Wednesday, December 20, 2017

দাদার গল্প ২

বাবা তখন বিভোর ছেলের মায়ায়। বন্ধুর ডাক শুনেও না শোনার ভান করলেন। বন্ধু বুঝলেন তিনি অতীব দূর্লভ একটি আবেগঘন মূহুর্তে উপস্থিত হয়েছেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজ পথে।

সেরাতে কনিষ্ঠ সন্তান রইল সবার চোখের মণি হয়ে। অন্য ভাইয়েরা কিঞ্চিত ঈর্ষান্বিত হলেও কিছু বল্লো না "ছোট ভাই" বিধায়। সে রাতে আর সবাই একসাথে বসে খাওয়া হল না, যে যার মত খেয়ে নিল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। 

সন্তানেরা একে একে ঘুমিয়ে পড়লো যে যার মত। 

বাবার চোখে ঘুম নেই। গিন্নী অন্য যেকোন দিনের মতই পানের বাটা থেকে পান সুপারী বের করে হামানদিস্তায় ছেঁচতে বসলেন। এ কথা সে কথা বলতে লাগলেন পান সুপারী পিষে ফেলার মাঝে মাঝে।

"ওগো, শুনেছ নাকি? পাশের বাড়ীর জলিল সাহেব এর মেয়েদের জন্য গানের শিক্ষক রেখেছে। আমাদের মেয়েগুলির  জন্য দেখবে নাকি? প্রয়োজনে ওরাও ঐ বাসায় গিয়ে এক সাথেই শিখবে। আমার খুব সখ আমার মেঝ মেয়েটা চুলের বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইবে স্কুলের অনুষ্ঠানে। মাইনে টাও খুব বেশি নয়"। 

বড় মেয়ে একটু গম্ভীর প্রকৃতির, এ বয়সেই অংকে খুব ভাল। মা যেকোন ছোট খাট হিসেব নিকেশ এর কাজ ওকেই দেন করতে, এবং খুব দ্রুত সে তা করেও দেয়। ভাই দের দুষ্টামি ও দুরন্তপণা কে ভ্রকুটি দিয়ে নিরুৎসাহিত করে বলে ভাইদের সাথে দুরত্ত্ব বেশি।  

এদিকে আবার মেঝ মেয়েটা খুব হাসি খুশি, চঞ্চল ধরণের। ভাইদের জন্য অনেক মায়া । একদিন দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা গাইছিল অচেনা কোন এক সুরে, মা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলেন অনেক্ষন। তখনি সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে গান শিখাবেন। 

মায়ের চিন্তাসূত্র এক সময় ছিন্ন হল। লক্ষ্য করলেন যে স্বামী একটা শব্দও করেন নি। এ ধরণের প্রাত্যহিক ব্যাপার গুলো নিয়ে জামাই বউ প্রায়শই আলাপ করে থাকেন। সাধারণত গিন্নী বলতে থাকেন, আর উনি হু হা করতে থাকেন। সাংসারিক ব্যাপার গুলোতে স্ত্রীর বিচার বুদ্ধির উপর উনার অনেক আস্থা।

তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ও আছে।  যতবার মেয়েদের গান শেখানোর প্রসংগ এসেছে, উনি শক্ত ভাবে প্রতিবাদ করেছেন। মেঝ ছেলের বিদ্যাপিঠ এর অংকন শিক্ষক অমল বাবুর সাথে একদিন কথা হচ্ছিল।

"স্যার, আপনার ছেলে তো আমার ক্লাশ এর সবচেয়ে ভাল আঁকিয়ে। এ বয়সে ওর যে আঁকার হাত, বড় হলে নির্ঘাত বিখ্যাত শিল্পী হবে। ওকে অবশ্যই চারু কলায় ভর্তি করাবেন কলেজ এর পর"।

"না হে, আমার ছেলে কে আমি পেইন্টার বানাব না কোন ভাবেই। শেষে দেখা যাবে কোন কাজ না পেয়ে দোকানের সাইন বোর্ড রঙ করছে বসে বসে। সে উপার্জনে ভাত জুটবে কি?"

চৌকস শিক্ষক অমল বাবু যথেষ্ঠ পরিমাণে বিরক্ত হলেও মুখের উপর সিরাজ সাহেব কে কিছু বললেন না। উনি এলাকার সম্মানিত মানুষ। সবাই উনাকে মানে, আর মনে মনে একটু দমে গেলেও অমল সাহেবও বুঝেন যে আসলেও চারুকলার ছাত্রদের আয় রোজগারের পথ বুয়েট পাশ ইঞ্জিনিয়ার দের মত এত সহজতর নয়। তবে তিনি মনে মনে পণ করলেন যে আজ হোক কাল হোক তিনি মেঝ কে নিজেই বলবেন চারুকলার কথা।

কে জানতে পেরেছিল যে সদাহাস্য অমল বাবু সে সুযোগটিও পাবেন না?

সিরাজ স্যার তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন, সম্পূর্ণ অন্যমনষ্ক। স্ত্রী যে উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে, তা উনার একদম খেয়ালে নেই। উনি তখন মনে করছেন হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের কথা।

পরালেখার পাট চুকিয়ে ঢুকেছিলেন সরকারী চাকুরী তে। শুল্ক বিভাগে। পোস্টিং হল চট্টগ্রাম, যা নিজ ভিটা থেকে বেশ দূরে। অন্তত প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত করার মত কাছে নয়।

সেখানে উনার কাজটি কি ছিল ? সারাক্ষণ পরিবার কে  স্মরণ করা আর পণ্য আমদানী রপ্তানীর খেয়াল রাখা। সবাই ঠিক মত শুল্ক দিচ্ছে তো? বিবরণী পত্রের সাথে আনীত মালামাল কি মিলেছে? কম বেশি নেই তো?

যথেষ্ঠ পরিমাণে একঘেয়ে কাজ, কিন্ত সময় ও পরিশ্রম সাপেক্ষ। কাজ শেষ করে সরকারী কোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। অল্প খাবার খেয়ে রেডিও শুনতে শুনতেই শেষ হত বেশির ভাগ দিন।

তখনো সেরকম সামর্থ্য নেই যে পুরো পরিবার কে নিয়ে আসবেন সেখানে। বাচ্চারাও ছোট ছোট। ছোট মেয়ে ও ছোট ছেলে তখনো আসেনি। তারপরেও পরিবারে সদস্য সংখ্যা একেবারে কম নয়।

এক মাস ও হয়নি উনি চাকরী তে ঢুকেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ও অপরিসীম সততা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন সুনাম। দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে সবাই সিরাজ কে পছন্দ করে। 

সেদিন ছিল মংগলবার। অন্য যেকোন কর্মদিবসের মতই, দিনের কোন বিশেষত্ত নেই আদতে। নিজের কক্ষে বসে কাগজে লিখে চলেছেন অবিরাম। টেবিল ফ্যান এর স্পিড একেবারেই কমানো। ঘরের মধ্যে শব্দ বলতে কাগজের উপর ফাউন্টেন পেন এর খস খস শব্দ। প্রিয়তমা স্ত্রী কে চিঠি লিখছেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে । মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে দোয়াতে চুবিয়ে নিচ্ছেন কলম খানা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন আরো কিছু মাল পত্র এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত দেখলেন আর্দালী একজন মধ্যম উচ্চতার মানুষ কে নিয়ে এসেছে ঘরে।

খুব বিগলিত কন্ঠে বলে উঠলেন "স্যার, কেমন আছেন? আজ ভারত থেকে কিছু প্রসাধনী আমদানী করেছি।আপনার মেহেরবানি হলে আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন। চৌধুরী সাহেব বলেছেন মাল গুলো নিয়ে আজকেই সদরে চলে যেতে"।

"কোন চৌধুরী?"
"চিনেন নাই? আপনার প্রতিবেশী জালাল চৌধুরী"

বিবরণপত্রে দ্রুত চোখ বুলাতে লাগলেন সিরাজ সাহেব। খটকা লাগলো। উঠে গিয়ে বাক্স গুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে চমকে গেলেন ভীষণ ভাবে। বর্ণনার সাথে দ্রব্যের কোন মিল নেই। যা আমদানী হয়েছে, তার শুল্ক অনেক বেশি হবে। সটান ঘুরে গিয়ে সেই মধ্যম উচ্চতার ব্যক্তির দিকে তাকালেন কড়া চোখে।

সে ক্রোধ ও রোখ মিশ্রিত ভয়ংকর চাহনীর দিকে বেশিক্ষণ কেউ তাকিয়ে থাকতে পারতো না। চোখ নামিয়ে নিত নিজের অজান্তেই। অনেক বেশি রেগে গেলেই কেবল উনার এই চেহারা প্রকাশ পেত। ফর্সা মুখ মূহুর্তে লাল টকটকে হয়ে যেত। 

স্কুল শিক্ষক হিসেবে অনেক দুষ্ট শিশুকে শিষ্টতার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি শুধু এই দৃষ্টি দিয়েই। 

কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন সেই খর্বকায় ব্যক্তিটি ভয় পাওয়ার বদলে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে একটি খাম।

"কি এখানে?"
"স্যার, আপনার জন্য চৌধুরী সাহেব দিয়েছেন"
"তোর নাম কি রে?"
"জ্বী কি বললেন?"

হঠাত আপনি থেকে তুই তে পদাবনতি পেয়ে লোকটি বেশ অবাক হয়ে গেল। তারপরেও নিচু স্বরে  উত্তর দিল "আমার নাম করিম, স্যার"

"করিম এর বাচ্চা করিম, কোন সাহসে আমাকে ঘুষ সাধিস? আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন"

এর পরের কয়েকটি মিনিট কেটে গেল চোখের পলকে। চটাশ করে  করিমের গালে পড়ল বজ্রাঘাত। পায়ের পাদুকাটি বহুদিন তার প্রতিদিনের একঘেয়ে হেটে চলার কাজ থেকে অব্যাহতি পেয়ে চলে এল উনার হাতে, অস্ত্র হিসেবে।

মূহুর্মূহূ  চটাশ চটাশ শব্দ এবং ক্রমাগত "ওরে বাবা, ওরে বাবা" ধ্বনী শুনে ঘরে ছুটে এল আর্দালী সহ আরো বেশ কয়েকজন। ততক্ষনে করিম দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। সিরাজ স্যার ধাওয়া দিতে গিয়েও আর দিলেন না। বেশি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে করিম উলটে পড়ে গেল ঘরে। টেবিলের কোনায় আটকে লুংগী ছিড়ে যায় যায় অবস্থা। কেউ আর তাকে কিছু বল্লো না, সে প্রায় উড়ে উড়ে পালিয়ে গেল।

এই ঘটনার এক দিন পরেই সাদা কাগজে নিজের পদত্যাগ পত্র লিখে সুপারভাইজার এর হাতে দিয়ে দেন সিরাজ স্যার। অনেক বুঝিয়েও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারে নি কেউ।

এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন, শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোন পেশায় জড়িত হন নি সিরাজ স্যার।


Sunday, December 17, 2017

দাদার গল্প ১

তিনি  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন।  পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে মোটামুটি বড় পরিবার। অভাব অনটন লেগেই আছে। তবে স্বস্তির বিষয় ছিল চাকরীর সূত্রে পাওয়া কোয়ার্টার। বাসা বেশি বড় না হলেও গাদাগাদি নেই। বেশ বড়সড় একটি বৈঠকখানা, দুইটি প্রশস্ত বারান্দা, তিন টি শোয়ার ঘর ও প্রক্ষালণকেন্দ্র, একটি ছোট অতিথি ঘর, আলাদা রান্নাঘর ও খাওয়ার জায়গা নিয়ে মোটামুটী আরামদায়ক বসবাস এর ব্যাবস্থা।

স্ত্রী পলিটিক্যাল সাইন্স গ্রাজুয়েট; সেকালের মাপকাঠি তে উচ্চ শিক্ষিত বলা যায় উনাকে। তখনো নারী দের শিক্ষা দীক্ষার উপর রয়েছে নানাবিধ বাধা বিপত্তি।তারপরেও তিনি বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে পাশ করেন সময় মত। বিয়ে হয় সুযোগ্য পাত্রের সাথে।

উনার স্ত্রীর কারণে বাসায় পড়ালেখার ব্যাপারে কোন ছাড় নেই। সেই সাথে গল্পের বই পড়ার ব্যাপারেও কোন বাধা নেই, তবে তা অবশ্যই হতে হবে পড়ালেখা শেষ করে। বাসায় ছিল ছোট লাইব্রেরী, বড় ভাই বোন দের বই ছোটরাও পড়তে পারতো সময় মত। 

মাগরিবের নামাজের আগেই সবাইকে বাসায় ফিরতে হয় বাধ্যতামূলক ভাবে।  কোন দিন যদি ভুলেও একটূ দেরী হয়ে যেত, সন্তান দের মুখোমুখি হতে হত বাবার রক্তচক্ষু ও সুকঠিন জেরার। পাঁচ তলা বাসায় প্রবেশ এর এক টাই দরজা ছিল, এবং ঘরে যেতে হত বৈঠকখানার ভেতর দিয়েই। ডানপিঠে বড় ছেলের কপালে মাঝে মাঝেই জুটতো উত্তম মদ্ধ্যম। সাথে বাঁচতে পারতো না চাচাতো ফুফাতো ভাইয়েরাও। ওরা মাঝে মাঝে এসে থাকতো সে বাসায়।

সেই বৈঠকখানা অনেক শাস্তির সাক্ষী। বাবা শুধু বাসায় দেরী করে ফেরা নয়, পরীক্ষায় আশানূরুপ ফলাফল না পাওয়া, পাশের বাড়ী থেকে অভিযোগ, কারো বাসা থেকে আম চুরি করে খাওয়া কিংবা ঢিল মেরে জানালার কাচ ভেঙ্গে দাওয়া ইত্যাদি নানা রকম ছোট বড় অপরাধের বিচার হত সেই কক্ষে।

অন্দরমহল থেকে বোনেরা শিউড়ে উঠতো ভাইদের আর্তচিতকার এবং বাতাশে বেতের শপাং শপাং শব্দে। সবাই ভাবতে জোরে চিৎকার করলে শাস্তি কমে যাব, কিন্তু তা কখনোই হত না। মাঝে মাঝে উনার মেজাজ ভাল থাকলে ভিন্ন শাস্তি দিতেন। এক ভাইকে বলতেন আরেক ভাই এর কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। এরকম দিন গুলো ছিল ঈদ এর মত।

পর্দার আড়াল থেকে ছোট ভাই বোনেরা হাসি মুখে উঁকি দিত ভাইদের চোখ পাকানো কে অগ্রাহ্য করে। বাবা লক্ষ্য করেও কিছু বলতেন না কারণ এ ঘটনায় শাস্তি আরো পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করতো।

সেই স্টাফ কোয়ার্টার ভিত্তিক সমাজে তিনি কড়া বাবা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এবং উনার সন্তানেরাও সে কারণে আদর্শ সন্তান হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেত।

মেঝ কে অনেক পছন্দ করতেন উনি।  মেঝ কখনো মিথ্যা বলতো না। মেঝর নির্দোষ স্বীকারোক্তির কারণে জেষ্ঠ সন্তানের অনেক জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেত। এ কারণে দুই ভাই এর মদ্ধ্যে একটি আদর্শগত রেষারেষি ছিল।

সবার শেষে জন্ম নেয় ছোট ভাই অঞ্জন। সবার কোলে কোলে, চরম আদরে বড় হয় সে। ততদিনে বাবা আর তেমন মারেন না সন্তান দের। সবাই মোটামুটি বড় হয়ে গিয়েছে, কেউ আর মার খাওয়ার মত কাজগুলিও করে না। তবে তিনি কখনোই বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা কিংবা অসৌজন্যমূলক আচরণকে বরদাশত করতেন না।

একদিন বাসায় ইলিশ মাছ এর ডিম রান্না হয়েছে। এক বাটিতে ঝোল শুকিয়ে ভুনা করে রান্না হওয়া তরকারী রাখলেন আম্মা। বাবা ও পাঁচ ভাই বসেছে টেবিলে। বোনেরা পরে খাবে, ওদের জন্যেও একটু তরকারী আলাদা করে রাখা আছে রান্নাঘরে। সবাই পাতে ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছে আম্মা কখন সবাইকে ডিম ভাগ করে দিবেন। প্রথা ভংগ করে প্রথমে কনিষ্ঠ সন্তান এর পাতে আদর করে ডিম তুলে দিলেন মা।

"আমাকে এত কম দিয়েছ কেন? আমি পূরোটা চাই। আজকে আমি একাই ইলিশ এর ডিম খাব, বাকিরা পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে খাক!" - বলে উঠলো কনিষ্ঠ।

বজ্রপাত হলেও হয়তো সবাই এত অবাক হত না। সেঝ ভাই সবার মদ্ধ্যে একটু চুপ চাপ স্বভাবের, মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল সে ছোট ভাই এর দিকে। বাকিরাও কম বেশি অবাক। বাবা মুখ খোলার আগেই বড় ভাই বলে উঠলেন "এই, এগুলা কি বলিস? সবাই মিলে খাবি না? আয় তোকে আমার থেকে একটু দিয়ে দেই"।

ছোট ভাই তাকে পাত্তা না দিয়ে তাকালো বাবার দিকে। কিন্তু মূহুর্তেই ওর আশার বেলুন চুপসে গেল।

বাবার মুখ লাল, চোখ জ্বলছে জলজল করে। সেই চোখে নেই কোন মমতা, বরং আছে অবিশ্বাস আর অদম্য রাগ।

"আমি পুরোটাই খাব, আমি পুরোটাই খাব" বলতে বলতে সেই শিশু টেবিল ছেড়ে দৌড়ে চলে গেল বারান্দায়। গলা ভাঙ্গা, কাঁদতে কাদতেই সে গেল পুরোটা পথ।

সে যুগের বারান্দা গুলো কোন ঘরের সাথে যুক্ত থাকতো না। দরজা দিয়ে আলাদা করা একটা ঘরের মত। বারান্দায় গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে দিল সে। বাইরে থেকে ভাই বোনেরা অনেকক্ষন ধাক্কা ধাক্কি করলেও সে খুল্লো না দরজা।

এদিকে পাথর হৃদয় বাবা একবারের জন্যেও টেবিল ছেড়ে উঠলেন না। ছোট ভাই এর জন্য সবার মন কাঁদে। কেউ ছুঁয়েও দেখলো না ইলিশের ডিম। সব্জী লবণ পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়েই সেদিনের খাওয়া শেষ হল। কেউ সেভাবে খেয়াল না করলেও গিন্নি ঠিকই খেয়াল করলেন যে বাবার প্লেট থেকে আর ভাত কমেনি। খালি নাড়াচাড়া করেছেন আর খানিক্ষন।

টেবিল থেকে উঠে গিয়ে উনি স্বাভাবিক ভাবে রিডিং গ্লাস টি নিয়ে দৈনিক পত্রিকা পড়তে বসলেন বৈঠকখানায়। পরনে সফেদ লুঙ্গি আর গেঞ্জি। নামাযে যাওয়ার জন্য উঠে একটা শার্ট পরলেন। তখন স্ত্রী বললেন "ছেলেটা তো এখনো দরজা খুলে না। কি করি?"

"এসব পাত্তা দিও না। ক্ষিদা লাগলেই সুর সুর করে এসে তোমার কাছে ভাত চাইবে" বলে বেরিয়ে গেলেন।

স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদে আসর এর নামাজ পড়ে গেলেন একই কলোনী তে অবস্থিত বন্ধু জামান এর বাসায়। তিন দান দাবা খেলতে খেলতেই মাগরিব এর সময় হয়ে গেল। মাগরিব এর নামাজ পড়ে বাসায় আসতে আসতে মনে পড়ে গেল ছোট ছেলের কথা। ১ পয়সা দিয়ে একটা কাঠি লজেন্স নিলেন ছেলের জন্য। মনে মনে ভাবলেন, বাকি ছেলে মেয়েদের চোখ এড়িয়ে ওকে এটা দিতে হবে।

বাসায় ঢুকতে ঢুকতে শুনলেন কান্নার আওয়াজ। এসে দেখলেন ছোট বোন তার ভাই এর জন্য কান্না করছে, দরজা তখনো খুলেনি।

দৌড়ে গেলেন বারান্দার সামনে। ধাক্কা দিলেন কয়েকবার, কোন সাড়া নেই। জোরে একটা লাথি দিলেন, দূর্বল কপাট ভেঙ্গে গেল। দেখলেন ছোট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছে এক কোনায়। ঘুমের মাঝেও যেন সে অভিমানী। বারান্দার এক কোণায় শুয়ে আছে আড়াআড়ি ভাবে।ভেজা শার্ট টা খুলে ওটাকে আকড়ে রেখেছে দুই হাতের মাঝে। চারপাশ ভিজে গিয়েছে ঘাম আর কান্নায়।

কোন দিকে না তাকিয়ে ছেলেকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলেন পরম মমতায়। পেছন থেকে বাকি সন্তানেরা দেখলো বিরল দৃশ্য। পাথরসম বাবার চোখে পানি। ছেলেকে ঘরে নিয়ে নিজে সারা গা ধুয়ে দিলেন, মুছে দিলেন আর পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে দিলেন। এর মাঝে কখন চোখ খুলেছে সন্তান, বাবার এইরুপ আচরণে সেও মূক হয়ে গিয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। দুপুরের সেই বেঁচে যাওয়া ইলিশ এর ডিম দিয়ে নিজ হাতে মাখিয়ে মাখিয়ে ভাত খাইয়ে দিলেন সন্তান কে পরম মমতায়। আর মনে মনে ভাবতে থাকলেন "আজ কাস্টোমস অফিস এর সেই চাকরী তা না ছাড়লে সবার জন্য একটা করে আস্ত ইলিশ এর ডিম থাকতো বাসায়"।

হঠাত বাইরের দরজায় জোরে জোরে আঘাত এর শব্দ শোনা গেল। ঘরে ঢুকলেন বন্ধু জামান ও পাড়ার আরো কয়েকজন।

"কাজ টা ভাল কর নাই সিরাজ। ছেলে মেয়ের সাথে এত জিদ করা ভাল না"।

(চলবে)

[ আমার দাদা ডক্টর সিরাজুল হক খান যখন মারা যান, উনার সন্তানেরা সবাই বেশ ছোট। বড় ছেলে মাত্র honours পরীক্ষা দিবে। উনাকে নিয়ে উনার ছেলেমেয়েদের অনেক স্মৃতি, কিন্তু উনারা বেশি বলেন না। অল্প যে কয়েকটা গল্প শুনেছি, সেগুলো নিয়ে লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। বন্ধু নাজমুল হুদা ও অনেকবার বলেছে লিখার জন্য। চেষ্টা করবো গল্প গুলো লিখে শেষ করতে। কে জানে, হয়তো এগুলো কে জোড়া দিয়েই কোন দিন উনার একটা পূর্নাঙ্গ আত্নজীবনী লিখে ফেলতে পারবো।

লিখতে গিয়ে বুঝলাম যে কাজ টা সহজ না। আমি দাদাকে কখনো দেখিনি, কিন্তু তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে চোখ ভিজে যাচ্ছিল বার বার। তাই অনেকদিন আগে শুরু করলেও আজকেই শেষ করতে পারলাম এই লেখাটি। গল্প টা মোটামুটি accurate, কিছু ডিটেলস আমি শুধু সংযোজন করেছি নিজের কল্পনা শক্তি খরচ করে। আশা করি এত লম্বা লিখা দিয়ে কাউকে বিরক্ত করি নাই]





Sunday, December 10, 2017

Tears in Heaven

Written in tribute to our batch mate friend Azami's son Anas.

মানুষের মৃত্যু ব্যাপারটার সাথে আমি কখনোই ঠিক মত মানিয়ে নিতে পারি না। আমার জীবনে প্রথম দেখা মৃত্যু ছিল আমার দাদীর। উনি অসুস্থ্য ছিলেন, কিন্তু মরণব্যাধি ছিল না কোন। হঠাৎ করেই চলে গেলেন দাদী, ঈদ এর ১ মাস আগে। সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয়, কিন্তু আমি কেন জানি কিছুই ভুলতে পারছিলাম না।

আমার নানা নানু খুব কেদেছিলেন যখন আমার মামা চলে গেলেন। উনার ব্যাপারে আগেও লিখেছি। সম্ভবত দুনিয়াতে সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে বাবা মায়ের সামনে সন্তানের মৃত দেহ। আমি চাই না কেউ এ কষ্ট ভোগ করুক। আমি নিতে পারি না, সহ্য করতে পারি না। যখনি কোন শিশুর মৃত্যুর কথা শুনি, নিজেকে বড় স্বার্থপর মনে হয়। মনে হয় যেন আমার চেয়ে ওর বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি জরুরী ছিল।

আজ হতে ১ বছর আগে। আমি গ্রুপে বেশি পোস্ট করি না, কিন্তু প্রচুর পোস্ট পড়তাম। কি হল বোঝার আগেই আমাদের বন্ধু আজামির ছেলে আনাস আমাদের কে ছেড়ে চলে গেল। প্রথমে শুনলাম অসুস্থ্য, তারপর হঠাত করেই শুনলাম ও নেই। তখন বাবা আজামি খুব সুন্দর ও আবেগী একটা লিখা দিয়েছিল। চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি সে লেখা পড়ে।

বিখ্যাত ব্লুজ গায়ক এরিক ক্ল্যাপটন আমাদের অনেক বড় বন্ধু। উনি জর্জ হ্যারিসন ও রবি শংকর এর সাথে কন্সার্ট ফর বাংলাদেশ এ বাজিয়েছিলেন। উনার ৪ বছর বয়সি ছেলে কনর (Connor) মারা গিয়েছিল একটি দূর্ঘটনায়। অবুঝ বাচ্চাটা তার দাদীর সাথে দাদীর বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। সেই বাসা ছিল এক বিল্ডিং এর ৫৩ তলায়। জানালা দিয়ে পড়ে গিয়েছিল পাশের বিল্ডিং এর ছাদে :(

সে দুর্ঘটনার পর এরিক তার সবচেয়ে বিখ্যাত গান "টিয়ারস ইন হ্যাভেন" লিখেন।

গানটির থিম হচ্ছে "তুমি কি আমাকে চিনবে, আমি যদি স্বর্গে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করি? কিন্ত আমি তো স্বর্গের যোগ্য নই এখনো, তাই আমাকে শক্ত হতে হবে, এবং জীবন চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না দেখা হয় তোমার সাথে"

সবাই আনাস এর জন্য দোয়ার করছে, আমিও দোয়ার পাশাপাশি ওর জন্য এই গান টি উতসর্গ করলাম। আল্লাহ Azami ও তার পরিবারকে এই নিদারুণ শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দিক।

Would you know my name
If I saw you in heaven?
Would it be the same
If I saw you in heaven?

I must be strong
And carry on
'Cause I know I don't belong
Here in heaven

Would you hold my hand
If I saw you in heaven?
Would you help me stand
If I saw you in heaven?

I'll find my way
Through night and day
'Cause I know I just can't stay
Here in heaven

Time can bring you down
Time can bend your knees
Time can break your heart
Have you begging please, begging please

Beyond the door
There's peace I'm sure
And I know there'll be no more
Tears in heaven

Would you know my name
If I saw you in heaven?
Would you be the same
If I saw you in heaven?

I must be strong
And carry on
'Cause I know I don't belong
Here in heaven

'Cause I know I don't belong
Here in heaven

https://youtu.be/JxPj3GAYYZ0

#ishtiaq_radical