Monday, April 23, 2018

Beirut Diary Part 4

আমি ছিলাম "পাদোভা" নামক একটি হোটেলে। হোটেল এর জানালা দিয়ে আমার অফিস দেখা যেত। দেখে মনে হত "এত কাছে!"। আগেরদিন বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭০০ টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে আমি কিঞ্চিৎ হতাশ ছিলাম। খাবারের দামের তুলনায় ট্যাক্সি ভাড়া অনেক বেশি মনে হয়েছিল। তাই পরের দিন (অর্থাৎ সোমবার) অফিস শেষে হাটা দিলাম হোটেল এর দিকে।

মাঝে একটা সপ্তাহান্ত চলে গিয়েছে--শনি ও রবি বার। এই দুইদিন কি করেছিলাম? সে কথায় পরে আসছি। নতুন একটা জায়গায় গিয়ে একদিন মাত্র অফিস করেই দুই দিন ছুটি পাওয়া, এই ব্যাপারটা একাধারে আশির্বাদ এবং অভিশাপ।

কিছুদুর হেটেই দেখি হাঁটু ব্যাথা করছে। কানে আইপড দিয়ে, জোশের চোটে হেটে যাচ্ছিলাম। সেখানে ফুটপাথ ছিল প্রশ্বস্ত, এবং বাংলার শেষ নবাব দের মত ফুটপাথে উঠে যাওয়া কোন উটকো বাইকারের আগ্রাসনও ছিল না। তাই মনের আনন্দে হেটে যাচ্ছিলাম গান শুনতে শুনতে। উপর দিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তা খাড়া উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। রাস্তা ভালই ঢালু, যা আগে বুঝিনি। তখন বয়স কম ছিল, আত্নবিশ্বাসেও ঘাটতি ছিল না এবং জাতিগত সম্মানের কথাও মাথায় ছিল--দিলাম হাঁটা।

প্রায় ৪০ মিনিট টানা হেটে পৌছুলাম পাদোভা হোটেল এ। গিয়ে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি না এরকম অবস্থা। কোন মতে হাল্কা কিছু খেয়ে ঘুম দিলাম। উইকেন্ডে কিছু শপিং করেছিলাম। পাউরুটি, চিজ, স্যান্ডুউচ মিট, এসব। সেগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। 

ফিরে যাই উইকেন্ডে। শুক্রবার অফিস করতে খুব অদ্ভুত লেগেছিল। সারা জীবন জানি শুক্র শনি ছুটি, রবি বারে অফিস। শরীরের ঘড়ি ও সেভাবেই সাজানো। তবে মাত্রই আগের রাতে ল্যান্ড করায় তখন খুব বেশি টের পাইনি ব্যাপারটা।

শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠলাম একটু ধীরে সুস্থে। হোটেল রুম টি যথেষ্ঠ পরিমাণে মন খারাপ জাগানিয়া ছিল। জানালা দিয়ে মোটামুটি সুন্দর একটি ভিউ পাওয়া যেত, কিন্তু রুম ছিল খুবই ছোট এবং জীর্ণ দশার। রুমে কোন ময়লা ছিল না, তবে বোঝা যেত যে অনেক পুরনো হোটেল, বহুদিনের মধ্যে কোন মেরামতির মধ্য দিয়ে যায় নি। 

ছোট একটা কামরা, সেখানে কোনমতে একটা বিশাল আকৃতির খাট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ছোট টয়লেট, খাট, ওয়ার্ক ডেস্ক,  ড্রেসিং টেবিল আর এল সি ডি টিভি -- এসবই ছিল সে রুমের আসবাব। দেয়ালে লাগানো ছিল কিছু হাস্যকর ধরণের পোস্টার।  এমনই হাস্যকর যে রুম এর ছবি তোলার সময় সযত্নে এমন এংগেল খুজতে হোত যাতে পোস্টার গুলো দেখা না যায়। রুম এর ছবি কেন তুলেছিলাম? অবশ্যই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য। 

লবি সংলগ্ন রেস্তোরাঁ তে গিয়ে নাস্তা করলাম। সকালের নাস্তা আমি একটু বিলিতি ধাঁচের বেশি পছন্দ করি। দুই টুকরো পাউরুটি টোস্ট এর সাথে মাখন, সেদ্ধ ডিম, চিকেন সসেজ, কয়েক টুকরো পনির আর বিভিন্ন রকম ফল নিলাম। বিভিন্ন রকম পনির ওদের দেশের যেকোন খাবারের মেনুর অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। ওখানেই প্রথম খাই হেলুমি (halloumi) চিজ, যা খুবই উপাদেয় ছিল। এছাড়াও এডাম চিজ, কেমেম্বার্ট সহ আর জানা অজানা অনেক রকম পনির সাজানো থাকতো ব্রেকফাস্ট বাফে তে। 

এক প্যাকেট ফ্লেভার্ড ইয়োগার্ট ও এক কাপ কফি দিয়ে শেষ করলাম খাওয়া। তারপর হোটেলের লবিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আশে পাশে সিনেমা দেখার কি ব্যবস্থা আছে। 

সেসময় ঢাকায় কোন থ্রিডি মুভি থিয়েটার খোলেনি। বন্ধু ও কলিগদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে গিয়ে থ্রিডি মুভি দেখে এসেছে ততদিনে। তাদের মুখে চমৎকার বর্ণ্না শুনে অনেক লোভ লাগতো। সে কারণে বৈরুত যাত্রার আগে থেকেই আমার মনের ইচ্ছা ছিল বেশ কিছু মুভি দেখে নেয়ার। 

সিটি সেন্টার মোটামুটি বৈরুত এর বেশ বড় সড় শপিং মল। হোটেল এর লোকজনের কথা অনুযায়ী ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। সুবিশাল শপিং মল দেখে মাথা মোটামুটি খারাপ হয়ে গেল। প্রায় অনেকক্ষন  উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সিনেমা হলের কাছে পৌছে গেলাম। দেখলাম বেশ কিছু সিনেমা দেখানো হচ্ছে। কি কারণে মনে হল স্টেপ আপ থ্রিডি নামক সিনেমাটিই দেখা দরকার। টিকেট কাটতে গিয়ে দেখলাম ছবিটির পরবর্তী শো শুরু হবে আর ১৫ মিনিটের মধ্যে। 

তড়িঘড়ি করে টিকেট কিনলাম। কিনেই গেলাম পপ কর্ণ কিনতে। গিয়ে দেখি ৪-৫ রকমের পপ কর্ণ পাওয়া যাচ্ছে। কাউন্টারের পেছনে অসম্ভব স্মার্ট কিছু ছেলে মেয়ে। আমি বাটারি পপকর্ণ পছন্দ করাতে দেখলাম ভদ্রলোক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। পপ কর্ণ রেডি করতে করতে জিজ্ঞেস করলো আমার কোন ড্রিঙ্ক লাগবে নাকি। আমি কোক এর দিকে অঙ্গুলি নিদ্রেশ করায় সে বলে উঠলো "নিশ্চয় তোমাকে ডায়েট কোক দিব, নাকি?"। 

এখনকার আমার সাথে তখনকার আমির একটা বড় পার্থক্য ছিল। এখন আমি ভয়াবহ মোটা, কিন্ত তখন আমি ভয়াবহ, কুৎসিত এবং দুঃখজনক ধরণের মোটা ছিলাম। সেলসম্যানটি কে চোখের দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইলাম, কিন্তু তার মুখের সেই হাসি মুছলো না। আমি বেশ জোরের সাথে বললাম "না, আমি রেগুলার কোক চাইছি"। 

ট্রে ভর্তি খাবার আর বুক ভর্তি উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে ঢুকে গেলাম হলে--জীবনের প্রথম ত্রিমাত্রিক চলচ্চিত্র দেখার উদ্দেশ্য। ত্রিমাত্রিক শব্দটার মধ্যেই একটা কেমন জানি নেশা নেশা ভাব আছে। শুনলেই নিজেকে মনে হয় আইজাক আসিমভ কিংবা মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এর গল্পের কোন চরিত্র। হলে প্রবেশ এর আগে যখন হাতে একটা ত্রিমাত্রিক চশমা ধরিয়ে দেয়া হল, তখন সেই অনুভূতি আরো প্রকট হল। 

সিনেমার শুরুতেই দেখলাম কিছু ছেলেমেয়ে পানির মধ্যে নাচানাচি করছে। একদিকে জোরালো বৃষ্টি আরেকদিকে তাদের জুতার আচড়ে পানিতে আলোড়ন। হঠাত একজন কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র (কেন্দ্রিয় বুঝলাম তার সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য দেখে) হঠাত স্ক্রিনের দিকে পা দিয়ে জোরে আঘাত করলো, এর এক গাদা পানি ঢেউ এর মত এসে আমাকে ভিজিয়ে দিল। লাফ দিয়ে উঠলাম সিট ছেড়ে। পাশের সিটে বসে থাকা ছেলেটা খেক খেক করে হাসা শুরু করলো। 

আমি নিশ্চিত হলাম যে, দেশ যাই হোক, জাতীয়তা যাই হোক, খেক শিয়ালের মত বিটলামির হাসির শব্দ সব দেশেই এক। ততক্ষণে আর বুঝতে বাকি নেই যে আমি খুবই বাস্তবসম্মত ত্রৈমাত্রিক এফেক্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। আসলে পানি টানি কিছুই আসেনি আমার দিকে, স্ক্রিণ ও থ্রিডি চশমার কারসাজি তে এরকম মনে হয়েছে। 

পুরো সিনেমাটাই নাচ ভিত্তিক এবং সারাক্ষণই বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক থ্রিডি এফেক্ট এর কারণে কোন দিক দিয়ে নব্বুই মিনিট চলে গেল, টেরই পাইনি। 

সেদিন সর্বমোট তিনটি সিনেমা দেখেছিলাম। মাঝে খালি লাঞ্চ ব্রেক নেই, আর রাতে ডিনার করে হোটেলে ফিরি। 

এভাবেই কেটে যায় লেবাননে আমার প্রথম উইকেন্ড। 


No comments: