Sunday, December 17, 2017

দাদার গল্প ১

তিনি  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন।  পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে মোটামুটি বড় পরিবার। অভাব অনটন লেগেই আছে। তবে স্বস্তির বিষয় ছিল চাকরীর সূত্রে পাওয়া কোয়ার্টার। বাসা বেশি বড় না হলেও গাদাগাদি নেই। বেশ বড়সড় একটি বৈঠকখানা, দুইটি প্রশস্ত বারান্দা, তিন টি শোয়ার ঘর ও প্রক্ষালণকেন্দ্র, একটি ছোট অতিথি ঘর, আলাদা রান্নাঘর ও খাওয়ার জায়গা নিয়ে মোটামুটী আরামদায়ক বসবাস এর ব্যাবস্থা।

স্ত্রী পলিটিক্যাল সাইন্স গ্রাজুয়েট; সেকালের মাপকাঠি তে উচ্চ শিক্ষিত বলা যায় উনাকে। তখনো নারী দের শিক্ষা দীক্ষার উপর রয়েছে নানাবিধ বাধা বিপত্তি।তারপরেও তিনি বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে পাশ করেন সময় মত। বিয়ে হয় সুযোগ্য পাত্রের সাথে।

উনার স্ত্রীর কারণে বাসায় পড়ালেখার ব্যাপারে কোন ছাড় নেই। সেই সাথে গল্পের বই পড়ার ব্যাপারেও কোন বাধা নেই, তবে তা অবশ্যই হতে হবে পড়ালেখা শেষ করে। বাসায় ছিল ছোট লাইব্রেরী, বড় ভাই বোন দের বই ছোটরাও পড়তে পারতো সময় মত। 

মাগরিবের নামাজের আগেই সবাইকে বাসায় ফিরতে হয় বাধ্যতামূলক ভাবে।  কোন দিন যদি ভুলেও একটূ দেরী হয়ে যেত, সন্তান দের মুখোমুখি হতে হত বাবার রক্তচক্ষু ও সুকঠিন জেরার। পাঁচ তলা বাসায় প্রবেশ এর এক টাই দরজা ছিল, এবং ঘরে যেতে হত বৈঠকখানার ভেতর দিয়েই। ডানপিঠে বড় ছেলের কপালে মাঝে মাঝেই জুটতো উত্তম মদ্ধ্যম। সাথে বাঁচতে পারতো না চাচাতো ফুফাতো ভাইয়েরাও। ওরা মাঝে মাঝে এসে থাকতো সে বাসায়।

সেই বৈঠকখানা অনেক শাস্তির সাক্ষী। বাবা শুধু বাসায় দেরী করে ফেরা নয়, পরীক্ষায় আশানূরুপ ফলাফল না পাওয়া, পাশের বাড়ী থেকে অভিযোগ, কারো বাসা থেকে আম চুরি করে খাওয়া কিংবা ঢিল মেরে জানালার কাচ ভেঙ্গে দাওয়া ইত্যাদি নানা রকম ছোট বড় অপরাধের বিচার হত সেই কক্ষে।

অন্দরমহল থেকে বোনেরা শিউড়ে উঠতো ভাইদের আর্তচিতকার এবং বাতাশে বেতের শপাং শপাং শব্দে। সবাই ভাবতে জোরে চিৎকার করলে শাস্তি কমে যাব, কিন্তু তা কখনোই হত না। মাঝে মাঝে উনার মেজাজ ভাল থাকলে ভিন্ন শাস্তি দিতেন। এক ভাইকে বলতেন আরেক ভাই এর কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। এরকম দিন গুলো ছিল ঈদ এর মত।

পর্দার আড়াল থেকে ছোট ভাই বোনেরা হাসি মুখে উঁকি দিত ভাইদের চোখ পাকানো কে অগ্রাহ্য করে। বাবা লক্ষ্য করেও কিছু বলতেন না কারণ এ ঘটনায় শাস্তি আরো পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করতো।

সেই স্টাফ কোয়ার্টার ভিত্তিক সমাজে তিনি কড়া বাবা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এবং উনার সন্তানেরাও সে কারণে আদর্শ সন্তান হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেত।

মেঝ কে অনেক পছন্দ করতেন উনি।  মেঝ কখনো মিথ্যা বলতো না। মেঝর নির্দোষ স্বীকারোক্তির কারণে জেষ্ঠ সন্তানের অনেক জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেত। এ কারণে দুই ভাই এর মদ্ধ্যে একটি আদর্শগত রেষারেষি ছিল।

সবার শেষে জন্ম নেয় ছোট ভাই অঞ্জন। সবার কোলে কোলে, চরম আদরে বড় হয় সে। ততদিনে বাবা আর তেমন মারেন না সন্তান দের। সবাই মোটামুটি বড় হয়ে গিয়েছে, কেউ আর মার খাওয়ার মত কাজগুলিও করে না। তবে তিনি কখনোই বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা কিংবা অসৌজন্যমূলক আচরণকে বরদাশত করতেন না।

একদিন বাসায় ইলিশ মাছ এর ডিম রান্না হয়েছে। এক বাটিতে ঝোল শুকিয়ে ভুনা করে রান্না হওয়া তরকারী রাখলেন আম্মা। বাবা ও পাঁচ ভাই বসেছে টেবিলে। বোনেরা পরে খাবে, ওদের জন্যেও একটু তরকারী আলাদা করে রাখা আছে রান্নাঘরে। সবাই পাতে ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছে আম্মা কখন সবাইকে ডিম ভাগ করে দিবেন। প্রথা ভংগ করে প্রথমে কনিষ্ঠ সন্তান এর পাতে আদর করে ডিম তুলে দিলেন মা।

"আমাকে এত কম দিয়েছ কেন? আমি পূরোটা চাই। আজকে আমি একাই ইলিশ এর ডিম খাব, বাকিরা পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে খাক!" - বলে উঠলো কনিষ্ঠ।

বজ্রপাত হলেও হয়তো সবাই এত অবাক হত না। সেঝ ভাই সবার মদ্ধ্যে একটু চুপ চাপ স্বভাবের, মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল সে ছোট ভাই এর দিকে। বাকিরাও কম বেশি অবাক। বাবা মুখ খোলার আগেই বড় ভাই বলে উঠলেন "এই, এগুলা কি বলিস? সবাই মিলে খাবি না? আয় তোকে আমার থেকে একটু দিয়ে দেই"।

ছোট ভাই তাকে পাত্তা না দিয়ে তাকালো বাবার দিকে। কিন্তু মূহুর্তেই ওর আশার বেলুন চুপসে গেল।

বাবার মুখ লাল, চোখ জ্বলছে জলজল করে। সেই চোখে নেই কোন মমতা, বরং আছে অবিশ্বাস আর অদম্য রাগ।

"আমি পুরোটাই খাব, আমি পুরোটাই খাব" বলতে বলতে সেই শিশু টেবিল ছেড়ে দৌড়ে চলে গেল বারান্দায়। গলা ভাঙ্গা, কাঁদতে কাদতেই সে গেল পুরোটা পথ।

সে যুগের বারান্দা গুলো কোন ঘরের সাথে যুক্ত থাকতো না। দরজা দিয়ে আলাদা করা একটা ঘরের মত। বারান্দায় গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে দিল সে। বাইরে থেকে ভাই বোনেরা অনেকক্ষন ধাক্কা ধাক্কি করলেও সে খুল্লো না দরজা।

এদিকে পাথর হৃদয় বাবা একবারের জন্যেও টেবিল ছেড়ে উঠলেন না। ছোট ভাই এর জন্য সবার মন কাঁদে। কেউ ছুঁয়েও দেখলো না ইলিশের ডিম। সব্জী লবণ পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়েই সেদিনের খাওয়া শেষ হল। কেউ সেভাবে খেয়াল না করলেও গিন্নি ঠিকই খেয়াল করলেন যে বাবার প্লেট থেকে আর ভাত কমেনি। খালি নাড়াচাড়া করেছেন আর খানিক্ষন।

টেবিল থেকে উঠে গিয়ে উনি স্বাভাবিক ভাবে রিডিং গ্লাস টি নিয়ে দৈনিক পত্রিকা পড়তে বসলেন বৈঠকখানায়। পরনে সফেদ লুঙ্গি আর গেঞ্জি। নামাযে যাওয়ার জন্য উঠে একটা শার্ট পরলেন। তখন স্ত্রী বললেন "ছেলেটা তো এখনো দরজা খুলে না। কি করি?"

"এসব পাত্তা দিও না। ক্ষিদা লাগলেই সুর সুর করে এসে তোমার কাছে ভাত চাইবে" বলে বেরিয়ে গেলেন।

স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদে আসর এর নামাজ পড়ে গেলেন একই কলোনী তে অবস্থিত বন্ধু জামান এর বাসায়। তিন দান দাবা খেলতে খেলতেই মাগরিব এর সময় হয়ে গেল। মাগরিব এর নামাজ পড়ে বাসায় আসতে আসতে মনে পড়ে গেল ছোট ছেলের কথা। ১ পয়সা দিয়ে একটা কাঠি লজেন্স নিলেন ছেলের জন্য। মনে মনে ভাবলেন, বাকি ছেলে মেয়েদের চোখ এড়িয়ে ওকে এটা দিতে হবে।

বাসায় ঢুকতে ঢুকতে শুনলেন কান্নার আওয়াজ। এসে দেখলেন ছোট বোন তার ভাই এর জন্য কান্না করছে, দরজা তখনো খুলেনি।

দৌড়ে গেলেন বারান্দার সামনে। ধাক্কা দিলেন কয়েকবার, কোন সাড়া নেই। জোরে একটা লাথি দিলেন, দূর্বল কপাট ভেঙ্গে গেল। দেখলেন ছোট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছে এক কোনায়। ঘুমের মাঝেও যেন সে অভিমানী। বারান্দার এক কোণায় শুয়ে আছে আড়াআড়ি ভাবে।ভেজা শার্ট টা খুলে ওটাকে আকড়ে রেখেছে দুই হাতের মাঝে। চারপাশ ভিজে গিয়েছে ঘাম আর কান্নায়।

কোন দিকে না তাকিয়ে ছেলেকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলেন পরম মমতায়। পেছন থেকে বাকি সন্তানেরা দেখলো বিরল দৃশ্য। পাথরসম বাবার চোখে পানি। ছেলেকে ঘরে নিয়ে নিজে সারা গা ধুয়ে দিলেন, মুছে দিলেন আর পরিষ্কার কাপড় পরিয়ে দিলেন। এর মাঝে কখন চোখ খুলেছে সন্তান, বাবার এইরুপ আচরণে সেও মূক হয়ে গিয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। দুপুরের সেই বেঁচে যাওয়া ইলিশ এর ডিম দিয়ে নিজ হাতে মাখিয়ে মাখিয়ে ভাত খাইয়ে দিলেন সন্তান কে পরম মমতায়। আর মনে মনে ভাবতে থাকলেন "আজ কাস্টোমস অফিস এর সেই চাকরী তা না ছাড়লে সবার জন্য একটা করে আস্ত ইলিশ এর ডিম থাকতো বাসায়"।

হঠাত বাইরের দরজায় জোরে জোরে আঘাত এর শব্দ শোনা গেল। ঘরে ঢুকলেন বন্ধু জামান ও পাড়ার আরো কয়েকজন।

"কাজ টা ভাল কর নাই সিরাজ। ছেলে মেয়ের সাথে এত জিদ করা ভাল না"।

(চলবে)

[ আমার দাদা ডক্টর সিরাজুল হক খান যখন মারা যান, উনার সন্তানেরা সবাই বেশ ছোট। বড় ছেলে মাত্র honours পরীক্ষা দিবে। উনাকে নিয়ে উনার ছেলেমেয়েদের অনেক স্মৃতি, কিন্তু উনারা বেশি বলেন না। অল্প যে কয়েকটা গল্প শুনেছি, সেগুলো নিয়ে লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। বন্ধু নাজমুল হুদা ও অনেকবার বলেছে লিখার জন্য। চেষ্টা করবো গল্প গুলো লিখে শেষ করতে। কে জানে, হয়তো এগুলো কে জোড়া দিয়েই কোন দিন উনার একটা পূর্নাঙ্গ আত্নজীবনী লিখে ফেলতে পারবো।

লিখতে গিয়ে বুঝলাম যে কাজ টা সহজ না। আমি দাদাকে কখনো দেখিনি, কিন্তু তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে চোখ ভিজে যাচ্ছিল বার বার। তাই অনেকদিন আগে শুরু করলেও আজকেই শেষ করতে পারলাম এই লেখাটি। গল্প টা মোটামুটি accurate, কিছু ডিটেলস আমি শুধু সংযোজন করেছি নিজের কল্পনা শক্তি খরচ করে। আশা করি এত লম্বা লিখা দিয়ে কাউকে বিরক্ত করি নাই]





No comments: