Sunday, March 11, 2018

ফাগুন এর খেতা পুড়ি

"ফাগুন এর খেতা পুড়ি"
সেই ছেলেটি হতে চেয়েছিল খাপছাড়া, লাগামহীন। সবাই যখন মেটালিকা মেগাডেথ নিয়ে মেতে আছে, ও আটকে ছিল রবীন্দ্রনাথ, শিরোনামহীন আর দলছুট কে নিয়ে। গান ছাড়া কোন নেশা ছিল না, কিন্তু উসকো খুসকো চুল, দুর্বিনিত দাড়ী আর রাত জাগা ঢূলু ঢূলু চোখের কারণে সবাই ওকে মনে করতো নেশাগ্রস্থ। বিলাসবহুল সেডান গাড়ী তে চলাফেরা আর বহুতল ভবনের লিফটে ওঠা নামা প্রতিদিন; অবস্থাপন্ন পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান হয়ে জীবনে ছিল না প্রাচুর্য্যের অভাব।
ফেব্রুয়ারীর সুদর্শন আবহাওয়া ঘুমের রুটিনে আনতে পারেনি কোন পরিবর্তন। সারাদিন বাইরে ঘুরে, বাসায় ফিরে অল্প কিছু খেয়েই বসে যেত গান আর গিটারের চর্চায়। গভীর রাত পর্যন্ত চলতো গিটার ও গলার সাথে রোমান্স।

কখনো কখনো বারান্দায় গিয়ে সিগারেটে দুই টান, নিজ হাতে বানানো ধুমায়িত কফির কাপে দুই চুমুক, সাদা কাগজে দুই কলম কবিতা কিংবা গদ্য। পরীক্ষা থাকলে কিঞ্চিত পড়াশোনা করার ব্যর্থ চেষ্টা।

জীবনের এ সব কিছু সুখকর মূহুর্তের সমন্বয় এনে দিত নিরবিচ্ছিন্ন এক উপলদ্ধি, "জীবন টা খুব এক টা খারাপ না।"

হঠাত কোন একদিন উদাস হয়ে আশে পাশে তাকানো। যেদিকে চোখ যায়, অট্টালিকা আর দালান, ইট পাথরের সভ্যতা। মাঝে হাল্কা সবুজের ছোয়া, দু'টি তাল গাছ আর কিছু ঝোপঝাড় আর হঠাত করে চোখে পড়ে যাওয়া পাশের বারান্দার কোন অজ্ঞাত, পলায়নপর মানুষের হলুদ পোষাকের ঝাপসা অবয়ব।

তাঞ্জির বুঝতো যে কেউ তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। সেই কেউ টার সেন্স কেউটে সাপের চেয়েও প্রখর ছিল। যখনই ওদিকে মাথা ফেরাতো, সাঁই করে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগীর ক্ষিপ্রতায় ভেগে যেত অজ্ঞাত সে জনা। কয়েকদিন ভেবেছে পাশের ফ্ল্যাটে বেল বাজাবে, নক করবে দরজায়, যদি সে খুলে দেয় দরজা! কিন্তু পরক্ষণেই বাতিল করে দিয়েছে সে চিন্তা। আবার মেতে উঠেছে গান বাজনা আর ধুম্র শলাকা নিয়ে।

গলা ছেড়ে গান গাইত ও। বন্ধু মহলে ওর গান খুবই জনপ্রিয় ছিল, ওকে ছাড়া আড্ডা জমতোই না। দূর পাহাড় কিংবা সমুদ্র তট, বন্ধুরা মিলে যেখানেই যাক না কেন, তাঞ্জির কে গান গাইতে হোত। সেই অভ্যাস বসে নিজের ঘরে বসেও গান গাইত জোরে জোরে, কিন্তু শক্ত কাঠের দরজা ভেদ করে বাসার ভেতরে যেত না সেই সুর। তবে পাশের বারান্দার কথা আলাদা।

একদিন লিফটে ঢুকেছে তাঞ্জির; ক্লাস শুরু হবে আর ২ ঘন্টা পরেই। গুন গুন করে "তারায় তারায় রটিয়ে দেব" গাইতে গাইতে খেয়াল করেনি যে লিফট উপরে যাচ্ছে। উপরে গেল, দরজাও খুলে গেল, কিন্তু কেউ লিফটে ঢুকলো না। মনে মনে অভিসম্পাত করলো সে ১৬ তলার বাসিন্দাদের।

১৬ তলা থেকে লিফট আবার ৭ এ এসে থামলো। লিফট এর কপাট খুলতেই একজোড়া মায়াবী চোখ তাঞ্জির কে ব্যবচ্ছেদ করতে করতে লিফটে প্রবেশ করলো। বোরখা, হিজাব ও নেকাব পরিহীতা ছিপছিপে গড়নের "পিচ্চি" টা তার দিকে তাকিয়ে রইলো কেমন কেমন করে জানি।

তাঞ্জির তেমন একটা পাত্তা দিল না। এভাবে বেশ কিছু মূহুর্ত চলে গেল। ওর গুন গুন ও থামেনি। হঠাত শুনতে পেল পিচ্চি কথা বলে উঠেছেঃ
"আপনাকে আমি ঠিক করবো, বুঝছেন? নেশা করে করে জীবন টা কে ধ্বংশ কেন করছেন?"
কি হল বোঝার আগেই নিচ তলায় চলে এল লিফট, দরজা খোলার সাথে সাথেই সেই বোরখাওয়ালী শজারুর মত ছুটে বের হয়ে গেল গেট দিয়ে। কেন জানি তাঞ্জির এর মনে হল বোরখার নিচে হলুদের আভাস।

ভাবলো দৌড় দেয় পিছে, কিন্তু গেট এর দারোয়ান এর কড়া চাহনী দেখে আর সে পথে পা মাড়ালো না ও।
সেদিন ছিল পহেলা ফাগুন। তাঞ্জির একটি হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে কলেজে গিয়েছিল সেদিন। সারাদিন মনে পড়ছিল সেই চোখ দু'টির কথা।

রাত ১১ টা পেরিয়ে গেল ঘড়ির কাটা। চার পাশে খালি সবুজ আর সবুজ; খুবই নয়নাভিরাম পরিবেশ। ল্যাম্প পোস্ট এর আলোটা দেখে মনে হচ্ছে যেন সূর্য মামা তার জৌলুস এর কিছুটা ধার দিয়েছে তাকে। আসে পাশে তেমন কেউ নেই, পার্ক এর এই অংশটা শুনশান, নিরব, নিস্তব্ধ। এমন কি নিশিকণ্যা ও তাদের দালালেরাও সহজে এদিকে আসতে চায় না। ওরা তিনজন এই জায়গার পারমানেন্ট বাসিন্দা। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওরা তিন জন চলে আসে মাল মশলা সমেত। পুলিশ ও মাস্তান কেউ ওদেরকে ঘাটায় না, কারণ ওদের মাঝে আছে একজন প্রভাবশালী নেতার কনিষ্ঠ সন্তান। বাকি দুইজন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ইউনিভার্সিটি তে গিয়ে ওদের বন্ধুত্ত। অল্প দিনেই গাজা থেকে শুরু করে সকল মাদক দ্রব্যে আসক্ত ও অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তিন জনেই। কেটে যায় সপ্তাহ, মাস, বছর--শেষ হয় না কোর্সগুলো।

"দোস্ত, শুন্সি টিকটিকির লেজে নাকি সবচেয়ে ভাল নেশা হয়। একটু জাম্বাক মিশায় তারপর লেজটা একদম ডাইরেক্ট মুখে দিয়ে দিতে হয়"।
"ধুর ...ল , এগুলা কি বলিস ...দনার মত? ওই দেখ কি সুন্দর সূর্য্য উঠসে"
"হ্যাঁ, আর ওই দেখ, তোর বোরখাওয়ালী আইতেসে এদিক দিয়ে"

বুকের মধ্যে টন টন করে উঠলো তাঞ্জির এর। মনে হল যেন এই মাত্র মুহাম্মদ আলীর মোক্ষম একটি ঘুষি এসে লাগলো তার পাঁজরে। না, পারেনি সে। পিচ্চি মেয়েটা পারেনি তাকে ঠিক করতে। বরং যতটুকু ঠিক ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভেঙ্গে গিয়েছে সে। নেশা করতে করতে আর সিগারেট টানতে টানতে দম আর নেই, গান গাইতে গেলে আসে কাশি, ভুলে যায় এক লাইনের পর দুই লাইন।

তারপরেও যখন মাঝে মাঝে এক দুই দিন গলা ছেড়ে গাইতে থাকে "আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব, তুমি আমার", নিশিকণ্যারা খদ্দের খোজা বাদ দিয়ে কান পেতে শুনে সেই গান, প্রকৃতি যেন থমকে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ফিরে আসে সেই আলোকিত বারান্দা আর হলুদ আভা, গিটারের টূং টাং। কিন্তু সে ভাল অনুভূতি ক্ষণিকের; আসে না কোন বোরখাওয়ালী, ঠিক হয় না কোন কিছুই। আবার আকড়ে ধরে সে নেশাদ্রব্য কে।

বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে সে, আর ১২, ৪৩৪ কিলোমিটার দূরে অন্য আরেকজন কে ঠিক করতে থাকে বোরখাওয়ালী; বাড়ীর সামনে পূরু হয়ে জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করে বেলচা দিয়ে।

শেষ দেখা হয়েছিল বছর দুই আগে। বোরখাওয়ালীর বোবা অভিমান তাঞ্জির এর নেশাগ্রস্থ মস্তিষ্কে কোন ভাবের উদয় ঘটাতে পারে নি।

ঘড়ির কাটা ১২ টা পেরুল, আরেকটা ফাগুন মাস এল।

জ্ঞান হারানোর আগে তাঞ্জির এর শেষ কথাটি ছিল "ফাগুন এর খেতা পুড়ি"।

No comments: