Monday, November 12, 2018

কালো দিনের কাব্য

সকালে ঘুম ভেংগে গেলো ওর; অন্য যেকোন দিনের মত। ঘুমানোর আগে সারা ঘরে এরোসল স্প্রে করে মশা তাড়িয়েছিল। তাও লক্ষ্য করলো কাঁথার এক কোণায় লালচে রঙ। অর্থাৎ যাবতীয় ব্যবস্থা নেয়া স্বত্তেও মশককূলের দংশনের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি ও। স্বগোক্তি করে উঠলো ও

"আরে বেটা, তুমি নিজেকে মশার হাত থেকেই রক্ষা করতে পারো না, দুনিয়ার হাত থেকে তোমাকে কে রক্ষা করবে?"।
জানালার পর্দা সরিয়ে দিল সে দু'হাতে। বাইরে তাকালো খোলা আকাশ দেখার আশায়। কিন্তু সে আশা নিমিষেই নিরাশায় পরিণত হল। কংক্রিট আর ইট পাথরের স্থাপনা ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না।

দাদী যখন টিনের চালের এক তলা বাড়ীটি তুলেছিলেন এখানে, তখন আশে পাশে ত্রিসিমানায় আর কোন স্থাপনা ছিল না। দিন গড়িয়ে মাস, মাস গড়িয়ে বছর গেল, আর আশে পাশে উঠে গেল বড় বড় বিল্ডিং। যুগের সাথে তাল মেলাতে টিনের চালের বাড়িও উন্নত তিন তলার কংক্রিটের স্থাপনায় রুপান্তরিত হল একসময়। কিন্তু পাশের বাড়ি বেরসিক এর মত খোলা আকাশ কে ঢেকে দিল। 

ঘরে আলো নেই বললেই চলে। কোন মতে চশমা খানা নাকের ওপর বসিয়ে ঘর থেকে বের হল সে। বারান্দা খানা খুজতে গিয়ে মনে পড়লো, মনুষ্যপ্রজাতির চাহিদার কোন অন্ত নেই। বাড়তি একখানা কাপড়ের আলমারী কে স্থান দিতে গিয়ে বারান্দার দেয়াল গুলো কিছুদিন আগেই উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন পুরোটাই "রুম"।

তবে জানালা রয়েছে। জানালা তো জেলখানাতেও থাকে, অফিসের ডেস্কের পাশেও কদাচ খুঁজে পাওয়া যায় কপাল ভালো থাকলে। শুধু মাত্র ভয়ানক খারাপ অপরাধীদের কে বন্দী করে রাখা কয়েদখানায় জানালা থাকে না।

বাইরে ঘোর অন্ধকার। মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যে বেলা। শো শো করে বাতাস বইছে।ঘড়ির কাটার রেডিয়াম আলো জানান দিল যে দুপুর বারোটা বাজে!

হায়, ভোর বেলায় ওঠার কথা ছিল আজ। সে জায়গায় এত বেলা হয়ে গিয়েছে, আর সাথে আকাশের এই অবস্থা। হঠাত এক দমকা হাওয়া ধাক্কা দিয়ে ওকে ঠেলে দিল পেছন দিকে।

"এমন দিনে কি কেউ বাসা থেকে বের হয়?"। কালো আকাশ, জোরালো বাতাস--যেকোন মূহুর্তে নামবে ঝড় আর বৃষ্টি। ভাবতে ভাবতেই শুরু হয়ে গেল বহুল প্রত্যাশিত বৃষ্টি। বছরের প্রথম, মৌসুমের প্রথম, কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো বেহেশতী ঝড়নাধারা।

মনে হচ্ছে কেউ চাবুক দিয়ে পেটাচ্ছে মাটিতে। প্রতিটি আঘাতের সাথে সাথে নেমে আসছে বড় বড় বৃষ্টির ফোটা। পিঠের নগ্ন চামড়ায় চাবুকের তীব্র কষাঘাতের মতই জোরালো শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন শিলা বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু প্রথম বর্ষার বৃষ্টির ফোটা বরফ পিন্ডের চেয়েও তেজস্বী।

এরকম দিনগুলোতে আশির দশকে শান্তিনগরের সকল শিক্ষকগণ তাদের ছাত্রদের স্বয়ংক্রিয় ছুটি দিয়ে দিতেন, কারণ বৃষ্টি কে যদিও ভুলে কেউ পরাভূত করতে পারতো, কিন্তু পুরো এলাকায় জমে থাকা বণ্যা সদৃশ জলাশয় পার হয়ে কেউ সুস্থ্য অবস্থায় গুরুদের কাছে পৌছুতে পারতো না।

এরকমই এক সন্ধ্যায় ও অসম্ভব কে সম্ভব করে গণিত স্যার এর বাসায় পৌছে গিয়েছিল, অর্ধভেজা অবস্থায়। স্যার ওকে দেখে বলেছিলেন, বাছা, তোমার অনেক সাহস আর অধ্যবসায়। এবার বীরদর্পে ফিরে যাও বাসায়। আজ আর ক্লাশ হবে না। ফেরার পথে আর রিকশা না পেয়ে পুরোটা পথ নির্বিকার চিত্তে, ভিজতে ভিজতে ফিরে গিয়েছিল ও।

ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল। সেদিন ছিল রবিবার। সময় আনুমানিক সন্ধ্যা ছয়টা।

ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির বড় বড় ফোটার হাত থেকে বাচতে সবাই বিভিন্ন স্থাপনার নিচে অবস্থান নিয়েছে, আর যাদের উপায় নেই, তারা ছাতা মাথায়, বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন কে দৌড়ুতেও দেখা যাচ্ছিল। এসব কর্মকান্ডের মাঝে একজন লম্বা মানুষ ধীরে ধীরে, গুন গুন করে এক অচেনা বিদেশী সংগীত এর সুর ভাজতে ভাজতে এগিয়ে যাচ্ছে -- এ দৃশ্য কাউকেই খুশী করতে পারছিল না। কিন্তু তাতে এ গল্পের নায়কের কোন বিকার ছিল না। সে তার লম্বা লম্বা হাতের আংগুল দিয়ে প্রতিটি ফোটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল আর আবেগিত হচ্ছিল। আবগিত বলে আসলে কোন শব্দ নেই, কিন্তু পাঠক বুঝলেই যথেষ্ঠ; কখনো কখনো।

বর্তমানের রুঢ় চপেটাঘাত! বারোটা হোক আর তেরোটা, বাসা থেকে বের হতে তো হবেই। ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছে সেই সকাল থেকেই। তার সাথে আছে রেইন কোট আর ছাতা; স্যার যাতে না ভিজে, সেটা নিশ্চিত করতে আগেই বাসার একেবারে সামনে পার্ক করে রেখেছে সে গাড়ী।

স্যার মাথা থেকে বৃষ্টি, কালো মেঘ আর এ জাতীয় সকল বাজে বিষয়বস্তু দূর করে দ্রুত রেডি হয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিট লাগলো হঠাত জেগে ওঠা মনুষ্যত্বের ভুতটাকে ভাগাতে। "সুইচ অফ" করে ইমেইল, সোশ্যাল মিডিয়া আর টাকা পয়সার যাঁতাকলে ঢুকে গেলো সে।

ওর মতই আরেকজন ছিল এই শহরেই। সেও কালো দিন ভালোবাসতো। সেও বৃষ্টিতে ভিজতো কোন কারণ ছাড়াই। তার প্রোফাইলটা এখনো খুলে দেখে ও প্রায়ই। "remembering" লেখাটা দেখেই শুধু রিমেম্বার করে। তখন আবার মনুষ্যত্বের ভুতটা ছটফট করে ওঠে। কিন্তু দায়িত্ব, কর্তব্য, অর্থ, বিত্ত, সোশ্যাল লাইফ এর ভুতগুলোর শক্তি অনেক বেশি।

পাঁচ মিনিটেই ওরা সবাই মিলে এই বেয়াড়া ভুত কে কুংফু ক্যরাটে টাই কোয়ান্দো জুজিতসু সহকারে বিদায় করে দেয়। ও ফিরে যায় যান্ত্রিক জীবনে।

কালো দিন এক সময় কালো রাত হয়ে যায়।

Thursday, November 08, 2018

The Coconut Man

he CoCoNuT MaN

Oh do you know the coconut man
The coconut man, the coconut man?

There is a tree at a cross section. It is rumored that green coconuts are borne from that tree, which ripens in to matured ones in due course.


Sometimes coconuts fall upon unsuspecting pedestrians. So beware! Lo and behold! Hold your horses whilst crossing a coconut tree. For all good it is to you, it's better not to cross them trees at all. After all, they contain "green" coconuts, which grows on to ripe ones, and from which we can extract hair oil, and apply oil on to an already oily head.

No matter how many days, years or decades pass by, no matter how much good, bad and ugly walks by the crossroad, the legend of the coconut man lives by. He rubs his ring and gets the strength of ten coconuts, e.g. the yield is as much as 10 heavy duty coconuts thrown on to the bad man's mouth.

The coconut man is a creature who
comes out at night, and why?
He likes the air, he likes to scare
the nervous passer-by!

Among the wildest of stories that behest his presence, one is said about a zoo bare animal. I mean, an animal that lives in the zoo, bare footed and sans cloths; and pecks at any unsuspecting visitor who dares to lay a finger on to the cage that enslaves him. There's A nother War elephant in the zoo, which has been encased by walls put up by his own self years ago. He roars, moans, growls, beckons and bellows,bares his yellow teeth, but the leaning tower stays static and nothing really happens.

No matter how many wild animal roams the face of the earth, everyone hates the coconut man. Because he likes to scare the nervous passer by his mere presence.

Oh my, oh my!

Letter from A Fan

প্রিয়তমেষু,

জানো কি হয়েছে গতকাল রাতে? বিবেক এসেছিল বেড়াতে!

অনেক্ষণ কড়া নেড়েও আমাকে ঘুম থেকে ওঠাতে পারলো না। বিবেকহীন মানুষ হিসেবেই আরেকটা রাত পার করলাম।

বেদনায় নীল হয়ে রাত ঘুম কে অনেক্ষণ ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। তারপর এক পর্যায়ে নীল বেদনার কাছে আত্নসমর্পণ করে ঘুমন্ত শহরের অংশ হয়ে গেলাম। সকালে হকারের পেপার পেপার ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম--কোন শহরে, তাতো জানোই। না, একাকী কোন ভিন্ন শহরে নয়, সেই পুরনো ঘুম ভাংগা শহরেই জেগে উঠলাম।আমার রিটায়ার্ড ফাদার এর সাথে নাস্তাও করলাম।

কষ্ট পেতে ভালবাসি, তাই ফ্রিজ থেকে আবার বের করলাম প্রায় শুন্য বোতলটি। চাঁদ মামা হেসে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে, আর আমি শুন্যতায় ডুবে যেতে যেতে উপলদ্ধি করলাম যে আমাকে তুমি কোন ভাবেই ফিরিয়ে নিবে না। তুমি এখন পুরোপুরি বোঝ যে তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়। আমার শেষ চিঠিতে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়াটাই কাল হয়েছে।

তুমি শুধু হাসিটার জন্যেই এসেছিলে, নীরবতা কে আস্বাদন করার কোন ইচ্ছে তোমার কখনোই ছিল না।দিশেহারা এই হৃদয় আমার শুধু কষ্টই পেল সারা জীবন। রুপালী গিটার টা আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা থেকে শুরু করে ঘন্টার পর ঘন্টা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা--আর সহ্য হয় না।

আমি পালাতে চাই তোমার কাছ থেকে আরো দূরে।

ইতি
একজন ভক্ত।

Monday, October 29, 2018

I Get Along Very Well

https://youtu.be/l88m22K_RC4

বলা হয়ে থাকে যে প্রতিদিন পৃথিবীতে যত গান লেখা হয় তার নব্বুই ভাগই প্রেম ভালবাসা সংক্রান্ত। একটা সময় ছিল, যখন প্রেমের গান শোনাকে দূর্বলতা ভাবতাম। কেউ রিচার্ড মার্ক্স কিংবা এলটন জন এর "প্যানপ্যানানি" ভালবাসে জানলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতেও ছাড়তাম না। কিন্তু কিছুদিন পরে টের পেলাম যে মেটালিকা, আইরন মেইডেন ও প্রেম ভালবাসা নিয়ে গান গায়।

মানুষের জীবনে খাওয়া দাওয়া ঘুম যেরকম চিরন্তন সত্য, সেরকম ভালবাসা, প্রেম, যৌনতা, এসব ব্যাপারকেও অগ্রাহ্য করা যায় না, এবং একারণেই বিখ্যাত অনেক গানে এই বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন  গায়ক, গীতিকার ও লেখকগণ। প্রিয় কবি রানা ব্যাপারটা কে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে বলেছেন, "অশ্লীলতা ছাড়া তো কেউ পয়দাই হইতো না"।

সে যাই হোক, প্রেম ভালবাসা যেমন সত্য, ব্রেকআপ আর স্বপ্নভংগও সেরকমই দৈনন্দিন ঘটনা। সবার জীবনেও কখনো না কখনো এরকম সময় এসেছে। আমি যেদিন জানলাম জুহি চাওলা আমার চেয়ে বয়সে প্রায় ২০ বছরের বড়, সেদিন যেই কষ্টটা লেগেছিল, তা আর বলার নয়...

যাই হোক, আগেও আমার কিছু লেখায় পেট শপ বয়েজ ব্যান্ড এর নাম উল্লেখ করেছি। ওরা আমার খুব প্রিয় কোন ব্যান্ড নয়, কিন্তু কেন জানি তাদের গানের লিরিক্স গুলো খুব ভাল লাগে, হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

I Get Along হচ্ছে সেরকমই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্রেকআপ সং। গানটি শুনতে শুনতে গায়কের সাথে আপনি একটা ছোট খাট সিনেমা দেখে ফেলবেন কল্পনায়। গানের মূল উপজীব্য হচ্ছে "আমি বেশ ভালই আছি, তোমাকে ছাড়া"। আশা করি গানটি ভাল লাগবে। ইচ্ছে আছে কোন একদিন নিজে গাওয়ার।

পাঠক/শ্রোতার সুবিধার্থে নিচে লিরিক্স দিয়ে দিলামঃ

Feeling like I'm stuck in a hole
Body and soul
While you're out of control
Now I know why you had to go
Well I think we both know
Why it had to be so
I've been trying not to cry
When I'm in the public eye
Stuck here with the shame
And taking
My share of the blame
While making
Sudden plans that don't include you
I get along, get along
Without you very well
I get along very well
Now I know you'd much rather be
With rock royalty
Instead of someone like me
The big boys are back and we need them, you said
Think it was something you'd read
And it stuck in your head
Even though I don't suppose
That's as far as it goes
You've go quite an appetite
For being wronged and in the right
Well from now on it won't affect me
I get along, get along
Without you very well
I get along very well
The morning after the night before
I'd been alerted
To your lies
I phoned you up
Your calls were all diverted
Took a long time to track you down
Even then you were defiant
It's not what you think it is, you said
And proceeded to deny it
So I lost my patience at last
And it happened so fast
You belong in the past
I've been trying not to cry
When I'm in the public eye
Stuck here with the shame
And taking
My share of the blame
While making
Sudden plans that don't include you
I get along, get along
Without you very well
I get along very well

#ishtiaq_radical
#aboutmusic


Friday, October 26, 2018

ট্রিবিউট টু এবি

উনার সাথে প্রথম দেখা ২০০০ সালে। এর আগেও উনার শো দেখেছি, কিন্তু একদম কাছে থেকে দেখার সুযোগ এর আগে পাইনি। আমার তৎকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি রেওয়াজ ছিল যে নতুন ব্যাচ ভর্তি হলে বিসিআইসি ভবনের অডিটোরিয়ামে একটা ঘরোয়া কনসার্ট এর মাধ্যমে তাদেরকে বরণ করে নেয়া। এই শো গুলো অন্য ব্যান্ড কনসার্ট এর মত হোত না কখনোই। ব্যান্ড অনেক আয়েশী আমেজে থাকতো আর খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তারা পারফর্ম করতো।

প্রতি বছরই এই শো হোত, এবং বরাবরের মত সেবারও পছন্দের ব্যান্ড ছিল এলআরবি। শুনেছিলাম শো ৭টা থেকে শুরু হলেও ব্যান্ড সদস্যগণ আরো অনেক আগেই চলে আসবে ভেনুতে--প্র্যাক্টিস এবং জ্যামিং করার জন্য। বাচ্চু ভাইকে একদম সামনে থেকে দেখতে পাওয়ার অতি আগ্রহে আমি আর আমার কিছু বন্ধু বেলা ৩টায় চলে গেলাম ভেনুতে। পৌছুনোর কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম ব্যান্ড এসেছে। বাচ্চু ভাই ও অন্যরা ব্যাকস্টেজে তাদের বাদ্যযন্ত্র সহ চলে গেলেন।

ব্যাকস্টেজ এরিয়াতে সাধারণত ভলান্টিয়ার কিংবা ব্যান্ড এর সদস্য, ম্যানেজার ও অন্যান্য স্টাফ ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। আমি সামান্য বুদ্ধি খরচ করে একটি ভলান্টিয়ার ব্যাজ জোগাড় করলাম। কিছুক্ষণ পর সাহস করে ঢুকে পড়লাম সেখানে।

লক্ষ্য করলাম বাচ্চু ভাই তার তখনকার ট্রেডমার্ক টুপি পড়ে আছেন। উনি উনার ব্যান্ড কে নিয়ে একটা লম্বা টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে রয়েছেন। জমেছে জম্পেশ আড্ডা, আর সাথে রয়েছে চিকেন ব্রোস্ট। সে আমলে হেলভেশিয়া ও কলাবাগানের "মিল ইন আ বক্স" ছাড়া আর কোথাও চিকেন ব্রোস্ট পাওয়া যেত না। সেই নির্দ্রিষ্ট ব্রোস্ট এর প্যাকেটখানা কোথা হতে আনা হয়েছিল তার আর আজ মনে নেই, কিন্তু বাচ্চু ভাই এর টেবিল মাতানো আড্ডার কথা ভুলিনি।উনি একটি মজার গল্প বলছিলেন আর সবাই হাসছিল তার কথা শুনে।

হঠাত টের পেলাম রুমে পিনপতন নিরবতা। আমি সম্ভবত ম্যানেকুইন স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। খেয়াল করলাম বাচ্চু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কি জানি বলছেন। ১৯ বছরের আমি ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে উনি আমাকে বলছেন "কিছু বলবেন ভাই?"।

আসলে আমার ইচ্ছা করছিল উনার সাথে এক্টূ কথা বলতে। জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম উনার ডায়ার স্ট্রেইটস, ডিপ পার্পল আর আয়রন মেইডেন কেমন লাগে। কোন ইংরেজী গান রিকুয়েস্ট করলে কি বাজাবেন নাকি? কিন্তু আমি "সরি" বলে ভেগে যাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না।

অডিটোরিয়ামে গিয়ে আসন গ্রহণ করলাম বন্ধুদের সাথে। ওদেরকে আর বললাম না আমার অভিজ্ঞতার কথা। একটু পরে দেখলাম এলআরবি এসে স্টেজে উঠলো। কিছুক্ষণ পর বেজে উঠলো ডায়ার স্ট্রেইটস এর "Wild West End" গানটার গিটার সলো। বাচ্চু ভাই একাই বাজালেন কিছুক্ষন, তারপর বাকি ব্যান্ড উনার সাথে যোগ দিল। গানেরও দুই এক লাইন গাইলেন। তখনো হল খালি। শো শুরু হয় নি। চলছিল সাউন্ড টেস্ট আর জ্যামিং।

তিনি একে একে গেয়ে ও বাজিয়ে গেলেন স্মোক অন দ্যা ওয়াটার, কমফর্টেব্লি নাম্ব, ওয়েলকাম টু দ্যা জাংগেল, সুলতান্স অফ সুইং, উইদ অর উইদাউট ইউ সহ আরো অনেক বিখ্যাত ইংরেজী গানের অংশবিশেষ।
বাচ্চু ভাই যে কত বড় মাপের একজন গিটারিস্ট, সেটা সেদিন খুব ভাল ভাবে অনুধাবন করেছিলাম। অবলিলায় উনি হয়ে যাচ্ছিলেন মার্ক নফলার, ডেভিড গিলমোর, স্ল্যাশ এবং আরো অনেকে। এল আর বি ব্যান্ড প্রায় কখনোই কনসার্টে কাভার সং করতো না, কিন্তু এ ধরণের ঘরোয়া শো গুলোতে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল।
ঠিক ৭টায় শো শুরু হল। শুরুতেই বাচ্চু ভাই সুন্দর করে বললেন "আপনাদের জন্য পছন্দের গানগুলো গাইবো। আপনারা তো ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করেন, নিশ্চয় ইংরেজী গান বেশী পছন্দ। আমাদের হিট গানের পাশাপাশি আজ আমরা অনেক কভার সং ও করবো"।
এর পরের ৩-৪ ঘন্টা কোন দিক দিয়ে গেল টের ও পেলাম না। উপরে উল্লিখিত ইংরেজী গানসমূহ ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিখ্যাত গান ও এল আর বি ব্যান্ড এর বেশিরভাগ হিট গান গেয়ে ফেললেন বাচ্চু ভাই, তেমন কোন ব্রেক না নিয়েই।

শো এর শেষ গান "সেই তুমি" উনাকে গাইতেই হোল না প্রায়, হল ভর্তি নতুন পুরাতন ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্ররা গেয়ে গেল পুরো গানটা। ওয়ান মোর ওয়ান মোর রব তোলাতে গিটারের মূর্ছনায় ও ফেরারী মন এর করুন সুরে হল ভরে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেও।
গান শেষে সবার চোখে পানি। এমন আবেগ খুব বেশি অনুভব করিনি জীবনে।বাসায় ফেরার পথে সারাক্ষণ কানে বাজছিল সেই গানগুলি। এরপরেও এলআরবির অন্য আরো অনেক শো দেখেছি, কিন্তু এরকম হৃদয়স্পর্শী পারফরম্যান্স আর দেখিনি।
আফসোস, বড় ক্ষণজন্মা ছিলেন উনি। উনার কাছে আমাদের যেই ঋণ, তা কখনোই শোধ করতে পারিনি আমরা। একদিকে উপভোগ করেছি উনার গান, আর আরেকদিকে তাকে দিয়েছি গালি, আর করেছি তার চরিত্র হানি। আল্লাহ উনার আত্না কে শান্তিতে রাখুন। আমিন।

(বহুদিন আগের স্মৃতি। কিছু ডিটেইলস এদিক ওদিক হয়ে থাকতে পারে)

Saturday, October 06, 2018

Beirut Diary 8

আগেরদিন রাতেই একজন ট্যাক্সি চালকের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম। পূর্ব কথা অনুযায়ী সে তার ছোটখাট নিসান সেডান গাড়ীটি নিয়ে সকাল সকাল আমার এপার্টমেন্ট এ হাজির হয়েছিল। আমি বলেছিলাম ৯ টায় আসতে, কিন্তু অলস আমার নামতে নামতে ৯ঃ৩০ বেজে গেল। হাস্যমুখী চালক এর কাছে সরি বলা শেষ করতে না করতেই সে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে নাড়তে "নো প্রব্লেম, নো প্রব্লেম" বলতে লাগলো।

জেইতা গ্রটো বৈরুত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। শহর থেকে বের হয়ে সুন্দর একটা রাস্তা ধরে যেতে হয়। আমার সাথে একটা পয়েন্ট এন্ড শুট সনি ক্যামেরা ছিল। সম্ভবত ৮ মেগাপিক্সেল এর। বছর দুয়েক আগে দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে কেনা।

সে যুগে মোবাইলে খুব ভাল ক্যামেরা থাকতো না; আমার নোকিয়া 6230 মোবাইল টিতে ভিজিএ ক্যামেরা ছিল, যা সুন্দর ছবি তোলার জন্য যথেষ্ঠ ছিল না।

যেতে যেতে আমি প্রচুর ছবি তুলছিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বেশ মজা পাচ্ছিল। সে নিজেই কয়েকবার গাড়ী থামিয়ে আমাকে বলেছিল "Take photo here, good view". আমিও তার নির্দেশনা অনুযায়ী ছবি তুলে নিলাম বেশ কিছু।

শহুরে ট্রাফিক জ্যাম এর কারণে প্রায় ঘন্টা খানিক লাগলো ওখানে পৌছাতে। মাঝের ছবি তোলার বিরতী গুলো তো ছিলই।

দু'টি আলাদা আলাদা চুনাপাথরের গুহা নিয়েই জেইতা গ্রটো। সম্মিলিত যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার এর মত।

টুরিস্ট দের জন্য দু'টি অংশ খোলা--একটি "আপার গ্যালারী", আর আরেকটি "লোয়ার কেইভস"। গেটের ঠিক বাইরেই বেশ আগ্রহউদ্দিপক একটি শ্বেত শুভ্র মূর্তি স্থাপনা দেখা যায়।

সময়ের প্রহরী বা "গার্ডিয়ান অফ টাইম" নামক এই সুবিশাল মূর্তিটির উচ্চতা ৬.৬ মিটার এবং ওজন প্রায় ৬৫ টন। মূর্তিটি দেখে আমার সত্যি সত্যি গায়ে কাটা দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল যেন সিনেমার স্ক্রিণ থেকে বের হয়ে এসেছে কোন প্রহরী।

গ্রটোর ভেতরে যাতায়াত এর জন্য রয়েছে রেলগাড়ী সার্ভিস, এবং এছাড়াও টুরিস্ট দের মনোরঞ্জনের জন্য স্যুভেনির শপ, রেস্তোরাঁ, ইত্যাদি সুবিধাও রয়েছে। রেলগাড়ীটা অনেকটা শিশু পার্ক এর রেলগাড়ীর মত, তবে আরো বড় এবং মজবুত প্রকৃতির।

আপার গ্যালারী জায়গাটাকে খুব বিশেষ কিছু মনে হয়নি। গুহার মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির বড় বড় পাথর। পুরো জায়গাটি অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু কোথাও কোথাও যাত্রাপথ সরু হয়ে ফটকের মত হয়ে গিয়েছে, যার কারণে মনে হয় ছোট ছোট ঘরে ভাগ করা জায়গাটি।বর্ণনার সুবিধার্থে ঘরই বলি। 

একেক ঘরের দেয়ালের চেহারা একেক রকম। কোনটায় সাদা সাদা, কোনটায় হলদেটে, আবার কোনটা লালচে রঙের পাথরে ভর্তি। বেশ বৈচিত্রময় ব্যাপার স্যাপার।

পনের জন করে একেকটি গ্রুপ এর সাথে একজন করে গাইড ছিল। আমার মত একাকী আর তেমন কেউ আসেনি, সবাই আত্নীয় বন্ধু নিয়েই এসেছে উইকেন্ড কাটাতে। এ কারণে আমাকে কেউ খুব একটা গ্রাহ্য করছিল না, আর আমিও তাদের কথায় খুব একটা কর্ণপাত করছিলাম না। আমি "অনেকের মাঝে একা" মোডে ভালই ছিলাম।

প্রথমে গাইড সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেছিল "এখানে কি সবাই আরবী পারেন?"। আমি একমাত্র না বোধক ইশারা দেয়ায় সে এবং আমার বাকি ১৪ জন সংগী (!) যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিল। এই একটা ব্যাপার আমাকে একাধারে মুগ্ধ এবং অবাক করতো। একজনও আরবী না জানা মানুষ থাকলেও গাইড দের ওপর কড়া নির্দেশনা ছিল তারা যেন মাতৃভাষা ব্যবহার না করে।

যথারীতি বিশেষ আরবীয় এক্সেন্ট সহযোগে গাইড এর ইংরেজী বচন অল্পক্ষণ শুনেই আগ্রহ হারিয়েছিলাম। কোন পাদ্রী কবে পা ফস্কে পড়ে গিয়ে এই গুহা আবিষ্কার করেছিল, সেই ইতিহাস জেনে কি হবে? তারচেয়ে মন ভরে আশে পাশের অপরুপ দৃশ্য গুলয় মনে গেথে নেয়াই শ্রেয় মনে করলাম।

হঠাত সবাই থেমে গেল। আমি সামনের সুবেশী লেবানীজ রমণীর পায়ে পাড়া দিতে দিতে কোন মতে ব্রেক কষলাম। জিজ্ঞাসু নেত্রে গাইড এর দিকে চাইলাম। সে বল্ল "দিস ইজ দ্যা এনদ অফ যে রোড"। আমি বললাম "You mean?".

"Now you gotta get down and ride a boat".

এ পর্যায়ে একটা কথা বলে রাখা দরকার। আপার গ্যালারি তে ঢোকার আগেই আমার (এবং বাকি সবার) ক্যামেরা সমূহ বাজেয়াপ্ত করা হয়, এবং ধরিয়ে দেয়া হয় একটি করে টোকেন। আমি প্রতিবাদ করতে গেলে তারা বল্ল "তোমার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আমাদের জাতীয় সম্পদ এর ক্ষতি করবে। সুতরাং ক্যামেরা এলাউড না"। একই ধরণের ফাইজলামি আচরণ এর শিকার হয়েছিলাম কায়রো যাদুঘরে; চার বছর আগের তুতানখামেন এ







র স্বর্ণ খচিত মূখোশের সাথে ছবি তুলতে না পারার ক্ষত তখনো শুকায়নি--আর সেদিন আবার নতুন করে সেই ক্ষতস্থানে আঘাত পেলাম। জেইতা গ্রটোর গেট এর বাইরে তোলা কিছু ছবিই রয়ে গেল স্মৃতি হিসেবে।

সে যাই হোক, গাইডের কথা মত নৌকায় উঠলাম। নৌকা না বলে ভেলা বলাই ভাল। সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দেয়া হল, এবং মনে করিয়ে দেয়া হল যে গুহার মদ্ধ্যে ছবি তোলা নিষেধ। মজার ব্যাপার হল যে কোন নৌকাতেই কোন মাঝি টাইপ লোকজন নেই। টুরিস্ট দের নিজেদেরই বৈঠা দিয়ে নৌকা চালিয়ে এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে যেতে হবে।

গুহার ভেতরে বেশ অন্ধকার, কিন্তু তার মাঝে মাঝে হালকা কিছু কৃত্তিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পানিতে তেমন কোন স্রোত নেই। আমার নৌকাটিতে আরো ৪ জন উঠেছিল; আমরা সবাই বেশ উতসাহের সাথে বৈঠা ঠেলছিলাম, কিন্তু তবুও গতি বেশ মন্থর ছিল।

বৈঠা ছেড়ে চারপাশের দৃশ্যাবলীর দিকে মনোযোগ দিলাম। নৌকা চালানোয় আমার অনাগ্রহ দেখে একজন আরবী তে ইয়াল্লা ইয়াল্লা টাইপ কি জানি একটা বল্লো, কিন্তু আমি তাকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করলাম।সেও আমাকে আর ঘাটালো না।

নিজেকে মনে হচ্ছিল লর্ড অফ দ্যা রিংস সিনেমার কোন এক চরিত্র। সুপ্রাচিন এক গুহার মধ্যে দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছি, সাথে রয়েছে মহামূল্যবান রিং। সারাক্ষণ আশংকা, কখন পেছন থেকে আততায়ীরা হামলা করবে। অপার্থিব নিরবতা বলে একটি শব্দ সেদিনই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।

ছোটবেলায় ভূগোল বই তে পড়েছিলাম stalactite stalagmite শিলার কাহিনী। তখন নিরীহ ছিলাম, ছোট ছিলাম, শিলা শুনলে পাথরের কথাই মনে পড়তো, মনের মধ্যে বেজে উঠতো না কোন চটুল হিন্দী গানের লিরিক। সে যাই হোক, বিভিন্ন আকৃতি ও বয়সের শিলা দেখতে দেখতে এগুতে লাগলাম। কোনটার উপর আলো পড়লে রঙ বদলে যায়, আবার কোনটা দূর থেকে একরকম আবার কাছে গেলে অন্যরকম। বাস্তবিক, এরকম কোন দৃশ্যের সাথে আমার এর আগে পরিচয় হয় নি।

হঠাত অনেক আলো এসে চোখ ধাধিয়ে দিল। সাথে অনেক মানুষের কোলাহল। পথের হল শেষ। নৌকা থেকে নেমে জানতে পারলাম যে চাইলে আবার একই পথে ফিরে যাওয়া সম্ভব, অথবা এদিক দিয়ে বের হয়ে সরাসরি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেও চলে যাওয়া যায়।

ততক্ষণে শরীরে নেই এনার্জী, খুধাও লেগেছে বেশ। টোকেন ফেরত দিয়ে ক্যামেরা ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে একই ট্যাক্সিযোগে বাসার দিকে রউনা দিলাম। বাসায় গিয়েই খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ার ইরাদা।

(চলবে)






Sunday, September 23, 2018

Passionate Fashionista

প্যাশনেট ফ্যাশনিস্তা
বেশ কিছুদিন ধরে জিহান তার রুম থেকে কম বের হয়। দিনে তিনবার নিয়ম করে বুয়া ট্রে ভর্তি খাবার দিয়ে যায়। আমেনা বুয়া অনেক বছর ধরেই ওদের বাসায় আছে। সম্ভবত তার মা যখন ছোট ছিল, তখন সে এসেছিল এ বাসায়। দুপুরের খাবার দেয়ার সময় আমেনা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। ট্রে যেরকম ছিল, সেরকমই আছে, এক দানা খাবারও খায়নি মেয়েটা।

হঠাত করেই সায়েম সাহেব চলে গেলেন হার্ট এটাক করে । বয়স ছিল মাত্র ৪৩। সেই শোক সহ্য করতে না পেরে মাস দুয়েক পরে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে জিহান এর মাও তার পাশের কবরে নিজের জায়গা নিয়ে নেন। একমাত্র মেয়ে জিহান হঠাত করে সম্পূর্ণ এতিম হয়ে গেল মাত্র ১৬ বছর বয়সে।

ম্যানেজার জলিল সাহেব খুব সৎ। তিনিই একক হাতে সায়েম সাহেব এর ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এইচ আর মারফত বেতনের যে টাকাটা আসে, তার থেকে এক পয়সাও বেশি নেন না। প্রতিদিন একবার আসেন বাচ্চা মেয়েটার খবর নিতে। বেশির ভাগ সময় তাকে জানানো হয় "আফা ঘুমায়"। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার অফিসের দিকে রউনা দেন।

উনিও পুরনো লোক। সায়েম সাহেব এর পিতা কাইউম সাহেব তাকে চাকরী দেন তার ফ্যাক্টরি তে প্রায় ২০ বছর আগে। জিহান কে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন, নিজের সন্তানের মতই তাকে ভালবাসেন তিনি। উনি নিজের জীবনের মিশন হিসেবে নিয়েছেন জিহান এর দেখা শোনা করাকে। অন্তত মেয়েটা যেন কখনো টাকা পয়সার অভাবে না পড়ে, সেটা দেখা তার পবিত্র দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করেন।

জোরে জোরে আইফোনের রিংটোন বাজছে। জিহান ফোন হাতে নিতে নিতেই কল কেটে গেল। আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় বুকের উপর ফেলে রাখা বং টা সরিয়ে ফোন আনলক করলো ও। ৪৩ টা মিস কল! ঘরের মধ্যে ক্রিস্টাল মেথ এর উগ্র গন্ধ। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছে ও ব্লু মেথ, যা কিনা এতদিন শুধু টিভি সিরিজেই দেখে এসেছে। সেরকম এক নেশায় আছে ও গত ৭২ ঘন্টা। খুধা তৃষ্ণা কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না এক্টুও। মাম্মা আর ড্যাডির কথাও একবারও মনে পড়ছে না।

কল লিস্ট চেক করে অবাক হল সে। ও নিজেই ২০-৩০ টা কল করেছে। কাকে কল করলো এ আশংকায় আশংকিত হবার আগেই বুঝলো যে ও আসলে ড্যাড কেই কল করে যাচ্ছিল, আর প্রতিবার ড্যাড এর ভয়েস মেইলে যাচ্ছিল কলগুলো। আধা নেশা আধা সচেতন অবস্থায় আবার কল দিল ও ড্যাড কেঃ

"আমি সায়েম রহমান বলছি। যদি আপনি কোন কিছু বিক্রি করার জন ফোন করে থাকেন, তাহলে মুড়ি খান। আর যদি আপনি আমার পরিচিত কেউ হন, তাহলে আপনি জানবেন আমাকে কখন ফোন করলে পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ"।

হায়! এত পরিচিত হয়েও ড্যাড কে আর কখনোই ফোন করে পাব না, ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে এল জিহান এর। আবার ডায়াল করলো একই নাম্বারে, শুধু বাবার গলা আবার শোনার জন্য।

মা একদম পছন্দ করতো না ওর মডেলিং এর নেশা, কিন্ত ড্যাড খুব উৎসাহ দিত। প্রথম যেদিন র‍্যাম্প মডেলিং করে সবার মন জয় করে নিয়েছিল ও, তখন সবচেয়ে জোরে তালি দিয়েছিল ওর বাবা। মা রাগ করে আসেইনি দেখতে। নিজেও মডেল ছিলেন জিশান। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে হয় ফ্যাশান ডিজাইনার নইলে আর্কিটেক্ট হবে। মডেলিং এ আসবে তা কখনোই চাইতেন না।

এসব ভাবতে ভাবতে মিসড কল এর লিস্ট এ চোখ গেল জিহান এর। চম্পা খালা ফোন দিয়েছে ২০ বার। হঠাত মনে পড়ে গেল সব। আজ বিকেলেই তার একটা ফটোশুট আছে। চম্পা খালা তার হেয়ার ড্রেসার ও ফ্যাশান কন্সালটেন্ট, প্রতিবার মডেলিং এসাইনমেন্ট এর আগে অন্তত একবার হলেও চম্পা খালার কাছে ওর যেতেই হবে। ও যা করে সেটা হচ্ছে কাজ কনফার্ম হলে সেই দিন তারিখ খালাকে জানিয়ে রাখে, আর খালা সময়মত তাকে ফোন করে মনে করিয়ে দেয়।

কল লিস্ট ভাল করে খেয়াল করে দেখলো যে ১৮ টা কলই পুরনো; আজকে মাত্র দুইবার ফোন দিয়েছে খালা। চম্পা খালা আর তার মা সমসাময়িক ছিলেন । দুইজনের বয়স কাছাকাছি, এবং দুইজনেরই একসাথে মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে উত্থান ও পতন। বিয়ের পর পরই মডেলিং ছেড়ে দেন মা।

জিহান এর সব মডেল বন্ধুরা আরো কম বয়সী ও আধুনিক ফ্যাশনিস্তা দের কাছে যায়, চম্পা খালার মত পুরনোরা তাদের কাছে বাতিল। উনার কাছে যাওয়া নিয়ে তাকে কম টিপ্পনী সহ্য করতে হয়নি। খালাকে জিহান এর বন্ধুর মতই লাগে। খালা তার মুখের দিকে তাকিয়েই বলতে পারেন কি চলছে। তা সে পিম্পলের যন্ত্রণাই হোক, আর বয়ফ্রেন্ড এর সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনই হোক।

মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ড্রাগস এর উপরেই আছে ও। বন্ধুরা এক এক করে সরে পড়েছে। মডেলিং এজেন্সী থেকেও কল আসা কমতে কমতে শুন্যের কোঠায়। পড়াশোনা আরো আগেই লাটে উঠেছে। শুধু খালার সাথেই মাঝে মাঝে কথা হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ও ঘর থেকে বের হয়ে এল। ডুপ্লেক্স বাসার নিচতলায় সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, ডাইনিং আর লিভিং রুম। উপরে সবার বেডরুম।

নিচে এসে খুব অবাক হয়ে জিহান দেখলো সোফায় চম্পা খালা বসে আছে। জিহান কে দেখে বলে উঠলেন "এতক্ষনে আসার সময় হল?"
জিহান প্রত্যুত্তরে বল্লো "আরে তুমি এসেছ আমাকে তো কেউ জানায়নি! একটু আগে আমেনা বুয়া আমার রুমে এসেছিল, সেও তো কিছু বলে নাই।"
"কি জানি! ও হয়তো আমাকে খেয়াল করে নাই" বলে জিহান এর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল ও।
"শুন, আজকে না তোর মডেলিং শুট? আয় তোর চুল ঠিক করে দেই"
"চল তাইলে তোমার স্টুডিও তে"
"স্টুডিওতে যাওয়া লাগবে না, এখানেই সাজিয়ে দিচ্ছি"
পরের এক ঘন্টা কোন দিক দিয়ে গেল জিহান টেরই পেল না। চম্পা খালার হাতে যেন যাদু। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতেই পারলো না জিহান। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো খালাকে।
"অনেক ধন্যবাদ তোমাকে খালা। You are the best"
"আরে ধুর পাগলী, এ আর এমন কি"
"শুন, তোর সাথে খুব জরুরী কথা আছে"
"কি?"
"আমি আর তোর হেয়ার স্টাইলিস্ট থাকতে চাই না। তুই এর পর থেকে তপন এর কাছে যাবি"
"এহ, ছি! ওই চ্যাংড়া ছেলের কাছে আমি কেন যাব?"
"না, আমি ছুটি চাই। আর কাজই করবো না। আর তোরও সময় এসেছে নতুন নতুন স্টাইল জানার আর শেখার"
এ কথা শুনেই জিহান এর দু'চোখ ছলছল করতে লাগলো। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তাকে থামিয়ে দিল চম্পা।
"শুন, ইমো হইস না। আমি আমার বাবার কাছে চলে যাব। তুই ভাল থাকিস। আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা কর, নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিবি। ড্রাগস ছেড়ে দিবি। পড়ালেখা করে অনেক বড় হবি, যাতে আমি গর্ব করে বলতে পারি এই মেয়েটা আমাকে খালা ডাকতো, কিন্তু আমরা বন্ধুর মত ছিলাম"।

জিহান বুঝলো না এত কথা কেন বলছে খালা। এর মধ্যেই খালা বিদায় নিয়ে চলে গেল, আর জিহান তাড়াতাড়ি বের হয়ে ড্রাইভার কে ডাক দিল। ঘর থেকে বের হতে হতে খেয়াল করলো আমেনা বুয়া ঘুমাচ্ছে এক কোণায়।

সেদিনের মডেলিং শুট খুব ভাল হল। সবাই অনেক প্রসংশা করলো। নতুন একটা প্রোডাক্ট এর লঞ্চিং অনুষ্ঠান ছিল। ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই এসেছিল। অনুষ্ঠানের শেষে ককটেল পার্টি। সবার হাতে চকচকে গ্লাস। জিহান ও এক গ্লাস শেম্পেইন নিল।

খেয়াল করলো ও, দূর থেকে লম্বা, হ্যান্ডসাম ধরণের একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে হ্যান্ডশেক করলো জিহান।

"কি, তপনদা, কেমন হল আমার আজকের পারফরম্যান্স?"
"অসাধারন! সম্ভবত তোমার ক্যারিয়ার এর সেরা কাজ।
যাহ! কি যে বলেন না!
না আসলেই। বিশেষ করে তোমার হেয়ার স্টাইল। আজকে একদম অন্যরকম লাগছে।
হ্যা, মাত্রই চম্পা খালার কাছ থেকে সেজে আসলাম। উনি আমার বাসায় এসে আমাকে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
চম্পা মানে চম্পা ফার্নান্দেজ? সেই এংলো মহিলা?
হ্যা, উনিই তো আমার হেয়ার স্টাইলিস্ট!"

তপন তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। জিহান বলেই যাচ্ছে "খালা রিটায়ার করবে বলেছে। এরপর থেকে আপনার কাছে যেতে বলেছে। আপনার শিডিউল কবে ফ্রি বলবেন? চম্পা খালা বলেছে তার বাবার কাছে থাকবে এখন থেকে"।
"তুমি মনে হয় একটু বেশি পান করে ফেলেছ।বাসায় চলে যাও" -- একটু রূঢ় ভাবেই বল্লো তপন।

জিহান কিছু বোঝার আগেই হনহন করে হেটে তপন চলে গেল সামনে থেকে। কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে গেল জিহান।ফোর পয়েন্টস হোটেল থেকে বেরিয়ে ড্রাইভার কে ফোন দিল। ড্রাইভার জানালো রাস্তার অপর পাশে নিউজ পেপার স্ট্যান্ড এর সামনে গাড়ী রেখেছে।

ড্রাইভার কে কিছু বাছা বাছা গালি দিতে দিতে রাস্তা পেরুলো জিহান। পেপার স্ট্যান্ড এর সামনে এসে গাড়ীতে উঠলো।রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম।বসে বসে বোরড হতে হতে কি মনে করে যেন ডিএক্টিভেট করা ফেসবুক আইডি আবার চালু করলো ও। ২০০-৩০০ নোটিফিকেশান, ৫০০ মেসেজ ও অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট কে পাত্তা না দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ও টাইপ করলো "চম্পা ফার্নান্দেজ"

হোম পেজে গিয়েই দেখলো "Remembering Champa Fernandez".
৩ মাস আগের ডেট। ছোট একটা আপডেট।
"আমাদের প্রিয় চম্পা আপা আজ সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে তার প্রয়াত পিতার পাশে কবর দেয়া হয়েছে।"

মুখে মেকাপ, চোখে আই শ্যাডো, চুলে সুন্দর করে খোপা করা, পেডিকিউর মেনিকিউর করা হাত ও পা। ভয়ে আতংকে অসাড় হয়ে আসতে লাগলো ওর সকল বোধ বুদ্ধি। ড্রাইভার কিছু বোঝার আগেই গাড়ীর দরজা খুলে বের হয়ে গেল জিহান। চৌরাস্তার মাঝখান থেকে চম্পা খালা আর ওর বাবা মাকে দেখতে পেল। তিনজনই হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে, সবার পরনে সাদা পোশাক। চোখে মুখে প্রশান্তির ছাপ, কিন্তু আবার কেমন যেন একটা বেদনাও ফুটে উঠেছে।

ওদের দিকে এক অমোঘ আকর্ষণে এগিয়ে গেল জিহান। ঠিক সেই মূহুর্তে এক বেপরোয়া পাঠাও বাইক রাইডার ধেয়ে আসছিল রাস্তার ওপর দিক থেকে ...
(শেষ)

Sunday, July 22, 2018

Love the Blues

আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী জেমস এর একটি গান আছে, যার নাম "গিটার কাঁদতে জানে"। বাস্তবিকই, গিটার কাঁদতে জানে, এবং পারে শ্রোতাদের কাঁদাতে। হ্যা, আমি ব্লুজ সংগীত এর কথা বলছি। 

আমি মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই গান শুনে আসছি। শুরু করেছিলাম বনি এম, এবা দিয়ে। সেখান থেকে হেভি মেটাল, হার্ড রক, পপ, ক্লাসিক রক পার হয়ে তারপর সাইকাডেলিক রক, প্রগ্রেসিভ রক, ডেথ মেটাল এসবে গিয়ে একটা ব্রেক নেই। হঠাত ব্লুজ আর জ্যাজ ভাল লাগা শুরু করে। 

প্রথম যখন গ্যারি মুর এর "স্টিল গট দ্যা ব্লুজ" শুনেছিলাম, তখনো অনুধাবন করতে পারিনি ব্লুজ এর শক্তি। বি বি কিং শোনার পর থেকে জীবন পালটে যায়। মেটালিকা মেগাডেথ স্যাভাটাজ মরবিড এঞ্জেল এর শ্রোতা একজন থ্রিল ইজ গন শুনে চোখের পানি মুছে--এই দৃশ্য আমি আমার অবাস্তবতম স্বপ্নেও ভাবিনি! ২০১৫ সালে যখন বি বি কিং মারা যান, আমি সারাদিন নিস্তব্ধ ছিলাম। আমার জীবদ্দশায় বেশ কিছু প্রিয় শিল্পী পরলোক গমন করেন, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ ব্যাপারগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। 

আসলে ব্লুজ বলতে কি বোঝায়, তা কাউকে লিখে, কিংবা বলে বলে বোঝানো কঠিন। যদি আপনি যথেষ্ঠ পরিমাণে ব্লুজ শুনেন, তাহলে বুঝতে পারবেন উহা কি বস্তু। আমি এইটুকু বুঝি যে প্রতিটি ব্লুজ গানের মাঝে লুকিয়ে আছে "ব্লু", অর্থাৎ বেদনা। বেদনার রঙ নীল, এটি কে না জানে?  

হালের জনপ্রিয় নেটফ্লিক্স সিরিজ "লিউক কেইজ"। কাহিনীর উপজীব্য হচ্ছে একজন বুলেটপ্রুফ হিরো লিউক, যে কিনা কালো অধ্যুষিত হার্লেম অঞ্চলে থাকে। এই সিরিজটি ব্লুজ ভক্তদের জন্য খুব আনন্দদায়ক। কৃশকায়, বিশালদেহী নায়ক যখন ভিলেনদের কিলিয়ে ভর্তা বানায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্লুজ বাজতে থাকে। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। যাই হোক, এই লেখা শেষ করবো আমার প্রিয়, এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত ব্লুজ একক এর লিংক দিয়েঃ

https://youtu.be/4fk2prKnYnI


Thursday, July 19, 2018

২৪ ঘন্টা

২৪ ঘন্টা

আজকে দিনটি অন্যরকম ছিল সব দিক দিয়েই। সকালে এলার্ম এর শব্দটা কেন জানি শুনিনি। অনেকদিন ধরেই সকালে ঘুম থেকে ওঠার প্রয়োজনীয়তাটি নেই, কিন্তু তারপরেও কেন জানি মোবাইলের ৬ঃ৩০র এলার্ম টা বন্ধ করা হয়নি।

যখন ঘুম ভাংলো, তখন বাইরে ঝকঝকে রোদ, ঘড়িতে বাজে ৯ টা। "আম্মা নাস্তা দাও" বলতে গিয়েও বলতে পারলো না তানভির, কথা গুলো মুখের কাছে এসে আটলে গেল। মনে পড়লো, এই ডাকে সাড়া দেয়ার মানুষটি চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে আরো তিন হাজার ছয়শো ষাতষট্টি দিন আগে।

তবে অন্যদিনের মত মন খারাপ হল না, কারণ আজ আর ঘুম থেকে উঠে ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করা লাগছে না, পাশের রেস্তোরাঁ থেকে প্লেটে করে নাস্তা দিয়ে গিয়েছে আরও আধ ঘন্টা আগেই। রশিদ মিয়া কে বলা আছে, সে জানালা দিয়ে কিভাবে জানি প্লেট টা ঢুকিয়ে টেবিলে রেখে দেয়।

আজ মেনুতে পরটা ভাজি। ভাজি খেতে খেতে হঠাত আবিষ্কার করলো ভেতরে লুকিয়ে আছে ২/৩ টূকরো কলিজা গুর্দা। ও যারপরনাই বিস্মিত হল, কিন্তু সে ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নিয়েই খেয়ে নিল। এই কলিজার জন্য বাড়তি কোন বিল দিতে হবে না ওর, কারণ সে জানে এটি তার প্রতি রেস্তোরাঁ মালিক কলিমুদ্দিন এর ব্যখাতিত স্নেহের বহিঃপ্রকাশ। তবে এর আগে অল্প স্বল্প মাংসের হাড্ডি আর ঝোল পেলেও আস্ত কলিজার টুকরা এই প্রথম।

খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে গিয়ে কল থেকেই পানি পেল তানভির। এ আরেক বিস্ময়! এ সময়ে কলে পানি থাকে না বললেই চলে, প্রতিদিন বালতি থেকে জমানো পানি মগ দিয়ে তুলে তুলে প্রাতকৃত্য সারতে হয় তাকে। আজকে সেই ঝামেলা পোহাতে হল না একদমই।

আলনায় ঝোলানো শার্টখানা দেখে একটু অবাক হল সে।

"আরে এই শার্ট কোত্থেকে আসলো?"

কয়দিন আগে আব্বার পুরনো জিনিসপত্র ঘাটতে গিয়ে এই শার্টটি পেয়েছিল ও। হালকা সবুজ রঙ এর শার্টখানা দেখেই মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা। আম্মা সেদিন এই শার্ট টা বের করে রেখেছিল আব্বার জন্য। নাইট শিফটের ডিউটিতে যাওয়ার সময় এটা পড়বে। কোন এক বিচিত্র কারণে আব্বার মেজাজ সেদিন খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। কথা কথায় রেগে যাচ্ছিল। সবুজ শার্ট দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো, আর মায়ের সাথে চরম রাগারাগি করে কালো শার্ট খানা গায়ে চড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।

শার্ট হাতে নিয়ে পুরো দৃশ্যটা তার চোখে ভেসে উঠলো, যেন গতকালের ঘটনা। তখন তার বয়স ছিল ১১। সেই রাতে মদ্যপ ট্রাক ড্রাইভার কালো শার্ট পরা হাসিখুশি, আত্নভোলা মানুষটাকে দেখতে পায়নি। চার চাকার দানবটাকে আব্বার অপুষ্টিতে ভোগা রোগা শরীরের উপর দিয়ে স্টিম রোলারের মত চালিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। কাজটা স্টিম রোলারের মত হলেও ট্রাকের স্পিড ছিল বৈদ্যুতিক ট্রেন এর মত।

যাক, দুঃখের কথা মনে করে লাভ নাই। রঙচটা জিন্স এর সাথে সবুজ শার্ট পরে বাসা থেকে বের হল তানভির। হঠাত টের পেল, বুক পকেটটা কেমন ভারী ভারী লাগে। পকেটে হাত দিয়ে পাচশো টাকার চকচকে চারটি নোট পেল। এ যেন মেঘ না চাইতে জল!

নিজের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানিব্যাগ টা খুলে সযত্নে টাকাগুলো রেখে দিল সে। এ যেন স্বর্গ থেকে আশির্বাদ এর মত। ছেড়া ময়লা দুই আর পাঁচ টাকার নোটগুলোর পাশে চারটি চকচকে নোট একেবারেই মানালো না।

অনেকদিন পর জুলিয়া কে ফোন করলো তানভির। ফোন কানে রাখার প্রয়োজনবোধ করলো না সে। কখনোই সে এক রিং এ ফোন ধরে না। আরো সুষ্পষ্ট করে বলতে গেলে, প্রায় কখনোই ফোনটা ধরেনা সে। গত ছয় মাস ধরে এরকম চলছে।

শেষ দেখা হয়েছে কবে মনে পড়ছে না তানভির এর। তবে সে দেখা হওয়াটাও মজার ছিল। জুলিয়া ওকে দেখেই বলে উঠলোঃ

"একদিনও কি আমার আগে আসতে পারো না? কি নিয়ে তুমি এত ব্যস্ত?"

কৈফিয়ত দেয়ার আগেই থামিয়ে দিল ওকে জুলিয়া। মোবাইল এর কল লিস্ট বের করে দেখালো।

"দেখেছ কাকে কল করছি গত ২০ মিনিট ধরে?"
"হ্যাঁ, আমাকে। কিন্তু আমার নাম V. Tanvir নামে সেইভ করেছ কেন?"
"করেছি কারণ আমি আরেকটা তানভির কে চিনি। সে হচ্ছে তানভির, জাস্ট তানভির। আর তুমি হচ্ছ ভেদাইম্মা তানভির। তাই ভি তানভির নামে সেইভ করেছি"।

অন্যমনষ্ক অবস্থায় হঠাত খেয়াল করলো তানভির যে কল রিসিভ করেছে জুলিয়া, আর ৩০ সেকেন্ড চলেও গিয়েছে। তাড়াতাড়ি মোবাইল কানে দিল সে।

"কি ভাই, ফোন দিয়ে কথা বল না কেন? সমস্যা কি?
কিছু না। কখনো তো একবারে ধর না।
তাই বলে রিসিভার কানে রাখবে না?
আচ্ছা ক্ষমা চাই, ক্ষমা।
ক্ষমা চাইলে হবে না, খাওয়াতে হবে।
আমি রাজি। কোথায় খাবে?
তুমি তো জানই কই খেতে চাই।
ইয়ে মানে, ভেদাইম্মার সাথে লাঞ্চ করলে তোমার মান ইজ্জত যাবে না?
Dude, don't push your luck. Don't be late"

আমারি হোটেল এর রুফটপ। সন্ধ্যায় বেশি জমে। তবে আজ দুপুরেও খুব ভাল লাগলো।

প্রথম বারের মত বুকে সাহস নিয়ে বিল দিতে চাইলো তানভির, কিন্তু অন্য সব দিনের মত আজকেও ওর চকচকে নোটগুলো ইগ্নোর করে নিজের প্লাটিনাম কার্ডটি এগিয়ে দিল জুলিয়া।

"আমি আসলে তোমার কল ধরবো ভাবি নাই। হঠাত কি মনে হল, রিসিভ করলাম। এতদিন পর ফোন করলে?
ইয়ে না, মানে, ব্যস্ত থাকি অনেক।
আমি বলেছি না আমার কাছে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স এর গল্প না করতে?
হুম। ওকে, মনে থাকবে!
এইসব বাদ দাও। আমাকে সময় দাও। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে। তোমার র‍্যান্ডম আচরণের কারনে বলতে পারি না।"

তানভির আর কিছু বল্ল না। নিস্তব্ধতা অনেক সময় অনেক কিছু অনেক ভাল ভাবে প্রকাশ করতে পারে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাসায় ফেরার পালা। ওকে মহাখালী টিএন্ডটি কলোনীর মাঠের পাশে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল জুলিয়া।একটু সামনেই ওদের বাসা।

গোধুলী বেলার এই সময়টা খুব তার খুব প্রিয়। মাঠে বাচ্চারা দাপাদাপি করে ফুটবল খেলছে। সবাইকে বাচ্চা বলাটা ঠিকও হচ্ছে না। কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেরাও খেলছে। বেশ সুসংহত ভাবে খেলা হচ্ছে। দু'টি দলের আবার জার্সি ও আছে দেখা যায়। একজন তাগড়া ধরণের রেফারী ও দেখা যাচ্ছে।

সারাদিনের কথা চিন্তা করতে করতে হেটে যেতে লাগলো সে। এরকম সুপ্রসন্ন ভাগ্য ওর অনেকদিনের মাঝে আসেনি। চায়ের দোকানে তিনশো টাকা বাকি পড়ে গিয়েছে, আজ সেটাও শোধ করে দিবে ও।

হঠাত জোরালো বাশীর শব্দ শুনতে পেল তানভির। খেলা শেষ হল বোধহয়। এরকম লম্বা বাশী তো খেলা শেষ না হলে বাজানো হয় না। বাঁশী শুনতে শুনতে মন্ত্রমুগ্ধ তানভির খেয়াল করলো না ছুটে আসা প্রাইভেট কার এর বিকট হর্ণ ধ্বনী।

এরপর শুধু আধার আর আধার।এই সব না, সব কিছুই বাদ দিতে হল।

Friday, June 08, 2018

দেরী

রহমান সাহেব কাজ করছেন। নিবিড় মনে। অফিসে উনার সমসাময়িক প্রায় সবাই ল্যাপটপ পেলেও উনি এখনো কাজ করেন পুরনো ডেস্কটপ পিসিতে। অফিসের জ্যেষ্ঠতম নয় বলে শুধু, অনেক সততা এবং কর্মদক্ষতার কারণেই সবার শ্রদ্ধার পাত্র উনি। সকালে সবার আগে আসেন অফিসে, বের হন সবার শেষে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ ঘন্টার মত অফিস করেন উনি। বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠান্ সপ্তাহে দু'দিন বন্ধ থাকলেও প্রায় শনিবারেই উনি হাজির হয়ে যান পরের সপ্তাহের কাজ এগিয়ে রাখার জন্য।সপ্তাহে ৭২ ঘন্টা।

লাঞ্চ টা টিফিন কেরিয়ারে করে দিয়ে যায় "মায়ের হাতের খাবার" নামের ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে। খাবার আসে ঠিক দুপুর ১ টায় এবং উনি ১৫ মিনিটে খাওয়া শেষ করে নামাজে দাড়ান। নামাজ সেরেই আবার কম্পিউটার এর সামনে বসে যান, আর শুরু হয় কিবোর্ডের উপর খটাস খটাস শব্দ আর মাউস এর ক্লিক ক্লিক শব্দ। এক্সেল ফাইলে জমা হতে থাকে হাজার হাজার সংখ্যা আর হতে থাকে কোটি কোটি টাকার হিসাব।

প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, কেউ কোনদিন এই রুটিনের ব্যত্যয় দেখেনি।শুধু একবার এক ডেলিভারী বয় আসার পথে গাড়ী চাপা পড়েছিল দেখে সেদিনের খাবার আসেনি। রহমান সাহেব অগ্নি মূর্তির মত কিছুক্ষন ঘড়ির দিকে চেয়ে থেকে আবার কাজে ফিরে যান। পরের সপ্তাহ থেকে নতুন একটি ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে খাবার আসা শুরু করে।

সেদিন ছিল খুব ঝামেলাপূর্ণ একটি দিন। সকাল থেকেই একটি হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছিলেন রহমান সাহেন। প্রায় ২০ লাখ টাকার হিসেবে গড়মিল। দেখা যাচ্ছে এমডির সাক্ষরের মাধ্যমেই এই টাকা টা তোলা হয়েছে, কিন্তু সেটার স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরুপ ওয়ার্ক অর্ডারটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে এমডির কাছে যাওয়ার আগে উনার নিজের নিজের হাত ধরেই যায় এই নির্দেশগুলো। তিনি সিস্টেমে দেখলেন যে তার এপ্রুভাল এর পরেই টাকাটা উত্তোলিত হয়েছে, কিন্তু সেটার নিয়মতান্ত্রিক কোন রেকর্ড নেই।

হঠাত ডেস্ক ফোনে কল এল। রিসিভ করেই এমডি জাহাংগীর সাহেব এর বাজখাই কন্ঠ শুনতে পেলেন তিনিঃ
"রহমান সাহেব, জলদী আমার রুমে আসেন"।

তারপরের ঘটনা আর স্পষ্ট মনে নেই। বয়সে ছোট হয়েও বস হয়ে যাওয়া জাহাংগীর সাহেব এর কাছে যখন একের পর এক বকা ও অভিসম্পাত শুনতে থাকলেন, তখন তার মনে হল চারপাশের দেয়াল থেকে পাথর খসে খসে পড়ছে মাথায়। একটা সময়ের পর আর কিছু শুনতে পেলেন না তিনি। আনমোনা হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন শেষ হবে এই অত্যাচার। হঠাত টের পেলেন তার ঘাড় ধরে ঝাকাচ্ছেন এমডি সাহেব।

"শুনেন, আপনি পুরনো কর্মচারী। লোকাল কোম্পানীতে কাজ নিয়েছিলেন, তখন কেউ এত খুঁটিনাটি হিসাব করতো না। কিন্তু বহুজাতিক হবার পর এখন আর আপনার মত ট্র্যাডিশনাল এমপ্লয়িদের উপর ভরসা করা যায় না। তাও আমরা আপনার উপর আস্থা রেখেছি এতকাল আগের দিনের কথা ভেবে। সামান্য কয়টা টাকার জন্য আপনি এরকম করবেন, এটা কষ্মিনকালেও ভাবিনি! আপনি হয় হিসেব টা মিলিয়ে দেন, অথবা টাকাগুলো ফেরত দিয়ে যান। আমার হাতে হাতে দিবেন, কেউ জানবে না কিছু। আপনি আপনার চাকরী ও রক্ষা করতে পারবেন, সম্মান ও অটুট থাকবে। আর যদি মনে করেন টাকা দিতে পারবেন না, তাহলে আর রবিবার থেকে আসার দরকার নেই অফিসে। আমরা বিভাগীয় তদন্ত করে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব"।

বাকিটা সন্ধ্যা কাটলো ঘোরের মধ্যে। রহমান সাহেব নিজের ডেস্কে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। সেদিন ছিল সপ্তাহের শেষ দিন। একে একে কর্মচারীরা সবাই বিদায় নিল। ততক্ষণে অফিসে সবাই জেনে গিয়েছে কাহিনী। যাওয়ার পথে অনেকেই উনার দিকে কটাক্ষমূলক দৃষ্টি তে তাকালো, চল্ল কানাঘুষা, আর অল্প দুই একজন, বিশেষ করে যারা পুরনো, তারা কিঞ্চিত করুণার দৃষ্টিতেও দেখলেন উনাকে।

এক পর্যায়ে রহমান সাহেব এর মনে হল উনি পারবেন। চালু করলেন আবার কম্পিউটার। এক ফাইল থেকে আরেক ফাইলে উড়ে যেতে লাগলেন তিনি। উনার দৃঢ় বিশ্বাস কোথাও কোন ভুল হয়েছে। নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ করতে লাগলেন। চারপাশে নিভে যেতে লাগলো এক এক করে বাতি, উনার হুশ নেই।
"ইউরেকা! পেয়েছি এবার!"

ফাইল সার্ভারের এক কোণায় পড়ে থাকা একটি গোপন ফাইল খুঁজে পেলেন রহমান সাহেব। খুলতে গিয়ে দেখলেন পাসওয়ার্ড দেয়া। iamtheboss টাইপ করতেই খুলে গেল ফাইলটি। পড়তে পড়তে রহমান সাহেব এর মুখে ফুটে উঠলো অনাবিল হাসি।

"পেয়েছি এবার বেটাকে! আমার সাথে মামদোবাজি! এই জিনিস হেডকোয়ার্টারে পাঠালে তো তোরই চাকরী থাকবে না। অতি উতসাহের সাথে প্রিন্ট দিলেন উনি ফাইলটির গুরুত্ত্বপূর্ব অংশগুলোর। উদ্দেশ্য প্রিন্ট আউট নিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হওয়া। সব ঠিক ঠাক থাকলে রাতেই উনি এই ফাইলগুলো রিজিওনাল হেড কে পাঠিয়ে দিবেন। বস কে সিসি তে রাখবেন কি না ভাবতে ভাবতে এগুলেন প্রিন্টার এর দিকে।

প্রিন্টার টা রুমের একদম শেষ মাথায়। হেটে যেতে যেতে খেয়াল করলেন পুরো অফিস গমগম করছে মানুষে। কাউকেই তেমন একটা চিনতে পারলেন না। বুঝে পেলেন না কোন দিক দিয়ে সকাল হয়েছে। কিন্তু...শুক্রবারে তো অফিসে এত লোক থাকে না। কেউ তাকে লক্ষ্যও করছে না। হঠাত মনে হল কে জানি উনার দেহের ভেতর দিয়ে চলে গেল। একটি উদ্ভিন যৌবনা নারী। কিন্তু উনি কোন সাড়া পেলেন না, মেয়েটাও একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির সাথে ধাক্কা খাওয়া সূচক কোন আচরণ করলো না।

যেখানে প্রিন্টার থাকার কথা, সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করলেন একটি উচু টেবিল রাখা, আর তার উপর একটি কালো রঙ এর অচেনা একটি মেশিন রাখা। সেখান থেকে প্লাস্টিকের কাপে ঢেলে ঢেলে কি জানি পান করছে ৩-৪ জন। উনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। বলে উঠলেনঃ

"এই যে ভাই, প্রিন্টার টা কোথায় সরিয়েছে বলেন তো? আমি খুব জরুরী কিছু ডকুমেন্ট প্রিন্ট দিয়েছি!"
কেউ তার কথা শুনতে পেল না। এবার প্রথম বারের মত তিনি উদ্বিগ্ন হলেন। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফিরে গেলেন নিজের ডেস্কে। চেয়ারে বসতে গিয়ে হোচট খেলেন। উনার ডেস্কটির চারপাশে কর্ডন দেয়া। এক ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন উনার সেই চিরপরিচিত চেয়ারটি রয়েছে, এবং পিসিটিও রয়েছে অক্ষত। পাশে একটি ছোট কাগজে অনেক কিছু লেখা। উনার নেম প্লেট টিও আছে অক্ষত "এম এম রহমান, সিনিয়ার একাউন্টস অফিসার"। দড়ির নিচ দিয়ে ভেতরে গেলেন তিনি।

কাগজে লেখাঃ
"এম এম রহমান (জন্ম ২১/২/১৯৬২, মৃত্যু ১/৬/২০১৮)"
রহমান সাহেব ছিলেন একবিংস শতাব্দীতে এই কোম্পানীর একমাত্র ডেস্কটপ ইউজার। আমাদের অত্যন্ত সৎ এবং নিষ্ঠাবান, চিরকুমার এই মিষ্টভাষী কলিগটি কাজ করতে করতেই মৃত্যমুখে পতিত হন। ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা যায় যে অতিরিক্ত কাজের চাপজনিত টেনশান থেকে উনার স্ট্রোক হয়, এবং তাতেই উনি মারা যান।

উনি মারা যাওয়ার পর বহুদিন পর্যন্ত এই ডেস্কে কেউ কাজ করতে পারেনি। সবাই বলতো তারা কিবোর্ড এর খটাশ খটাশ শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সারাক্ষণ, আর কেউ কেউ প্রিন্ট হওয়া কিছু কাগজও দেখতে পায় ডেস্কের উপর ছড়ানো, কিন্তু কাগজ ধরতে গেলেই সেগুলো ভ্যানিশ হয়ে যেত।

আমরা একটি প্রগতিশীল বহুজাতিক সংগঠন হিসেবে আদিভৌতিক কোন ব্যাপার কে অবশ্যই প্রমোট করতে চাই না, তবে রহমান সাহেব এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক এবং তাকে নিয়ে চালু ভুতের গল্প গুলোকে অফিসের গসিপ হিসেবে চিরস্থায়ী করার জন্য উনার ওয়ার্কস্পেস কে যাদুঘর এর মর্যাদা দেয়া হল।"

রহমান সাহেব এর পুরো দুনিয়া টলে উঠলো। লেখাগুলো আবার পড়লেন উনি। কোন রহমান এইটা? কি কাহিনী? একই নামে আরেকজন? আমি কি ভুল অফিসে?

হঠাত চোখ গেল ক্যালেন্ডারের পাতায়। সেদিনের তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০৩০।
১২ বছর লাগলো বস এর চুরি ধরতে? একটু বেশিই দেরী হয়ে গেল মনে হয়।
মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন রহমান সাহেব। শরীরে কোন বোধ নেই।
(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে লাগলো U2 band এর Stuck In a Moment গানটি। আস্তে আস্তে লিরিক্স শুনা যাচ্ছেঃ
You've got to get yourself together
You've got stuck in a moment
And now you can't get out of it
Don't say that later will be better
Now you're stuck in a moment
And you can't get out of it)

রহমান সাহেব এর মনে পড়ে গেল সব। উনার নিথর দেহ নিয়ে মর্গের ডাক্তার দের টানাটানি, নির্মম ছুরি প্রয়োগ, কবরে নামিয়ে দেয়ার সময়ের দুঃসহ স্মৃতি, লাশের চা এর কটু গন্ধ। মোনাজাত এর সময় বস এর মেকি কান্না, কয়েকজন কলিগের সত্যিকারের অশ্রু, আর তেমন কিছু না।

সারা জীবন কাজের পেছনে ছুটে গেলেন, কি পেলেন জীবনে? একটি মুহুর্তের মাঝেই আটকে রইলো জীবন টা।