Wednesday, October 25, 2017

ক্যাফেইনিত ইন্টার্ন

কফির সাথে আমার ভালোবাসা টা হঠাত করেই হয়েছিল। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বের হয়ে জয়েন করলাম একটি বহুজাতিক সংস্থায় ইন্টার্ণ হিসেবে। সেই ৩ মাসে কফি খাওয়ার অভ্যাস হল। সে প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন দের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ ছিল চোখে পড়ার মত। তবে সঠিক করে বলতে গেলে, আমাদের (আমি ছাড়াও আর ২ জন ছিলেন) অস্তিত্ত্ব কে মোটামুটি অগ্রাহ্য করা হত, যা ছিল রুঢ় আচরণের চেয়েও মর্মান্তিক।

আমরা প্রথম প্রথম একটু দূঃখ পেলেও আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছিলাম ব্যাপারটির সঙ্গে। আমরা তৈরি করে নিয়েছিলাম আমাদের নিজেদের জগত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতো জম্পেশ আড্ডা আর কফি খাওয়া।

ইন্টার্ন দের তেমন কোন সু্যোগ সুবিধা দেয়া হত না, কিন্ত আমরা ফ্রি কফি খেতে পারতাম। মেশিনের কফি, কিংবা নিজ হাতে বানিয়ে নেয়া কফি। কিচেন কাম রান্নাঘর ছিল একটা, সেখানে কফি বিন্স, কফি মেট, গুড়া দুধ, চিনি ইত্যাদি রাখা থাকতো, এবং সবাই দিন ভর কফি বানিয়ে বানিয়ে পান করতো।

আমাদের কাজ ছিল সেই ব্যাঙ্ক এর সকল কাস্টোমার কে কল করে করে তাদের ইমেইল এড্রেস সংগ্রহ করা। তখন ২০০৩ সাল, মানুষ অত ইন্টার্নেট নির্ভর হয় নি। ফেসবুক এর জন্ম হয় নি তখনো। সুতরাং আমাদের কাজ ও ছিল অনেক কঠিন।

প্রথমত, কোন এর কারণে সেই ব্যাঙ্ক এর উপর তাদের গ্রাহকগণ অনেক ক্ষিপ্ত ছিলেন। অনেকেই "ওহ, তুমি "চোরা" ব্যাঙ্ক থেকে ফোন করসো? দাড়াও আজকে তোমার খবর করতেসি" মোডে চলে যেতেন সহজেই। অনেক ঝাড়ি টাড়ি শুনে যখন বলতাম, "দুঃখিত, আমি একজন সামান্য ইন্টার্ন, আপনার অভিযোগ সমূহ দয়া করে লিখিত ভাবে ব্র্যাঞ্চ এ এসে দিয়ে যান"--তখন অনেকেই মুখের উপর রিসিভার রেখে দিত।

আবার অনেকে অনেক গল্পও করতো। একজন ভদ্রলোক খুব বিনয়ের সাথে বললেন "ভাই এতদিন এই ব্যাঙ্কে একাউন্ট আছে, আপনিই প্রথম ফোন দিলেন"। আরেকজন বললেন "ভাই আমার তো ইমেল নাই, কিন্ত আমার মেয়ের আছে। মেয়েরটা নেন--চিয়ারফুল সাদিয়া এট হটমেইল ডট কম।" নিজের সাথে কিচ্ছুক্ষন যুদ্ধ করতে হয়েছিল সেই হাসি খুশী সাদিয়া কে এম এস এন মেসেঞ্জারে এড করা থেকে বিরত রাখতে!

আরেকজন রিতিমত জেরা শুরু করেছিলেন। ব্যাঙ্ক এর এমডির নাম কি? ট্রেজারির হেড কে? মার্কেটিং এর হেড কে? ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ? আমি যে ব্যাংক থেকে ফোন করেছি, সেটার প্রমাণ কি? গলদ্ঘর্ম হয়ে কোন মতে উত্তর দিয়েছিলাম সব গুলো প্রশ্নের।

এ প্রসঙ্গে বলে দেয়া উচিৎ যে আমাদেরকে সিটিসেল এর মোবাইল সরবরাহ করা হয়েছিল কল গুলো করার জন্য, তাই পিএবিএক্স এর হোল্ডিং টোন শুনিয়ে প্রমাণ করার কোন উপায় ছিল না যে আমরা ব্যাংক থেকে কল করেছি!

যাদেরকে কল করতে হবে, তাদের নাম ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দেয়া থাকতো লিস্ট এ। এক বার দেখলাম এক ভদ্রমহিলার ঠিকানা দেয়া আছে সোনারগাঁও হোটেল এর একটি রুম নাম্বার। ২২ বছরে সঞ্চিত সকল সারল্য কে সম্বল করে বস কে প্রশ্ন করলাম "ভাইয়া, এই আপুটা কি হোটেলেই থাকে?" বস কট্মট করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষন, উদ্ধার করলেন ডিপার্ট্মেন্ট এর আরেকটা ভাইয়া। "বুঝ না কেন এই এড্রেস দিসে?"

লজ্জায় কান টান লাল করে বাকি দিন পার করলাম। সাথের দুইজন সারাক্ষন এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে টিজ করতে থাকলো।

আরেকবার লিস্টে পেলাম ইউনিভার্সিটির এক "খাটাশ" টাইপ সার কে। ভার্সিটি তে তিনি কোন ছেলেকে "ছেমড়া" ছাড়া অন্য কোন সম্ভাষণে ডাকতেন না। মেয়েরা অবশ্য "মামণী" ডাক শুনতো। সার কে ফোন দিলাম ভয়ে ভয়ে। এমন মধুর আর অমায়িক ব্যাবহার করলেন যে আমি অবাক হয়ে আর নিজের পরিচয় দিলাম না!

আরেকবার পেলাম ভার্সিটির এক সুকন্ঠী কে, যে দেখতেও ছিল অনেক আধুনিক। জীবনেও তার সাথে সামনা সামনি কথা বলার সাহস পাই নাই! ফোনে তার 'মেরিকান এক্সেন্ট শুনে বিশেষ প্রীত হলাম। কয়দিন আগে একজনের গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত শুনে বহুদিন আগে শুনা সেই কন্ঠ মনে পড়ে গেল।

একজন কাস্টোমার কে ফোন করলেই "ভয়েস মেইল" এ কল চলে যেত। "অমুক এখন আপনার ফোন রিসিভ করতে পারছেন না, দয়া করে জরুরী বার্তা রেকর্ড করুন"। তো আমি যথাযথ সিরিয়াস ভঙ্গী তে বললাম "একটি বিশেষ জরুরী কারণে অমুক ব্যাঙ্ক আপনার সাথে যোগাযোগ করছে। এই মেসেজ টি পাওয়া মাত্র যোগাযোগ করুন"।

প্রায় ২/৩ মিনিটের মাথায় ঐ নাম্বার থেকে কল এল। একজন বললেন যে উনি ওই ভদ্রলোকের ম্যানেজার,
"স্যার" বিদেশে। উনি যেই বড় অঙ্কের ডিপোজিট টা আশা করছিলেন, সেটা কি এসেছে? আমি থতমত খেয়ে বললাম "ইমেইল"। উত্তর এল আরে ভাই আমাদের স্যার মেল নিয়ে ডিল করে না, ফিমেল এর কোন কাহিনী থাকলে বলেন! আমি বললাম "ইমেল এড্রেস দেন"। ওপাশে কিছুক্ষন নিরবতা, তারপর উত্তর এল "ইমেল ছাড়া টাকা আসবে না?"। ততক্ষনে আমি নিজেকে ফিরে পেয়েছি। বললাম আমরা আমাদের ডাটাবেস আপডেট করছি, এজন্য ইমেল এড্রেস লাগবে।

উত্তরে সেই ম্যানেজার ইমেল এর মাতার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন সংক্রান্ত পরিকল্পনার কথা বলে অভদ্রের মত ফোন টা রেখে দিলেন।

আমাদেরকে বিশাল একটি নাম্বার লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল--টার্গেট ছিল ৩ মাসের মদ্ধ্যে সবার ইমেইল কালেক্ট করা লাগবে। আমরা ৩ জন বেশ ভাল ভাবেই সফল হয়েছিলাম সেই কাজে। প্রায় ৮৫-৯০ ভাগ এড্রেস সংগৃহীত হয়েছিল। সেসব এড্রেস জুড়ে দেয়া হয়েছিল তাদের ইমেল মার্কেটিং টুল এর মদ্ধ্যে।

সেই ৩ মাসের অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে যা পরবর্তীকালে আমার চাকুরী জীবনে অনেক সাহায্য করেছে। এরপর আর আমাকে কখনো সরাসরি কাস্টমার হ্যান্ডেল করতে হয়নি, কিন্তু যারা করে থাকে, তাদের প্রতি জন্মেছে গভীর শ্রদ্ধা।