Tuesday, December 05, 2017

সূর্য ডুবে গিয়েছে

আমি ছোট বেলা থেকেই হাল্কা লেখা লেখি কর। যদিও মাঝে অনেকদিন বন্ধ ছিল লিখা। প্রথম উল্লেখযোগ্য লিখা টি লিখেছিলাম ক্লাস ১ এ থাকতে। কেন উল্লেখযোগ্য, আর কেনই বা মনে আছে? লিখাটি ছিল ঘোড়া সংক্রান্ত। সে লিখায় আমার তৎকালীন শিক্ষীকা এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে ক্লাস ১ পাশ করার পর আমাকে সরাসরি ক্লাস ৩ তে উঠায় দেয়া হল। আমার যতদুর মনে পরে আমি ঘোড়া ঘাস খায়, তার চারটি পা এবং তাকে ছেড়ে দিলে সে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়--এগুলাই লিখেছিলাম, ইংরেজী তে। কে জানে কেন উনার এত ভাল লেগেছিল?

হু, সে যুগে এসব সম্ভব ছিল। ডাবল প্রমোশোন, কিংবা মায়ের কাছে হাতেখড়ি নিয়ে সরাসরি ক্লাস ওয়ানে স্কুল শুরু করা। আর আমার মেয়েকে পার হতে হচ্ছে প্লেগ্রুপ, নার্সারী, কেজি ১, কেজি ২, ইত্যাদি হাবিজাবি। আল্লাহই জানে আমরা আমাদের সন্তান দের জীবনে কি দূর্যোগ এনে দিচ্ছি! 

সৌদি আরব এর মদিনা শহরের কাছে দাম্মাম নামের একটা জায়গায় আমরা থাকতে থাকতেই খুলেছিল দূতাবাস স্কুল, এবং আমরাই ছিলাম ফার্স্ট ব্যাচ। এখন আর কোন আইডিয়া নাই সে স্কুল টিকে আছে কি না। গুগল এ খুঁজে কিছু পেলাম না। মজার ব্যাপার, এত বছরে একবারো এই সার্চিং টা করার ইচ্ছা জাগে নাই। 

তা যাই হোক, সেখানে দেড় বছর পড়ার পরেই আমার জীবনের সৌদি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। আব্বা চাকুরী তে ইস্তফা দিয়ে খাঁটি দেশপ্রেমিক এর মত দেশে ফিরে এলেন। দেশে এসে ক্লাশ ৩ এর অর্ধেক শেষ করলাম, আর তারপর সরকারী স্কুলে ক্লাস ৪ এ ভর্তি। একবারে এস এস সি পর্যন্ত ওখানেই। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লিখতাম আইটি নিয়ে। তখন এপল ম্যাক জি ৪ নামক খুবই সুদর্শন কম্পিঊটার নিয়ে স্টিভ জবস এর কোম্পানী মাত্র ফিরে আসি আসি করছে। সেসময় দেশে কম্পিউটার কিংবা আইটি পত্রিকা বলতে ছিল কম্পিউটার বিচিত্রা, কম্পিউটার টাইমস সহ আরো কয়েকটি পত্রিকা। ইত্তেফাক এর আইটি পাতাও জনপ্রিয় ছিল। সাপ্তাহিক ২০০০ এও আইটি নিয়ে লেখা আসতো। 

আইটি সাংবাদিকতা তখন অনেকটাই বেঁচে ছিল বিদেশী ওয়েব সাইট এর লেখা অনুবাদ এর উপর ভিত্তি করে। 2000 সালের কথা। ওইটুকে বাগ নিয়ে উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেছে ততদিনে। 

এক সোনালী সন্ধায় কিছু স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের সাথে পরিচয় হল, আমার ছোট মামার মাধ্যমে। আমার সেঝ মামা যদি হয়ে থাকেন সংগীত অনুরাগের অনুঘটক, তাহলে নিঃসন্দেহে ছোট মামা আমার লেখালেখির গুরু। 

এই স্বাপ্নিক দের স্বপ্নের সাথে একাত্নতা প্রকাশ করলো প্রখ্যাত মহিলাদের ম্যাগাজিন "অনন্যা"। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নিদ্দ্রিষ্ট  লক্ষ্য নিয়ে বের করা হল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বাংগ্লাদেশী মাসিক আইটি ম্যাগাজিন, যার নাম "অনন্যা কম্পিউটার টাইমস"। তখনো আমি ছাত্র, এবং নেই কোন হাত খরচ উপার্জনের উপায়। লেখালেখি সূত্রে একটি আয়ের উৎস তৈরি হল। 

পরবর্তি বেশ কিছুদিন আমি এই পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলাম। আমাকে মূলত নেয়া হয়েছিল ভিডিও গেমস রিভিউ  লেখার জন্য। আমার অতিরিক্ত ভিডিও গেমস অনুরাগের কথা তখন অনেকেই জানতো।তবে আমি অন্যান্য বিষয় নিয়েও লিখতাম। 

বেশিদিন চলেনি পত্রিকা, কিন্তু মজার ছিল জীবন টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ শেষ করে চলে আসতাম মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড এ অবস্থিত অফিসে। অনন্যা ম্যাগাজিনের সাথে আমাদের অনেক শেয়ার্ড রিসোর্স ছিল। যিনি ফ্যাশান বিষয়ক লেখার প্রুফ রিড করেন, উনিই আবার আমার লিখা আনরিয়েল টুর্নামেন্ট গেম এর রিভিউ এর প্রুফ রিডিং করতেন। ফলে স্বভাবতই তৈরি হত অনেক টানা পোড়েন। আমি লিখলাম "অস্ত্র সংগ্রহ করে এগিয়ে যেতে হবে প্রতিপক্ষের ক্যাসেল এর দিকে", আর প্রুফ রিডার সেটাকে বানিয়ে দিত "হাতিয়ার গ্রুহণ করে অগ্রসর হতে হবে শত্রু পক্ষের দুর্গের অভিমুখে--হানা দিয়ে জয়ের মাল্য ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে।"

২য়্ ভার্সান শুনতে যতই কাব্যিক লাগুক না কেন, আইটি পত্রিকার পাঠক, এবং বিশেষত যারা গেম রিভিউ এর টার্গেট, তারা এরকম ভাষা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরবে, সন্দেহাতীত ভাবে। কিন্ত কে বুঝাবে কাকে ? তারপরেও প্রায় ছয় মাস চলেছিল পত্রিকা; এর মধ্যে শেষ এর দুই মাস সম্পাদক ছিলেন একজন কবি(!) মানুষ, যার মতে হার্ডওয়্যার রিভিউ এর পাশে ফিলার হিসেবে মনীষিদের বাণী দেয়া উচিৎ! 

বহুদিন আগের কথা, কিন্তু মনে পরলে এখনো দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছা করে! পৃষ্ঠার এক পাশে জিটিএ ২ গেম এর চিট কোড, আর আরেক পাশে বড় করে লিখা "প্রত্যেক্টা মেয়ের বাবাই একজন প্রকৃতি প্রদত্ত ব্যাংকার"। 

এই বাণী কার, তা জানি না। 
এর মানে কি, তাও জানি না। 
ভাবসিলাম মেয়ের বাবা হইলে জানতে পারবো, 
তাও পারি নাই! 

তারপর আমার জীবনে ঘটে গেল অনেক গুলো ঘটনা। জীবন ৩৬০ ডিগ্রি উল্টে গেল। লেখালেখি গেল ব্যাকসিটে। অনেক ঝড় ঝাপ্টা সামলিয়ে ঢুকলাম চাকুরী তে। সেখানেও দেখলাম ভেজাল। গেঞ্জি কেনার টাকা জোগাড় করতে করতে লুংগী ছিড়ে যায় যায় অবস্থা, অগত্যা স্লিপিং ড্রেস কিনা শুরু করলাম। তা যাই হোক...

আরো বছর দুয়েক পরে, এক ইন্সপিরিশনাল মূহুর্তে লেখা শুরু করলাম একটি ইংরেজী উপন্যাস। তখন আমার একটি ব্লগ ছিল (এখনো আছে), সেখানে পর্ব হিসেবে পোস্ট করতাম একেকটি অধ্যায়। দুই একজন কাছের বন্ধু ছাড়া কেউ পড়তো না সেসব লিখা। এক সময় লিখে শেষ করলাম, মূলত সেই বন্ধুদের পীড়াপীড়িতেই। 

বহুদিন পার হয়ে গেল এরপরেও। হঠাত একদিন দেখলাম Monsoonletters নামের একটি ইংরেজী গল্প সংকলন  প্রকাশিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকেই, এবং তারা বাংলাদেশী লেখক দের কাছ থেকে লেখা আহ্ববান করছে। কিভাবে কিভাবে জানি আমার লেখাটা সেই পত্রিকায় প্রকাশিত হল। Kozmo Lounge নামের একটি রেস্তোরা ছিল তখন ধানমন্ডী তে। পত্রিকার লঞ্চিং অনুষ্ঠান ছিল ওখানে। 

সেদিন পরিচয় হল অনেকের সাথে, যাদের লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংখ্যায়। আমার লেখাটি ছিল সবচেয়ে বড়, পত্রিকার সম্পাদক আমাদের প্রিয় মেয়র আনিসুল হক এর স্ত্রি রুবানা হক আপা আমাকে বললেন যে "তোমার লেখাটা এত বড় যে এজন্য কয়েকজনের লেখা বাদ দিতে হয়েছে।" আমি অবাক হয়ে উনার কথা শুনলাম, আর কি বলবো তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু বলার আগেই উনি বল্লেন "কিন্তু আমি কিছুতেই তোমার লেখাটা বাদ দিতাম না। তোমার উচিৎ আরো বেশি করে লিখা"। 

এখন, এতদিন পরে এসে মনে হচ্ছে, আহা, উনার সাথে যদি আর ভাল পরিচয় থাকতো, তাইলে উনাকে বলতে পারতাম "আপা, আপনি একজন অসাধারণ মানুষের স্ত্রী ছিলেন, যিনি আমাদেরকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন"। 

RIP Mayor Annisul Huq , you will forever be in my mind. We didn't deserve you at all. 

"সুর্য ডুবে গিয়েছে"
#ishtiaq__radical

No comments: