Friday, October 26, 2018

ট্রিবিউট টু এবি

উনার সাথে প্রথম দেখা ২০০০ সালে। এর আগেও উনার শো দেখেছি, কিন্তু একদম কাছে থেকে দেখার সুযোগ এর আগে পাইনি। আমার তৎকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি রেওয়াজ ছিল যে নতুন ব্যাচ ভর্তি হলে বিসিআইসি ভবনের অডিটোরিয়ামে একটা ঘরোয়া কনসার্ট এর মাধ্যমে তাদেরকে বরণ করে নেয়া। এই শো গুলো অন্য ব্যান্ড কনসার্ট এর মত হোত না কখনোই। ব্যান্ড অনেক আয়েশী আমেজে থাকতো আর খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে তারা পারফর্ম করতো।

প্রতি বছরই এই শো হোত, এবং বরাবরের মত সেবারও পছন্দের ব্যান্ড ছিল এলআরবি। শুনেছিলাম শো ৭টা থেকে শুরু হলেও ব্যান্ড সদস্যগণ আরো অনেক আগেই চলে আসবে ভেনুতে--প্র্যাক্টিস এবং জ্যামিং করার জন্য। বাচ্চু ভাইকে একদম সামনে থেকে দেখতে পাওয়ার অতি আগ্রহে আমি আর আমার কিছু বন্ধু বেলা ৩টায় চলে গেলাম ভেনুতে। পৌছুনোর কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম ব্যান্ড এসেছে। বাচ্চু ভাই ও অন্যরা ব্যাকস্টেজে তাদের বাদ্যযন্ত্র সহ চলে গেলেন।

ব্যাকস্টেজ এরিয়াতে সাধারণত ভলান্টিয়ার কিংবা ব্যান্ড এর সদস্য, ম্যানেজার ও অন্যান্য স্টাফ ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। আমি সামান্য বুদ্ধি খরচ করে একটি ভলান্টিয়ার ব্যাজ জোগাড় করলাম। কিছুক্ষণ পর সাহস করে ঢুকে পড়লাম সেখানে।

লক্ষ্য করলাম বাচ্চু ভাই তার তখনকার ট্রেডমার্ক টুপি পড়ে আছেন। উনি উনার ব্যান্ড কে নিয়ে একটা লম্বা টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে রয়েছেন। জমেছে জম্পেশ আড্ডা, আর সাথে রয়েছে চিকেন ব্রোস্ট। সে আমলে হেলভেশিয়া ও কলাবাগানের "মিল ইন আ বক্স" ছাড়া আর কোথাও চিকেন ব্রোস্ট পাওয়া যেত না। সেই নির্দ্রিষ্ট ব্রোস্ট এর প্যাকেটখানা কোথা হতে আনা হয়েছিল তার আর আজ মনে নেই, কিন্তু বাচ্চু ভাই এর টেবিল মাতানো আড্ডার কথা ভুলিনি।উনি একটি মজার গল্প বলছিলেন আর সবাই হাসছিল তার কথা শুনে।

হঠাত টের পেলাম রুমে পিনপতন নিরবতা। আমি সম্ভবত ম্যানেকুইন স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। খেয়াল করলাম বাচ্চু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কি জানি বলছেন। ১৯ বছরের আমি ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে উনি আমাকে বলছেন "কিছু বলবেন ভাই?"।

আসলে আমার ইচ্ছা করছিল উনার সাথে এক্টূ কথা বলতে। জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম উনার ডায়ার স্ট্রেইটস, ডিপ পার্পল আর আয়রন মেইডেন কেমন লাগে। কোন ইংরেজী গান রিকুয়েস্ট করলে কি বাজাবেন নাকি? কিন্তু আমি "সরি" বলে ভেগে যাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না।

অডিটোরিয়ামে গিয়ে আসন গ্রহণ করলাম বন্ধুদের সাথে। ওদেরকে আর বললাম না আমার অভিজ্ঞতার কথা। একটু পরে দেখলাম এলআরবি এসে স্টেজে উঠলো। কিছুক্ষণ পর বেজে উঠলো ডায়ার স্ট্রেইটস এর "Wild West End" গানটার গিটার সলো। বাচ্চু ভাই একাই বাজালেন কিছুক্ষন, তারপর বাকি ব্যান্ড উনার সাথে যোগ দিল। গানেরও দুই এক লাইন গাইলেন। তখনো হল খালি। শো শুরু হয় নি। চলছিল সাউন্ড টেস্ট আর জ্যামিং।

তিনি একে একে গেয়ে ও বাজিয়ে গেলেন স্মোক অন দ্যা ওয়াটার, কমফর্টেব্লি নাম্ব, ওয়েলকাম টু দ্যা জাংগেল, সুলতান্স অফ সুইং, উইদ অর উইদাউট ইউ সহ আরো অনেক বিখ্যাত ইংরেজী গানের অংশবিশেষ।
বাচ্চু ভাই যে কত বড় মাপের একজন গিটারিস্ট, সেটা সেদিন খুব ভাল ভাবে অনুধাবন করেছিলাম। অবলিলায় উনি হয়ে যাচ্ছিলেন মার্ক নফলার, ডেভিড গিলমোর, স্ল্যাশ এবং আরো অনেকে। এল আর বি ব্যান্ড প্রায় কখনোই কনসার্টে কাভার সং করতো না, কিন্তু এ ধরণের ঘরোয়া শো গুলোতে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল।
ঠিক ৭টায় শো শুরু হল। শুরুতেই বাচ্চু ভাই সুন্দর করে বললেন "আপনাদের জন্য পছন্দের গানগুলো গাইবো। আপনারা তো ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করেন, নিশ্চয় ইংরেজী গান বেশী পছন্দ। আমাদের হিট গানের পাশাপাশি আজ আমরা অনেক কভার সং ও করবো"।
এর পরের ৩-৪ ঘন্টা কোন দিক দিয়ে গেল টের ও পেলাম না। উপরে উল্লিখিত ইংরেজী গানসমূহ ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিখ্যাত গান ও এল আর বি ব্যান্ড এর বেশিরভাগ হিট গান গেয়ে ফেললেন বাচ্চু ভাই, তেমন কোন ব্রেক না নিয়েই।

শো এর শেষ গান "সেই তুমি" উনাকে গাইতেই হোল না প্রায়, হল ভর্তি নতুন পুরাতন ব্যবসায় প্রশাসনের ছাত্ররা গেয়ে গেল পুরো গানটা। ওয়ান মোর ওয়ান মোর রব তোলাতে গিটারের মূর্ছনায় ও ফেরারী মন এর করুন সুরে হল ভরে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেও।
গান শেষে সবার চোখে পানি। এমন আবেগ খুব বেশি অনুভব করিনি জীবনে।বাসায় ফেরার পথে সারাক্ষণ কানে বাজছিল সেই গানগুলি। এরপরেও এলআরবির অন্য আরো অনেক শো দেখেছি, কিন্তু এরকম হৃদয়স্পর্শী পারফরম্যান্স আর দেখিনি।
আফসোস, বড় ক্ষণজন্মা ছিলেন উনি। উনার কাছে আমাদের যেই ঋণ, তা কখনোই শোধ করতে পারিনি আমরা। একদিকে উপভোগ করেছি উনার গান, আর আরেকদিকে তাকে দিয়েছি গালি, আর করেছি তার চরিত্র হানি। আল্লাহ উনার আত্না কে শান্তিতে রাখুন। আমিন।

(বহুদিন আগের স্মৃতি। কিছু ডিটেইলস এদিক ওদিক হয়ে থাকতে পারে)

No comments: