Wednesday, December 20, 2017

দাদার গল্প ২

বাবা তখন বিভোর ছেলের মায়ায়। বন্ধুর ডাক শুনেও না শোনার ভান করলেন। বন্ধু বুঝলেন তিনি অতীব দূর্লভ একটি আবেগঘন মূহুর্তে উপস্থিত হয়েছেন। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভাবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন নিজ পথে।

সেরাতে কনিষ্ঠ সন্তান রইল সবার চোখের মণি হয়ে। অন্য ভাইয়েরা কিঞ্চিত ঈর্ষান্বিত হলেও কিছু বল্লো না "ছোট ভাই" বিধায়। সে রাতে আর সবাই একসাথে বসে খাওয়া হল না, যে যার মত খেয়ে নিল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। 

সন্তানেরা একে একে ঘুমিয়ে পড়লো যে যার মত। 

বাবার চোখে ঘুম নেই। গিন্নী অন্য যেকোন দিনের মতই পানের বাটা থেকে পান সুপারী বের করে হামানদিস্তায় ছেঁচতে বসলেন। এ কথা সে কথা বলতে লাগলেন পান সুপারী পিষে ফেলার মাঝে মাঝে।

"ওগো, শুনেছ নাকি? পাশের বাড়ীর জলিল সাহেব এর মেয়েদের জন্য গানের শিক্ষক রেখেছে। আমাদের মেয়েগুলির  জন্য দেখবে নাকি? প্রয়োজনে ওরাও ঐ বাসায় গিয়ে এক সাথেই শিখবে। আমার খুব সখ আমার মেঝ মেয়েটা চুলের বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে গান গাইবে স্কুলের অনুষ্ঠানে। মাইনে টাও খুব বেশি নয়"। 

বড় মেয়ে একটু গম্ভীর প্রকৃতির, এ বয়সেই অংকে খুব ভাল। মা যেকোন ছোট খাট হিসেব নিকেশ এর কাজ ওকেই দেন করতে, এবং খুব দ্রুত সে তা করেও দেয়। ভাই দের দুষ্টামি ও দুরন্তপণা কে ভ্রকুটি দিয়ে নিরুৎসাহিত করে বলে ভাইদের সাথে দুরত্ত্ব বেশি।  

এদিকে আবার মেঝ মেয়েটা খুব হাসি খুশি, চঞ্চল ধরণের। ভাইদের জন্য অনেক মায়া । একদিন দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা গাইছিল অচেনা কোন এক সুরে, মা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলেন অনেক্ষন। তখনি সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে গান শিখাবেন। 

মায়ের চিন্তাসূত্র এক সময় ছিন্ন হল। লক্ষ্য করলেন যে স্বামী একটা শব্দও করেন নি। এ ধরণের প্রাত্যহিক ব্যাপার গুলো নিয়ে জামাই বউ প্রায়শই আলাপ করে থাকেন। সাধারণত গিন্নী বলতে থাকেন, আর উনি হু হা করতে থাকেন। সাংসারিক ব্যাপার গুলোতে স্ত্রীর বিচার বুদ্ধির উপর উনার অনেক আস্থা।

তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ও আছে।  যতবার মেয়েদের গান শেখানোর প্রসংগ এসেছে, উনি শক্ত ভাবে প্রতিবাদ করেছেন। মেঝ ছেলের বিদ্যাপিঠ এর অংকন শিক্ষক অমল বাবুর সাথে একদিন কথা হচ্ছিল।

"স্যার, আপনার ছেলে তো আমার ক্লাশ এর সবচেয়ে ভাল আঁকিয়ে। এ বয়সে ওর যে আঁকার হাত, বড় হলে নির্ঘাত বিখ্যাত শিল্পী হবে। ওকে অবশ্যই চারু কলায় ভর্তি করাবেন কলেজ এর পর"।

"না হে, আমার ছেলে কে আমি পেইন্টার বানাব না কোন ভাবেই। শেষে দেখা যাবে কোন কাজ না পেয়ে দোকানের সাইন বোর্ড রঙ করছে বসে বসে। সে উপার্জনে ভাত জুটবে কি?"

চৌকস শিক্ষক অমল বাবু যথেষ্ঠ পরিমাণে বিরক্ত হলেও মুখের উপর সিরাজ সাহেব কে কিছু বললেন না। উনি এলাকার সম্মানিত মানুষ। সবাই উনাকে মানে, আর মনে মনে একটু দমে গেলেও অমল সাহেবও বুঝেন যে আসলেও চারুকলার ছাত্রদের আয় রোজগারের পথ বুয়েট পাশ ইঞ্জিনিয়ার দের মত এত সহজতর নয়। তবে তিনি মনে মনে পণ করলেন যে আজ হোক কাল হোক তিনি মেঝ কে নিজেই বলবেন চারুকলার কথা।

কে জানতে পেরেছিল যে সদাহাস্য অমল বাবু সে সুযোগটিও পাবেন না?

সিরাজ স্যার তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন, সম্পূর্ণ অন্যমনষ্ক। স্ত্রী যে উত্তরের অপেক্ষায় তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে, তা উনার একদম খেয়ালে নেই। উনি তখন মনে করছেন হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের কথা।

পরালেখার পাট চুকিয়ে ঢুকেছিলেন সরকারী চাকুরী তে। শুল্ক বিভাগে। পোস্টিং হল চট্টগ্রাম, যা নিজ ভিটা থেকে বেশ দূরে। অন্তত প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত করার মত কাছে নয়।

সেখানে উনার কাজটি কি ছিল ? সারাক্ষণ পরিবার কে  স্মরণ করা আর পণ্য আমদানী রপ্তানীর খেয়াল রাখা। সবাই ঠিক মত শুল্ক দিচ্ছে তো? বিবরণী পত্রের সাথে আনীত মালামাল কি মিলেছে? কম বেশি নেই তো?

যথেষ্ঠ পরিমাণে একঘেয়ে কাজ, কিন্ত সময় ও পরিশ্রম সাপেক্ষ। কাজ শেষ করে সরকারী কোয়ার্টারে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। অল্প খাবার খেয়ে রেডিও শুনতে শুনতেই শেষ হত বেশির ভাগ দিন।

তখনো সেরকম সামর্থ্য নেই যে পুরো পরিবার কে নিয়ে আসবেন সেখানে। বাচ্চারাও ছোট ছোট। ছোট মেয়ে ও ছোট ছেলে তখনো আসেনি। তারপরেও পরিবারে সদস্য সংখ্যা একেবারে কম নয়।

এক মাস ও হয়নি উনি চাকরী তে ঢুকেছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ও অপরিসীম সততা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছেন সুনাম। দক্ষ ও নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে সবাই সিরাজ কে পছন্দ করে। 

সেদিন ছিল মংগলবার। অন্য যেকোন কর্মদিবসের মতই, দিনের কোন বিশেষত্ত নেই আদতে। নিজের কক্ষে বসে কাগজে লিখে চলেছেন অবিরাম। টেবিল ফ্যান এর স্পিড একেবারেই কমানো। ঘরের মধ্যে শব্দ বলতে কাগজের উপর ফাউন্টেন পেন এর খস খস শব্দ। প্রিয়তমা স্ত্রী কে চিঠি লিখছেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে । মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে দোয়াতে চুবিয়ে নিচ্ছেন কলম খানা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন আরো কিছু মাল পত্র এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত দেখলেন আর্দালী একজন মধ্যম উচ্চতার মানুষ কে নিয়ে এসেছে ঘরে।

খুব বিগলিত কন্ঠে বলে উঠলেন "স্যার, কেমন আছেন? আজ ভারত থেকে কিছু প্রসাধনী আমদানী করেছি।আপনার মেহেরবানি হলে আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেন। চৌধুরী সাহেব বলেছেন মাল গুলো নিয়ে আজকেই সদরে চলে যেতে"।

"কোন চৌধুরী?"
"চিনেন নাই? আপনার প্রতিবেশী জালাল চৌধুরী"

বিবরণপত্রে দ্রুত চোখ বুলাতে লাগলেন সিরাজ সাহেব। খটকা লাগলো। উঠে গিয়ে বাক্স গুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে চমকে গেলেন ভীষণ ভাবে। বর্ণনার সাথে দ্রব্যের কোন মিল নেই। যা আমদানী হয়েছে, তার শুল্ক অনেক বেশি হবে। সটান ঘুরে গিয়ে সেই মধ্যম উচ্চতার ব্যক্তির দিকে তাকালেন কড়া চোখে।

সে ক্রোধ ও রোখ মিশ্রিত ভয়ংকর চাহনীর দিকে বেশিক্ষণ কেউ তাকিয়ে থাকতে পারতো না। চোখ নামিয়ে নিত নিজের অজান্তেই। অনেক বেশি রেগে গেলেই কেবল উনার এই চেহারা প্রকাশ পেত। ফর্সা মুখ মূহুর্তে লাল টকটকে হয়ে যেত। 

স্কুল শিক্ষক হিসেবে অনেক দুষ্ট শিশুকে শিষ্টতার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি শুধু এই দৃষ্টি দিয়েই। 

কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন সেই খর্বকায় ব্যক্তিটি ভয় পাওয়ার বদলে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে একটি খাম।

"কি এখানে?"
"স্যার, আপনার জন্য চৌধুরী সাহেব দিয়েছেন"
"তোর নাম কি রে?"
"জ্বী কি বললেন?"

হঠাত আপনি থেকে তুই তে পদাবনতি পেয়ে লোকটি বেশ অবাক হয়ে গেল। তারপরেও নিচু স্বরে  উত্তর দিল "আমার নাম করিম, স্যার"

"করিম এর বাচ্চা করিম, কোন সাহসে আমাকে ঘুষ সাধিস? আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন"

এর পরের কয়েকটি মিনিট কেটে গেল চোখের পলকে। চটাশ করে  করিমের গালে পড়ল বজ্রাঘাত। পায়ের পাদুকাটি বহুদিন তার প্রতিদিনের একঘেয়ে হেটে চলার কাজ থেকে অব্যাহতি পেয়ে চলে এল উনার হাতে, অস্ত্র হিসেবে।

মূহুর্মূহূ  চটাশ চটাশ শব্দ এবং ক্রমাগত "ওরে বাবা, ওরে বাবা" ধ্বনী শুনে ঘরে ছুটে এল আর্দালী সহ আরো বেশ কয়েকজন। ততক্ষনে করিম দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। সিরাজ স্যার ধাওয়া দিতে গিয়েও আর দিলেন না। বেশি তাড়াহুড়া করতে গিয়ে করিম উলটে পড়ে গেল ঘরে। টেবিলের কোনায় আটকে লুংগী ছিড়ে যায় যায় অবস্থা। কেউ আর তাকে কিছু বল্লো না, সে প্রায় উড়ে উড়ে পালিয়ে গেল।

এই ঘটনার এক দিন পরেই সাদা কাগজে নিজের পদত্যাগ পত্র লিখে সুপারভাইজার এর হাতে দিয়ে দেন সিরাজ স্যার। অনেক বুঝিয়েও তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারে নি কেউ।

এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন, শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোন পেশায় জড়িত হন নি সিরাজ স্যার।


No comments: