Sunday, March 31, 2019

আকাশে আগুন

(প্রথমেই বলে নিচ্ছি, এটি একটি দীর্ঘ পোস্ট। বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নি দূর্ঘটনার পর প্রায় ৩ দিন চলে গিয়েছে, কিন্তু এখনো আমি সেই শক থেকে পূরোপুরি মুক্ত নয়। প্রায় আমার চোখের সাম্নেই ঘটনাগুলো ঘটছিল। চেয়েছিলাম সেদিনই লিখে রাখতে, কিন্ত খুব কষ্ট হচ্ছিল লিখতে।)

আজকে দিনটি একটু অন্যরকম ছিল। অবশ্য বৃহস্পতিবারগুলো সব সময়ই একটু ভিন্ন ধরণের হয়। একটা ভালো লাগার আমেজ নিয়ে দিন শুরু হয়। কারণ আর কিছুই না, পরের দুই দিন অফিস থাকবে না, এটাই ভালো লাগার একটা আবেশ এনে দেয়।

এ সপ্তাহে আবার মেয়ের স্কুলও বন্ধ, তাই সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হবার তাড়া নেই। ৮টায় বের হলে ৯টার মধ্যে অফিসে প্রবেশ করা যায়, আজ আলসেমি করতে করতে ৮ঃ২৭ বাজলো বাসা থেকে। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে খুব বেশি দেরী হলো না।৯ঃ০৯ এ অফিসে ঢুকতে পারলাম। শুরু করলাম কর্মদিবস।

কাজ প্রসঙ্গে হঠাত এক কলিগ হঠাত বলে উঠলেন "আপ্নারা কি আমাকে শান্তি দিবেন না?"

আমি আমার স্বভাবসূলভ সারকাস্টিক টোনে বলে ফেললাম "শান্তি আছে একমাত্র মাটির নিচে"। কেউ কেউ হেসে উঠলো, আবার কেউ কেউ বেশ গম্ভীর হয়ে গেলো। যার উদ্দেশ্যে বললাম, সে রীতিমত খেপেই গেলো

আসলে জীবন মৃত্যু নিয়ে রসিকতা করা উচিৎ না। কিন্তু আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারি না অনেক সময়। তখনো বুঝি নাই যে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যুর সাথে কোলাকুলি।

অন্যান্য দিন আমরা লাঞ্চ করি ১টা বা ২টায়। আমাদের অফিসে সব এমপ্লয়িদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকে। বাইরের একটি কেটারিং সার্ভিস থেকে খাবার আসে। সাধারণত ১টার দিকেই খাবার আসে।

খবর পেলাম আজ ১২ঃ২০ এই লাঞ্চ চলে এসেছে। নতুন মেনু। ফ্রাইড রাইস, চিকেন আর চায়নিজ ভেজিটেবল। কি মনে করে আমরা সবাই ১২ঃ৩০ এ চলে গেলাম লাঞ্চ করতে। ১০ মিনিটও লাগলো না খেয়ে শেষ করতে। এরপর রেগুলার রুটিন অনুযায়ী আমরা তিনজন ছাদে উঠলাম । উনারা সিগারেটে মন দিলেন, আর আমি অতীব জরুরী কিছু ফোন কল করার উদ্দেশ্যে ছাদের তূলনামূলক ভাবে নির্জন অংশের দিকে ধাবমান হলাম।

ফোনে কথা বলতে বলতে হঠাত শুনলাম অনেক শব্দ। সাইরেন আর হর্ণ এর। সাথে মানুষের চিৎকার। ফোন রেখে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই আশেপাশে। ছাদের অন্য মাথায় গিয়ে দেখি নিচে অগুনতি মানুষ আর মানুষ, আর কালো ধোয়ায় পুরো এলাকা ভরে গিয়েছে। নিশ্চিত হলাম যে আমাদের বিল্ডিং এ নয়, আশে পাশে অন্য কোন বিল্ডিং এ সম্ভবত আগুন লেগেছে।

আমার অফিস ছাদের এক ফ্লোর নিচেই। দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশত প্যানিক না করে ঠান্ডা মাথায় নিচে গেলাম। গিয়ে দেখি সব আলো নেভানো, লিফট ও বন্ধ। একবার ভাবলাম ভেতরে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসি। পরে চিন্তা করলাম যে ব্যাগ সহ নিচে নামলে বাকি কলিগরা, বিশেষ করে বস রা ভাববে আমি ভেজে যাওয়ার তালে আছি। তাই ব্যাগ ছাড়াই হেটে হেটে নিচে নামলাম।

আস্তে আস্তে, মাথা ঠান্ডা রেখে নামছিলাম। প্যানিক করে দৌড় দেই নাই। পুরো সিড়ি খালি ছিলো। কোন ফ্লোরেই কোন মানুষ দেখলাম না। আলো কম থাকায় ভুতুড়ে একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বাইরে তখনো মানুষের চিৎকার আর সাইরেন এর জোরালো শব্দ বেজেই যাচ্ছে।

যখন নবম ফ্লোর পর্যন্ত নেমেছি, তখন এক বন্ধু ফোন করলো। আমি ঠিক আছি নাকি জানতে চাইলো। আমি বললাম যে হ্যা, আগুন সম্ভবত পাশের কোন বিল্ডিং এ লেগেছে, আমাদের এখানে নয়। তবে আমি বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। সে আশ্বস্ত হয়ে ফোন রেখে দিলো।

এক সময় দীর্ঘ পদ যাত্রা শেষ হলো। নিচের ফ্লোরে পৌছুলাম। গেটের সামনে গিয়ে দেখি গেট বাইরে থেকে তালা দেয়া। আরেকবার প্যানিক আক্রান্ত হতে হতেও হলাম না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কে বললাম গেট খুলে দেয়ার জন্য। সে খানিকক্ষন আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। তারপর আরেকজন কে ডেকে আনলো তালা খুলার জন্য। সিকিউরিটি গার্ড।

"স্যার আপনি এতক্ষন উপরে কি করছিলেন?"
"টের পাই নাই, ফোনে ছিলাম"
"এইটা একটা কাজ করসেন! তাড়াতাড়ি বাইরে আসেন"।


বাইরে বের হয়ে দেখলাম বেশ নারকীয় পরিবেশ। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে রাস্তায়। সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ।

আমার অফিসের ঠিক একটা বিল্ডিং পরেই একটা ২২ তলার বহুতল ভবন। নাম এফ আর টাওয়ার। সেই টাওয়ারের উপরের দিকের কয়েকটা ফ্লোরে আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিস এর ছোট একটা ট্রাক এসে পৌছেছে। সেটা দিয়ে মই উপরে ওঠানোর বৃথা চেষ্টা দেখলাম। অর্ধেক দূরত্বেও পৌছুলো না হোস পাইপ কিংবা মই।

দেখলাম কিছু মানুষ আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে লাফিয়ে পড়লো। তারা কেউই বাচেনি।

কিছুক্ষণ পর ইলেক্ট্রিকের তার বেয়ে কয়েকজন নামার চেষ্টা করলো। একজন সফলও হলেন। সবাই জোরে জোরে আলহামদুলিল্লাহ বলে আর হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করলো।

এরপর একজন বেশ ধীরে ধীরে নামছিলেন। হঠাত পা ফস্কে পড়ে গেলেন। আমার দৃষ্টি সিমানার মধ্যে নিচের ফ্লোর ছিল না। তাই পড়ে যাওয়ার পরের নিয়তি দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি আমার।

পরে শুনেছি তার মাথা ফেটে গিয়ে মারা গিয়েছেন।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ কাউকে দেখলাম না। এরপর একজন বলিষ্ঠ এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষকে দেখলাম নামার চেষ্টা করছেন, একই ভাবে। উনার পরনে ছিল নীল জিন্স এবং সুন্দর চেক চেক শার্ট। জানি না এই অবস্থায় কিভাবে আমার পোষাকের দিকে নজর গেলো। উনি বেশ লম্বা ছিলেন, হয়তো আমার মতই হবেন।

বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে তরতর করে নেমে গেলেন দুই তিন ফ্লোর। এরপর একটু বিরতি নিয়ে আবার। আর হয়তো এক দফা বেয়ে নামলেই নিচে পৌছে যেতেন। হঠাত শরীরের ভারসাম্য রাখতে পারলেন না। দড়ি থেকে পা ফস্কে একটা লাফ দিলেন। অনেক জোরে শব্দ হলো, আশে পাশের অসংখ্য মানুষের আহাজারি। অনেকে কেদে উঠলেন জোরে। অনেকে জোরে জোরে দোয়া পড়ছিলেন। অনেকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। আমার চোখের পানি ধরে রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল।

লোকটা এত সুন্দর ভাবে নেমে আসছিল। কেন পারলো না শেষ অংশটা পার হতে? এই দুঃখ সারা জীবন তাড়া করে বেড়াবে আমাকে।

এরপর দেখি হাত পা আর চলছে না। চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। ওখানে আমার দুইজন কলিগ ছিলেন। তারা বললেন "চলেন এখান থেকে সরে যাই"। এ সময় দেখলাম ফায়ার সার্ভিস এর বড় ট্রাকটি এসে পৌছুলো। ততক্ষনে ৮-১০ জন মারা গিয়েছে।

সারা গা ঘামছিলো। মাথা আর ঘাড়ে প্রচন্ড ব্যথা। বিপদ্গ্রস্থদের জন্য কিছুই করতে না পারা এক নিস্ফল আহাজারি।

আমরা রাস্তার ওপর পাশে অবস্থিত নর্থ এন্ড কফি রোস্টারস এ চলে এলাম। এখান থেকে এফ আর টাওয়ারের সাম্নের অংশ দেখা যাচ্ছিল। এদিকে আগুনের তেজ আরো অনেক বেশি। কফির দোকানে বসে কিছুক্ষন এসির বাতাস খেয়ে নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করলাম। যেহেতু এ দোকানে আগেও অনেকবার এসেছি, তাই কিছু অর্ডার না দেয়া স্বত্তেও দোকানের স্টাফরা কিছু বলছিলো না।

একটু পরে আবার বাইরে গেলাম। এখানেও অসংখ্য উদ্বিগ্ন মানুষ দেখলাম। একজন আরেকজন কে বলছে ঃ

"তুমি বাসায় যাও না কেন?"
"এই মানুষ গুলারে রেখে কিভাবে যাই?
"তুমি এখানে দাঁড়ায় দাঁড়ায় ওদের কে কিভাবে সাহায্য করবে?"
"আরে ওদের জন্য দোয়া করলেও যদি আল্লাহ ওদেরকে বাচায় দেয়! না, আমি পারবো না যেতে এখন"


এরকম মানুষের পাশাপাশি প্রচুর মজা নেয়ার মানুষ ও ছিল রাস্তায়। ওরা মোবাইলে ভিডিও করছিল, ফেসবুকে লাইভ দিচ্ছিল, ফোনে জোরে জোরে কথা বলছিল; আর দুই একজন কে দেখলাম ভিডিও কল ও দিচ্ছে মানুষ কে।

এ সময় হঠাত দেখা গেল কালো মত একটা জিনিস গড়ায় গড়ায় এফ আর টাওয়ারের এপাশের জানালার দিকে এগিয়ে আসছে। মানে যেখানে আগে জানালা ছিল, সেখানে। সেই কালো জিনিসটা নিচে পড়ে গেল, আর আমি অনুধাবন করলাম সেটি একটি পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশ।

এবারের আহাজারির শব্দ হয়তো মহাশুন্য পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।

আমি অসুস্থ বোধ করলাম। শুনেছি আগুনে পুড়ে মরা হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টকর মৃত্যুগুলোর মদ্ধ্যে একটা, কারণ মানুষ টের পায় তার শরীরের চামড়া পুড়ছে, একে একে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর পুড়ে যাওয়াও বেশিরভাগ মানুষ টের পায়। একদম সারা শরীর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার আগে কেউ জ্ঞান হারায় না--পুরো কষ্টটা সাথে নিয়েই সে ওপারে গমন করে।

এ জন্যেই হয়তো দোজখে গেলে মানুষকে আগুনে পোড়ানো হবে। যাতে শাস্তিতা ঠিক মত পায়। আমি ভাবি গরম পাতিলে হাত লাগলেই লাফ দিয়ে উঠি, বাল্বের উপর আঙ্গুল লাগলে কষ্ট পাই--আগুনে পুড়ে মরাটা না জানি কত কষ্টের। যত ভাবি, ততই খারাপ লাগে, কষ্ট পাই।

আর এইসব দুর্মূখ গুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিল।

কবে আমরা মানুষ হব? কবে আমাদের দেশে শান্তি আসবে? কবে বন্ধ হবে এসব মৃত্যু?

এসব প্রশ্নের কোন উত্তর হয়তো পাব না আমার জীবদ্দশায়। কিন্তু ভাবতে ভালো লাগে যে একদিন হয়তো বাংলাদেশ খুব উন্নত কোন দেশ হবে, ঢাকা শহর হবে একটি মডেল শহর, আর আল্লাহ আমাদের দেশের মানুষ গুলো কে কমন সেন্স ও শিক্ষিত হয়ে ওঠার ক্ষমতা দিবেন।

মনটা আর কখনোই ভালো হবে না হয়তো।

#ishtiaq_radical