Sunday, March 11, 2018

দাদুকে মনে পড়ে

আজকে আমার দাদু সুরাইয়া খানম এর ১৮ তম মৃত্যু বার্ষিকী।

আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডঃ সিরাজুল হক খান রাজাকার বাহিনীর হাতে অপহৃত হন ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর। উনার লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

দীর্ঘ ২৯ বছর দাদু প্রায় একক ভাবে ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের বড় সংসার কে টেনে নিয়েছেন। দাদা যখন মারা যান, তখন আমার আব্বা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র এবং বড় চাচা সদ্যবিবাহিত এবং মাত্র চাকরী শুরু করেছেন। বাকি চাচা ফুফুরা অনেক ছোট ছিলেন। পরবর্তীকালে ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে দাদুকে সহায়তা করলেও উনিই ছিলেন নেপথ্যের চালিকাশক্তি। ছোট বড় সংকটে দাদুর কথাই ছিল শেষ কথা।

আমাদের অনেক সৌভাগ্য যে দাদুর আদর পেয়ে বড় হতে পেরেছি। উনি মারা যাওয়ার পরেই কেবল বুঝতে পেরেছি পরিবারে মুরুব্বির ভূমিকা কত বড়। ১৮ বছর চলে গিয়েছে, কিন্তু এখনো মনে পড়ে উনার সাথে প্রতিটি কথোপকথন।

দাদুর গল্প লিখে শেষ করতে পারবো না। যেই উনাকে দেখেছেন, চিনেছেন, তিনিই উনাকে মনে রেখেছেন আজ অবধি। শধু একটা গল্প শুনাই।

আমাদের বাসায় অনেক ফেরিওয়ালার আনাগোনা ছিল। দারোয়ান সব সময় রাখতাম না আমরা, কারণ বিল্ডিং এর নিচ তলায় ব্যাংক ছিল এবং ব্যাংক এর গার্ড থাকতো ২৪/৭। মূলত দারোয়ান না থাকার কারণেই ফেরিওয়ালারা সোজা উঠে যেতে পারতো তিন তলায়, বাধাহীন ভাবে।

কেউ হয়তো নিয়ে আসতো ইলিশ, কেউ সব্জী, আবার কেউ আনতো মুরগী--সবার সাথেই দাদু দরদাম করতেন। এমন সব দাম বলতেন যে শুনে ওদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। এক মাছওয়ালা একদিন দাদুর বলা দাম শুনে কানে হাত দিয়ে পাতিল মাথায় নিয়ে দৌড় দেয়। আমার নিজের চোখে দেখা সে ঘটনা। সম্ভবত ২০০ টাকা দাম চাওয়া মাছের দাম ২০ টাকার বেশি হবে না ধরণের কিছু একটা বলেছিলেন দাদু।

যাওয়ার সময় বলছিল " কানে ধরেছি, আর আসবো না জীবনে"। কিন্তু ঠিকই তারা ফিরে আসতো আবার। কারো দাদী, কারো নানী হয়ে উনি কখনো বেশি দাম দিয়ে আবার কখনো অনেক কম দামেই কিনতেন নানা পণ্য। বেশিরভাগ সময় জিতে যেত ফেরিওয়ালারাই, সবাই ফিরে যেত হাসি মুখে।

বাসায় বাজার থাকলেও কিনতেন; উনার জন্য এই কাজটি কিছুটা শখ এর মত ছিল, এবং আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতাম যে এটা ছিল উনার এক ধরণের বদান্যতা।

আমাদের তিন তলায় তিনটি ফ্ল্যাটে আমরাই থাকতাম, তাই কমন একটা গেট ছিল। মাঝখানের করিডোরে একটা বড় চেয়ার রাখা থাকতো দাদুর জন্য। সেই চেয়ারের সামনের মেঝেতে ফেরিওয়ালারা বসতো তাদের বেসাতি নিয়ে।

প্রতিদিনই কোন না কোন ফেরিওয়ালা আসতো; এসেই হাঁকডাক -- "কই দাদী কই? সবচেয়ে ভাল মাছ নিয়ে আসছি আপনার জন্য, একবার খাইলে জীবনে ভুলবেন না"।

তখন আমার আম্মা, কিংবা চাচী খুব কষ্ট নিয়ে দুঃসংবাদ টা দিত। "আম্মা আর নাই"।

একেকজনের প্রতিক্রিয়া হত একেকরকম। কেউ শকড হোত, কে বা কান্না শুরু করতো, কেউ অবিশ্বাসে মাথা দুলাতে থাকতো। একজন কোন কথা না বলে দৌড়ে চলে গিয়েছিল নিচে। একজন বিশ্বাস ই করতে পারে নাই, বলে যাচ্ছিল "কি কন? কি কন? উনি বাড়ি গেসে? কবে ফিরবে?"।

দাদু নিজেও জানতেন না কত মানুষ কে উনি প্রভাবিত করেছেন। দাদু মারা যাওয়ার পর প্রায় বছরখানেক একই দৃশ্যের অবতারণা হত। কেউ না কেউ এসে দুঃসংবাদ শুনে দুঃখ করতে করতে চলে যেত।


মোটামুটি সুস্থ্য অবস্থাতেই উনি মারা যান। হাসপাতালে গিয়েছিলেন সহজ উপসর্গ নিয়ে; হঠাত করেই অবস্থার অবনতি এবং মৃত্যু। উনি যে হাসপাতালে, সেই খবরটাই তখনো সবাই জানতো না।


দাদা কে কোনদিন দেখি নাই, কিন্তু দাদুর মাঝে দেখেছি একজন বিশুদ্ধ, আত্নত্যাগি ও আদর্শ মানুষ। আল্লাহ উনাকে বেহেস্তবাসী করুন।

সবাই দয়া করে উনার বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করবেন আজকে।

No comments: