Sunday, March 22, 2020

Italian Blues

বেশ কয়েক বছর আগে, হঠাত করেই আমার ইউরোপ যাওয়ার একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল, এবং তা কর্মসূত্রে।
রোম আর আমস্টারডামে পরপর দুইটি ওয়ার্কশপ/কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্যে দাওয়াত পেলাম। যেহেতু ইতালীরটা আগে শুরু হবে, সেহেতু ভিএফএস মারফত ইতালীয় দূতাবাসে শেনজেন ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দিলাম।
বিজনেস ভিসা বিধায় অনেক কাগজপত্র জমা নিল। আমি তখন যে প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতাম, সেই প্রতিষ্ঠানের বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্ঠির পরিচয় সম্বলিত সকল কাগজ তাদেরকে দিতে হলো, এবং তারপরেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হল--দূতাবাসে প্রায় অর্ধ দিন বসায় রেখে তারপর একটি প্রহসনমূলক ইন্টার্ভিউ নিয়ে তারপর আমাকে বল্লো "ভিএফএস থেকে জানায় দেয়া হবে ভিসা হয়েছে নাকি"। পরে জানতে পেরেছিলাম যে অনেক বাঙ্গালী "ফ্যামিলি ভিসা" নামক এক বিচিত্র উপায়ে ইতালী যেতে পারে, অর্থাৎ পরিবারের একজন ইতালীর ভিসা পেলেই বাকিরাও আবেদন করতে পারে। কিন্তু সে ভিসার ক্ষেত্রে অনেক জালিয়াতি হয়, এবং এ কারণে বাঙ্গালীদের প্রতি দূতাবাসের কর্মীদের এই বৈরি আচরণ।
এত কাঠ খড় পোড়ানোর পরেও লাভ হলো না; কনফারেন্স শেষ হবার একদিন পরে ভিসা পেলাম।
অফিসে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম এই ঝামেলার কথা। ইতালী যাওয়া হচ্ছে না, কিন্তু তখনো মনে আশা যে অন্তত ডাচদের সাথে নিশ্চিত দেখা হচ্ছে।
কিন্তু সেখানেও ঝামেলা। আমাকে এডমিন থেকে জানানো হলো যে ইতালী থেকে যেহেতু ভিসা পেয়েছি, সেহেতু আমাকে ইতালী হয়েই ইউরোপে প্রবেশ করতে হবে। নচেৎ আমস্টার্ডামে প্রবেশ করতে ঝামেলা হতে পারে।
কিন্তু ইতালীর কনফারেন্স তো শেষ হয়ে যাবে আমি পৌছুতে পৌছুতে, তাহলে কি উপায়? উদ্ভট একটা ট্র্যাভেল প্ল্যান করা হলো। শুক্রবার দুপুর ৩টায় রোমে পৌছুবো, আর পরেরদিন দুপুর ২টায় আমস্টারডামের উদ্দেশ্যে রওনা দিব। অর্থাৎ ইতালী তে আমার থাকার সময় পুরো একদিনও নয়।
ভাগ্য গুণে রোমে আমার জন্য হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল, যা তখনো ক্যান্সেল করিনি। তারমিনি রেল স্টেশনের কাছে একটা ছোটখাট হোটেলে উঠলাম। পুরা খুপড়ি টাইপ একটা রুম, কিন্তু ভাড়া ছিল ১০০ ডলারের উপরে। সারা জীবন পূর্ব এশিয়ার ৪০-৫০ ডলারের বিলাসবহুল হোটেল রুম দেখে অভ্যস্ত আমার চোখে এই রুম কে খুবই দীনহীন মনে হলো।
এই ২৪ ঘন্টারও কম সময়ে সৌভাগ্য হয়েছিল অনেক কিছু দেখার, শোনার। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে এসেই কোন মতে ব্যাগ রেখে, শাওয়ার নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। বাসায় ফিরেছি গভীর রাতে, প্রায় ২টার দিকে। এই পুরো সময়টা খালি হেটেছি আর হেটেছি--হা করে গিলেছি অপরুপ রোম শহরের সকল সুধা। ট্রেভি ফাউন্টেন আর কলিসিয়াম সহ আরো অনেক কিছু দেখেছি দিনভর। পরেরদিন ভোরে উঠে আবার ভ্যাটিকান সিটিতেও গিয়েছিলাম।
আজকে করোনা ভাইরাসের ছোবলে এই সুপ্রাচীন শহর আর সমগ্র ইতালী রাষ্ট্রের মানুষের দূঃখ দুর্দশা দেখে খুবই খারাপ লাগছে। অনেকে হয়তো ভাববে, নিজের দেশ আর শহর নিয়েই চিন্তা করে কূল পাই না, ইতালী নিয়ে ভাবার সময় কই?
কিন্তু, আমার আসলেই অনেক খারাপ লাগছে ওদের এই অবস্থা দেখে।
২১ মার্চ পর্যন্ত সেখানে ৫৩,৫৭৮ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, আর মারা গিয়েছে ৪,৮২৫ জন। এক দিনেই প্রায় ৭৯৩ জন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে এই রোগে।
লাইফ ইজ বিউটিফুল ও গডফাদার মুভি, বিভিন্ন বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, আর্টিস্ট --এসব কারণে ছোটবেলা থেকেই এই দেশটি ও দেশের মানুষের প্রতি একটা টান অনুভব করি। যারা দীর্ঘদিন ঐ দেশে আছে, তাদের কাছেও শুনেছি, ইতালিয়ানরা অনেকটা আমাদের মত। আবেগী, সব সময় যুক্তি তর্ক মেনে কাজ করে না। কে জানে, হয়তো এই আবেগের কারণে ওরা আজকে এত দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
আসুন সবাই মিলে আজকে ইতালীর জন্য একটু প্রার্থনা করি, যার যার ধর্মীয় আচার অনুযায়ী, আর সাথে এটাও কামনা করি যেন আমাদের দেশের উপর এরকম বিপর্যয় না নেমে আসে। তবে প্রার্থনাটা একা একা, নিজের ঘরে বসে করলে ভালো হয়।
আল্লাহ সর্বশক্তিমান।

No comments: