Sunday, December 08, 2019

Beirut Diary 9

জীবন একেক জায়গায় একেক রকম। সেরকম, আমার কাছে মনে হয় আকাশও একেক দেশে একেক রকম। ঢাকা শহরের মেঘলা মেঘলা আকাশে দুপুর বারোটার সময় যেমন সন্ধ্যা রাতের মত লাগে, সেরকম অপার্থিব উপলব্ধি আর কোনও দেশে পাওয়া যাবে না, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

বৈরুতের আকাশটাও অন্যরকম ছিল। সব সময় একই ধরণের, শান্ত শিষ্ট মেঘ। গর্জায় না, বৃষ্টি নামায় না, আবার রোদকেও আটকে দেয় সুযোগমত।

ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া খুব উপভোগ করেছিলাম দুইটি মাস। কিন্তু মজার ব্যাপার হল সেই সাগর পাড়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি মাত্র দুই তিন বারের মত।



আসলে আমি তখন খুব বড় ধরণের বিষন্নতায় ভুগতাম। অফিসের বৈরি পরিবেশ, ভাষাগত সমস্যা ও প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে থাকা--এই তিন মিলিয়ে দিনগুলো খুব একটা ভালো যেত না। তবে উইকেন্ডে ঘুরাঘুরি করে সময়টা ভালোই কেটে যেত।

ভাষার সমস্যা নিয়ে একটু বলি। আমরা মনে করি বাংলাদেশে এসে বিদেশীরা অনেক সমস্যায় ভোগে। কিন্তু লেবাননে সমস্যা আরও অনেক বেশি প্রকট। যদিও বা কেউ ইংরেজী জানে, সে তার সেই জ্ঞান প্রকাশ করে না সহজে।

একবার ট্যাক্সি তে করে অফিসে যাচ্ছি। হঠাত ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে আরবীতে কি জানি বলা শুরু করলো। ইশারা ইঙ্গিতে বোঝালাম যে আমি আরবী জানি না। তখন সে ফরাসী ভাষায় কথা শুরু করলো, যা আমার কাছে আরো বেশি দুর্বোধ্য। মাথা নেড়ে অপারগতা প্রকাশ করায় সে বেশ বিরক্তির সাথে ইংরেজী তে জিজ্ঞেস করলো "আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি কোথায় নামবে। তুমি আরবী জানো না?" আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। সে তারপর বল্লো "ফ্রেঞ্চ?", আমি সেটাতেও না বলাতে সে বেশ উগ্রভাবেই বললো "তুমি আরবী জানো না, ফ্রেঞ্চ জানো না, তাইলে কোন দুঃখে তুমি এখানে? (what the hell you are doing here?)।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলে রাখি, লেবানন এর জাতীয় ভাষা আরবী, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজী--অর্থাৎ ইংরেজীর স্থান সবার শেষে। ওদের আরবীও একটু ভিন্ন প্রকৃতির, ওরা একটি বিশেষ বাচনভঙ্গি ব্যবহার করে, যা সৌদি আরব, মিসর কিংবা আরব আমিরাত এর আরব দের আরবী থেকে অনেকটাই অন্যরকম।

আমি সেদিন বেশ দুঃখই পেয়েছিলাম। অফিসেও একই সমস্যার মুখোমুখি হতাম। দেশের কর্পোরেট অফিসগুলোতে একটি অলিখিত নিয়ম আছে; সেটা হচ্ছে কোন মিটিং এ বিদেশী কোন ব্যক্তি থাকলে সেখানে নিজ ভাষায় কথা বলা দোষণীয়। আমি নিজে এটা খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। বিভিন্ন টেলিকমে কাজ করার সুবাদে প্রচুর বিদেশী কন্সাল্ট্যান্টদের সাথে কাজ করতে হোত। আমি কখনই তাদের সামনে বাংলায় কথা বলতাম না; ব্যাপারটাকে আমার কাছে খুবই রুঢ় মনে হোত।

কিন্তু লেবাননে আমার আরব কলিগরা এ ব্যাপারটাকে একেবারে ধর্তব্যে নিতেন না। সারাদিনই তারা তাদের ভাষায় কথা বলে যেত, আর খুব প্রয়োজন না পড়লে আমার সাথে কথাই বলতো না। আমাকে আসলে তারা কলিগ হিসেবে মেনে নিতেই পারেনি; তারা আমাকে দেখতো ভুঁইফোড় কনসালট্যান্ট হিসেবে, যে কিনা তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ থেকে দৈবক্রমে তাদের উপর ছড়ি ঘোরাতে এসেছে।

মজার বিষয় হল, খোদ রাজধানী শহরেও ইংরেজী জানা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শপিং মলে গিয়ে বিপদে পড়েছি প্রায়শই; শেলফে সকল পণ্যের লেবেল আরবীতে থাকতো, আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বুঝতো না। একবার লবণ কিনতে গিয়ে এই বিপদে পড়েছিলাম। "সল্ট" শব্দটা তারা কেউ কোনদিন শুনেছে বলে মনে হয়নি। পরে আমি নিজেই হাতড়ে হাতড়ে খুজে বের করেছিলাম লবণের ডিব্বা।

উইকেন্ডের ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রেও খুব বেশি দুরের কোন জায়গায় যেতাম না। দুই মাসের সফরে অনেকটা সময় কাটিয়েছি সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আর বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরে ঘুরে দোকানপাট দেখে আর বিবিন্ন রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়া করে।

লেবানিজদের জীবন যাত্রায় খাবার ও ফ্যাশান দুইটাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়টায় আমার তেমন কোন আগ্রহ না থাকলেও খাবারের ব্যাপারে আমি বেশ উৎসাহী ছিলাম। প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন ধরণের খাবার খেতাম। এর মাঝে কয়েকটি বিশেষ আইটেম বেশি ভালো লেগে গিয়েছিল, যা বারবার খেয়েছি।

তবে একই রেস্তোরাঁয় দুই তিন বারের বেশি যাওয়া হয়নি। একবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে খুব অস্থির লাগা শুরু করলো। নেমে পড়লাম রাস্তায়। অনেক টেনশন। কাউকেই চিনি না, রাস্তা ঘাটও খুব একটা ভাল করে চিনি না। বেশিদূর যাই না কোনদিন, কারণ পথ হারালে কায়কে যে জিজ্ঞেস করে ফিরে আসবো, সেই উপায়ও নেই।

তারপরেও সেদিন বেশ দূরে চলে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাত খেয়াল করলাম রাত প্রায় ৯টার মত বাজে, আর বেশ খিদাও লেগেছে।

বৈরুত ঠিক "রাতের শহর" নয়। রাত ৮-৯ এর মধ্যে বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। উইকেন্ড ছাড়া অন্যান্য দিনে রেস্তোরাঁগুলিও খুব বেশিক্ষণ খোলা থাকে না। একটি শর্মার দোকান চোখে পড়লো। নাম "হাওয়া চিকেন"।

যদিও শর্মার ভ্যুতপত্তি তুরষ্ক তে, কিন্তু লেবানিজ শর্মাও বেশ বিখ্যাত। কোন এক বিচিত্র কারণে এক মাস পেরিয়ে গেলেও বৈরুতে আমার শর্মা খাওয়া হয়নি তখন পর্যন্ত।

দোকানে ঢুকে ইংরেজী তে বললাম যে আমি শর্মা চাই, দাম কত? দোকানী শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমারও জিদ চেপে গিয়েছিল সেদিন। আমি নানান রকম অঙ্গভংগী করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার মনের ইচ্ছা। কিন্তু কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না, আর আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, তখন দেবদূতের মত আবির্ভূত হলেন একজন লম্বা, একহারা গড়নের ভদ্রলোক। মাথায় চকচকে টাক আর বুদ্ধিদীপ্ত হাসির কল্যানে উনাকে কিছুটা মমি সিনেমার ভিলেন এর মত লাগছিল।

উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কোন সাহায্য লাগবে কি না। আমি বললাম যে একটি শর্মা কেনার চেষ্টা করছি। উনি জিজ্ঞেস করলেন যে কি ধরণের শর্মা লাগবে আমার? এখানে চিকেন, ল্যাম্ব আর চিকেন লিভার এর শর্মা পাওয়া যায়।

আমি দু'টো শর্মা নিলাম। একটা সকালের নাস্তার জন্য, আর একটা রাতের খাবার। চিকেন এবং চিকেন লিভার। বাসায় ফিরলাম দ্রুত। শর্মা দু'টো দেখতে ছিল বেশ সরেস, আর কলিজাযুক্ত শর্মাটি মুখে দিয়েই মনে হল যেন বেহেশতী খাবার খাচ্ছি।



ঢাকায় বহু বনেদি রেস্তোরাঁয় শর্মা খেয়েছি। অন্যান্য দেশেও খেয়েছি। কিন্তু সেদিনের সেই কলিজা শর্মার স্বাদ আমি জীবনেও ভুলবো না।

হ্যা, অবশ্যই আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, কিন্তু শর্মাটিও ছিল স্বাদে অতুলনীয়। কলিজার পাশাপাশি সেটাতে ছিল বিশেষ একধরণের সস, যা ওরা টক দই, কিছু ভেষজ মসল্লা, শৈবাল ও সব্জী মিশিয়ে বানায়। শর্মার রুটিটাও ছিল জিভে জল আনার মত।

(চলবে)









No comments: