Wednesday, March 21, 2018

Beiruit Diary Part 1

পৃথিবীতে অনেক ব্যাক্ষাতিত ঘটনা ঘটে। যেমন, এই মূহূর্তে জনাকীর্ণ কফি শপে দুই ভদ্রলোক অর্ডার দিচ্ছেন ২টা এপেল জ্যুস এবং ১টি অরেঞ্জ জ্যুস। এগুলো ফ্রেশ জ্যুস নয়, ক্যানের, প্রসেস করা জ্যুস। কে জানে কেন উনারা জ্যুস খেতে কফি শপে এল?

আজ হতে প্রায় ৯ বছর আগে কর্মসূত্রে লেবানন গিয়েছিলাম ৩ মাসের একটা প্রজেক্ট এ অংশ নেয়ার জন্য। সেটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম বারের মত এত দীর্ঘদিনের জন্য বাসা থেকে দূরে থাকা। আমি কখনোই হলে থাকি নাই, আর স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি ঢাকাতেই হওয়াতে কখনোই বাসার বাইরে বেশি থাকা হয় নি। 

দুবাই এয়ারপোর্টে ৮ ঘন্টার সুদীর্ঘ ট্রানজিট শেষ করে যখন রাজধানী বৈরুত এর রফিক হারীরী এয়ারপোর্টে নামলাম, তখন আমি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। ঢাকায় লেবানন এর কোন দূতাবাস ছিল না। অনেক ঝামেলা করে অফিস মারফত একটি চিঠি জোগাড় হয়েছিল, যেখানে আরবী তে লেখা ছিল যে এই ভদ্রলোক কে যেন "অন এরাইভাল" ভিসা দেয়া হয়। 

ঢাকা এয়ারপোর্টেই প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয় আমাকে। এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশান অফিসার রা সেই কাগজের ভরসায় আমাকে প্লেনে উঠতে দিতে চাচ্ছিলেন না। পরবর্তীতে অফিসের সহায়তায় সেই ঝামেলা মিটে।

বৈরুত বিমান বন্দরেও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল ভিসার জন্য। আমার সাথে আসা যাত্রীরা সবাই যখন মোটামুটি বাসায় পৌছে গিয়েছে, আমি তখনো লাগেজ হাতে নিয়ে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে ছিলাম। মজার ব্যাপার হল ওখানের ইমিগ্রেশান অফিসার গুলো খুব হাল্কা মেজাজে ছিল। আমাকে নানা রকম মজার মজার প্রশ্ন করছিল।

সিকিউরিটি চেক এর এরিয়াতে গিয়ে দেখি যে লোক টা ব্যাগ চেক করছে, সে সিগারেট টানে। পাশেই বড় করে "নো স্মোকিং" লেখা। আমি খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে । সে কিছুটা বিব্রত হয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিয়ে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলো, "what happened?".

আমি কিছু না বলে নো স্মোকিং সাইন টার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলাম। 

সে বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে কিছু আদিরসাত্নক অংগভংগী করে বল্লো "তুমি এগুলা কর না?"। আমি কিছু না বুঝে হা করে তাকায় থাকতে থাকতে শুনলাম সে বল্ল "ওগুলাও তো নিষিদ্ধ, তাও সবাই করে"। আমি টাস্কি খেলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। পাছে আমার ভিসা আটকে যায়!

আমাকে অফিস থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে আমার জন্য এয়ারপোর্টে গাড়ী রাখা থাকবে। রোমিং সিম দিয়ে কল করলাম সেই ড্রাইভার কে। সে আমার কথা প্রায় কিছুই বুঝলো না, আর আমিও বুঝলাম না প্রত্যুত্তরে সে ইয়েস নো হাবিজাবি কি বল্ল । তখন বুঝলাম কেন আমাকে নির্দিষ্ট একটি ডিপারচার গেট দিয়ে বের হতে বলা হয়েছিল, এবং কেনই বা গাড়ীর রেজিস্ট্রেশান নাম্বার ও আগে থেকে দিয়ে দেয়া হয়েছিল! গিয়ে হেটে হেটে খুজে বের করলাম গাড়ী, আর বিনা বাক্য ব্যায়ে উঠে পড়লাম সেটায়।

চালক ভদ্রলোক এক বর্ণ ইংরেজী ও জানতেন না, এবং উনি চেষ্টাও করলেন না আমার সাথে কোন কথা বলার। 

লেবানন এর অফিশিয়াল ভাষা আরবী, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজী। বেশিরভাগ মানুষ আরবী আর ফ্রেঞ্চ জানে, ইংরেজী জানা মানুষ খুব কমই পেয়েছি পরবর্তী দুই মাসে। 

অফিসের কাছাকাছি একটা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। এখানে ছিলাম দুই সপ্তাহ। প্রতিদিন সকালে হোটেলের বুফে নাস্তা খেতে নামতাম ৮ টার দিকে। একই খাবার খেতে খেতে যখন আমি প্রায় ত্যক্ত বিরক্ত, তখন আমাকে অফিস থেকে জানানো হল যে হোটেল এর পরিবর্তে আমাকে একটা স্টূডিও এপার্ট্মেন্টে থাকতে দেয়া হবে। 

ডেকওয়ানেহ নামক একটা এলাকায় ছিল সেই এপার্ট্মেন্ট। পরবর্তী ২ মাস সেটি হয়ে উঠলো আমার নিজের বাসা। একটা রুম, সেটার মধ্যেই ছোট কিচেনেট আর সাথে ছোট ওয়াশরুম। কাপড় ধোয়ার জন্য কমন ওয়াশিং রুম ছিল বেইসমেন্ট এ। 

অফিস শুরু হত ৯ টা থেকে। প্রথম দিন থেকেই একটি বিরুপ মনোভাব লক্ষ্য করলাম আমার নতুন কলিগদের মাঝে। তারা হয়তো মেনে নিতে পারছিল না যে বাংলাদেশী এক ভদ্রলোক কন্সাল্টেন্ট হিসেবে তাদের উপর ছড়ি ঘুরাবে। মার্কেট অপারেশান্স ডিপার্ট্মেন্ট এ তখন কর্মরত ছিলেন পাঁচ জন ভদ্রমহিলা এবং তিন জন ভদ্রলোক। হেড মার্কেটিং ছিলেন তাদের বস। 

আমি কোন মতে ৮টায় উঠে ঘুম ঘুম চোখে অফিসে আসতাম, আর দেখতাম আমার কলিগ গুলোকে অবাক দৃষ্টিতে। সবাই থাকতো সুসজ্জিত এবং দেখে মনে হত কোন পার্টিতে এসেছে, অফিসে নয়। খুব হই হুল্লোড় করতো ওরা সবাই, কিন্তু আমি আরবী না জানায় তাদের কাহিনী গুলা বুঝতাম না একদমই। কখনো কখনো করুনার বশবর্তী হয়ে ইংরেজী তে তর্জমা করে আমাকে শুনাতো ওদের কাহিনী গুলো। 

ইউসুফ এর সাথে আমার কিছুটা সখ্যতা হয়। তাকে সবাই "জো" বলে সম্বোধন করতো। ওর বয়স আমার মতই ছিল, কিন্তু সে ছিল খুবই স্মার্ট এবং অসম্ভব সুপুরুষ। টিম এর অপর দুই ভদ্রলোকের মধ্যে লুইস এর সাথে খুব একটা কথা হত না। সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। মূলত আমি, জো আর নিকোলাস মাঝে মাঝে আড্ডা দিতাম আর দুপুরে লাঞ্চে যেতাম একসাথে। 

লাঞ্চ এর ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং ছিল। সব কর্মী অফিস ক্যান্টিনে ফ্রি লাঞ্চ পেত, এবং সেই লাঞ্চ ও ছিল খুব চিন্তা ভাবনা করে বানানো। 

সবাইকে প্রথমে একটা ছোট বাটি, প্লেট এবং ছুরি, কাটা আর চামচ দিয়ে দেয়া হত। আইডি কার্ড দেখালে এই জিনিসগুলো পাওয়া যেত। তারপর প্রথমেই বিশাল সালাদ বারে যেত সবাই। সেই বাটি ভর্তি করে একবারের মত সালাদ নেয়া যেত সেখান থেকে। একপাশে থাকতো কিছু "আগে থেকে বানিয়ে রাখা সালাদ"। ওগুলো নিলে বাটি ফিরিয়ে দিতে হত। আর অন্যপাশে থাকতো সালাদের বিভিন্ন টাটকা উপকরণ। 

ভেতো বাংগালী হিসেবে সালাদ খাওয়ার খুব একটা অভ্যাস কখনোই ছিল না, আর সালাদ বলতে আমি তখন শসা গাজর টমেটোই বুঝতাম। ওইখানে গিয়ে ধারণা পালটে গেল পুরাপুরি। শসা, গাজর, টমেটো তো থাকতোই, পাশাপাশি, বীট, শীমের বিচি, লেটুস, আলু, ডিম, অ্যাপেল, পীচ সহ আরো অনেক ধরণের উপাদান থাকতো সেখানে। এর সাথে মেশানোর জন্য থাকতো বিভিন্ন ধরনের তেল এবং সালাদ ড্রেসিং। অনেকে দেখতাম সালাদ টাই অনেক আয়োজন করে খেত, মেইন ডিশ আর নিতই না।

মেইন ডিশের ক্ষেত্রে ২/৩ ধরনের অপশান থাকতো। হালাল সহ। সেখানেও অনেক বাহারী খাবার থাকতো। এম্নিতে লেবানিজ খাবার খুবই সুস্বাদু; ওরা কিছু ভূমধ্যসাগরীয় শৈবাল ব্যাবহার করে রান্না, যাতে রান্নার স্বাদ অনেক বেড়ে যায়। এগুলো "মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট কিংবা আজি নো মোটোর" মত ক্ষতিকারক না, বড়ং স্বাস্থ্যকর। 

শেষ আইটেম হিসেবে একটা ডেজার্ট ও থাকতো।

খাওয়া দাওয়া করে অফিসে ফিরতাম। অফিসে শুধু এস্প্রেসো কফি পাওয়া যেত, যা আমার সহ্য হোত না। লাঞ্চ পরবর্তী চা কফির জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করতো, কিছু বলতেও পারতাম না, সইতেই পারতাম না। পরবর্তীকালে অফিসের কাছে একটা কফি শপ আবিষ্কার করেছিলাম, কিন্তু সেই গল্প আরেকদিন।

সবাই বের হয়ে যেত ৫ টার দিকে। যতদিন ছিলাম ওখানে, এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম দেখিনি। তবে আমি থাকতাম আরো কিছুক্ষন। ৭-৮ টার দিকে বের হতাম; সরাসরি বাসায় যেতাম। খুব বিষন্নতায় কাটতো সন্ধ্যা গুলো। মিস করতাম দেশে ফেলে আসা সবাইকে। 

হোটেলের ওয়াইফাই খুব বাজে ছিল; কোন মতে yahoo mesenger চালানো যেত, যা দিয়ে অডিও কল করতে পারতাম। কিন্তু কল ড্রপ হত প্রায়শই। অফিস থেকে একটা সিম দিয়েছিল, কিন্তু আইএসডি কল রেট অনেক বেশি ছিল, আর রোমিং সিমে ছিল আরো বেশি। কলিং কার্ড নামক বস্তুটি আমার কাছে তখনো অচেনা। 

টিভি তে ছিল সব আরবী চ্যানেল; লেবানিজ গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম প্রায় দিন। 


No comments: