Monday, March 30, 2020

করোনা কাব্য ১

১৯৮৯ সালে দেশে ভয়াবহ ধরণের বন্যা হল। আমাদের বাসার সামনের জায়গাটা একদম নদীর মত হয়ে গেল। কোথাও যেতে হলে নৌকায় করে যেতে হোত। স্কুল বন্ধ ছিল। আব্বা কে দেখতাম নৌকায় করে অফিসে যেতে। 

আমিও একবার গেলাম; বিয়ের দাওয়াত খেতে। খিলগাঁও টু শান্তিনগর ডাইরেক্ট সার্ভিস। ধুন্ধুমার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা স্বত্ত্বেও সেই বিয়ে কিন্তু মুলতবি হয়নি। আমরাও মজা পেয়েছিলাম কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে; কারণ আলু ও আলুবোখারার চাটনি, কোনটারই অভাব ছিল না। খাসীগুলোও ছিল সরেস ।

পুরনো কাসুন্দি ঘাটার মূল কারণ হচ্ছে, যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য একেক জন মানুষ একেক ধরণের কৌশল অবলম্বন করে। কেউ বিয়ে করে, কেউ বাসায় বসে খাওয়া দাওয়া করে, আর কেউ বা জনসেবা করতে রাস্তায় নেমে যায়। কিন্তু কারও জীবনই আগের মত থাকে না। আর করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন এসেছে, তা নজিরবিহীন। কারণ আমাদের জীবদ্দশায়, এর চেয়ে বৃহত্তর কোন সংকট আমরা দেখিনি। হয়তো আমাদের বাবা দাদারা দেখেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়টা। 

স্মরণাতীতকালে আমাকে বা আমার চারপাশের মানুষদের এতদিন গৃহে অন্তরীণ থাকা লাগেনি। যখন একটি মানুষ ১০-১৫ বছর ধরে দৈনিক সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অফিস করে, তখন সে কামনা করে তার যেন অখন্ড অবসর আসে, বাসা থেকে বের না হয়েও যেন মাস শেষে একাউন্টে টাকা গুলো জমা হয়। 

কিন্তু সত্য সত্য যখন অনুরুপ একটি অবস্থা চলে আসে, তখন সেটা বিষময় হয়ে যায় খুব শীঘ্রই। আর কাজ তো কখনো থেমে থাকে না, হোম অফিস বা ফোন অফিস, যেটাই হোক, সেটা চলতেই থাকে। আর যারা সারা বছর বাসায় থাকেন, তারাও একজন অনাহুত অতিথির নিরন্তর অস্থিরতার সাথে মানিয়ে নিতে চ্যালেঞ্জের শিকার হন। 

সব মিলিয়ে, এই পরিবর্তিত অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য যে যাই করুক, আরেকজনের মানুষের কোন অধিকার নেই সেটা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার। যার যার সংগ্রাম তার নিজের কাছে। যে মানুষটা প্রতিদিন ভাল ভাল খাবারের ছবি দিচ্ছে, সে হয়তো আড়ালে গরীব দুঃখীদের জন্য অনেক টাকাও  দান করছে। 

সুতরাং "বাসায় বসে খাওয়া দাওয়া না করে গরীবদের সাহায্য করলেই পারে" টাইপ কথাবার্তা বলা থেকে সবার বিরত থাকা উচিৎ। 

করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাচার জন্য মানুষকে বাসায় থাকতে বলা হয়েছে। এর মানে এই না যে বাসায় বসে ভয়ে কুঁকড়ে থেকে সারাক্ষন সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে হবে। আরেকদল মানুষ বলেন "সারাদিন ফেসবুকে ছবি না দিয়ে দোয়া দুরুদ পড়লেও তো পারে"। তারা এটা ভাবে না যে ফেসবুকে এক্টিভ থাকার সাথে ধর্ম কর্মের সরাসরি কোন যোগসূত্র নেই। 

অবশ্যই এটা আপনি বলতে পারেন যে, ছবি তোলা আর পোস্ট করারই তো অনুমোদন নেই ধর্মে। কিন্তু আপনি আমি কি অত কঠোরভাবে ধর্ম পালন করি? এ ধরণের প্রশ্ন তুল্লে অনেক কিছুই জীবন থেকে বাদ দিতে হবে আপনার; সেগুলো তো বাদ দিচ্ছেন না? এমন কি প্রতিবাদের এই ফ্রি প্ল্যাটফর্ম, ফেসবুক ব্যবহার করাও বাদ দিতে হবে, কেননা এটি বানিয়েছেন জনৈক ইহুদি নাসারা! 

বর্তমানে ফেসবুক আমাদের অনেকের জন্যেই একটি নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকের কাছে এটি আলো বাতাস অক্সিজেনের মতই গুরুত্বপূর্ণ। 

এই মুহুর্তে ফেসবুকে নেগেটিভ সংবাদের সংখ্যা অনেক বেশী। সারা বিশ্বে প্রায় ত্রিশ হাজারেরও অধিক জীবন কেড়ে নিয়েছে এই প্রাণহন্তারক ভাইরাস; আর অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে। 

আমি বলছি না যে এই দূর্যোগের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের অবগত থাকার দরকার নেই, কিন্তু সারাক্ষণ এ ধরণের নেগেটিভিটি দেখে অনেকেই মানসিক চাপের শিকার হচ্ছেন। আমি আমার চারপাশের অত্যন্ত পজিটিভ মানুষদেরকেও দেখছি মুষড়ে পড়তে, আর যারা একটু দূর্বল চিত্তের, তাদের কথা তো বাদই দিলাম। তাদের অনেকেই "প্যানিক" করছেন। 

এসব চাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অনেকে গান, নাচ, খাবার দাবার, খেলাধুলা, রান্নাবান্না ইত্যাদি বিভিন্ন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কাজের বর্ণনা সম্বলিত পোস্ট করছেন। এগুলো দেখে কিছু মানুষ খুব বিরুপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, যা একেবারেই অনভিপ্রেত। আমার মতে করোনা ভাইরাসের মত শত্রুর সাথে জয়ী হবার জন্য পজিটিভ মাইন্ডসেট রাখা খুবই জরুরী। আপনি যদি বিশ্বাসই না করেন যে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন সম্ভাবনা নেই, তাহলে সমস্যা দূর হবে কেন? 

জীবন চলুক। পজিটিভ থাকুক সবার জীবন, আর ফেসবুক ওয়াল। 

Sunday, March 22, 2020

Italian Blues

বেশ কয়েক বছর আগে, হঠাত করেই আমার ইউরোপ যাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল, এবং তা কর্মসূত্রে।
রোম আর আমস্টারডামে পরপর দুইটি ওয়ার্কশপ/কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্যে দাওয়াত পেলাম। যেহেতু ইতালীরটা আগে শুরু হবে, সেহেতু ভিএফএস মারফত ইতালীয় দূতাবাসে শেনজেন ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিলাম।
বিজনেস ভিসা বিধায় অনেক কাগজপত্র জমা নিল। আমি তখন যে প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতাম, সেই প্রতিষ্ঠানের বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্ঠির পরিচয় সম্বলিত সকল কাগজ তাদেরকে দিতে হলো, এবং তারপরেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হল--দূতাবাসে প্রায় অর্ধ দিন বসায় রেখে তারপর একটি প্রহসনমূলক ইন্টার্ভিউ নিয়ে তারপর আমাকে বল্লো "ভিএফএস থেকে জানায় দেয়া হবে ভিসা হয়েছে নাকি"। পরে জানতে পেরেছিলাম যে অনেক বাঙ্গালী "ফ্যামিলি ভিসা" নামক এক বিচিত্র উপায়ে ইতালী যেতে পারে, অর্থাৎ পরিবারের একজন ইতালীর ভিসা পেলেই বাকিরাও আবেদন করতে পারে। কিন্তু সে ভিসার ক্ষেত্রে অনেক জালিয়াতি হয়, এবং এ কারণে বাঙ্গালীদের প্রতি দূতাবাসের কর্মীদের এই বৈরি আচরণ।
এত কাঠ খড় পোড়ানোর পরেও লাভ হলো না; কনফারেন্স শেষ হবার একদিন পরে ভিসা পেলাম।
অফিসে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম এই ঝামেলার কথা। ইতালী যাওয়া হচ্ছে না, কিন্তু তখনো মনে আশা যে অন্তত ডাচদের সাথে নিশ্চিত দেখা হচ্ছে।
কিন্তু সেখানেও ঝামেলা। আমাকে এডমিন থেকে জানানো হলো যে ইতালী থেকে যেহেতু ভিসা পেয়েছি, সেহেতু আমাকে ইতালী হয়েই ইউরোপে প্রবেশ করতে হবে। নচেৎ আমস্টার্ডামে প্রবেশ করতে ঝামেলা হতে পারে।
কিন্তু ইতালীর কনফারেন্স তো শেষ হয়ে যাবে আমি পৌছুতে পৌছুতে, তাহলে কি উপায়? উদ্ভট একটা ট্র্যাভেল প্ল্যান করা হলো। শুক্রবার দুপুর ৩টায় রোমে পৌছুবো, আর পরেরদিন দুপুর ২টায় আমস্টারডামের উদ্দেশ্যে রওনা দিব। অর্থাৎ ইতালী তে আমার থাকার সময় পুরো একদিনও নয়।
ভাগ্য গুণে রোমে আমার জন্য হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল, যা তখনো ক্যান্সেল করিনি। তারমিনি রেল স্টেশনের কাছে একটা ছোটখাট হোটেলে উঠলাম। পুরা খুপড়ি টাইপ একটা রুম, কিন্তু ভাড়া ছিল ১০০ ডলারের উপরে। সারা জীবন পূর্ব এশিয়ার ৪০-৫০ ডলারের বিলাসবহুল হোটেল রুম দেখে অভ্যস্ত আমার চোখে এই রুম কে খুবই দীনহীন মনে হলো।
এই ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে সৌভাগ্য হয়েছিল অনেক কিছু দেখার, শোনার। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে এসেই কোন মতে ব্যাগ রেখে, শাওয়ার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। বাসায় ফিরেছি গভীর রাতে, প্রায় ২টার দিকে। এই পুরো সময়টা খালি হেটেছি আর হেটেছি--হা করে গিলেছি অপরুপ রোম শহরের সকল সুধা। ট্রেভি ফাউন্টেন আর কলিসিয়াম সহ আরো অনেক কিছু দেখেছি দিনভর। পরেরদিন ভোরে উঠে আবার ভ্যাটিকান সিটিতেও গিয়েছিলাম।
আজকে করোনা ভাইরাসের ছোবলে এই সুপ্রাচীন শহর আর সমগ্র ইতালী রাষ্ট্রের মানুষের দূঃখ দুর্দশা দেখে খুবই খারাপ লাগছে। অনেকে হয়তো ভাববে, নিজের দেশ আর শহর নিয়েই চিন্তা করে কূল পাই না, ইতালী নিয়ে ভাবার সময় কই?
কিন্তু, আমার আসলেই অনেক খারাপ লাগছে ওদের এই অবস্থা দেখে।
২১ মার্চ পর্যন্ত সেখানে ৫৩,৫৭৮ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, আর মারা গিয়েছে ৪,৮২৫ জন। এক দিনেই প্রায় ৭৯৩ জন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে এই রোগে।
লাইফ ইজ বিউটিফুল ও গডফাদার মুভি, বিভিন্ন বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, আর্টিস্ট --এসব কারণে ছোটবেলা থেকেই এই দেশটি ও দেশের মানুষের প্রতি একটা টান অনুভব করি। যারা দীর্ঘদিন ঐ দেশে আছে, তাদের কাছেও শুনেছি, ইতালিয়ানরা অনেকটা আমাদের মত। আবেগী, সব সময় যুক্তি তর্ক মেনে কাজ করে না। কে জানে, হয়তো এই আবেগের কারণে ওরা আজকে এত দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আসুন সবাই মিলে আজকে ইতালীর জন্য একটু প্রার্থনা করি, যার যার ধর্মীয় আচার অনুযায়ী, আর সাথে এটাও কামনা করি যেন আমাদের দেশের উপর এরকম বিপর্যয় না নেমে আসে। তবে প্রার্থনাটা একা একা, নিজের ঘরে বসে করলে ভালো হয়।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান।