Wednesday, October 23, 2019

লেনন কাহিনী



অন্য যেকোন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মতই তার বড় হয়ে ওঠা ইংল্যান্ডের লিভারপুল শহরে । ব্যতিক্রম হল, শৈশবে বাবা মায়ের আদর স্নেহ না পাওয়া। বাবা আলফ্রেড আর মা জুলিয়ার ঝামেলাপূর্ণ দাম্পত্য জীবন এবং বিবিধ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জন তার খালা মিমির কাছেই বড় হন।

মিমি যখন জন কে শাস্তি দিতে চাইতেন, তখন তাকে অবজ্ঞা করতেন। জন যতই তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন, মিমি ততই তার অন্যান্য কাজে বেশি করে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। এটি ছিল জনের জন্য সর্বাধিক হৃদয়বিদারক। স্নেহের জন্য বুভুক্ষু ছিল তার মন, আর অবজ্ঞার শিকার হয়ে সে খুব দ্রুতই দিশেহারা হয়ে পড়তো এবং বলতেও থাকতো 

"Don't 'nore me mimi, don't 'nore me". 

Ignore টা ঠিক মত বলতে পারতো না। শিশু কন্ঠে তা "নোর" এর মত শোনা যেত।সে কথাগুলোই হুবহু উঠে এসেছে খালা মিমির স্মৃতিচারণে।

খালার কাছে বড় হলেও জন লেনন এর জীবনে তার মায়ের অবদান কে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। শৈশবে খালার বাসায় থাকলেও একটু বড় হবার পর মায়ের সাথে নিয়মিত দেখা হোত জন এর। কোন কোন দিন গিয়ে মায়ের বাসায় ও থাকতেন, যেখানে তার তৎকালীন পার্টনার এবং দুই মেয়ে (অর্থাৎ জন এর সৎ বোনেরা) ও থাকতেন।

জুলিয়ার বাসার বাথরুমের সামনে গিয়ে পল ম্যাকার্টনি (বিটলস এর অন্যতম সদস্য এবং জন এর বন্ধু) এবং জন গান গাওয়া ও গিটার বাজানো প্র্যাক্টিস করতেন--সেই বাথরুমে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে নাকি লাইভ মিউজিকের মত একটি আবেশ তৈরি হোত।

জুলিয়াই জন কে তার প্রথম গিটারটি কিনে দিয়েছিলেন। তিনি তাকে উকেলেলে আর গিটার বাজানো শেখান ছোটকালেই।অনেকের মতে জুলিয়ার প্রভাবেই জন লেনন এর পরবর্তি জীবনে সংগীত প্রতিভা বিকশিত হয়।

হঠাত করে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান জুলিয়া। তখন জন এর বয়স মাত্র ১৮। মায়ের অকাল প্রয়াণ জন লেননের মাঝে রেখে যায় এক চিরস্থায়ী দাগ। পরবর্তী জীবনে মা কে নিয়ে উনি রচণা করেন দু'টি কালজয়ী গান; "জুলিয়া" এবং "মাদার"।

জুলিয়া গানের লিরিক্স অনেক কারণেই কালজয়ী। অনেকে ভাবেন গানটি জন এর দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়োকো কে নিয়ে লেখা। আবার কেউ কেউ বলেন জন ইয়োকর মাঝে তার মা কেই খুজে পেতেন। জন লেনন এর জীবন এতই বৈচিত্র্যময় যে তার মৃত্যুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরেও তাকে নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই!

জুলিয়া গানটির দু'টি লাইন বিশেষ আগ্রহের জন্ম দেয় সবার মনেঃ

Her hair of floating sky is shimmering
Glimmering in the Sun

মেয়েদের মাথার চুলের বর্ণনা অনেক গান, লেখা ও কবিতায় উঠে এসেছে বিভিন্ন ভাবে। কিন্তু চুল কে এত সুন্দর ভাবে এর আগে কেউ বর্ণনা করেনি! 

জন লেনন ছিলেন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিভা। ছবি আঁকতেন, লিখতেন, গান কম্পোজ করতেন, লিরিক্স লিখতেন, গাইতেন, সুর দিতেন এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় পারদর্শী ছিলেন। উনি এবং উনার ব্যান্ড দ্যা বিটলস সংগীতে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। বিভিন্ন পরীক্ষামূলক বাদ্যযন্ত্র এবং ব্যাকরণ বিরুদ্ধ গান গেয়ে ও বাজিয়ে উনি একাধারে যেমন সমালচিত হয়েছিলেন, সেরকম ভাবে বহুল প্রশংসিতও হয়েছেন। বিটলস এর আগে গান গাওয়ার একটা নিয়ম ছিল। চার লাইন করে দুইটা স্ট্যাঞ্জা হবে, তারপর দুই লাইনের কোরাস--এই ব্যাকরণের বাইরে গিয়ে কেউ গান লেখার দুঃসাহসও দেখাতো না।

জন লেনন শুরু করলেন আট লাইনের স্টাঞ্জা ও চার লাইনের কোরাস দিয়ে। আবার একটা গান লিখলেন যার পুরোটাই কোরাস। এরকম উলটাপালটা, অব্যকরণিয় গান লিখেও অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেতে থাকলো বিটলস আর ওদিকে সংগীত বোদ্ধা পন্ডিত দের সব ব্যাকরণ বই ব্যর্থ হতে থাকতো, আর তারা বসে বসে মাথার চুল ছিড়তেন!

জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকার সময় "আমরা এখন যীশু খ্রীস্টের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়" বলে এক সপ্তাহের মধ্যে মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন, আবার পরে ক্ষমাও চেয়েছেন এজন্য। নাইটহুড প্রাপ্তি নিয়ে করেছেন রসিকতা, আর সব সময় তাই করেছেন যা উনার নিজের পছন্দের ছিল। অন্যদের খুশি করার জন্য কখনো কিছু করেন নি।

এই কালজয়ী শিল্পীর ৭৯ তম জন্মদিন ছিল গত ৯ই অক্টোবর। মাত্র ৪০ বছর বয়সে নিজ বাড়ির সামনে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন এই মহান শিল্পী, যিনি সব সময় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে ভালোবাসায় জীবন অতিবাহিত করার মন্ত্র শেখাতেন।

শ্রদ্ধাভরে জন লেনন কে স্মরণ করি উনার জন্ম মাসে।

(লেখার তথ্য সূত্র বিভিন্ন জীবনি মূলক গ্রন্থ ও ব্যক্তি গবেষণা লব্ধ।)