Wednesday, April 25, 2018

জানালার পাশে


রাত বাজে ৩ টা।

একটার পর একটা গাড়ী চলে যাচ্ছে ধূলোর ঝড় উড়িয়ে। গাড়ীর জোরালো শব্দ বার বার রাতের সুনশান নীরবতা কে বিঘ্নিত করছে। জানালা টা নামিয়ে দিবে ভাবছে নীল, কিন্তু আবার বাতাস টাও মন্দ লাগছে না।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে গান। খুব কম ভলিউমে, কান পাতলে শোনা যায় লিরিকসঃ
The cars hiss by my window,
Like the waves down on the beach)

রাত ১ টার পর থেকে একটা অদ্ভত সময় শুরু হয়। বেশিরভাগ মানুষ ১ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সময়টা ঘুমিয়ে উপভোগ করে। নাইট শিফট এর কর্মীদের কথা অবশ্য আলাদা।

নীল এর ৯-৫ চাকরী। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়, কিন্তু তাও রাতে বেশি ঘুমায় না। বহুদিনের অভ্যাস।

(একই লাইন আবার রিপিট হচ্ছেঃ
The cars hiss by my window,
Like the waves down on the beach)

কাছেই রকি বিচ। ঢেউ এর মৃদুমন্দ ঝংকার এর সাথে প্রিয় শিল্পীর সংগীত। Blues ধাচের গান।
স্টিয়ারিং হুইল ধরে আছে মিরিন। অনেক্ষন ধরে গাড়ীর ইঞ্জিন নিস্তব্ধ। গাড়ীর সব বাতি নেভানো, শুধু স্টেরিও তে চলছে গান। নীল তাকিয়ে আছে মিরিন এর দিকে। মেয়েটা একদম হাতের নাগালের মদ্ধ্যে, কিন্ত তবু কেন জানি বহুদুরে।

(গানের পরের লাইন বাজছেঃ
I got this girl beside me
But she's out of reach )

নীল এর মনে পড়ে যায় উদ্দাম ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা। ওর জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ দেশেই। ছোটবেলা থেকেই গ্রেকো রোমান কুস্তিগীড় এর প্যাঁচের মত করে দৃঢ় আলিংগনে জড়িয়ে ধরেছিল সে পশ্চিমা জীবন কে। তাকে দেখলেও সহজে মানুষ বুঝতো না যে তার পূর্বপুরুষ রা এসেছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গরিব দেশটি থেকে। সে জীবনেও দেখেনি পা দিয়ে কাউকে বেশিক্ষণের জন্য ফুটবল খেলতে।

মায়ের ভাষা সে ভুলেই যেত, যদি না প্রতিদিন দেশ থেকে ফোন রিসিভ করতে হত। মা একবার কল করলে আর ছাড়তেই চেত না।

এরকমই একদিন ম্যাকডোনাল্ডস এ বসে মায়ের সাথে কথা বলছিল নীল। তাকে খাবার দিচ্ছিল একটি পূর্বদেশীয় ছিপছিপে তরুণী। ফোনে মশগুল থাকায় ভাল করে খেয়াল ও করেনি কি বলছিল তাকে মেয়েটি। সে মায়ের দীর্ঘ আলাপ থেকে মুক্তির পথ খুজছিল। মা ঘুরে ফিরে খালি একটা কথাই বলছিল।

"কোর্স শেষ করে দেশে আয়, বিয়ে কর। আমরা নাতি নাতনীর চেহারা দেখি"। কিন্ত প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ হু ছাড়া কিছুই বলতো না নীল। আদতে তার দেশে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিল না। অন্তত সেদিনের আগ পর্যন্ত।
হঠাত সে শুনলো একটা তরুণী তার কানের কাছে এসে বলছে "ভাইয়া, বার্গার এর সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস আর কোক নিবেন?"

থতমত খেয়ে ফোন থেকে মাথা তুল্লো নীল। প্রথম বারের মত ভাল করে খেয়াল করলো সে তার সার্ভার কে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেল নীল। ততক্ষনে হতোদ্যম হয়ে চলে গিয়েছে তরুণী। যে কাজ জীবনেও করে নি, সেদিন সেটাই করেছিল নীল। পকেট থেকে এক টুকরা আকাশী রঙ এর কাগজ বের করে তাতে লিখে দিয়েছিল নিজের ফোন নাম্বার। দৌড়ে গিয়ে সেই সার্ভার এর হাতে কাগজটি গুঁজে দিয়ে দেখেছিল তার লাল নীল হওয়া মুখ। কল মি মেইবি? বলে ফিরে গিয়েছিল বার্গার এর কাছে।

বর্তমানে ফিরে এল নীল।
মিরিন এর হাত স্টিয়ারিং এ, কিন্তু গাড়ী চলছে না। ঘুমাচ্ছে ও।
"ঘুমাক। বহুদিন বিশ্রাম পায়নি ও। চায়ও নি। তবে তাতে কিছু আসে যায় না"।
(ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে যাচ্ছে গিটার এর করুণ সুর)

-------------------------------------------------


পূর্ণিমার চাঁদের মাঝে একটি বিশেষ ধরণের মাদকতা রয়েছে। মাঝরাতে যখন গোল হয়ে চাঁদখানা মাথার উপর উঠে থাকে, তখন অন্য কোন কিছুর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। চাঁদের আলোর প্রতিবিম্ব সমুদ্রের পানির উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে, সেটাকে দূর থেকে একটি লম্বা অট্টালিকার মত দেখা যায়। পানির কম্পনের সাথে সাথে সেই অপরুপ আলোও কাঁপতে থাকে, এবং মনে হয় যেন সরু হতে থাকা সেই প্রতিবিম্ব ধরে সাঁতরে চলে যাওয়া যাবে চাঁদে।

পূর্ণিমা মানেই মিরিন থাকবে চন্দ্রাহত। পাশে বসে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা, কিন্তু চোখ থাকবে আকাশের দিকে। নীল প্রথম প্রথম অবাক হত, কিন্তু পরে ব্যাপারটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।

থেমে থাকা গাড়ী তে বসে মিরিন এর দিকে অপলক দৃষ্টিতে আরো কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো নীল। আবার ফিরে গেল সে অতীতে।

ম্যাক এ লাঞ্চ করার পর বেশ কিছুদিন চলে গিয়েছে। সেদিনের পাগলামি আচরণ এর কথা মনে পড়লে নীল এর ফর্সা মুখে লাল বেগুনী রঙ ফুটে উঠে। সেদিন ভার্সিটি ডর্মে আড্ডা মারতে মারতে হঠাত আনমনা হয়ে সেদিনের কথা ভাবছিল নীল। স্প্যানিশ বান্ধবী মারিয়া ওর মুখের সামনে জোরে তুড়ি বাজানোর পর তার সম্বিত ফিরলো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কি হচ্ছে বোঝার আগেই মারিয়া উধাও, দূর থেকে ক্যাটওয়াক দেখা আর "idiota!" ডাক শোনা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার।

আবার ডুবে গেল সে দিবাস্বপ্নে। নিরীহ মেয়েটি অনেক লজ্জা পেয়েছিল সেদিন! ওর হাতে মোটামুটি জোর করেই তার নাম্বার টা ধরিয়ে দিয়েছিল নীল, কিন্ত মেয়েটি মাথা তার দিকে একবারো তাকায়নি।

কাগজ টা নিয়েছিল সে। ছিঁড়ে ফেলে দেয়নি, মুঠোবন্ধ করে রেখেছে।তার নামটিও জানা হয় নি সেদিন । নীল যখন গট গট করে বেরিয়ে যাচ্ছিল রেস্তোরা থেকে, সে একবারো ফিরে তাকায়নি। তাকালে দেখতে পেত তার পিঠের ওপর স্থির হয়ে আছে এক জোড়া মায়াবী, প্রায় আদ্র চোখ।

ডর্ম থেকে বেরিয়ে ক্লাশে গেল নীল। ক্লাশেও খুব একটা মনোযোগ দিতে পারলো না সেদিন। ক্লাশ শেষে খেয়াল করলো দূর থেকে মারিয়া ওকে দেখছে। হয়তো ভাবছে সে এগিয়ে গিয়ে সরি বলবে। তবে নীল এর মন সেদিন অন্যদিকে ছিল। বিস্মিত হয়ে ক্লাস এর সেরা সুন্দরী খেয়াল করলো তাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে গটগট করে বেরিয়ে গেল পূর্বদেশীয় হ্যান্ডসাম ছেলেটি। অস্ফুটে আবার বলে উঠলো সে "ইডিওটা!"।

ভার্সিটি সংলগ্ন পার্কে চলে গেল নীল। ও নিজেও জানে না কিভাবে কিভাবে সে পাথরের তৈরি বেঞ্চ এর সামনে চলে এল। ক্লাশ রুম থেকে এখানে আসা পর্যন্ত পথটির কোন স্মৃতি তার নেই। খালি মনে পড়ছে মেয়েটির লাল হলুদ ইউনিফর্মের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান নীল রঙ এর কানের দুল এর কথা।

পার্কের নিস্তব্ধতা কে ভেঙ্গে দিয়ে একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এল, বেজে উঠলো লাস্ট রিসোর্ট গানের প্রথম পংক্তি দ্বয়ঃ
"Cut my life into pieces
This is my last resort"

অচেনা কন্ঠ, কিন্তু শুনেই নীল বুঝলো সেই রেস্টুরেন্ট ললনা ফোন করেছে। ১০ মিনিট এর সংক্ষিপ্ত আলাপ। সেখান থেকে কফি শপে দেখা। প্রতি সপ্তাহের রুটিন প্রতিদিনের রুটিনে যেতে বেশিদিন লাগেনি। একই শহরে থাকতো দু'জনে, তবে বিপরীত প্রান্তে।

দুইজনের মধ্যে তেমন কোন মিল ছিল না। নীল ছিল অনেক সরব, মিরিন ছিল লাজুক। নীল থাকতো আসরের মধ্যমণি হয়ে, আর মিরিন এর একমাত্র সঙ্গী ছিল তার পোষা জ্যাক রাসেল টেরিয়ার কুকুরটি। আদর করে তাকে সে ডাকতো "বু" বলে।নীল ছিল অবস্থাপন্ন পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান, আর মিরিন ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আশা ভরসার প্রতীক।

মিরিন বেশি কিছু বলতো না, মুখ টিপে হাসতো খালি, আর শুনতো নীল এর শিশুদের মত হাত নেড়ে নেড়ে বলা মিষ্টী কথা গুলি। নীল প্রায়ই অভিযোগ করতো "তুমি এত কম কথা বল কেন?"। মিরিন বলেছিল "আমি লিখতে পারি, বলতে পারি না"।

দেখা হওয়ার ঠিক এক মাসের মাথায় দেশ থেকে এল জরুরী তলব, সাত দিনের নোটিশে নীল ফিরে গেলে দেশে--অসুস্থ্য মা কে দেখতে। পৌছে গিয়ে পেল বড় বড় কিছু সারপ্রাইজ। দ্বিতয় দিনে নীল এর মেইল বক্সে এল হাতে লিখা নীল খামের চিঠি। কাগজ টি সাদা, হাল্কা ল্য্যাভেন্ডার পারফিউম এর সুগন্ধ মাখা। সেখানে গোটা গোটা হাতে নীল কালিতে লিখা একটি কবিতা, যা নীল এর জীবন কে ওলট পালট করে দেয় নিমিষে।

"উষার আকাশের নব উদিত তারার আভাসে আঁঁচও করিনি,
একদিন.....
হৃদয়মম উচ্ছলিয়া প্রনয় গাঁথা রচিব।
এমন প্রেমোন্মত্তে সিক্ত হবো।
সদাই বিমোহিত হয় অবারিত মন....
আমার ছায়াপথ কেনো
পুরোটাই তোমায় আচ্ছন্ন!
আমার আকাশপটে কেনো
কেবলি তুমিই!
পূর্ণিমাতিথিতে সাগরের জলরাশির উন্মাদনার মতো,
একদিন......
পুরোটাই আমি কেনো তোমায় সঁপে দেবো!
তবে.....
সব প্রাপ্তিযোগে পূর্ণতা আসে না !
শুধু হয় মুগ্ধতার সলিলসমাধি।
তাই......
পূর্ণতা নয়!
মুগ্ধতার রঙধনুতে প্রোজ্জ্বল হোক
আমার সরোবর।
ঠিক তেমনি করে,
একদিন.....
এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে
মিলিয়ে যাবো অমানিশার কালান্তরে।"

এক নিমিষে পড়ে ফেল্লো নীল। তারপর আবার। কমপক্ষে ২০-৩০ বার পড়লো চিঠিখানা। কিন্তু আবেগ কে নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো সে, ভাবলো চিঠির উত্তরে চিঠিই দিতে হবে। হাতে তুলে নিল কাগজ কলম, কিন্তু দুই লাইন এর বেশি আগালো না। তখনো সে বোঝেনি যে মিরিন এর চিঠির চেয়েও বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল ওর জন্য।

অসুস্থ্য মা পরের দিন তার হাত ধরে একটি অনুরোধ করলেন।
----------------------------------

মিরিন এর মনের মাঝে চলছে ঝড় ঝঞ্ঝা। উত্তাল সাগরের ঢেউ এর মত একেক পর এক চিন্তা আছড়ে পড়ছে মনের মাঝে।বু কে সিরিয়াস বকা দিয়েছে ও। প্রতিদিনের মত কাজ থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ওর কোলে ঝাপিয়ে পড়েছিল আদুরে ডাক দিতে দিতে, কিন্তু জীবনেও যা করিনে মিরিন আজ তা করে ফেলেছে নির্দ্বিধায়--ঝটকা দিয়ে বু কে ফেলে দিয়েছে কোল থেকে। আহত ও ব্যাথিত মানব সন্তানের মত মায়াকাড়া দৃষ্টিতে বু তাকিয়ে ছিল মিরিন এর দিকে। দুঃখ ও অভিমানের মিশ্রণে বোবা কান্না কেঁদেছিল বেশ কিছুক্ষণ।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে মৃদু সুরে কান্ট্রি সং)
("Me and you and a dog named boo
Travellin' and livin' off the land")

প্রবাস জীবনের প্রায় শুরু থেকেই বু তার বেস্ট ফ্রেন্ড। ক্লাশ শেষে একদিন হেটে বাসায় ফেরার সময় একটা পেট শপ এর সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মিরিন। অতিকায় কৃশকায় ছেলেটাকে সে শুধুই মনে রেখেছে "পেট শপ বয়" হিসেবে। এর আগে কখনোই সে দেখেনি এত লম্বা কোন মানুষ। বেহায়ার মত চেয়ে ছিল ছেলেটির দিকে, কোন রকম ভালবাসা কিংবা ভাল লাগার অনুভব নিয়ে নয়, বড়ং বোবা কৌতুহল থেকে।

"Yo girl, whassup? What'cha lookin at?" শুনে সম্বিত ফিরেছিল ওর।
ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে পেট শপ বয়েজ এর গান
(Every time I see you something happens to me
Like a chain reaction between you and me
My heart starts missing a beat
My heart starts missing a beat
Every time
Oh oh oh, every time)

মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গিয়েছিল সেই পোষা প্রাণীর দোকানে, আর প্রায় এক ঘন্টা লাগিয়ে কিনেছিল জ্যাক টেরিয়ার রাসেল কুকুরটি। জারমেইন ওকে জানিয়েছিল যে এই কুকুরটি আগে আরেক বাসায় ছিল, ওরা ওকে "বু" ডাকতো। ও আর নাম টা বদলায়নি। জারমেইন এর সাথেও আর কখনো দেখা হয় নি ওর।কিভাবে বু আরেক বাসা থেকে ওর দোকানে এল, সেটাও আর জানতে চায়নি মিরিন।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হাত থেকে ছুড়ে মারলো সে ব্রাউন খামটি। ভেতরে ভারী কিছু না থাকায় ঘুরতে ঘুরেতে বুমেরাং এর মত সেটি গিয়ে গোত্তা খেল বই এর আলমারীর কাঁচের সাথে। খামের একটি কোনা আটকে গেল কাঠের ফ্রেম এর সাথে। এয়ার কুলার এর বাতাসের ধাক্কায় চিঠিটা কাঁপতে থাকলো ক্রমাগত।

মনের বিষন্নতা কে দূর করার জন্য টিভি ছাড়লো ও। তখনো শোনা যাচ্ছে অবোধ প্রাণীটির ক্ষীন আওয়াজ। টিভি ছাড়ার সাথে সাথেই শুরু হল আবহাওয়ার বার্তা।

"Welcome to tomorrow's weather forecast. Tomorrow will be a sunny day and the sky will be in its bluest form. It will be a perfect day to visit the blue sea and to gaze at the blue sky all day long".
"ধেত্তেরি, সব খানে খালি নীল আর নীল!" বলে টিভি বন্ধ করে রিমোট টা মোটামুটি ছুড়েই ফেল্ল মিরিন।

মিরিন এর প্রায় সব ক্লাশমেট ডর্মে কিংবা রুমমেট নিয়ে থাকে। ছোটবেলা থেকেই ও এক্টূ ইন্ট্রোভার্ট টাইপ; ডর্মে থাকার কথা ও কল্পনাও করতে পারে না! বিশেষ করে এক সিনেমায় ডর্ম এর শেয়ার্ড ওয়াশরুমের ভয়াবহ নমুনা দেখার পর থেকে ওর ডর্ম ভীতি অন্য লেভেলে চলে গিয়েছে।

রুমমেট এর ব্যাপারে ও অনেক ভেবেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও ভয় ওকে বাধা দিয়েছে এতকাল । হঠাত ওর গালে লাল আভা ফুটে উঠলো। ভেবেছিল এবার ফিরলে নীল কে বলবে ওর রুম মেট হতে। ওর ব্যাপারে বিন্ধুমাত্র দ্বিধাও ছিল না ওর মনে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার চোখ টা গেল আধ-ঝুলন্ত খামটির দিকে। খামটির মতই ওর আর নীল এর সম্পর্ক এখন দূর্বল ভিত্তির উপর।

আজকাল আর কেউ পেপারওয়েট ব্যাবহার করে না, কিন্তু তারপরেও কেন জানি একটা ছিল মিরিন এর বাসায়। প্রবল ক্রোধের সাথে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল সে পেপার ওয়েট টি। ফুঁসতে লাগলো রাগে...
--------------------------------------------------------------------

অনেকক্ষণ ধরে গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ। ফুয়েল ট্যাংক প্রায় খালি। এখন গাড়ী চালালেও খুব বেশী দূর যেতে পারবে না নীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ড্রাইভিং সিট দখল করে আছে মিরিন।

রকি বিচের ঢেউ গুলোর কোন বিকার নেই। বিরতিহীন ভাবে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। শব্দটা যেন বহুদুর থেকে আসছে। কানে ঢুকছে, আবার ঢুকছে না। আলাদা করে খেয়াল করার মত না, আবার অবজ্ঞা করার মতও না। একেক টা ঢেউ যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে মষ্টিষ্কের কোন এক বিশেষ জায়গায়, মনে পড়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো স্মৃতি।

প্রায় দুই ঘন্টা ধরে একই জায়গায়, একই ভাবে বসে আছে ও। চারপাশের পটভূমিকায় তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে হচ্ছে যোহান স্ট্রাউস একটানা বাজিয়ে যাচ্ছে তার নীল দানিউব অর্কেস্ট্রা। কখন জানি গাড়ীর স্টেরিও বন্ধ হয়ে কল্পনার সংগীত বাজা শুরু হয়েছে। এই সুর তার চির চেনা, জীবনে অসংখ্য বার শুনেছে ও। এত বেশি যে চোখ বন্ধ কর হাত দু'টো মাথার পেছনে নিয়ে হেলান দিলেয় বাজা শুরু হয়। আজকে বোনাস হিসেবে সাথে আছে ঢেউ এর বাজনা।।

১ টা ১১ মিনিটে একটি পুলিশ প্যাট্রল কার দেখতে পেল নীল। ডজ চার্জার গাড়ীটির ক্রম অগ্রসরমান অবয়ব দেখে আশাবাদী হয়ে গেল ও। সম্ভবত অফিসারটি তার শিফট শেষ করে বাড়ীর পথে যাচ্ছিল। বিচের ধারে থেমে থাকা ধূসর ফোর্ড মাস্ট্যাং গাড়ীটিকে দেখেও দেখলো না কেন জানি। এমন কি, গতিও কমালো না একটু। কিছুটা মন খারাপ, আর কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার মিশ্র অনুভূতি হল নীল এর। হয়তো বা সেই অজানা পুলিশ অফিসারটা বেচে গেল শেষ রাতের উদ্ধার কর্ম থেকে।

আসলেই কি একজন পুলিশ অফিসার পারবে নীল ও মিরিন কে উদ্ধার করতে? ভাবতে ভাবতে হেসে উঠলো নীল। হাত বাড়ালো গ্লোভ কম্পার্ট্মেন্ট এ। ওখানেই লাইটার আর রথম্যানস এর কিং সাইজ প্যাকেট। খুলেই মনে পড়লো, গত সপ্তাহেই রাগ করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মিরিন ওর সাধের সিগারেট আর লাইটার।

এ তো এক ধরনের ভালবাসাই, নাকি? ডাক্তার তো মানাই করেছে ধুম্রশলাকা টানতে। কিন্তু, কিন্তু, এ তো এক ধরনের অত্যাচারও, নাকি? আর ভাবতে পারে না নীল। চিৎকার গুলো কানে বাজতে থাকে। চিল কন্ঠি মিরিন...

সময় থেমে আছে বীচের ধারের এক টুকরো কাজ চালিয়ে নেয়ার পার্কিং স্পেস এ। হাত ঘড়িটির দম ফুরিয়ে গেছে, ১ঃ১১ তেই থেমে আছে কাটা। অন্য যেকোন দিন হলে নীল প্যানিক এটাক এর শিকার হত। ঘড়ির কাটার সাথে মিলিয়ে তার এক্সিকিউটিভ জীবন। হয় ঘড়ি নাহলে মোবাইল, যেকোন এক মাধ্যমে সময় জানা লাগবেই। মোবাইলের চার্জ অনেক আগেই শেষ।

আজকের ঘটনা ভিন্ন। আজকে নীল এর হাতে অফুরন্ত সময় এবং তার একটুও টেনশান হচ্ছে না। অনেকক্ষন আটকে রাখা দীর্ঘঃস্বাস ছেড়ে দিলে যেরকম আনন্দ হয়, সেরকম আনন্দ হচ্ছে নীল এর।

হাইওয়ে ৮৯ দিয়ে ফিরছিল ওরা। প্রতিদিনের মত আজকেও নীল এর কফি বানানো ও মিরিন এর ড্রাইভ করার পালা। বহুকাল আগে কবে জানি এই দৈনন্দিন দায়িত্ব ওরা ভাগ করে নিয়েছিল। দুইজনেই দেরি করে ফিরে কাজ থেকে। মিরিন এর কাজ শেষ হয় আগে, ও অফিসে ওভারটাইম করে নীল কে তার অফিস থেকে পিক করে নিয়ে বাসায় ফিরতো। অন্তত নীল তাই জানতো, অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্ত।

কোন কোন দিন রকি বিচের ধারে গাড়ী পার্ক করে কিছুক্ষণ বিরতী নিত ওরা। ওদের দুইজনের একটি সিক্রেট হাইড আউট আছে যেখানে গাড়ী পার্ক করলে হাইওয়ে থেকে কিছু দেখা যায় না। আজকেও সেই বিশেষ জায়গায় গাড়ী টি পার্ক করা। মূলত এ কারণেই প্যাট্রল কার ওদেরকে দেখতে পায়নি।

ড্রাইভ ইন মুভির মত ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ীতে বসে আড্ডা দিয়েছে ওরা অনেকবার। সমুদ্রতট এর চেয়ে চিত্তাকর্ষক সিনেমা আর কি হতে পারে? শুক্রবার রাতে সবাই যখন বিভিন্ন ক্লাবে কিংবা আনন্দ ফূর্তির জায়গায় সময় কাটাচ্ছে, ওরা দুইজন তখন তাদের এই লুকানো জায়গায় মেতে উঠতো আদিম ভালবাসায়। কোন এক রাতে বাজি তে হেরে দু'জন দু'জন কে তাড়া করেছিল বীচের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। গাড়ী তে ফিরে, ছেড়ে যাওয়া কাপড় পড়ে, থার্মোস থেকে দুই কাপ কফি খাওয়ার পরেও অনেকক্ষন কমেনি মিরিন এর ঠকঠকানি।

আজকেও থার্মোস এ কফি ছিল, কিন্তু নিজে খায় নি ও। মিরিন কে খেতে দিয়েছে। নীল জানে আজকে ও ওর জীবনের সেরা কফিটি বানাতে পেরেছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------


"It is Done"
এক নিঃশ্বাসে লিখলো মিরিন। পাঠিয়ে দিল নীল কে।

তখন নীল ব্যস্ত ছিল। সারা গা থেকে ঘাম ঝড়ে পড়ছে, পরিশ্রান্ত দেহ থেকে টপ টপ করে পড়ছে ঘাম গুলো অশ্রু ফোটার মত ধীর লয়ে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থেকেও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল ও। হঠাত আইফোনের চিরাচরিত মেসেজ ডেলিভারীর শব্দ টা পেয়ে বিরক্তির সাথে উঠে দাড়ালো সে। পাশে সরিয়ে দিল এতক্ষন বাহুডোরে আকড়ে ধরে রাখা ডাম্ববেল দু'টি।

মেসেজ স্ক্রীন এর দিকে দুই তিন মূহুর্ত তাকিয়ে রইলো নীল। মনেই করতে পারছিল না কোন কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। পরে মনে পড়লো, উত্তর না পেলেও মিরিন এর ছেলেমানুষি একমুখী মেসেজ চালাচালির অভ্যেসটা এখনো যায়নি। আগেও এরকম করতো। নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই আবার উত্তর দিয়ে দিত।

"আচ্ছা, আজকে টমেটো সুপ বানাবো না ক্যাবেজ সুপ?
ওহ, ক্যাবেজ তো নাই বাসায়, টমেটোই সই।
আচ্ছা, টমেটো বেশী শক্ত শক্ত ছিল, সুপ না বানিয়ে সালাদ বানিয়েছি।
কখন আসবে?
না আসলেও সমস্যা নাই, আমি খাব না।
অনেক খিদা, এখনো আস না কেন?
খেয়ে ফেললাম কিন্তু
It is done"

"তার মানে হচ্ছে, উনি খেয়ে ফেলেছেন। আর আমি ভেবেছি না জানি কি!" - গজ গজ করতে করতে সে ফিরে গেল তার ডাম্বেল আর ওয়ার্ক আউট পার্টনার এর কাছে।

"What happened Neal?"
"Nothing serious, babe.
Then why do you look so pissed off?
Never mind, let's get back to work"

অল্প সময়ের মধ্যে তারা ফিরে গেল ওয়ার্ক আউট এ। দু'জনের মনে একই চিন্তা, কঠিন পরিশ্রমের পরেই আসে ভাল সময়। জিমের পাশেই সেই স্বর্ণকেশী বিদেশীনির ফ্ল্যাট।

ভাবতে ভাবতে বর্তমানে ফিরে আসে নীল। মিরিন এর পুরনো মেসেজ ঘেটে সেদিনের কথোপকথন টি খুজে বের করার অদম্য ইচ্ছা জাগে তার মনে। কিন্তু তা না করে সে নিউ মেসেজ অপশানে গেল। লিখা শুরু করলোঃ

It is done
But it doesn't feel right
We have been wallowed in the mire
As if our love became a funeral pyre
But I also made it right.

মেসেজ টা আর পাঠানো হল না। মনে পড়ে গেল নীল এর, ওদের সিক্রেট হাইড আউটে আছে ওরা। এখানে নেটওয়ার্ক নেই। মেসেজ ডেলিভারী ফেইল হয়ে লেখাগুলো ড্রাফট এ চলে গেল।

আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। বৃষ্টি টা জোরালো হয়েছে। মনে হচ্ছে প্রতিটি বৃষ্টির ফোটা ঘুচিয়ে দিচ্ছে গ্লানি, আর পবিত্র করে দিচ্ছে অন্তর। হঠাত পাশের সিটে চোখ গেল নীল এর।

সেই চির পরিচিত, নিষ্পাপ চেহারা। স্টিয়ারিং এ মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে যেন। সেই লাজুক হাসি মাখা ওয়েট্রেসটি। বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিত, কিন্তু যেকোন সিদ্ধান্ত নিত ঠান্ডা মাথায়। শুধু নীল এর উপর ভরসা করার ক্ষেত্রে কোন চিন্তা করতো না। আজও কিছু না ভেবেই খেয়ে নিল কফি।

দুই কাপ কফি খেয়ে কেউ এভাবে ঘুমায়?

হঠাত চারদিক অন্ধকার হয়ে এল নীল এর। এতক্ষন যেন একটা ঘোর এর মধ্যে ছিল ও। মনে পড়ে গেল বিষ সংগ্রহের কষ্টকর প্রয়াসের কথা। অনেক খুজে বের করেছিল সেই বিষ, যা সহজেই কোন পানীয়র সাথে মিশিয়ে দেয়া যায়।

চাঁদ ডুবে গিয়েছে কখন জানি। জিম মরিসন তখনো করুন সুরে গেয়ে যাচ্ছে জানালার পাশ দিয়ে গাড়ী ছুটে চলার সংগীত। কখন জানি সিডি টা আবার চলতে শুরু করেছে।

গাড়ী থেকে বের হয়ে হেটে হেটে সুমুদ্রের পাড়ে চলে এল নীল। শুনতে পেল মেসেজ ডেলিভার হবার পরিচিত সুর। পকেট থেকে ফোন বের করে ৯১১ এ কল দিল।
"Hello, there has been a murder. Yes, I am the killer".

ফোন টা ছুড়ে মারলো নীল। এটার আর দরকার হবে না। ফিরে এল আবার গাড়ীর কাছে।

পকেট থেকে বের করে বাকি বিষটুকু ঢেলে নিল থার্মোস এ। ঢক ঢক করে গিলে নিলে বাকি থাকা কফিটুকু। ঠান্ডা কফি, খেতে গিয়ে মুখ টা বিকৃত করে ফেল্ল নীল।
কে যে এইসব ছাইপাশ বানায়?

দূর থেকে একটা বাচ্চা কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে যেন। সত্য না কল্পনা, ঠিক বুঝতে পারলো না নীল। বু এর কথা মনে পড়লো। আহারে! বেচারা দ্বিতীয় বারের মত এতিম হল।

মিরিন এর মাথার পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো নীল। পুলিশের গাড়ীর জোরালো শব্দ কাছে চলে আস্তে লাগলো।

আর কোন শব্দ নেই চার পাশে।
(শেষ)


No comments: