Monday, November 04, 2019

ইরিকারাহা

"ইরিকারাহা"



"রিকি! রিকি! শুনতে পাচ্ছো?"

ডাকটা যেন অনেক দূর থেকে আসছে। কান খাড়া করে শুনেও রিকি বুঝতে পারলো না বার্তাটি কোন ফ্রিকোয়েন্সী তে আসছে। সে তার কপোট্রন থেকে রেডিও সিগ্নালিং ডিভাইসটিতে নির্দেশ পাঠালো সিগনালটিকে আরো ভালো ভাবে টিউন করার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে সিগনালটি পরিষ্কার হল। সে বুঝতে পারলো, ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে তার বন্ধু এরেবাস তাকে খুজছে।

রিখি একজন "গোর্মে ২৯" সিরিজের রাঁধুনি রোবট। প্রথম রাঁধুনি রোবটটির নাম ছিল রামসি। রামসি স্টেক ভালো রান্না করতে পারলেও ভারতীয় কোন ডিশ রান্না করতে গেলেই ভজভট পাকিয়ে ফেলতো।ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্ধ ভোক্তাদের মুহুর্মুহু অভিযোগে সিরিজটি বাতিল করতে বাধ্য হয় এপ্সিলন কর্প।

পরবর্তী কালে একে একে রামসি ২,৩,৪ করে করে ২৫ নম্বর পর্যন্ত রোবট বানিয়েও এপসিলন কর্পোরেশন তাদের মনের মত রাঁধুনি রোবটটি খুজে পেল না। তারপর রিকির বর্তমান বস প্রফেসর শ্যাঙ্কেন আর তার স্ত্রী মায়রেন শেলীন এ প্রজেক্টে যোগ দিয়ে একটি স্বয়ংসম্পুর্ণ মডেল তৈরি করতে সমর্থ হন।

তাদের কাজে খুশী হয়ে এপসিলনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শ্যাঙ্কেন কে বলেন সিরিজটির একটি নতুন নাম দিতে। তার দৃষ্টিতে রামসি নামটা কুফা ব্যাতিত কিছুই না!

অল্প সময়ের মধ্যে গোর্মে ২৬ এর জন্ম হল।গোর্মে ২৯ রিলিজ হবার পর সমগ্র মানব জাতির রান্না করার প্রয়োজনীয়তা উবে গেলো। একটি গোর্মে রোবট রন্ধন কাজে এতই পারদর্শী যে সে একাই হাজার দশেক লোকের দৈনিক খাবারের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারতো।

এপসিলন কর্প এর জন্য সেদিনটি ছিল বিশেষ সম্মানের। এপ্সিলন এর ব্র্যান্ড এর রঙ অনুযায়ী সেদিনটি আজো পালন করা হয় লাল রঙ এর সাজসজ্জার মাধ্যমে। দিবসটি "ইরিকারাহা দিবস" নামে পরিচিত। রোবটদের প্রোগ্রামিং ভাষা চিকিভ এ ইরিকারাহা শব্দটির মানে রক্তিম শুভেচ্ছা।

১৬ সেপ্টেম্বর, ৩০৪২ সাল। জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধাণ নির্বাহী বার্জিলিয়াস ঘোষণা দিলেনঃ

"আমরা পেরেছি!
আমরা পেরেছি মানুষ কে সকল কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে।
আমাদের রোবটেরা এখন সুদূর প্লুটোর রেসিপি থেকে শুরু করে প্রাচীন মিসরীয় ও মেসোপটেমিয় রেসেপিতেও খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে।
আপ্নারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে আমাদের অন্যান্য সিরিজের রোবটগণ গল্প ও কবিতা লেখা, আগুন নেভানো, গ্রহাণুপুঞ্জ ধবংস করা, ট্রেনের টিকেট চেকিং, ব্যাংকের ক্যাশিয়ার এর কাজ সহ যেকোন কাযে আরো আগে থেকেই পারদর্শী। আপনাদের উদ্দেশ্যে আমার চ্যালেঞ্জ, সারাদিন চিন্তা করে একটি কাজ খুজে বের করেন, যা আমাদের রোবট করতে পারবে না।"

এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, "আপনাদের রোবট কি ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে পারে?"

প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন বার্জিলিয়াস। উত্তরে বললেন "আপনি চাইলে সে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তৈরি করে নিজে গেমের ভেতরে ঢুকে গিয়ে খেলে দেখাবে"।

"আমি নিজে ঢুকতে পারবো, ক্যান্ডি ক্রাশের ভেতরে?"
"ইয়ে মানে, আপনার নিজের ঢোকার কি দরকার? সেই প্রযুক্তি তো কবেই পুরনো হয়ে গিয়েছে। প্রোগেমার ৬৬ রোবট আপনার হয়ে এই কাজটি করে দিবে"

তরুণ সেই সাংবাদিকটি খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না। আস্তে আস্তে বল্লো "নিজে করতে না পারলে মজা কোথায়?"।

বার্জিলিয়াস সেটি খেয়াল করলেন না। চলে গেলেন পরের প্রশ্নে।

রিকি বার্জিলিয়াস এর সেই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও ক্লিপটি অনেকবার দেখেছে। রোবটদের ইতিহাস তার প্রিয় বিষয়। যখন রান্না করা লাগে না, তখন অবসর সময়ে বসে বসে সে ইতিহাস চর্চা করে। এই সময়টা সে তার কপোট্রন কে কর্ভাসের সাথে সংযুক্ত করে নেয়। কর্ভাস হচ্ছে কেন্দ্রীয় তথ্যসম্ভার। যেকোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে সব রোবট কর্ভাস এর খোজ করে।

মাঝে মাঝে রিকি শাফল মোডে পুরনো ভিডিও দেখতে থাকে।

আজ হঠাত তার প্রিয় একটি ভিডিও চলে আসে। এক সাথে দু'টি রুমের দৃশ্য। এক রুমে বেশ মোটা মোটা অনেকগুলো লোক। সবার পরনে জল্পাই সবুজ রঙ এর আর্মি পোষাক। অর্ধেক মানুষ ঘুমে, বাকিরাও চরম বিরক্ত। তাদের মধ্যে নেতাগোছের একজন হঠাত বলে উঠলেন

"আবাল গুলার আবলামি শেষ হইসে?"
২/৩ মিনিট পর একজন জানালো "না স্যার, মাত্র শুরু হইলো"।
"যত্তসব বালছাল", বলে নেতা স্ক্রিণের দিকে নজর দিলেম।

স্ক্রিণে আরেকটি রুমের দৃশ্য। ওখানে হলুদ পোষাকের বিপ্লবী দল। শুশ্রুমন্ডিত একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ এই দলটির নেতা। তিনিও ঝিমাচ্ছেন আর একটি বড় স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোটে একটি বেঢপ আকৃতির হাভানা চুরুট এবং মাথায় একটি টুপি। সেই ব্যক্তিটি কি বলছেন তার কিছুই শোনা যাচ্ছে না, শুধু সেন্সর হুওয়ার টুট টুট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

হঠাত এই দুই রুম সরে গিয়ে সেই বড় স্ক্রিণটি ফুটে উঠলো। দেখা গেলো ২টি রোবট দাঁড়িয়ে একজন আরেকজন কে আঘাত করছে। যুদ্ধের দুই পক্ষের প্রতীক হিসেবে একটি রোবটের রঙ জল্পাই সবুজ, আর আরেকটির রঙ হলুদ। ওয়ার সিমুলেটর ৫.১১ এর নিয়ম অনুসারে শুধুমাত্র শলার ঝাড়ু কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

দু'টি রোবট একজন আরেকজন কে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে আঘাত করছে। স্ক্রিণে লেখা উঠছে

"ডিফেন্ডার রোবট ড্যামেজ লেভেল ১১২%

রেবেল রোবট ড্যামেজ লেভেল ১১১.৯%"

কিছুক্ষণ পর ভিডিওটি শেষ হল একটি বার্তার মাধ্যমে।

"৩১৫২ সালে ষষ্ঠ বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়নি। ১০ বছর অপেক্ষা করার পরেও ফল না আসায় ক্লান্ত ও বিষন্ন হয়ে পারষ্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে দুই পক্ষই চলে গিয়েছিল ইরিকারাহা দিবস পালন করতে।

হঠাত রিকির সংবিত ফিরে এল। প্রফেসর এবং তার মিসেস এর লাঞ্চ সার্ভ করার সময় হয়ে গিয়েছে। এরেবাস কে একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা পাঠিয়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে এগুলো রিকি। রান্নাঘরে ওভেন, ফ্রিজ, চুলা সহ সকল আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সুন্দর করে সাজানো রয়েছে। কিন্তু রিকি গত এক শতাব্দীর মধ্যে এগুলো ব্যবহার করেনি। রোবটদের রান্নার জন্য এগুলো কিছুই লাগে না। সে এবার মেনু সাজানো শুরু করেঃ

এসপারাগাস সুপ

রাশিয়ান সালাদ

হায়দ্রাবাদী দম বিরিয়ানী

বন মোরগের রোস্ট

তিতির পাখির ডিম ভুনা

কচি ভেড়ার স্টেক আর ম্যাশড পটেটো

ভায়োলেট ওয়াইন

চিজকেক আইসক্রিম

ভারতীয় বংশদ্ভুত প্রফেসর শ্যাঙ্কেন এর বিরিয়ানী খুবই পছন্দ। তার স্ত্রী মায়রেন এর অবশ্য স্টেক জাতীয় খাবার বেশি পছন্দ। সাথে তারা ভায়োলেট ওয়াইন পছন্দ করে, যা হজম সহায়ক।

অল্প সময়ের মধ্যেই সব রেডি করে ফেল্লো রিকি। এবার অপেক্ষার পালা। প্রায় ঘন্টাখানিক অপেক্ষা করে রিকি আবার টেবিল পরিষ্কার করে ফেল্লো। আজও উনারা এলেন না, ভাবতে ভাবতে রিকি তার পার্সোনাল চার্জিং স্টেশানে ঢুকে গেলো। এই স্টেশনের মাধ্যমে তার ব্যাটারিটি ৯,৯৯৯ বার চার্জ দেয়া যাবে।

প্রায় একশো বছর আগে ইরিকারাহা দিবস পালন করতে গিয়েছিলেন প্রফেসর এবং তার স্ত্রী।

কর্ভাস এর সার্ভার থেকে ঠিক সেই মুহূর্তেই ইরিকারাহা দিবস সংক্রান্ত ভিডিওটি চলতে শুরু করেঃ

"এপ্সিলন গ্রুপ মানব জাতিকে সকল কাজকর্ম থেকে মুক্তি দেয়। এ উপলক্ষ কে উদযাপন করার জন্য জন্ম নেয় ইরিকারাহা দিবসের। প্রতি বছরই লক্ষ লক্ষ মানুষ লাল পোষাক পরে জমায়েত হয় সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে; দিবসটিকে পূর্ণ মর্যাদায় পালন করার উদ্দেশ্য।

তবে মজার বিষয়, প্রতি বছরই একদল মানুষ ইরিকাহারা কে প্রাচীণ জাপানি রীতি হারাকিরির সাথে গুলিয়ে ফেলতে লাগে। প্রথমে এক হাজার, তারপর এক লক্ষ, এরকম করে করে কোটি কোটি মানুষ নিজেদেরকে এই দিনটিতে রক্তাক্ত করে ফেলতে শুরু করে। এভাবে আস্তে আস্তে সৌর জগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবী থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স নামক প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

অসংখ্য গণকবর তৈরি হয়, যাদের প্রতিটির উপরেই লেখা থাকে "এই মানুষটি শেষ পর্যন্ত একটি কাজ নিজে করতে পেরেছিলেন"।

এ সকল হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা অনেকেই রেখে যায় অগাথ সম্পত্তি আর তাদের ব্যক্তিগত রোবট সমূহ। শোনা যায়, সেই রোবটদের অনেকেই, বিশেষ করে ৩০ মডেল এর আগের মডেলের রোবটগুলো এখনও নিষ্ঠার সাথে তাদের গৃহস্থালী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে--শুধুমাত্র এই আশায়, যে তাদের মনিবেরা কোন একদিন আবার ফিরে আসবে।

অবুঝ রোবট গুলো খুবই কিউট।

#ishtiaq_radical

Image: Google

No comments: