Saturday, October 06, 2018

Beirut Diary 8

আগেরদিন রাতেই একজন ট্যাক্সি চালকের সাথে কথা বলে রেখেছিলাম। পূর্ব কথা অনুযায়ী সে তার ছোটখাট নিসান সেডান গাড়ীটি নিয়ে সকাল সকাল আমার এপার্টমেন্ট এ হাজির হয়েছিল। আমি বলেছিলাম ৯ টায় আসতে, কিন্তু অলস আমার নামতে নামতে ৯ঃ৩০ বেজে গেল। হাস্যমুখী চালক এর কাছে সরি বলা শেষ করতে না করতেই সে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে নাড়তে "নো প্রব্লেম, নো প্রব্লেম" বলতে লাগলো।

জেইতা গ্রটো বৈরুত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে। শহর থেকে বের হয়ে সুন্দর একটা রাস্তা ধরে যেতে হয়। আমার সাথে একটা পয়েন্ট এন্ড শুট সনি ক্যামেরা ছিল। সম্ভবত ৮ মেগাপিক্সেল এর। বছর দুয়েক আগে দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে কেনা।

সে যুগে মোবাইলে খুব ভাল ক্যামেরা থাকতো না; আমার নোকিয়া 6230 মোবাইল টিতে ভিজিএ ক্যামেরা ছিল, যা সুন্দর ছবি তোলার জন্য যথেষ্ঠ ছিল না।

যেতে যেতে আমি প্রচুর ছবি তুলছিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বেশ মজা পাচ্ছিল। সে নিজেই কয়েকবার গাড়ী থামিয়ে আমাকে বলেছিল "Take photo here, good view". আমিও তার নির্দেশনা অনুযায়ী ছবি তুলে নিলাম বেশ কিছু।

শহুরে ট্রাফিক জ্যাম এর কারণে প্রায় ঘন্টা খানিক লাগলো ওখানে পৌছাতে। মাঝের ছবি তোলার বিরতী গুলো তো ছিলই।

দু'টি আলাদা আলাদা চুনাপাথরের গুহা নিয়েই জেইতা গ্রটো। সম্মিলিত যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার এর মত।

টুরিস্ট দের জন্য দু'টি অংশ খোলা--একটি "আপার গ্যালারী", আর আরেকটি "লোয়ার কেইভস"। গেটের ঠিক বাইরেই বেশ আগ্রহউদ্দিপক একটি শ্বেত শুভ্র মূর্তি স্থাপনা দেখা যায়।

সময়ের প্রহরী বা "গার্ডিয়ান অফ টাইম" নামক এই সুবিশাল মূর্তিটির উচ্চতা ৬.৬ মিটার এবং ওজন প্রায় ৬৫ টন। মূর্তিটি দেখে আমার সত্যি সত্যি গায়ে কাটা দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল যেন সিনেমার স্ক্রিণ থেকে বের হয়ে এসেছে কোন প্রহরী।

গ্রটোর ভেতরে যাতায়াত এর জন্য রয়েছে রেলগাড়ী সার্ভিস, এবং এছাড়াও টুরিস্ট দের মনোরঞ্জনের জন্য স্যুভেনির শপ, রেস্তোরাঁ, ইত্যাদি সুবিধাও রয়েছে। রেলগাড়ীটা অনেকটা শিশু পার্ক এর রেলগাড়ীর মত, তবে আরো বড় এবং মজবুত প্রকৃতির।

আপার গ্যালারী জায়গাটাকে খুব বিশেষ কিছু মনে হয়নি। গুহার মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির বড় বড় পাথর। পুরো জায়গাটি অবিচ্ছিন্ন, কিন্তু কোথাও কোথাও যাত্রাপথ সরু হয়ে ফটকের মত হয়ে গিয়েছে, যার কারণে মনে হয় ছোট ছোট ঘরে ভাগ করা জায়গাটি।বর্ণনার সুবিধার্থে ঘরই বলি। 

একেক ঘরের দেয়ালের চেহারা একেক রকম। কোনটায় সাদা সাদা, কোনটায় হলদেটে, আবার কোনটা লালচে রঙের পাথরে ভর্তি। বেশ বৈচিত্রময় ব্যাপার স্যাপার।

পনের জন করে একেকটি গ্রুপ এর সাথে একজন করে গাইড ছিল। আমার মত একাকী আর তেমন কেউ আসেনি, সবাই আত্নীয় বন্ধু নিয়েই এসেছে উইকেন্ড কাটাতে। এ কারণে আমাকে কেউ খুব একটা গ্রাহ্য করছিল না, আর আমিও তাদের কথায় খুব একটা কর্ণপাত করছিলাম না। আমি "অনেকের মাঝে একা" মোডে ভালই ছিলাম।

প্রথমে গাইড সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেছিল "এখানে কি সবাই আরবী পারেন?"। আমি একমাত্র না বোধক ইশারা দেয়ায় সে এবং আমার বাকি ১৪ জন সংগী (!) যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিল। এই একটা ব্যাপার আমাকে একাধারে মুগ্ধ এবং অবাক করতো। একজনও আরবী না জানা মানুষ থাকলেও গাইড দের ওপর কড়া নির্দেশনা ছিল তারা যেন মাতৃভাষা ব্যবহার না করে।

যথারীতি বিশেষ আরবীয় এক্সেন্ট সহযোগে গাইড এর ইংরেজী বচন অল্পক্ষণ শুনেই আগ্রহ হারিয়েছিলাম। কোন পাদ্রী কবে পা ফস্কে পড়ে গিয়ে এই গুহা আবিষ্কার করেছিল, সেই ইতিহাস জেনে কি হবে? তারচেয়ে মন ভরে আশে পাশের অপরুপ দৃশ্য গুলয় মনে গেথে নেয়াই শ্রেয় মনে করলাম।

হঠাত সবাই থেমে গেল। আমি সামনের সুবেশী লেবানীজ রমণীর পায়ে পাড়া দিতে দিতে কোন মতে ব্রেক কষলাম। জিজ্ঞাসু নেত্রে গাইড এর দিকে চাইলাম। সে বল্ল "দিস ইজ দ্যা এনদ অফ যে রোড"। আমি বললাম "You mean?".

"Now you gotta get down and ride a boat".

এ পর্যায়ে একটা কথা বলে রাখা দরকার। আপার গ্যালারি তে ঢোকার আগেই আমার (এবং বাকি সবার) ক্যামেরা সমূহ বাজেয়াপ্ত করা হয়, এবং ধরিয়ে দেয়া হয় একটি করে টোকেন। আমি প্রতিবাদ করতে গেলে তারা বল্ল "তোমার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আমাদের জাতীয় সম্পদ এর ক্ষতি করবে। সুতরাং ক্যামেরা এলাউড না"। একই ধরণের ফাইজলামি আচরণ এর শিকার হয়েছিলাম কায়রো যাদুঘরে; চার বছর আগের তুতানখামেন এ







র স্বর্ণ খচিত মূখোশের সাথে ছবি তুলতে না পারার ক্ষত তখনো শুকায়নি--আর সেদিন আবার নতুন করে সেই ক্ষতস্থানে আঘাত পেলাম। জেইতা গ্রটোর গেট এর বাইরে তোলা কিছু ছবিই রয়ে গেল স্মৃতি হিসেবে।

সে যাই হোক, গাইডের কথা মত নৌকায় উঠলাম। নৌকা না বলে ভেলা বলাই ভাল। সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দেয়া হল, এবং মনে করিয়ে দেয়া হল যে গুহার মদ্ধ্যে ছবি তোলা নিষেধ। মজার ব্যাপার হল যে কোন নৌকাতেই কোন মাঝি টাইপ লোকজন নেই। টুরিস্ট দের নিজেদেরই বৈঠা দিয়ে নৌকা চালিয়ে এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে যেতে হবে।

গুহার ভেতরে বেশ অন্ধকার, কিন্তু তার মাঝে মাঝে হালকা কিছু কৃত্তিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পানিতে তেমন কোন স্রোত নেই। আমার নৌকাটিতে আরো ৪ জন উঠেছিল; আমরা সবাই বেশ উতসাহের সাথে বৈঠা ঠেলছিলাম, কিন্তু তবুও গতি বেশ মন্থর ছিল।

বৈঠা ছেড়ে চারপাশের দৃশ্যাবলীর দিকে মনোযোগ দিলাম। নৌকা চালানোয় আমার অনাগ্রহ দেখে একজন আরবী তে ইয়াল্লা ইয়াল্লা টাইপ কি জানি একটা বল্লো, কিন্তু আমি তাকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করলাম।সেও আমাকে আর ঘাটালো না।

নিজেকে মনে হচ্ছিল লর্ড অফ দ্যা রিংস সিনেমার কোন এক চরিত্র। সুপ্রাচিন এক গুহার মধ্যে দিয়ে নৌকা বেয়ে চলেছি, সাথে রয়েছে মহামূল্যবান রিং। সারাক্ষণ আশংকা, কখন পেছন থেকে আততায়ীরা হামলা করবে। অপার্থিব নিরবতা বলে একটি শব্দ সেদিনই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল।

ছোটবেলায় ভূগোল বই তে পড়েছিলাম stalactite stalagmite শিলার কাহিনী। তখন নিরীহ ছিলাম, ছোট ছিলাম, শিলা শুনলে পাথরের কথাই মনে পড়তো, মনের মধ্যে বেজে উঠতো না কোন চটুল হিন্দী গানের লিরিক। সে যাই হোক, বিভিন্ন আকৃতি ও বয়সের শিলা দেখতে দেখতে এগুতে লাগলাম। কোনটার উপর আলো পড়লে রঙ বদলে যায়, আবার কোনটা দূর থেকে একরকম আবার কাছে গেলে অন্যরকম। বাস্তবিক, এরকম কোন দৃশ্যের সাথে আমার এর আগে পরিচয় হয় নি।

হঠাত অনেক আলো এসে চোখ ধাধিয়ে দিল। সাথে অনেক মানুষের কোলাহল। পথের হল শেষ। নৌকা থেকে নেমে জানতে পারলাম যে চাইলে আবার একই পথে ফিরে যাওয়া সম্ভব, অথবা এদিক দিয়ে বের হয়ে সরাসরি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেও চলে যাওয়া যায়।

ততক্ষণে শরীরে নেই এনার্জী, খুধাও লেগেছে বেশ। টোকেন ফেরত দিয়ে ক্যামেরা ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে একই ট্যাক্সিযোগে বাসার দিকে রউনা দিলাম। বাসায় গিয়েই খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ার ইরাদা।

(চলবে)






No comments: