Monday, December 23, 2019

Beirut Diary 10

বৈরুতে বনবাসঃ পর্ব ১০

জন্মদিন ব্যাপারটা আসলে দুঃখের একটি ঘটনা। প্রতিটি জন্মদিন আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে জীবন থেকে আরেকটি বছর চলে গেল। তবে যে যাই বলুক না কেন, আমি সেই শিশুকাল থেকেই এই দিনটি কোন না কোন ভাবে উদযাপন করে আসছি। একেক বছর একেক রকম উদযাপন, কিন্তু একটি ব্যাপার সব সময়ই একই থেকেছে, যেটা হচ্ছে পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবের সরব উপস্থিতি।

তবে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসটি ছিল ভিন্ন। সেবার আমি ছিলাম পরিবার পরিজন ও বন্ধুবান্ধব থেকে শত শত মাইল দূরে। জন্মদিনে কি করবো, কিভাবে পালন করবো সেটা নিয়ে খুব দোটানায় ছিলাম। আগে থেকে চিন্তা করে রেখেছিলাম যে দিনটি কে যেভাবেই হোক, স্পেশাল বানাতেই হবে।

সৌভাগ্যজনক ভাবে সেদিনটি ছিল রবিবার। অর্থাৎ অফিস ছুটি।

বাংলাদেশে সারা জীবন দেখে এসেছি শুক্র শনি ছুটি। ছোট থাকতে কিছুদিনের জন্য বৃহস্পতিবার অর্ধ দিবস ছুটিও দেখেছি। কিন্তু শুক্রবার কখনই ছুটি ছাড়া থাকিনি। বৈরুতে প্রথম কয়েক সপ্তাহ শুক্রবার অফিস করতে খুব অদ্ভুত লাগতো। পরে অবশ্য অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অপরদিকে আবার রবিবার অফিস যেতে হচ্ছে না, এ ব্যাপারটাতেও মজা পেতাম।

 এই পর্যন্ত হেটে গিয়েছিলাম

ঠিক করলাম জন্মদিনে সারাদিন কাটাবো সাগর পাড়ে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত যেমন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেরকমই ভূমধ্যসাগরও লেবাননের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে অতপ্রোত ভাবে জড়িত। বৈরুত শহর থেকে সমুদ্র দেখতে হলে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে রাউশে (Raouche) নামক একটি আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় যাওয়া। এই এলাকাটিকে খুব সহজেই সে শহরের গুলশান বনানী বলে চালিয়ে দেয়া যায়। সুউচ্চ এপার্ট্মেন্ট, দামী দামী রেস্তোরাঁ এবং সমুদ্রতটের কারণে উইকেন্ডে সেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা দেখা যেত।


এরকম পানি শুধু সেন্ট মার্টিনে দেখেছি এর পর


অন্য যেকোন দিনের মত সেদিনও সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। মোবাইল হাতে নিয়েই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুভানুধ্যায়ীদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা পড়ে মন ভাল হয়ে গেল। বাছা বাছা কিছু বার্তার উত্তর দিয়ে নাস্তা সারলাম একটি ডবল ডিমের চিজ টমেটো ওমলেট আর কফি দিয়ে।


বের হয়ে কিছুক্ষণ শেয়ার্ড ট্যাক্সি খোজার বৃথা চেষ্টা করলেম। কোন একাকী যাত্রী সেদিন রাউশের দিকে যাচ্ছিল না। একজন ট্যাক্সি চালক আমাকে উপদেশ দিলেন কোন একটি গাড়ীকে রিজার্ভ করে নিয়ে যেতে। অগত্যা তাই করলাম। বেশ মোটা অংকের ভাড়া গুণতে হলো, কারণ জায়গাটা ডেকওয়ানেহ/সালুমে থেকে বেশ খানিকটা দূরে।


রাস্তা ফাকাই ছিল সেদিন। আমার জন্য বিশেষ দিন হলেও বৈরুতবাসীর জন্য সেদিনটি ছিল অন্য যেকোন রবিবারের মতই। আমাকে ট্যাক্সি চালক একেবারে সমুদ্রের পাড়েই নামিয়ে দিলেন। ভাড়া চুকিয়ে হেটে হেটে এগিয়ে গেলাম সমুদ্রতটের দিকে।


সেদিনের আবহাওয়া ছিল খুবই চমৎকার। ঝিরি ঝিরি বাতাস ছিল, কিন্তু ঠান্ডা পড়া শুরু হয়নি তখনো। শীতবস্ত্র ছাড়াই সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বিচের সামনে দেখলাম অনেকেই সাঁতারের পোশাক পড়ে পানিতে নেমে যাচ্ছে। নিজে কেন অতিরিক্ত পোশাক সাথে করে আনিনি সেকথা মনে করে বেশ দুঃখ পেয়েছিলাম সেদিন।


আমার সাথে ছিল একটি সনি পয়েন্ট এন্ড শ্যুট ডিজিটাল ক্যামেরা। আজকাল আর এসব ক্যামেরা তেমন কেউ ব্যবহার করে না, কিন্তু সেসময় ছবি তোলার জন্য মোবাইল অপ্রতুল ছিল আর সবাই ডিএসএলআর জাতীয় ক্যামেরা বহন করতে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো না, তেমনি ওরকম জটিল ক্যামেরা ব্যবহার করার মত জ্ঞানও খুব কম মানুষেরই ছিল।


রাউশে জায়গাটা পিজিয়ন রক (কবুতরের পাথর) নামেই বেশি পরিচিত। জায়গাটা রক অফ রাউশে নামেও পরিচিত। বৈরুতের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে দু'টি সুবিশাল পাথরের ভিত্তি পাহারাদারের মত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে; ভূমধ্যসাগরের তীরে। এটি স্থানীয় এবং পর্যটক--সবার কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি জায়গা।


গ্রীক মিথোলজিতেও রাউশের বড় ভূমিকা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে রাউশে হচ্ছে একটি বড় সামুদ্রিক দানবের অংশবিশেষ, যাকে হত্যা করেছিলেন গ্রীক বীর পারসিউস; এন্ড্রোমিডা কে বাচানোর জন্য। দানবটা পাথর হয়ে গিয়েছে কারণ পারসিউস মেডুসার মাথা দিয়ে এই পাথরের উপর আঘাত করেছিল। আর মেডুসার চোখের দিকে তাকালে যে পাথর হয়ে যেতে হয়, সে গল্প মোটামুটি সবারই জানা।

ট্যাক্সি থেকে যে জায়গায় নামিয়ে দেয়, সেখান থেকে কবুতর প্রস্তরের কাছে যেতে হলে বেশ খানিকটা জায়গা নামতে হয়। নামার রাস্তাটা বেশ দূর্গম ছিল। বেখেয়ালে হাটলে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙ্গার সমূহ সম্ভাবনা। খুব সাবধানে, আস্তে আস্তে নামলাম।


খুব একটা কষ্ট হয়নি, কারণ পুরো এলাকাটা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আধার। চারপাশে মুগ্ধতা নিয়ে তাকাতে তাকাতে, ধীরে সুস্থেই নেমেছি পুরোটা পথ।

আমার হাতে সময়ের অভাব ছিল না। সাথে আর কেউ না থাকায় কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না সামনে আগানোর কিংবা পেছনে যাওয়ার। যেতে যেতে ক্লিকিং চলছিলো অবিরাম। সাথে একটা মোবাইল থাকলেও সেটা একবারের জন্যেও বের করার প্রয়োজন বোধ করিনি।

বৈরুত আমার দেখা সবচেয়ে ব্য্যবহুল জায়গাগুলোর মধ্যে একটি; অন্তত মোবাইল ব্যবহারের খরচের দিক দিয়ে। সেখানে প্রতি মিনিট কথা বলার জন্য গুনতে হতো ৩৮ সেন্ট, এবং হ্যা, এটি ইউএস ডলারের সেন্ট। অর্থাৎ টাকার বর্তমান মূল্য মান হিসেব করলে (১ ডলারে = ৮৬ টাকা) প্রতি মিনিট কথা বলার জন্য খরচ হয় প্রায় ৩৪ টাকার মত! অথচ, সেই যুগেই বাংলাদেশে কল রেট নেমে এসেছিল মিনিট প্রতি এক টাকারও কমে।


লেবাননে এটা আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল। সব জায়গায় সকল মূল্য তালিকা মার্কিন ডলারে দেয়া থাকতো। যদিও "লেবানিজ পাউন্ড" বলে একটি জিনিস পাওয়া যেত সেই দেশে, কিন্তু মূদ্রাস্ফীতির কারণে সেই পাউন্ড এর তেমন কোন দামই ছিল না। ঐ যুগে এক ডলারের পরিবর্তে হাজার খানিক এলবিপি (LBP = Lebanese Pound) পাওয়া যেত, যা বর্তমানে দেড় হাজারেরও বেশি। প্রথম প্রথম আমি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি একেবারেই।

একদিন হোম ডেলিভারী দিতে আসা এক ব্যক্তি কে এক হাজার পাউন্ডের একটি নোট টিপস হিসেবে দিয়ে বেশ প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। কিন্তু দেখলাম লোকটির মুখে বিরক্তি এবং আহত আহত ভাব। ইংরেজী জানে না বিধায় সে আমাকে মনের ভাব বোঝাতে পারেনি, কিন্তু পরে আমি বুঝেছিলাম যে এক হাজার পাউন্ড আসলে তেমন কোন টাকাই না। এরপর অন্ত দু'তিন হাজার পাউন্ডের কমে কখনো কাউকে টিপ্স দেইনি।

ডাকাতমূলক কলরেটের পাশাপাশি ইন্টার্নেট ব্যবহারের খরচও অমানবিক লেভেলে ছিল। এখন যেভাবে ইন্টার্নেট ব্যবহার করি, সেই সময় তা করতে গেলে পকেটের সব টাকা তো শেষ হোতই, আর বাকি খরচ চালানোর জন্য জিনিসপত্রও বিক্রী করা লাগতো।

সেসময় মোবাইলের চেয়েও আমার কাছে প্রিয় ছিল আমার আইপড টাচ ডিভাইসটি। এপল কোম্পানী আইফোন রিলিজ করার আগে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্যাজেটসমূহের মাঝে ছিল আউপড ও আইম্যাক কম্পিউটার।

আমার আইপডটি ছিল টাচ মডেল এর। গান শোনার পাশাপাশি এতে ছবি আর ভিডিও দেখার ব্যবস্থাও ছিল। মনে আছে, সেদিনের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ একাকী সংগীত সূধা উপভোগ করেছি। "উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার" শুনতে শুনতে বেশ আবেগী হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু আবার একাকীত্ব টাকেও উপভোগ করেছি ইচ্ছেমতই।

সকাল দশটার দিকে পৌছিয়েছিলাম রাউশে তে। হেটে তীরে নামতে নামতে দুই ঘন্টা লেগে গেল প্রায়। নিরবিচ্ছিন্নভাবে নামলে আরো কম সময় লাগতো অবশ্যই।

তটে নেমে একটি রেস্তোরাঁ আবিষ্কার করলাম। সেটির নাম "বে রক রেস্তোরাঁ"। গ্রিলড প্রণ অর্ডার দিয়ে বসে বসে অনেক্ষন সমুদ্র আর পায়রার পাথরের অসামান্য ভিউ উপভোগ করলাম। খাবারটি আসার পর বেশ মজা করে খেলাম। বড় বড় গ্রিল করা চিংড়ী মাছের সাথে লেবুর রস আর সাদা সস মিশুয়ে খেতে অসাধারণ লেগেছিল।


একা একা খাচ্ছিলাম দেখে সামনের টেবিলের দুই তরুণী আমার দিকে করুণা মিশ্রিত বিদ্রুপের হাসি দিচ্ছিল। এই প্রসংগে খুব একটা আলোকপাত করা হয়নি এ পর্যন্ত, তবে লেবানিজ তরুণীরা দেখতে খুবই সুন্দর। তারা এতটাই সুসজ্জিত থাকতো সব সময়, যে তাদের দেখে আমার নিজের মাঝেও পোষাক সংক্রান্ত সচেতনতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল সেই দুই মাসে। এমন কি আমার অফিসের কলিগেরাও প্রতিদিন সকালে এমনই সাজ দিয়ে আসতো যেন মনে হোত কোন পার্টিতে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে ছেলে অপেক্ষা মেয়ের সংখ্যাই ছিল বেশী!

আমি বে রক রেস্তোরাঁয় বসে দুই তরুণীকে আমার সর্বাপেক্ষা কিউট, নারী হন্তারক হাসিখানা উপহার দিলাম---দু'জনের একজন কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল বলে মনে হলো। বেশ কিছুক্ষণ তারা নিজেদের মধ্যে কানাকানি করলো। আমিও খাওয়ার ফাকে ফাকে সেই তরুণীর গালের লাল আভা উপভোগ করতে রইলাম। আশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল মেয়েটি, কিন্তু আমি নিজের "গাড়ল বাংগালী" ইমেজ কে ধ্বংস করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। বিল পরিশোধ করে উঠে গেলাম, এবং শেষ পর্যায়ের হাঁটা শুরু করলাম।

এবার চলে এলাম একেবারে পিজিয়ন রকের সামনে। এখানে বেশ কিছু চমৎকার ছবি তুল্লাম। এক পর্যায়ে কবিতাও লিখতে ইচ্ছে করছিল।


এক সময় বের হয়ে এলাম সেখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম রাউশের শহুরে অংশতে, যা কিনা প্লাজা নামে পরিচিত। সেখানে ডাংকিন ডোনাটস থেকে দু'টি ডোনাট ও এক কাপ কফি অর্ডার দিলাম। খাবার নিয়ে বসে ভাবতে লাগলাম, এরকম একাকী জন্মদিন কি আর কখনও পার করতে হবে?

ফোনের কল লিস্ট চেক করে দেখলাম যে না, সেদিন কোন কলই আসেনি। একটু দুঃখ পেলাম। ভেবেছিলাম অন্তত বাসা থেকে কেউ না কেউ তো ফোন করবেই। তারপর টাইম জোন এর কথা মনে পড়লো।

বিষন্নতা পুরোপুরি গ্রাস করে নেয়ার আগে তিতকুটে কফিখানা শেষ করছিলাম। এক সময় সন্ধ্যা নামলো, উঠে দাঁড়ালাম...

(চলবে)

No comments: