Saturday, April 07, 2018

Beirut Diary Part 2

বৈরুতে বনবাস পর্ব ২

ব্যাখাতীত ঘটনা টা জানি কি ছিল? ইতালীয় ভাষার এক বর্ণও না জেনে সেই ভাষার একটি গান মাথার মধ্যে ঢুকে যাওয়া! রাস্তা ঘাটে, শপিং মল ও কফি শপে, সবখানেই we no speak Americano গানটি বাজতে থাকতো।তখন অবশ্য গানটার নাম জানতাম না। জেনেছি অনেক পরে। সে আরেক কাহিনী। 

ইমিগ্রেশানের সকল কাজ কর্ম সেরে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌছাতে পৌছাতে রাত ৯ টা বেজে গেল। পেটে তখন খিদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল। কোন মতে হোটেলে জিনিসপত্র রেখে বের হলাম খাদ্যের খোজে।

হোটেলটি ছিল বেশ উচু একটি জায়গায়। ঢালু রাস্তা সোজা নেমে গিয়েছে নিচের দিকে, এবং সেই রাস্তা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বৈরুত সম্পর্কে তেমন কোন পূর্ব ধারণা ছিল না; ভেবেছিলাম মধ্যপ্রাচ্যের আর আট দশটা শহরের মতই হবে। আমি ল্যান্ড করেছিলাম বৃহস্পতিবার, কোন উইকেন্ডেও না।

যখন বের হলাম রাস্তায়, চারিদিক শুনশান। সব দোকানপাট বন্ধ। হোটেল এর চার পাশে দেখার মট কিছু ছিলই না, প্রচুর পরিমাণে বড় বড় অট্টালিকা আর গাড়ীর সমাহার ছাড়া। প্রায় ১৫ মিনিট হেটেও দৃশ্যপটের তেমন কোন পরিবর্তন হল না । পুরাই এক শহুরে জংগল।

প্রতিটি রাস্তার দুইধারেই অসংখ্য গাড়ী পার্ক করে রাখা; আশে পাশে কেউ নেই। কোন কোনটায় পুরু ধুলার আস্তরণ দেখে নিশ্চিত হলাম যে মাসের পর মাস এগুলো এখানেই আছে। প্রথম যেই চিন্তা টা মাথায় এল সেটা হচ্ছে--"বৈরুতে যদি একটা ধোলাইখাল থাকতো, তাহলেই খবর ছিল এই গাড়ী মালিক গুলোর।" 

অনেকক্ষন হেটে হেটে একটা জায়গায় পৌছুলাম, যেখানে পাশাপাশি বেশ কিছু রেস্তোরাঁ ছিল। বেশি ভীড় এর কোন জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। মোটামুটি ফাঁকা একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। বাইরে থেকে দেখে মনে হল এখানে রুটি কাবাব জাতীয় খাবার পাওয়া যেতে পারে। পেট ভরানোর মত পরিচিত খাবার পাওয়াটাই তখন ছিল একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। মনে পড়ে গিয়েছিল হোটেল গ্রোভার ইন গল্পে প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর ফ্রেঞ্চ টোস্ট অর্ডার দেয়ার কাহিনী। 

রেস্টুরেন্ট এর ম্যানেজার কিসিমের একজন জানালো আমি চাইলে দোতালায় খোলা আকাশের নিচে বসতে পারি। সেদিনের আবহাওয়া ছিল চমৎকার, ঠান্ডাও না, গরম ও না। প্রস্তাব মনে ধরায় গিয়ে বসলাম উপরের ফ্লোরে। এখানেও সেই একই ভিউ। বিভিন্ন সাইজের নতুন পুরনো অট্টালিকা আর অল্প কিছু গাছ গাছালি।  ততক্ষণে ব্যাপারটার সাথে চোখ সয়ে গিয়েছে।সিত্রোয়া, আলফা রোমিও, পন্টিয়াক, শেভ্রোলে, ড্যাটসান এর মাঝে একটাও টয়োটা চোখে পড়লো না। 

একজন হাসিখুসী ভদ্রমহিলা এলেন অর্ডার নিতে। মেনুতে দেখলাম রিব আই স্টেক আছে, দাম ঢাকা শহরের তুলনায় কমই মনে হল। মজার ব্যাপার হল, লেবাননে ওদের দেশীয় মুদ্রার পাশাপাশি ইউএস ডলারও ব্যবহার করা যায় কোন বাধা ছাড়াই। মুদ্রাস্ফিতির কারণে ১ ডলার ভাংগিয়ে তখন প্রায় ১,৫০০ লেবানিজ পাউন্ড পাওয়া যেত, যা লেনদেন এর জন্য অসুবিধাজনক ছিল। একটি বার্গার খেলেন? বেরিয়ে গেল ৩০০০ টাকা! এক বোতল পানি কিনবেন? দাম ৭০০ টাকা। এরকম আর কি! সে কারণে অনেকেই ডলার দিয়েই সারতেন লেনদেন; মূল্য তালিকাতেও ডলারে দাম দেয়া থাকতো। নিজেকে আমেরিকান আমেরিকান মনে হচ্ছিল। 

দেখলাম স্টেক এর দাম $9.99, যা বাংলাদেশী স্ট্যান্ডার্ডে মোটামুটি সস্তাই বলা যায়। কথা প্রসংগে ফাতিমার কাছ থেকে তার নামের পাশাপাশি আরো জানতে পারলাম যে স্টেক টির ওজন হবে প্রায় ৩০০ গ্রাম এর মত এবং সাথে ম্যাশড পটেটো ও স্টিমড ভেজিটেবল দেয়া হবে, এবং আমি ৫০ সেন্ট যোগ করে দু'খানা আরবীয় খুবজ রুটিও এড করে নিতে পারবো অনায়াসে। পানীয় কি খাব জানতে চাওয়াতে আমি "এক বোতল ঠান্ডা পানি" চাইলাম।

অন্য রেস্তোরার ওয়েটারের মত উনি উধাও হয়ে গেলেন না। কিচেনে অর্ডার বার্তা পৌছে দিয়ে বারবার এসে এসে নানা খোজ খবর নিতে লাগলেন। আমি কই থাকি, কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তার ইংরেজী ছিল এক্সেন্টেড। আমরা ইংরেজী ছবিতে আরব টেররিস্ট দের যেরকম ইংরেজী বলতে শুনি, অনেকটা সেরকম। 

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর এল কাঙ্ক্ষিত খাবার। সাথে পেলাম সবুজ এক বোতল পানীয়। জিজ্ঞাসু নেত্রে মহিলার দিকে তাকালে সে জানালো আজকেই তাদের রেস্তোরাঁর ওপেনিং হয়েছে, আর এজন্য সব কাস্টোমার দের ফ্রি একটা ড্রিংক দেয়া হচ্ছে। আমি কি দরকার ছিল, এইসব খাই না লাইনে কিছু একটা বলা শুরু করতে না করতেই সে হড়বড় করে বলে উঠলো "তুমি শুধু মাংশ অর্ডার দিয়েছ। এর সাথে এই পানীয় পারফেক্ট কম্বিনেশান। আমরা এই জিনিস ছাড়া স্টেইক খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না। চেষ্টা করে দেখ।"

খাওয়া শেষ হতে বেশ খানিকক্ষণ লাগলো। প্লেন থেকে নামার পর যে অপরিসীম বিষন্নতা আমাকে গ্রাস করেছিল তা এই ঘরোয়া পরিবেশের রেস্তোরাঁ অনেকটাই দূর করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল পরবর্তী দু'মাস এখানেই ডিনার করবো। তবে বাস্তবে আর মাত্র একবারই আসা হয়েছিল এখানে। সেদিনের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। যথাসময়ে বলবো। 

বিল চুকিয়ে বের হলাম যখন, তখন রাত ১০ঃ৩০। আমার জন্য তেমন কোন রাতই না, কিন্তু বৈরুত স্ট্যান্ডার্ডে নিশুতি রাত মনে হল। রাস্তায় কাক পক্ষীও নাই। হেটে হেটে অনেকদুর চলে এসেছিলাম একটি মাত্র ভরসায় যে হোটেল এর নাম ঠিকানা লেখা একটি কার্ড রয়েছে সাথে, যেটি দেখালে ট্যাক্সি ড্রাইভার পৌছে দেবে জায়গা মত।

পরেরদিন সকাল ৯ টার মধ্যে অফিসে পৌছাতে হবে। সে চিন্তায় আচ্ছন্ন হতে হতে একটি ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। ট্যাক্সিওয়ালা প্রথমেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো "ট্যাক্সি?"। আমি অবাক হয়ে তার দিয়ে চেয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম "আরে বেটা ট্যাক্সি লেখা সাইন আছে দেখেই তো তোর গাড়ীতে উঠসি"। কিছু না বুঝেই বললাম ওকে। সে বেশ খুশী হয়ে গাড়ী হাঁকাল আমার হোটেলের উদ্দেশ্যে। ভাড়াটা একটু বেশি মনে হলেও আর তেমন কিছু বললাম না।






No comments: