every time
Oh oh oh, every time)

মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গিয়েছিল সেই পোষা প্রাণীর দোকানে, আর প্রায় এক ঘন্টা লাগিয়ে কিনেছিল জ্যাক টেরিয়ার রাসেল কুকুরটি। জারমেইন ওকে জানিয়েছিল যে এই কুকুরটি আগে আরেক বাসায় ছিল, ওরা ওকে "বু" ডাকতো। ও আর নাম টা বদলায়নি। জারমেইন এর সাথেও আর কখনো দেখা হয় নি ওর।কিভাবে বু আরেক বাসা থেকে ওর দোকানে এল, সেটাও আর জানতে চায়নি মিরিন।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হাত থেকে ছুড়ে মারলো সে ব্রাউন খামটি। ভেতরে ভারী কিছু না থাকায় ঘুরতে ঘুরেতে বুমেরাং এর মত সেটি গিয়ে গোত্তা খেল বই এর আলমারীর কাঁচের সাথে। খামের একটি কোনা আটকে গেল কাঠের ফ্রেম এর সাথে। এয়ার কুলার এর বাতাসের ধাক্কায় চিঠিটা কাঁপতে থাকলো ক্রমাগত।

মনের বিষন্নতা কে দূর করার জন্য টিভি ছাড়লো ও। তখনো শোনা যাচ্ছে অবোধ প্রাণীটির ক্ষীন আওয়াজ। টিভি ছাড়ার সাথে সাথেই শুরু হল আবহাওয়ার বার্তা।

"Welcome to tomorrow's weather forecast. Tomorrow will be a sunny day and the sky will be in its bluest form. It will be a perfect day to visit the blue sea and to gaze at the blue sky all day long".
"ধেত্তেরি, সব খানে খালি নীল আর নীল!" বলে টিভি বন্ধ করে রিমোট টা মোটামুটি ছুড়েই ফেল্ল মিরিন।

মিরিন এর প্রায় সব ক্লাশমেট ডর্মে কিংবা রুমমেট নিয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকেই ও এক্টূ ইন্ট্রোভার্ট টাইপ; ডর্মে থাকার কথা ও কল্পনাও করতে পারে না! বিশেষ করে এক সিনেমায় ডর্ম এর শেয়ার্ড ওয়াশরুমের ভয়াবহ নমুনা দেখার পর থেকে ওর ডর্ম ভীতি অন্য লেভেলে চলে গিয়েছে।

রুমমেট এর ব্যাপারে ও অনেক ভেবেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও ভয় ওকে বাধা দিয়েছে এতকাল । হঠাত ওর গালে লাল আভা ফুটে উঠলো। ভেবেছিল এবার ফিরলে নীল কে বলবে ওর রুম মেট হতে। ওর ব্যাপারে বিন্ধুমাত্র দ্বিধাও ছিল না ওর মনে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চোখ টা গেল আধ-ঝুলন্ত খামটির দিকে। খামটির মতই ওর আর নীল এর সম্পর্ক এখন দূর্বল ভিত্তির উপর।

আজকাল আর কেউ পেপারওয়েট ব্যাবহার করে না, কিন্তু তারপরেও কেন জানি একটা ছিল মিরিন এর বাসায়। প্রবল ক্রোধের সাথে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল সে পেপার ওয়েট টি। ফুঁসতে লাগলো রাগে...
--------------------------------------------------------------------

অনেকক্ষণ ধরে গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ। ফুয়েল ট্যাংক প্রায় খালি। এখন গাড়ী চালালেও খুব বেশী দূর যেতে পারবে না নীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ড্রাইভিং সিট দখল করে আছে মিরিন।

রকি বিচের ঢেউ গুলোর কোন বিকার নেই। বিরতিহীন ভাবে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। শব্দটা যেন বহুদুর থেকে আসছে। কানে ঢুকছে, আবার ঢুকছে না। আলাদা করে খেয়াল করার মত না, আবার অবজ্ঞা করার মতও না। একেক টা ঢেউ যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে মষ্টিষ্কের কোন এক বিশেষ জায়গায়, মনে পড়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো স্মৃতি।

প্রায় দুই ঘন্টা ধরে একই জায়গায়, একই ভাবে বসে আছে ও। চারপাশের পটভূমিকায় তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে হচ্ছে যোহান স্ট্রাউস একটানা বাজিয়ে যাচ্ছে তার নীল দানিউব অর্কেস্ট্রা। কখন জানি গাড়ীর স্টেরিও বন্ধ হয়ে কল্পনার সংগীত বাজা শুরু হয়েছে। এই সুর তার চির চেনা, জীবনে অসংখ্য বার শুনেছে ও। এত বেশি যে চোখ বন্ধ কর হাত দু'টো মাথার পেছনে নিয়ে হেলান দিলেয় বাজা শুরু হয়। আজকে বোনাস হিসেবে সাথে আছে ঢেউ এর বাজনা।।

১ টা ১১ মিনিটে একটি পুলিশ প্যাট্রল কার দেখতে পেল নীল। ডজ চার্জার গাড়ীটির ক্রম অগ্রসরমান অবয়ব দেখে আশাবাদী হয়ে গেল ও। সম্ভবত অফিসারটি তার শিফট শেষ করে বাড়ীর পথে যাচ্ছিল। বিচের ধারে থেমে থাকা ধূসর ফোর্ড মাস্ট্যাং গাড়ীটিকে দেখেও দেখলো না কেন জানি। এমন কি, গতিও কমালো না একটু। কিছুটা মন খারাপ, আর কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার মিশ্র অনুভূতি হল নীল এর। হয়তো বা সেই অজানা পুলিশ অফিসারটা বেচে গেল শেষ রাতের উদ্ধার কর্ম থেকে।

আসলেই কি একজন পুলিশ অফিসার পারবে নীল ও মিরিন কে উদ্ধার করতে? ভাবতে ভাবতে হেসে উঠলো নীল। হাত বাড়ালো গ্লোভ কম্পার্ট্মেন্ট এ। ওখানেই লাইটার আর রথম্যানস এর কিং সাইজ প্যাকেট। খুলেই মনে পড়লো, গত সপ্তাহেই রাগ করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মিরিন ওর সাধের সিগারেট আর লাইটার।

এ তো এক ধরনের ভালবাসাই, নাকি? ডাক্তার তো মানাই করেছে ধুম্রশলাকা টানতে। কিন্তু, কিন্তু, এ তো এক ধরনের অত্যাচারও, নাকি? আর ভাবতে পারে না নীল। চিৎকার গুলো কানে বাজতে থাকে। চিল কন্ঠি মিরিন...

সময় থেমে আছে বীচের ধারের এক টুকরো কাজ চালিয়ে নেয়ার পার্কিং স্পেস এ। হাত ঘড়িটির দম ফুরিয়ে গেছে, ১ঃ১১ তেই থেমে আছে কাটা। অন্য যেকোন দিন হলে নীল প্যানিক এটাক এর শিকার হত। ঘড়ির কাটার সাথে মিলিয়ে তার এক্সিকিউটিভ জীবন। হয় ঘড়ি নাহলে মোবাইল, যেকোন এক মাধ্যমে সময় জানা লাগবেই। মোবাইলের চার্জ অনেক আগেই শেষ।

আজকের ঘটনা ভিন্ন। আজকে নীল এর হাতে অফুরন্ত সময় এবং তার একটুও টেনশান হচ্ছে না। অনেকক্ষন আটকে রাখা দীর্ঘঃস্বাস ছেড়ে দিলে যেরকম আনন্দ হয়, সেরকম আনন্দ হচ্ছে নীল এর।

হাইওয়ে ৮৯ দিয়ে ফিরছিল ওরা। প্রতিদিনের মত আজকেও নীল এর কফি বানানো ও মিরিন এর ড্রাইভ করার পালা। বহুকাল আগে কবে জানি এই দৈনন্দিন দায়িত্ব ওরা ভাগ করে নিয়েছিল। দুইজনেই দেরি করে ফিরে কাজ থেকে। মিরিন এর কাজ শেষ হয় আগে, ও অফিসে ওভারটাইম করে নীল কে তার অফিস থেকে পিক করে নিয়ে বাসায় ফিরতো। অন্তত নীল তাই জানতো, অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্ত।

কোন কোন দিন রকি বিচের ধারে গাড়ী পার্ক করে কিছুক্ষণ বিরতী নিত ওরা। ওদের দুইজনের একটি সিক্রেট হাইড আউট আছে যেখানে গাড়ী পার্ক করলে হাইওয়ে থেকে কিছু দেখা যায় না। আজকেও সেই বিশেষ জায়গায় গাড়ী টি পার্ক করা। মূলত এ কারণেই প্যাট্রল কার ওদেরকে দেখতে পায়নি।

ড্রাইভ ইন মুভির মত ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ীতে বসে আড্ডা দিয়েছে ওরা অনেকবার। সমুদ্রতট এর চেয়ে চিত্তাকর্ষক সিনেমা আর কি হতে পারে? শুক্রবার রাতে সবাই যখন বিভিন্ন ক্লাবে কিংবা আনন্দ ফূর্তির জায়গায় সময় কাটাচ্ছে, ওরা দুইজন তখন তাদের এই লুকানো জায়গায় মেতে উঠতো আদিম ভালবাসায়। কোন এক রাতে বাজি তে হেরে দু'জন দু'জন কে তাড়া করেছিল বীচের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। গাড়ী তে ফিরে, ছেড়ে যাওয়া কাপড় পড়ে, থার্মোস থেকে দুই কাপ কফি খাওয়ার পরেও অনেকক্ষন কমেনি মিরিন এর ঠকঠকানি।

আজকেও থার্মোস এ কফি ছিল, কিন্তু নিজে খায় নি ও। মিরিন কে খেতে দিয়েছে। নীল জানে আজকে ও ওর জীবনের সেরা কফিটি বানাতে পেরেছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------


"It is Done"
এক নিঃশ্বাসে লিখলো মিরিন। পাঠিয়ে দিল নীল কে।

তখন নীল ব্যস্ত ছিল। সারা গা থেকে ঘাম ঝড়ে পড়ছে, পরিশ্রান্ত দেহ থেকে টপ টপ করে পড়ছে ঘাম গুলো অশ্রু ফোটার মত ধীর লয়ে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থেকেও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল ও। হঠাত আইফোনের চিরাচরিত মেসেজ ডেলিভারীর শব্দ টা পেয়ে বিরক্তির সাথে উঠে দাড়ালো সে। পাশে সরিয়ে দিল এতক্ষন বাহুডোরে আকড়ে ধরে রাখা ডাম্ববেল দু'টি।

মেসেজ স্ক্রীন এর দিকে দুই তিন মূহুর্ত তাকিয়ে রইলো নীল। মনেই করতে পারছিল না কোন কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। পরে মনে পড়লো, উত্তর না পেলেও মিরিন এর ছেলেমানুষি একমুখী মেসেজ চালাচালির অভ্যেসটা এখনো যায়নি। আগেও এরকম করতো। নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই আবার উত্তর দিয়ে দিত।

"আচ্ছা, আজকে টমেটো সুপ বানাবো না ক্যাবেজ সুপ?
ওহ, ক্যাবেজ তো নাই বাসায়, টমেটোই সই।
আচ্ছা, টমেটো বেশী শক্ত শক্ত ছিল, সুপ না বানিয়ে সালাদ বানিয়েছি।
কখন আসবে?
না আসলেও সমস্যা নাই, আমি খাব না।
অনেক খিদা, এখনো আস না কেন?
খেয়ে ফেললাম কিন্তু
It is done"

"তার মানে হচ্ছে, উনি খেয়ে ফেলেছেন। আর আমি ভেবেছি না জানি কি!" - গজ গজ করতে করতে সে ফিরে গেল তার ডাম্বেল আর ওয়ার্ক আউট পার্টনার এর কাছে।

"What happened Neal?"
"Nothing serious, babe.
Then why do you look so pissed off?
Never mind, let's get back to work"

অল্প সময়ের মধ্যে তারা ফিরে গেল ওয়ার্ক আউট এ। দু'জনের মনে একই চিন্তা, কঠিন পরিশ্রমের পরেই আসে ভাল সময়। জিমের পাশেই সেই স্বর্ণকেশী বিদেশীনির ফ্ল্যাট।

ভাবতে ভাবতে বর্তমানে ফিরে আসে নীল। মিরিন এর পুরনো মেসেজ ঘেটে সেদিনের কথোপকথন টি খুজে বের করার অদম্য ইচ্ছা জাগে তার মনে। কিন্তু তা না করে সে নিউ মেসেজ অপশানে গেল। লিখা শুরু করলোঃ

It is done
But it doesn't feel right
We have been wallowed in the mire
As if our love became a funeral pyre
But I also made it right.

মেসেজ টা আর পাঠানো হল না। মনে পড়ে গেল নীল এর, ওদের সিক্রেট হাইড আউটে আছে ওরা। এখানে নেটওয়ার্ক নেই। মেসেজ ডেলিভারী ফেইল হয়ে লেখাগুলো ড্রাফট এ চলে গেল।

আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। বৃষ্টি টা জোরালো হয়েছে। মনে হচ্ছে প্রতিটি বৃষ্টির ফোটা ঘুচিয়ে দিচ্ছে গ্লানি, আর পবিত্র করে দিচ্ছে অন্তর। হঠাত পাশের সিটে চোখ গেল নীল এর।

সেই চির পরিচিত, নিষ্পাপ চেহারা। স্টিয়ারিং এ মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে যেন। সেই লাজুক হাসি মাখা ওয়েট্রেসটি। বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিত, কিন্তু যেকোন সিদ্ধান্ত নিত ঠান্ডা মাথায়। শুধু নীল এর উপর ভরসা করার ক্ষেত্রে কোন চিন্তা করতো না। আজও কিছু না ভেবেই খেয়ে নিল কফি।

দুই কাপ কফি খেয়ে কেউ এভাবে ঘুমায়?

হঠাত চারদিক অন্ধকার হয়ে এল নীল এর। এতক্ষন যেন একটা ঘোর এর মধ্যে ছিল ও। মনে পড়ে গেল বিষ সংগ্রহের কষ্টকর প্রয়াসের কথা। অনেক খুজে বের করেছিল সেই বিষ, যা সহজেই কোন পানীয়র সাথে মিশিয়ে দেয়া যায়।

চাঁদ ডুবে গিয়েছে কখন জানি। জিম মরিসন তখনো করুন সুরে গেয়ে যাচ্ছে জানালার পাশ দিয়ে গাড়ী ছুটে চলার সংগীত। কখন জানি সিডি টা আবার চলতে শুরু করেছে।

গাড়ী থেকে বের হয়ে হেটে হেটে সুমুদ্রের পাড়ে চলে এল নীল। শুনতে পেল মেসেজ ডেলিভার হবার পরিচিত সুর। পকেট থেকে ফোন বের করে ৯১১ এ কল দিল।
"Hello, there has been a murder. Yes, I am the killer".

ফোন টা ছুড়ে মারলো নীল। এটার আর দরকার হবে না। ফিরে এল আবার গাড়ীর কাছে।

পকেট থেকে বের করে বাকি বিষটুকু ঢেলে নিল থার্মোস এ। ঢক ঢক করে গিলে নিলে বাকি থাকা কফিটুকু। ঠান্ডা কফি, খেতে গিয়ে মুখ টা বিকৃত করে ফেল্ল নীল।
কে যে এইসব ছাইপাশ বানায়?

দূর থেকে একটা বাচ্চা কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে যেন। সত্য না কল্পনা, ঠিক বুঝতে পারলো না নীল। বু এর কথা মনে পড়লো। আহারে! বেচারা দ্বিতীয় বারের মত এতিম হল।

মিরিন এর মাথার পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো নীল। পুলিশের গাড়ীর জোরালো শব্দ কাছে চলে আস্তে লাগলো।

আর কোন শব্দ নেই চার পাশে।
(শেষ)


Monday, April 23, 2018

Beirut Diary Part 4

আমি ছিলাম "পাদোভা" নামক একটি হোটেলে। হোটেল এর জানালা দিয়ে আমার অফিস দেখা যেত। দেখে মনে হত "এত কাছে!"। আগেরদিন বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭০০ টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে আমি কিঞ্চিৎ হতাশ ছিলাম। খাবারের দামের তুলনায় ট্যাক্সি ভাড়া অনেক বেশি মনে হয়েছিল। তাই পরের দিন (অর্থাৎ সোমবার) অফিস শেষে হাটা দিলাম হোটেল এর দিকে।

মাঝে একটা সপ্তাহান্ত চলে গিয়েছে--শনি ও রবি বার। এই দুইদিন কি করেছিলাম? সে কথায় পরে আসছি। নতুন একটা জায়গায় গিয়ে একদিন মাত্র অফিস করেই দুই দিন ছুটি পাওয়া, এই ব্যাপারটা একাধারে আশির্বাদ এবং অভিশাপ।

কিছুদুর হেটেই দেখি হাঁটু ব্যাথা করছে। কানে আইপড দিয়ে, জোশের চোটে হেটে যাচ্ছিলাম। সেখানে ফুটপাথ ছিল প্রশ্বস্ত, এবং বাংলার শেষ নবাব দের মত ফুটপাথে উঠে যাওয়া কোন উটকো বাইকারের আগ্রাসনও ছিল না। তাই মনের আনন্দে হেটে যাচ্ছিলাম গান শুনতে শুনতে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তা খাড়া উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। রাস্তা ভালই ঢালু, যা আগে বুঝিনি। তখন বয়স কম ছিল, আত্নবিশ্বাসেও ঘাটতি ছিল না এবং জাতিগত সম্মানের কথাও মাথায় ছিল--দিলাম হাঁটা।

প্রায় ৪০ মিনিট টানা হেটে পৌছুলাম পাদোভা হোটেল এ। গিয়ে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না এরকম অবস্থা। কোন মতে হাল্কা কিছু খেয়ে ঘুম দিলাম। উইকেন্ডে কিছু শপিং করেছিলাম। পাউরুটি, চিজ, স্যান্ডুউচ মিট, এসব। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। 

ফিরে যাই উইকেন্ডে। শুক্রবার অফিস করতে খুব অদ্ভুত লেগেছিল। সারা জীবন জানি শুক্র শনি ছুটি, রবি বারে অফিস। শরীরের ঘড়ি ও সেভাবেই সাজানো। তবে মাত্রই আগের রাতে ল্যান্ড করায় তখন খুব বেশি টের পাইনি ব্যাপারটা।

শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠলাম একটু ধীরে সুস্থে। হোটেল রুম টি যথেষ্ঠ পরিমাণে মন খারাপ জাগানিয়া ছিল। জানালা দিয়ে মোটামুটি সুন্দর একটি ভিউ পাওয়া যেত, কিন্তু রুম ছিল খুবই ছোট এবং জীর্ণ দশার। রুমে কোন ময়লা ছিল না, তবে বোঝা যেত যে অনেক পুরনো হোটেল, বহুদিনের মধ্যে কোন মেরামতির মধ্য দিয়ে যায় নি। 

ছোট একটা কামরা, সেখানে কোনমতে একটা বিশাল আকৃতির খাট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ছোট টয়লেট, খাট, ওয়ার্ক ডেস্ক,  ড্রেসিং টেবিল আর এল সি ডি টিভি -- এসবই ছিল সে রুমের আসবাব। দেয়ালে লাগানো ছিল কিছু হাস্যকর ধরণের পোস্টার।  এমনই হাস্যকর যে রুম এর ছবি তোলার সময় সযত্নে এমন এংগেল খুজতে হোত যাতে পোস্টার গুলো দেখা না যায়। রুম এর ছবি কেন তুলেছিলাম? অবশ্যই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য। 

লবি সংলগ্ন রেস্তোরাঁ তে গিয়ে নাস্তা করলাম। সকালের নাস্তা আমি একটু বিলিতি ধাঁচের বেশি পছন্দ করি। দুই টুকরো পাউরুটি টোস্ট এর সাথে মাখন, সেদ্ধ ডিম, চিকেন সসেজ, কয়েক টুকরো পনির আর বিভিন্ন রকম ফল নিলাম। বিভিন্ন রকম পনির ওদের দেশের যেকোন খাবারের মেনুর অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ওখানেই প্রথম খাই হেলুমি (halloumi) চিজ, যা খুবই উপাদেয় ছিল। এছাড়াও এডাম চিজ, কেমেম্বার্ট সহ আর জানা অজানা অনেক রকম পনির সাজানো থাকতো ব্রেকফাস্ট বাফে তে। 

এক প্যাকেট ফ্লেভার্ড ইয়োগার্ট ও এক কাপ কফি দিয়ে শেষ করলাম খাওয়া। তারপর হোটেলের লবিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আশে পাশে সিনেমা দেখার কি ব্যবস্থা আছে। 

সেসময় ঢাকায় কোন থ্রিডি মুভি থিয়েটার খোলেনি। বন্ধু ও কলিগদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে গিয়ে থ্রিডি মুভি দেখে এসেছে ততদিনে। তাদের মুখে চমৎকার বর্ণ্না শুনে অনেক লোভ লাগতো। সে কারণে বৈরুত যাত্রার আগে থেকেই আমার মনের ইচ্ছা ছিল বেশ কিছু মুভি দেখে নেয়ার। 

সিটি সেন্টার মোটামুটি বৈরুত এর বেশ বড় সড় শপিং মল। হোটেল এর লোকজনের কথা অনুযায়ী ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। সুবিশাল শপিং মল দেখে মাথা মোটামুটি খারাপ হয়ে গেল। প্রায় অনেকক্ষন  উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সিনেমা হলের কাছে পৌছে গেলাম। দেখলাম বেশ কিছু সিনেমা দেখানো হচ্ছে। কি কারণে মনে হল স্টেপ আপ থ্রিডি নামক সিনেমাটিই দেখা দরকার। টিকেট কাটতে গিয়ে দেখলাম ছবিটির পরবর্তী শো শুরু হবে আর ১৫ মিনিটের মধ্যে। 

তড়িঘড়ি করে টিকেট কিনলাম। কিনেই গেলাম পপ কর্ণ কিনতে। গিয়ে দেখি ৪-৫ রকমের পপ কর্ণ পাওয়া যাচ্ছে। কাউন্টারের পেছনে অসম্ভব স্মার্ট কিছু ছেলে মেয়ে। আমি বাটারি পপকর্ণ পছন্দ করাতে দেখলাম ভদ্রলোক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। পপ কর্ণ রেডি করতে করতে জিজ্ঞেস করলো আমার কোন ড্রিঙ্ক লাগবে নাকি। আমি কোক এর দিকে অঙ্গুলি নিদ্রেশ করায় সে বলে উঠলো "নিশ্চয় তোমাকে ডায়েট কোক দিব, নাকি?"। 

এখনকার আমার সাথে তখনকার আমির একটা বড় পার্থক্য ছিল। এখন আমি ভয়াবহ মোটা, কিন্ত তখন আমি ভয়াবহ, কুৎসিত এবং দুঃখজনক ধরণের মোটা ছিলাম। সেলসম্যানটি কে চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইলাম, কিন্তু তার মুখের সেই হাসি মুছলো না। আমি বেশ জোরের সাথে বললাম "না, আমি রেগুলার কোক চাইছি"। 

ট্রে ভর্তি খাবার আর বুক ভর্তি উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে ঢুকে গেলাম হলে--জীবনের প্রথম ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র দেখার উদ্দেশ্য। ত্রিমাত্রিক শব্দটার মধ্যেই একটা কেমন জানি নেশা নেশা ভাব আছে। শুনলেই নিজেকে মনে হয় আইজাক আসিমভ কিংবা মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর গল্পের কোন চরিত্র। হলে প্রবেশ এর আগে যখন হাতে একটা ত্রিমাত্রিক চশমা ধরিয়ে দেয়া হল, তখন সেই অনুভূতি আরো প্রকট হল। 

সিনেমার শুরুতেই দেখলাম কিছু ছেলেমেয়ে পানির মধ্যে নাচানাচি করছে। একদিকে জোরালো বৃষ্টি আরেকদিকে তাদের জুতার আচড়ে পানিতে আলোড়ন। হঠাত একজন কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র (কেন্দ্রিয় বুঝলাম তার সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য দেখে) হঠাত স্ক্রিনের দিকে পা দিয়ে জোরে আঘাত করলো, এর এক গাদা পানি ঢেউ এর মত এসে আমাকে ভিজিয়ে দিল। লাফ দিয়ে উঠলাম সিট ছেড়ে। পাশের সিটে বসে থাকা ছেলেটা খেক খেক করে হাসা শুরু করলো। 

আমি নিশ্চিত হলাম যে, দেশ যাই হোক, জাতীয়তা যাই হোক, খেক শিয়ালের মত বিটলামির হাসির শব্দ সব দেশেই এক। ততক্ষণে আর বুঝতে বাকি নেই যে আমি খুবই বাস্তবসম্মত ত্রৈমাত্রিক এফেক্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। আসলে পানি টানি কিছুই আসেনি আমার দিকে, স্ক্রিণ ও থ্রিডি চশমার কারসাজি তে এরকম মনে হয়েছে। 

পুরো সিনেমাটাই নাচ ভিত্তিক এবং সারাক্ষণই বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক থ্রিডি এফেক্ট এর কারণে কোন দিক দিয়ে নব্বুই মিনিট চলে গেল, টেরই পাইনি। 

সেদিন সর্বমোট তিনটি সিনেমা দেখেছিলাম। মাঝে খালি লাঞ্চ ব্রেক নেই, আর রাতে ডিনার করে হোটেলে ফিরি। 

এভাবেই কেটে যায় লেবাননে আমার প্রথম উইকেন্ড। 


Thursday, April 12, 2018

Beirut Diary Part 3

বৈরুতে বনবাস ৩

আমি একটা জিনিস ভাবতে ভালবাসি, যেটা হচ্ছে প্রত্যেক দেশের আকাশ আলাদা আলাদা। ঢাকার আকাশ আর বৈরুত এর আকাশ কখনোই এক রকম লাগে নাই আমার কাছে। দুইটাই সুন্দর। লেবানন প্রকৃতপক্ষে এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও, এটি মূলত ভূমধ্যসাগরীয় একটি দেশ। দেশটি খুব বেশি মাত্রায় ইউরোপ দ্বারা প্রভাবিত।

ভূমধ্যসাগর এর তীরে অবস্থিত হওয়ায় বৈরুত এর আবহাওয়া ছিল খুবই আরামদায়ক। সব সময় একটা বসন্ত বসন্ত ভাব। না ঠান্ডা, না গরম। এসি ছাড়া চলে না, আবার এসি বেশিক্ষণ চালিয়ে রাখলে ঠান্ডা লাগে--এরকম অবস্থা।

প্রথম দিনের অফিস দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল। সবার সাথে আলাপ পরিচয় আর কুশল বিনিময় করতে করতেই দেখি বিকেল ৪ টা বাজে। মাঝে লাঞ্চ করতে গিয়েছিলাম, যার বর্ণনা আগেই দিয়েছি।

আমি ছিলাম ওদের কাছে রহস্যময় একটি চরিত্র, যার কারন অনেক পরে জেনেছি। সেদিনের বড় এজেন্ডা ছিল সব অধিদপ্তরের লোকজনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়া। আমি মার্কেট অপারেশান্স এ যোগ দিয়েছিলাম কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে। এইচ আর, সেলস, ব্র্যান্ড, প্ল্যানিং, কাস্টোমার কেয়ার--দুই বিল্ডিং মিলিয়ে মোটামুটি ১০টি ফ্লোর জুড়ে ছিল তাদের অফিস।

আমার অফিসটি ছিল "শেভ্রোলে" নামক একটি জায়গায়। ভাবছেন জায়গার নাম কি করে গাড়ীর নামে হয়? এর কারন হল, সেই জায়গাটায় আগে শেভ্রোলে কোম্পানীর একটি সুবিশাল ফ্যাক্টরি ছিল, যেখানে বড় বড় গাড়ী তৈরি হত। ফ্যাক্টরি নেই, কিন্তু নাম টা রয়ে গিয়েছে।জায়গাটার অন্য একটি পোষাকী নাম ছিল, কিন্তু সেই নাম বললে কেউ চিনতো না, তাই আমি কখনোই তা ব্যবহার করিনি।

চাকুরীর সুবাদে এর আগেও বিদেশ ভ্রমণ হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু এরকম লম্বা সময়ের জন্য নয়। এবং সে ট্যুর গুলোতে মূলত ২/৩ দিন থেকেছি, এবং অফিস-হোটেল-অফিস এরকম রুটিনেই ছিলাম মূলত। সেবারই প্রথম সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে বিদেশ যাত্রা বলা যায়। অফিস শেষে আর উইকেন্ডে কি কি আমোদ ফূর্তি করবো এ চিন্তায় আমি কিঞ্চিত উদ্বেলিতই ছিলাম বলা যায়।

ছয়টার দিকে অফিস থেকে বের হয়ে আবিষ্কার করলাম যে পাশেই একটি বড় সড় বার্গার কিং। এর আগে মালয়েশিয়া তে গিয়ে টুইন টাওয়ারের নিচে বার্গার কিং এর বার্গার খেয়েছিলাম, এবং জীবনে প্রথম বারের মত আনলিমিনিটেড সফট ড্রিংক্স এর অপশান পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সাত পাঁচ চিন্তা না করে ঢুকে গেলাম ভেতরে। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে হোটেলে গিয়ে আর বের হব না, একবারে ডিনার করেই হোটেল ফিরবো।

"Double Whopper" মিল এর দাম দেখলাম মাত্র ২ ডলার। একটা ডাবল বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস আর এক গ্লাস কোকা কোলা-এই হল মিল। এখানে অনন্ত কোমল পানীয়ের অফারটি ছিল না, তবে তাতে দুঃখ পাইনি এক্টুও।

মেনুর পাশে বড় বড় করে লেখা দেখলাম যে আর ১ ডলার যোগ করলেই আমি আমার মিলটা কে এক্সট্রা লার্জ করে নিতে পারবো। সেটাই নিলাম। অর্ডার দিয়ে কিউ তে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম মোটামুটি সবাই বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এসেছে ওখানে। কোন একাকী খাদক কিংবা জুটি দেখলাম না, সবার সাথেই ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চা, এবং সবার পরনেই হাল ফ্যাশানের পশ্চিমা পোষাক। সেখানে স্যুট টাই পরা নিজেকে খুবই বেমানান লাগছিল।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে স্যুট টাই খুবই অপছন্দ করি। আমার কাছে স্মার্ট ক্যাজুয়াল হচ্ছে সেরা পোষাক। তারপরেও ভাবলাম "দেশের সম্মান", একটা বিদেশী অফিসে জাচ্ছি , সেখানে একটু ফর্মাল না পড়লে কিভাবে হয়?

সেদিন অফিসে অবশ্য সবাই ক্যাজুয়াল পোষাকে ছিল, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম শুক্রবার, সপ্তাহের শেষ দিন বিধায় সবাই ক্যাজুয়াল পড়েছে। কিন্তু পরে জানতে পারি যে ওখানে ড্রেস কোড খুবই শিথিল।

কিছুক্ষণ পর যখন আমার হাতে একটা ট্রে ধরিয়ে দেয়া হল, আমার চোখ কপালে উঠে গেল। বার্গার এর সেই প্রমাণ সাইজ আমি আজো ভুলতে পারিনি। দুই হাতেও ধরতে পারছিলাম না ঠিকমত, এত বিশাল সেই এক্সট্রা লার্জ বার্গার। আমাকে যারা ব্যক্তিগত ভাবে চেনে, তারা জানে আমি অনেক বড় ধরনের খাদক। আমাকে দেখলেও অবশ্য সেটা বোঝা যায়। সেই আমি অনেক কষ্ট করেও পুরো বার্গার শেষ করতে পারলাম না। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস যা ছিল তা দিয়ে দেশে ৪-৫ জন মানুষের পেট ভরে যেত, আর কোক এর গ্লাসটি কে মনে হয়েছিল অন্তহীন। বরফ দিতে মানা করে দেয়াতে আসলেও পরিমাণে অনেক বেশি পেয়েছিলাম।

আসার সময় রাস্তা চিনে রেখেছিলাম। সেদিন পণ করেছিলাম যে ট্যাক্সি ভাড়া বাচানোর জন্য মাঝে মাঝে হেটে হেটে বাড়ী ফিরবো। সেদিন প্রথম দিন হওয়া তে ডিনার করার পর পরই ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম হোটেলে।

এ ভাবেই শেষ হয়ে গেল লেবাননে আমার প্রথম দিনটি।


Saturday, April 07, 2018

Beirut Diary Part 2

বৈরুতে বনবাস পর্ব ২

ব্যাখাতীত ঘটনা টা জানি কি ছিল? ইতালীয় ভাষার এক বর্ণও না জেনে সেই ভাষার একটি গান মাথার মধ্যে ঢুকে যাওয়া! রাস্তা ঘাটে, শপিং মল ও কফি শপে, সবখানেই we no speak Americano গানটি বাজতে থাকতো।তখন অবশ্য গানটার নাম জানতাম না। জেনেছি অনেক পরে। সে আরেক কাহিনী। 

ইমিগ্রেশানের সকল কাজ কর্ম সেরে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌছাতে পৌছাতে রাত ৯ টা বেজে গেল। পেটে তখন খিদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। কোন মতে হোটেলে জিনিসপত্র রেখে বের হলাম খাদ্যের খোজে।

হোটেলটি ছিল বেশ উচু একটি জায়গায়। ঢালু রাস্তা সোজা নেমে গিয়েছে নিচের দিকে, এবং সেই রাস্তা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বৈরুত সম্পর্কে তেমন কোন পূর্ব ধারণা ছিল না; ভেবেছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের আর আট দশটা শহরের মতই হবে। আমি ল্যান্ড করেছিলাম বৃহস্পতিবার, কোন উইকেন্ডেও না।

যখন বের হলাম রাস্তায়, চারিদিক শুনশান। সব দোকানপাট বন্ধ। হোটেল এর চার পাশে দেখার মট কিছু ছিলই না, প্রচুর পরিমাণে বড় বড় অট্টালিকা আর গাড়ীর সমাহার ছাড়া। প্রায় ১৫ মিনিট হেটেও দৃশ্যপটের তেমন কোন পরিবর্তন হল না । পুরাই এক শহুরে জংগল।

প্রতিটি রাস্তার দুইধারেই অসংখ্য গাড়ী পার্ক করে রাখা; আশে পাশে কেউ নেই। কোন কোনটায় পুরু ধুলার আস্তরণ দেখে নিশ্চিত হলাম যে মাসের পর মাস এগুলো এখানেই আছে। প্রথম যেই চিন্তা টা মাথায় এল সেটা হচ্ছে--"বৈরুতে যদি একটা ধোলাইখাল থাকতো, তাহলেই খবর ছিল এই গাড়ী মালিক গুলোর।" 

অনেকক্ষন হেটে হেটে একটা জায়গায় পৌছুলাম, যেখানে পাশাপাশি বেশ কিছু রেস্তোরাঁ ছিল। বেশি ভীড় এর কোন জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। মোটামুটি ফাঁকা একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। বাইরে থেকে দেখে মনে হল এখানে রুটি কাবাব জাতীয় খাবার পাওয়া যেতে পারে। পেট ভরানোর মত পরিচিত খাবার পাওয়াটাই তখন ছিল একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। মনে পড়ে গিয়েছিল হোটেল গ্রোভার ইন গল্পে প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর ফ্রেঞ্চ টোস্ট অর্ডার দেয়ার কাহিনী। 

রেস্টুরেন্ট এর ম্যানেজার কিসিমের একজন জানালো আমি চাইলে দোতালায় খোলা আকাশের নিচে বসতে পারি। সেদিনের আবহাওয়া ছিল চমৎকার, ঠান্ডাও না, গরম ও না। প্রস্তাব মনে ধরায় গিয়ে বসলাম উপরের ফ্লোরে। এখানেও সেই একই ভিউ। বিভিন্ন সাইজের নতুন পুরনো অট্টালিকা আর অল্প কিছু গাছ গাছালি।  ততক্ষণে ব্যাপারটার সাথে চোখ সয়ে গিয়েছে।সিত্রোয়া, আলফা রোমিও, পন্টিয়াক, শেভ্রোলে, ড্যাটসান এর মাঝে একটাও টয়োটা চোখে পড়লো না। 

একজন হাসিখুসী ভদ্রমহিলা এলেন অর্ডার নিতে। মেনুতে দেখলাম রিব আই স্টেক আছে, দাম ঢাকা শহরের তুলনায় কমই মনে হল। মজার ব্যাপার হল, লেবাননে ওদের দেশীয় মুদ্রার পাশাপাশি ইউএস ডলারও ব্যবহার করা যায় কোন বাধা ছাড়াই। মুদ্রাস্ফিতির কারণে ১ ডলার ভাংগিয়ে তখন প্রায় ১,৫০০ লেবানিজ পাউন্ড পাওয়া যেত, যা লেনদেন এর জন্য অসুবিধাজনক ছিল। একটি বার্গার খেলেন? বেরিয়ে গেল ৩০০০ টাকা! এক বোতল পানি কিনবেন? দাম ৭০০ টাকা। এরকম আর কি! সে কারণে অনেকেই ডলার দিয়েই সারতেন লেনদেন; মূল্য তালিকাতেও ডলারে দাম দেয়া থাকতো। নিজেকে আমেরিকান আমেরিকান মনে হচ্ছিল। 

দেখলাম স্টেক এর দাম $9.99, যা বাংলাদেশী স্ট্যান্ডার্ডে মোটামুটি সস্তাই বলা যায়। কথা প্রসংগে ফাতিমার কাছ থেকে তার নামের পাশাপাশি আরো জানতে পারলাম যে স্টেক টির ওজন হবে প্রায় ৩০০ গ্রাম এর মত এবং সাথে ম্যাশড পটেটো ও স্টিমড ভেজিটেবল দেয়া হবে, এবং আমি ৫০ সেন্ট যোগ করে দু'খানা আরবীয় খুবজ রুটিও এড করে নিতে পারবো অনায়াসে। পানীয় কি খাব জানতে চাওয়াতে আমি "এক বোতল ঠান্ডা পানি" চাইলাম।

অন্য রেস্তোরার ওয়েটারের মত উনি উধাও হয়ে গেলেন না। কিচেনে অর্ডার বার্তা পৌছে দিয়ে বারবার এসে এসে নানা খোজ খবর নিতে লাগলেন। আমি কই থাকি, কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ইংরেজী ছিল এক্সেন্টেড। আমরা ইংরেজী ছবিতে আরব টেররিস্ট দের যেরকম ইংরেজী বলতে শুনি, অনেকটা সেরকম। 

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর এল কাঙ্ক্ষিত খাবার। সাথে পেলাম সবুজ এক বোতল পানীয়। জিজ্ঞাসু নেত্রে মহিলার দিকে তাকালে সে জানালো আজকেই তাদের রেস্তোরাঁর ওপেনিং হয়েছে, আর এজন্য সব কাস্টোমার দের ফ্রি একটা ড্রিংক দেয়া হচ্ছে। আমি কি দরকার ছিল, এইসব খাই না লাইনে কিছু একটা বলা শুরু করতে না করতেই সে হড়বড় করে বলে উঠলো "তুমি শুধু মাংশ অর্ডার দিয়েছ। এর সাথে এই পানীয় পারফেক্ট কম্বিনেশান। আমরা এই জিনিস ছাড়া স্টেইক খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না। চেষ্টা করে দেখ।"

খাওয়া শেষ হতে বেশ খানিকক্ষণ লাগলো। প্লেন থেকে নামার পর যে অপরিসীম বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করেছিল তা এই ঘরোয়া পরিবেশের রেস্তোরাঁ অনেকটাই দূর করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল পরবর্তী দু'মাস এখানেই ডিনার করবো। তবে বাস্তবে আর মাত্র একবারই আসা হয়েছিল এখানে। সেদিনের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। যথাসময়ে বলবো। 

বিল চুকিয়ে বের হলাম যখন, তখন রাত ১০ঃ৩০। আমার জন্য তেমন কোন রাতই না, কিন্তু বৈরুত স্ট্যান্ডার্ডে নিশুতি রাত মনে হল। রাস্তায় কাক পক্ষীও নাই। হেটে হেটে অনেকদুর চলে এসেছিলাম একটি মাত্র ভরসায় যে হোটেল এর নাম ঠিকানা লেখা একটি কার্ড রয়েছে সাথে, যেটি দেখালে ট্যাক্সি ড্রাইভার পৌছে দেবে জায়গা মত।

পরেরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে অফিসে পৌছাতে হবে। সে চিন্তায় আচ্ছন্ন হতে হতে একটি ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। ট্যাক্সিওয়ালা প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো "ট্যাক্সি?"। আমি অবাক হয়ে তার দিয়ে চেয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম "আরে বেটা ট্যাক্সি লেখা সাইন আছে দেখেই তো তোর গাড়ীতে উঠসি"। কিছু না বুঝেই বললাম ওকে। সে বেশ খুশী হয়ে গাড়ী হাঁকাল আমার হোটেলের উদ্দেশ্যে। ভাড়াটা একটু বেশি মনে হলেও আর তেমন কিছু বললাম না।