Sunday, March 18, 2018

জানালার পাশে পর্ব ৪

অনেকক্ষণ ধরে গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ। ফুয়েল ট্যাংক প্রায় খালি। এখন গাড়ী চালালেও খুব বেশী দূর যেতে পারবে না নীল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ড্রাইভিং সিট দখল করে আছে মিরিন।

রকি বিচের ঢেউ গুলোর কোন বিকার নেই। বিরতিহীন ভাবে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। শব্দটা যেন বহুদুর থেকে আসছে। কানে ঢুকছে, আবার ঢুকছে না। আলাদা করে খেয়াল করার মত না, আবার অবজ্ঞা করার মতও না। একেক টা ঢেউ যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে মষ্টিষ্কের কোন এক বিশেষ জায়গায়, মনে পড়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো স্মৃতি।

প্রায় দুই ঘন্টা ধরে একই জায়গায়, একই ভাবে বসে আছে ও।  চারপাশের পটভূমিকায় তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে হচ্ছে যোহান স্ট্রাউস একটানা বাজিয়ে যাচ্ছে তার নীল দানিউব সিম্ফনি। কখন জানি গাড়ীর স্টেরিও বন্ধ হয়ে কল্পনার সংগীত বাজা শুরু হয়েছে। এই সুর তার চির চেনা, জীবনে অসংখ্য বার শুনেছে ও। এত বেশি যে চোখ বন্ধ কর হাত দু'টো মাথার পেছনে নিয়ে হেলান দিলেয় বাজা শুরু হয়। আজকে বোনাস হিসেবে সাথে আছে ঢেউ এর বাজনা।।

১ টা ১১ মিনিটে একটি পুলিশ প্যাট্রল কার দেখতে পেল নীল। ডজ চার্জার গাড়ীটির ক্রম অগ্রসরমান অবয়ব দেখে আশাবাদী হয়ে গেল ও। সম্ভবত অফিসারটি তার শিফট শেষ করে বাড়ীর পথে যাচ্ছিল। বিচের ধারে থেমে থাকা ধূসর ফোর্ড মাস্ট্যাং গাড়ীটিকে দেখেও দেখলো না কেন জানি। এমন কি, গতিও কমালো না একটু। কিছুটা মন খারাপ, আর কিছুটা আশ্বস্ত হওয়ার মিশ্র অনুভূতি হল নীল এর। হয়তো বা সেই অজানা পুলিশ অফিসারটা বেচে গেল শেষ রাতের উদ্ধার কর্ম থেকে।

আসলেই কি একজন পুলিশ অফিসার পারবে নীল ও মিরিন কে উদ্ধার করতে? ভাবতে ভাবতে হেসে উঠলো নীল। হাত বাড়ালো গ্লোভ কম্পার্ট্মেন্ট এ। ওখানেই লাইটার আর রথম্যানস এর কিং সাইজ প্যাকেট। খুলেই মনে পড়লো, গত সপ্তাহেই রাগ করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে মিরিন ওর সাধের সিগারেট আর লাইটার।

এ তো এক ধরনের ভালবাসাই, নাকি? ডাক্তার তো মানাই করেছে ধুম্রশলাকা টানতে। কিন্তু, কিন্তু, এ তো এক ধরনের অত্যাচারও, নাকি? আর ভাবতে পারে না নীল। চিৎকার গুলো কানে বাজতে থাকে। চিল কন্ঠি মিরিন...

সময় থেমে আছে বীচের ধারের এক টুকরো কাজ চালিয়ে নেয়ার পার্কিং স্পেস এ। হাত ঘড়িটির দম ফুরিয়ে গেছে, ১ঃ১১ তেই থেমে আছে কাটা। অন্য যেকোন দিন হলে নীল প্যানিক এটাক এর শিকার হত। ঘড়ির কাটার সাথে মিলিয়ে তার এক্সিকিউটিভ জীবন। হয় ঘড়ি নাহলে মোবাইল, যেকোন এক মাধ্যমে সময় জানা লাগবেই। মোবাইলের চার্জ অনেক আগেই শেষ।

আজকের ঘটনা ভিন্ন। আজকে নীল এর হাতে অফুরন্ত সময় এবং তার একটুও টেনশান হচ্ছে না। অনেকক্ষন আটকে রাখা দীর্ঘঃস্বাস ছেড়ে দিলে যেরকম আনন্দ হয়, সেরকম আনন্দ হচ্ছে নীল এর।

হাইওয়ে ৮৯ দিয়ে ফিরছিল ওরা। প্রতিদিনের মত আজকেও নীল এর কফি বানানো ও মিরিন এর ড্রাইভ করার পালা। বহুকাল আগে কবে জানি এই দৈনন্দিন দায়িত্ব ওরা ভাগ করে নিয়েছিল। দুইজনেই দেরি করে ফিরে কাজ থেকে। মিরিন এর কাজ শেষ হয় আগে, ও অফিসে ওভারটাইম করে নীল কে তার অফিস থেকে পিক করে নিয়ে বাসায় ফিরতো। অন্তত নীল তাই জানতো, অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্ত।

কোন কোন দিন রকি বিচের ধারে গাড়ী পার্ক করে কিছুক্ষণ বিরতী নিত ওরা। ওদের দুইজনের একটি সিক্রেট হাইড আউট আছে যেখানে গাড়ী পার্ক করলে হাইওয়ে থেকে কিছু দেখা যায় না। আজকেও সেই বিশেষ জায়গায় গাড়ী টি পার্ক করা। মূলত এ কারণেই প্যাট্রল কার ওদেরকে দেখতে পায়নি।

ড্রাইভ ইন মুভির মত ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ীতে বসে আড্ডা দিয়েছে ওরা অনেকবার।  সমুদ্রতট এর চেয়ে চিত্তাকর্ষক সিনেমা আর কি হতে পারে? শুক্রবার রাতে সবাই যখন বিভিন্ন ক্লাবে কিংবা আনন্দ ফূর্তির জায়গায় সময় কাটাচ্ছে, ওরা দুইজন তখন তাদের এই লুকানো জায়গায় মেতে উঠতো আদিম ভালবাসায়। কোন এক রাতে বাজি তে হেরে দু'জন দু'জন কে তাড়া করেছিল বীচের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়। গাড়ী তে ফিরে, ছেড়ে যাওয়া কাপড় পড়ে, থার্মোস থেকে দুই কাপ কফি খাওয়ার পরেও অনেকক্ষন কমেনি মিরিন এর ঠকঠকানি।

আজকেও থার্মোস এ কফি ছিল, কিন্তু নিজে খায় নি ও। মিরিন কে খেতে দিয়েছে। নীল জানে আজকে ও ওর জীবনের সেরা কফিটি বানাতে পেরেছে।

(চলবে)

No comments: