Friday, January 03, 2020

Boro Chacha

গত বছর, এই দিনে হঠাত করেই চলে গেলেন আমার বড় চাচা Mohammad Enamul Haque Khan, আমাদের সবাইকে ছেড়ে।

সবার জীবনে কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে দেখলেই মনের জোর বেড়ে যায়, শরীরে শক্তি ফেরে আসে আর ইচ্ছে করে আবারও চেষ্টা করতে। আমার জীবনের কঠিনতম দুঃসময়ে বড় চাচাকে পেয়েছি পাশে, বন্ধুর মত। তবে এ লেখায় সে প্রসঙ্গ আসবে না।

একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র কোন এক বিশেষ দাবী দাওয়া পূরণ না হওয়াতে ক্ষীপ্ত হয়ে ভাংচুর আর মারপিট করছিল ক্যাম্পাসের ভেতরে। এই গল্প আমার চাচাতো ভাই এর মুখে শোনা; এবং বহু বছর আগে। আর কোন খুটিনাটি তথ্য মাথায় নেই।

তাদের কারও কারও হাতে অস্ত্রসস্ত্রও ছিল, এবং তারা নিরীহ ছাত্র ছাত্রীদের কে মারধোর করছিল ইচ্ছেমত। লোহার পাইপ, হকিস্টিক, পিস্তল, চায়নিজ কুড়াল, কাটা রাইফেল-- ছাত্র সন্ত্রাসীদের এইসব নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির কোনটাই মিসিং ছিল না।

অন্য শিক্ষকেরা যখন ভয়ে এদিক সেদিক পালাচ্ছিলেন ছাত্র ছাত্রীদের সাথে, তখন তিনি রুখে দাড়ালেন। কারন যারা এই নারকীয় তান্ডব চালাচ্ছে, তারা তো বাইরের কেউ না, এই একই মানুষগুলোই তো কোন কোন দিন উনার ক্লাসে বসে মনোযোগ দিয়ে লেকচার শুনেছে; হাত উঠিয়ে কঠিন কোন প্রশ্ন করেছে । সেদিন ছাত্রদের কোন কথায় বা কাজে তো তিনি বিব্রত হন নি, তাহলে আজ কেন?

এক ছাত্রের দিকে বাঘের মত এগিয়ে গেলেন। বজ্রকন্ঠে বলে উঠলেন, এই, তোমরা এগুলো কি করছো? টান দিয়ে মুখ থেকে মুখোস খুলে দিলেন, আর হাতে নিয়ে নিলেন খেলনা সদৃশ সেই "অস্ত্র"।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে ছাত্র বলে উঠলো "এনাম স্যার! আমি সরি"। খুব দ্রুতই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল নাশকতা সৃষ্টিকারী ছাত্রেরা। এনাম স্যারের সাহসী আচরণে তাদের মাঝে বিচিত্র এক লজ্জা ছড়িয়ে দিল। ক্যাম্পাসে ফিরে এলো শান্তি।

পরবর্তীতে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছে অনেক ভৎসনা শুনেছেন, অনেকেই প্রকাশ করেছেন উষ্মা। কেন তিনি নিজের জীবনের উপর বাজি রেখে এগিয়ে গেলেন সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির মাঝে? আমারো রাগ হয়েছিল চাচার উপর।

এখন আমি একটু একটু বুঝি চাচার চিন্তাধারা। নিজের আদর্শ ও জীবনদর্শন কে জলাঞ্জলি দিতে লাগে একটি মুহূর্ত; কিন্তু বাকী জীবন সেই গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয় আফসোসের সাথে। কাপুরুষের ন্যায় শত বছর বেঁচে থাকার চেয়ে বীরের ন্যায় অল্প দিন বেঁচে থাকা শ্রেয়--চাচা সব সময় এভাবেই ভাবতেন।

বাকিটা ইতিহাস। হ্যা, ইতিহাসই বটে। আমার বড় চাচা ডঃ এনামুল হক খান সবার কাছে এনাম স্যার নামেই পরিচিত ছিলেন। ইতিহাসের প্রফেসর ছিলেন তিনি।

আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবি ডঃ সিরাজুল হক খান এর ৮ সন্তানের মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা জেষ্ঠ্য ছিলেন, এবং তিনিই একমাত্র সন্তান, যিনি পিতার পদাংক অনুসরণ করে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করে সারা জীবন শিক্ষকতার সাথে জড়িত থেকেছেন। জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভিসিও ছিলেন তিনি কিছুদিন, আর লম্বা সময় থেকেছেন পরিবার নিয়ে সাভারের ক্যাম্পাসে।

আমাদেরকে খুব আদর করতেন। দাদা কে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু চাচার মাঝেই খুজে পেয়েছি আমরা সব কাজিনরা দাদাকে। নিজের এক নাতী কে একরত্তি শিশু থেকে বাবা কে উচ্চতায় ছাড়িয়ে যাওয়া বড় মানুষ হিসেবে দেখেছেন, আর আমাদের মাধ্যমে খুজে পেয়েছেন আরো অনেক নাতী নাত্নী। আমার দুই কন্যাকেই অসম্ভব আদর করতেন; মৃত্যুবরণ করার অল্প কিছুদান আগেও মিশেল কে হাসপাতালে দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। শক্ত কেমোথেরাপি নেয়ার কারণে চাচার স্মৃতিশক্তি তখন একটু দূর্বল; সবাইকে ভাল করে চিনতে না পারলেও মিশেল কে একনজর দেখেই চিনতে পেরেছিলেন। আদরের ডাক "ঢংগী দাদু" ডেকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন ওকে।

খিলগাও তালতলা এলাকায় সবার মুখে মুখে উনার নাম। শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহ সবাই "পিয়ারু ভাই" কে চিনতেন। এলাকার সব মানুষ আমাদেরকে চেনে উনার আত্নীয় হিসেবে। খিলগাঁয়ের পুরাতন পাকা মসজিদের নিয়মিত নামাজী ছিলেন চাচা; উনার জানাজার সময় অসংখ্য মানুষ কে দেখেছি আফসোস করতে। এখনো দোকানে গেলে লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে "তুমি পিয়ারু ভাই এর ভাতিজা না? বড় ভালো মানুষ ছিলেন তোমার চাচা"।

দাদু ঠিক করে বলতে পারতেন না তার সন্তানদের জন্মদিবস। বিশেষ করে যাদের জন্ম অনেক আগে। চাচার ক্ষেত্রে বলেছিলেন একবার "শেখের জন্মদিনেই তোর বড় চাচার জন্ম, আর তার সাত দিন পরে তোর বাপের"। আমরা সে কথাই মাথায় রেখে ১৭ মার্চ চাচার জন্মদিন পালন করি।

চাচা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন। উনার সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে রাজাকার আল বদর বাহিনীর দুই নেতাকে ফাঁসীর আদেশ দেয়া হয়। তারা বর্তমানে ধর্মীয় নেতা সেজে যুক্তরাষ্ট্রে আর যুক্তরাজ্যে পালিয়ে রয়েছেন। এই লেখায় তাদের নাম নিয়ে লেখাটিকে কলুষিত করতে চাই না--we all know who they are.

চাচাকে নিয়ে লিখতে গেলে লেখা শেষ হবে না সহজে। খুব সংক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করলাম উনি কেমন মানুষ ছিলেন।

আজ উনার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। সবাই দয়া করে উনার জন্য দোয়া করবেন। আমার ইচ্ছা ছিল দাদার ছোটবেলার সব কাহিনী চাচার কাছ থেকে শুনে নিয়ে উনার একটা জীবনি লিখবার। কিন্তু সে সময় আর পেলাম কই?

আসলেই সময় কখন ফুরিয়ে যায়, টের পাওয়া যায় না, তাই আগামীকালের জন্য কিছু ফেলে রাখা উচিৎ না।