Monday, January 15, 2018

জানালার পাশে পর্ব ২

জানালার পাশেঃ পর্ব ২


পূর্ণিমার চাঁদের মাঝে একটি বিশেষ ধরণের মাদকতা রয়েছে। মাঝরাতে যখন গোল হয়ে চাঁদখানা মাথার উপর উঠে থাকে, তখন অন্য কোন কিছুর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব সমুদ্রের পানির উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে, সেটাকে দূর থেকে একটি লম্বা অট্টালিকার মত দেখা যায়। পানির কম্পনের সাথে সাথে সেই অপরুপ আলোও কাঁপতে থাকে, এবং মনে হয় যেন সরু হতে থাকা সেই প্রতিবিম্ব ধরে সাঁতরে চলে যাওয়া যাবে চাঁদে।

পূর্ণিমা মানেই মিরিন থাকবে চন্দ্রাহত। পাশে বসে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা, কিন্তু চোখ থাকবে আকাশের দিকে। নীল প্রথম প্রথম অবাক হত, কিন্তু পরে ব্যাপারটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।

থেমে থাকা গাড়ী তে বসে মিরিন এর দিকে অপলক দৃষ্টিতে আরো কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো নীল। আবার ফিরে গেল সে অতীতে।

ম্যাক এ লাঞ্চ করার পর বেশ কিছুদিন চলে গিয়েছে। সেদিনের পাগলামি আচরণ এর কথা মনে পড়লে নীল এর ফর্সা মুখে লাল বেগুনী রঙ ফুটে উঠে। সেদিন ভার্সিটি ডর্মে আড্ডা মারতে মারতে হঠাত আনমনা হয়ে সেদিনের কথা ভাবছিল নীল। স্প্যানিশ বান্ধবী মারিয়া ওর মুখের সামনে জোরে তুড়ি বাজানোর পর তার সম্বিত ফিরলো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কি হচ্ছে বোঝার আগেই মারিয়া উধাও, দূর থেকে ক্যাটওয়াক দেখা আড় "idiota!" ডাক শোনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।

আবার ডুবে গেল সে দিবাস্বপ্নে। নিরীহ মেয়েটি অনেক লজ্জা পেয়েছিল সেদিন! ওর হাতে মোটামুটি জোর করেই তার নাম্বার টা ধরিয়ে দিয়েছিল নীল, কিন্ত মেয়েটি মাথা তার দিকে একবারো তাকায়নি।

কাগজ টা নিয়েছিল সে। ছিঁড়ে ফেলে দেয়নি, মুঠোবন্ধ করে রেখেছে।তার নামটিও জানা হয় নি সেদিন । নীল যখন গট গট করে বেরিয়ে যাচ্ছিল রেস্তোরা থেকে, সে একবারো ফিরে তাকায়নি। তাকালে দেখতে পেত তার পিঠের ওপর স্থির হয়ে আছে এক জোড়া মায়াবী, প্রায় আদ্র চোখ।

ডর্ম থেকে বেরিয়ে ক্লাশে গেল নীল। ক্লাশেও খুব একটা মনোযোগ দিতে পারলো না সেদিন। ক্লাশ শেষে খেয়াল করলো দূর থেকে মারিয়া ওকে দেখছে। হয়তো ভাবছে সে এগিয়ে গিয়ে সরি বলবে। তবে নীল এর মন সেদিন অন্যদিকে ছিল। বিস্মিত হয়ে ক্লাস এর সেরা সুন্দরী খেয়াল করলো তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে গটগট করে বেরিয়ে গেল পূর্বদেশীয় হ্যান্ডসাম ছেলেটি। অস্ফুটে আবার বলে উঠলো সে "ইডিওটা!"।

ভার্সিটি সংলগ্ন পার্কে চলে গেল নীল। ও নিজেও জানে না কিভাবে কিভাবে সে পাথরের তৈরি বেঞ্চ এর সামনে চলে এল। ক্লাশ রুম থেকে এখানে আসা পর্যন্ত পথটির কোন স্মৃতি তার নেই। খালি মনে পড়ছে মেয়েটির লাল হলুদ ইউনিফর্মের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান নীল রঙ এর কানের দুল এর কথা।

পার্কের নিস্তব্ধতা কে ভেঙ্গে দিয়ে একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এল, বেজে উঠলো লাস্ট রিসোর্ট গানের প্রথম পংক্তি দ্বয়ঃ

"Cut my life into pieces

This is my last resort"


অচেনা কন্ঠ, কিন্তু শুনেই নীল বুঝলো সেই রেস্টুরেন্ট ললনা ফোন করেছে। ১০ মিনিট এর সংক্ষিপ্ত আলাপ। সেখান থেকে কফি শপে দেখা। প্রতি সপ্তাহের রুটিন প্রতিদিনের রুটিনে যেতে বেশিদিন লাগেনি। একই শহরে থাকতো দু'জনে, তবে বিপরীত প্রান্তে।

দুইজনের মধ্যে তেমন কোন মিল ছিল না। নীল ছিল অনেক সরব, মিরিন ছিল লাজুক। নীল থাকতো আসরের মধ্যমণি হয়ে, আর মিরিন এর একমাত্র সঙ্গী ছিল তার পোষা জ্যাক রাসেল টেরিয়ার কুকুরটি। আদর করে তাকে সে ডাকতো "বু" বলে।নীল ছিল অবস্থাপন্ন পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান, আর মিরিন ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা ভরসার প্রতীক।

মিরিন বেশি কিছু বলতো না, মুখ টিপে হাসতো খালি, আর শুনতো নীল এর শিশুদের মত হাত নেড়ে নেড়ে বলা মিষ্টী কথা গুলি। নীল প্রায়ই অভিযোগ করতো "তুমি এত কম কথা বল কেন?"। মিরিন বলেছিল "আমি লিখতে পারি, বলতে পারি না"।

দেখা হওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় দেশ থেকে এল জরুরী তলব, সাত দিনের নোটিশে নীল ফিরে গেলে দেশে--অসুস্থ্য মা কে দেখতে। পৌছে গিয়ে পেল বড় বড় কিছু সারপ্রাইজ। দ্বিতয় দিনে নীল এর মেইল বক্সে এল হাতে লিখা নীল খামের চিঠি। কাগজ টি সাদা, হাল্কা ল্য্যাভেন্ডার পারফিউম এর সুগন্ধ মাখা। সেখানে গোটা গোটা হাতে নীল কালিতে লিখা একটি কবিতা, যা নীল এর জীবন কে ওলট পালট করে দেয় নিমিষে।

"উষার আকাশের নব উদিত তারার আভাসে আঁঁচও করিনি,
একদিন.....
হৃদয়মম উচ্ছলিয়া প্রনয় গাঁথা রচিব।
এমন প্রেমোন্মত্তে সিক্ত হবো।

সদাই বিমোহিত হয় অবারিত মন....
আমার ছায়াপথ কেনো
পুরোটাই তোমায় আচ্ছন্ন!
আমার আকাশপটে কেনো
কেবলি তুমিই!

পূর্ণিমাতিথিতে সাগরের জলরাশির উন্মাদনার মতো,
একদিন......
পুরোটাই আমি কেনো তোমায় সঁপে দেবো!

তবে.....
সব প্রাপ্তিযোগে পূর্ণতা আসে না !
শুধু হয় মুগ্ধতার সলিলসমাধি।

তাই......
পূর্ণতা নয়!
মুগ্ধতার রঙধনুতে প্রোজ্জ্বল হোক
আমার সরোবর।

ঠিক তেমনি করে,
একদিন.....
এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে
মিলিয়ে যাবো অমানিশার কালান্তরে।"

এক নিমিষে পড়ে ফেল্লো নীল। তারপর আবার। কমপক্ষে ২০-৩০ বার পড়লো চিঠিখানা। কিন্তু আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো সে, ভাবলো চিঠির উত্তরে চিঠিই দিতে হবে। হাতে তুলে নিল কাগজ কলম, কিন্তু দুই লাইন এর বেশি আগালো না। তখনো সে বোঝেনি যে মিরিন এর চিঠির চেয়েও বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল ওর জন্য।

অসুস্থ্য মা পরের দিন তার হাত ধরে একটি অনুরোধ করলেন।

(চলবে)



















Thursday, January 04, 2018

জানালার পাশে পর্ব ১

রাত বাজে ৩ টা।

একটার পর একটা গাড়ী চলে যাচ্ছে ধূলোর ঝড় উড়িয়ে। গাড়ীর জোরালো শব্দ বার বার রাতের সুনশান নীরবতা কে বিঘ্নিত করছে। জানালা টা নামিয়ে দিবে ভাবছে নীল, কিন্তু আবার বাতাস টাও মন্দ লাগছে না।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে গান। খুব কম ভলিউমে, কান পাতলে শোনা যায় লিরিকসঃ
The cars hiss by my window,
Like the waves down on the beach)

রাত ১ টার পর থেকে একটা অদ্ভত সময় শুরু হয়। বেশিরভাগ মানুষ ১ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সময়টা ঘুমিয়ে উপভোগ করে। নাইট শিফট এর কর্মীদের কথা অবশ্য আলাদা।

নীল এর ৯-৫ চাকরী। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়, কিন্তু তাও রাতে বেশি ঘুমায় না। বহুদিনের অভ্যাস।

(একই লাইন আবার রিপিট হচ্ছেঃ
The cars hiss by my window,
Like the waves down on the beach)

কাছেই রকি বিচ। ঢেউ এর মৃদুমন্দ ঝংকার এর সাথে প্রিয় শিল্পীর সংগীত। Blues ধাচের গান।

স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে মিরিন। অনেক্ষন ধরে গাড়ীর ইঞ্জিন নিস্তব্ধ। গাড়ীর সব বাতি নেভানো, শুধু স্টেরিও তে চলছে গান। নীল তাকিয়ে আছে মিরিন এর দিকে। মেয়েটা একদম হাতের নাগালের মদ্ধ্যে, কিন্ত তবু কেন জানি বহুদুরে।

(গানের পরের লাইন বাজছেঃ
I got this girl beside me
But she's out of reach )

নীল এর মনে পড়ে যায় উদ্দাম ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ দেশেই। ছোটবেলা থেকেই গ্রেকো রোমান কুস্তিগীড় এর প্যাঁচের মত করে দৃঢ় আলিংগনে জড়িয়ে ধরেছিল সে পশ্চিমা জীবন কে। তাকে দেখলেও সহজে মানুষ বুঝতো না যে তার পূর্বপুরুষ রা এসেছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গরিব দেশটি থেকে। সে জীবনেও দেখেনি পা দিয়ে কাউকে বেশিক্ষণের জন্য ফুটবল খেলতে।

মায়ের ভাষা সে ভুলেই যেত, যদি না প্রতিদিন দেশ থেকে ফোন রিসিভ করতে হত। মা একবার কল করলে আর ছাড়তেই চেত না।

এরকমই একদিন ম্যাকডোনাল্ডস এ বসে মায়ের সাথে কথা বলছিল নীল। তাকে খাবার দিচ্ছিল একটি পূর্বদেশীয় ছিপছিপে তরুণী। ফোনে মশগুল থাকায় ভাল করে খেয়াল ও করেনি কি বলছিল তাকে মেয়েটি। সে মায়ের দীর্ঘ আলাপ থেকে মুক্তির পথ খুজছিল। মা ঘুরে ফিরে খালি একটা কথাই বলছিল।

"কোর্স শেষ করে দেশে আয়, বিয়ে কর। আমরা নাতি নাতনীর চেহারা দেখি"। কিন্ত প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ হু ছাড়া কিছুই বলতো না নীল। আদতে তার দেশে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিল না। অন্তত সেদিনের আগ পর্যন্ত।

হঠাত সে শুনলো একটা তরুণী তার কানের কাছে এসে বলছে "ভাইয়া, বার্গার এর সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস আর কোক নিবেন?"

থতমত খেয়ে ফোন থেকে মাথা তুল্লো নীল। প্রথম বারের মত ভাল করে খেয়াল করলো সে তার সার্ভার কে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেল নীল। ততক্ষনে হতোদ্যম হয়ে চলে গিয়েছে তরুণী। যে কাজ জীবনেও করে নি, সেদিন সেটাই করেছিল নীল। পকেট থেকে এক টুকরা আকাশী রঙ এর কাগজ বের করে তাতে লিখে দিয়েছিল নিজের ফোন নাম্বার। দৌড়ে গিয়ে সেই সার্ভার এর হাতে কাগজটি গুঁজে দিয়ে দেখেছিল তার লাল নীল হওয়া মুখ। কল মি মেইবি? বলে ফিরে গিয়েছিল বার্গার এর কাছে।

বর্তমানে ফিরে এল নীল।

মিরিন এর হাত স্টিয়ারিং এ, কিন্তু গাড়ী চলছে না। ঘুমাচ্ছে ও।

"ঘুমাক। বহুদিন বিশ্রাম পায়নি ও। চায় ও নি। তবে তাতে কিছু আসে যায় না"। 

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে যাচ্ছে গিটার এর করুণ সুর)