Saturday, December 14, 2019

দাদার গল্প ৩

পচানব্বুই বছর কি কেউ বাচে? আপনাদের পরিচিত কেউ কি এতদিন বেঁচেছে? আমার খুব ভাবতে ভাল লাগে যে একদিন মানুষ বিভিন্ন রোগ শোক আর জরা কে জয় করবে--সবার আয়ু বেড়ে যাবে, আর প্রিয়জনেরা একজন আরেকজনের সান্নিধ্য উপভোগ করতে পারবে আরও বেশিদিন ধরে।
আমার দাদা বেঁচে থাকলে ২০১৯ সালে উনি ৯৫ বছরে পা দিতেন। উনার জন্মদিনটি কারও জানা নেই। সার্টিফিকেটে একটা দিন দেয়া আছে, কিন্তু সেটা সম্ভবত সঠিক নয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, একজন পচানব্বই বছর বয়সি মানুষ কিভাবে দুনিয়াটাকে দেখবেন। একজন সুস্থ, সবল ও প্রাণবন্ত পচানব্বই বছর বয়সী দাদার জন্য মনটা আনচান করে। পরমুহূর্তে মনে পড়ে, আমার জন্মের ৯ বছর আগেই তো দাদা হারিয়ে গেছেন। তখন উনার বয়স ছিল ৪৭; আমার এখনের বয়সের চেয়ে ৮ বছর বেশি। আমি না হয় দাদা কে পাইনি, কিন্তু আমার আব্বা, চাচারা এবং ফুফুরা যে পিতৃহীন হলেন ছোটকালে, সেটার কষ্টটা নিশ্চয়ই আরো অনেক বেশি কষ্টের ছিল। ছোট চাচা ও ছোট ফুফু তখন নেহায়েত শিশু; বড় চাচা মাত্র পাশ করে চাকুরীতে ঢুকেছেন, আর আমার বাবা মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন দাদা, দাদী এবং উনাদের পরিবার। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে সুখী ও শান্তিপূর্ণ জীবন। উনার ছোট ভাইও থাকতেন সেখানে।
বিএ পাশ করে যোগ দিয়েছিলেন কাস্টমস বিভাগে। উনি ছিলেন সাতকুচিয়া গ্রাম থেকে বিএ পাশ করা প্রথম ব্যক্তি। কিন্তু সে চাকরীতে বেশিদিন টিকতে পারেননি তিনি।
অধস্তন এক কর্মচারী ঘুষ গ্রহণ করেছেন জানতে পেরে উনি বিশেষ ভাবে ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। পরে উনাকেও ঘুষ সাধা হলে রাগান্বিত হয়ে চাকরী ছেড়ে দেন। অন্য অধিদপ্তরে যাওয়ার প্রস্তাবও নাকচ করে দেন সরাসরি।
এই চাকুরী ছাড়ার পর ঢাকাস্থ আরমানিটোলা স্কুলে শিক্ষকতার জন্য ট্রেনিং নিতে থাকেন। এর মাঝেই উনাকে শিক্ষকতা করার প্রস্তাব দেয় স্কুল কতৃপক্ষ। একই সাথে ট্রেনিং এবং টিচিং এর এক অনবদ্য বিন্যাসে চলতে থাকে উনার চাকুরী জীবন।
উনি M.Ed করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের Institute of Education and Research (IER) থেকে, এবং পরবর্তীতে State College of Colorado, United States থেকে ১৯৬৭ সালে Ed. D ডিগ্রী পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং সেসময় থেকেই পরিবারসহ বাস করতে থাকেন ফুলার রোড এর বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টারে।
১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। সকাল ১০-১১ টার মত বাজে। নাস্তা খেয়ে সবাই যে যার মত কাজে ব্যস্ত। দাদা পেপার পড়ছিলেন। ততদিনে সবাই বুঝে গিয়েছে যে আমাদের বিজয় আসন্ন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে পাকবাহিনী ও প্রশাসনের নাস্তানাবুদ হবার টুকরো টুকরো সংবাদ। সেদিনের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এই খবরটিঃ
"DACCA, Pakistan, dec. 14- The entire regional government of East Pakistan resigned today, dissociating itself from further actions from the central administration of President Agha Mohammad Yahya Khan in the country's West.
Dr. A.M.Malik, Governor of East Pakistan, wrote the draft of the resignation letter for his cabinet to President yahya Khan with a shaking ballpoint pen on a scrap of office paper as Indian MIG-21's destroyed his official residence, Government House. "
দেশে নিউইয়র্ক টাইমস পাওয়া যেত না, কিন্তু অন্য, দেশী পত্রিকা ঠিকই পাওয়া যেত। এরকমই কোন হেডলাইন পড়ে হয়তো দাদার মুখে ফুটে উঠিছিল এক চিলতে মিষ্টি হাসি। আবার ক্ষনিকের বিষন্নতাও হয়তো তাকে গ্রাস করেছিল। আব্বার কাছে শুনেছি, আগের দিন রাতে উনি কেন জানি উনার সব সন্তান কে আদর করছিলেন ঘুমের মধ্যে। হয়ত মনে মনে জানা হয়ে গিয়েছিল দাদার; এই আদর আর কখনোই দিতে পারবেন না সন্তানদের।
আব্বা টের পেয়েছিলেন, কিন্তু ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিলেন। দাদার মত কড়া মেজাজের মানুষের কাছ থেকে এধরণের কোমল আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। এই আদর এতটাই ভিন্ন ছিল যে আজও আব্বাকে সেদিনের কথা জিজ্ঞেস করলে উনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
দাদাকে সেদিন সকালে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা অপহরণ করে নিয়ে যায়, এবং সেদিনই উনাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। বাসা থেকে বের হবার আগে উনাকে রেডি হবার সুযোগ দেয়া হয়, এবং উনি ফর্মাল পোষাক পড়েই বাসা থেকে বের হন।
পাকবাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর আত্নসমর্পণ করে--আমরা জয়ী হই। অবসান হয় দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের। তারও প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে দাদার লাশ খুজে পাওয়া যায় রায়েরবাজার বদ্ধ্যভূমিতে।
সেসময়ের একটা খুব অদ্ভুৎ ছবি আছে আমার পরিবারের কাছে। ছবিটা আমার হাতে নেই এই মুহুর্তে; থাকলে হয়তো শেয়ার করতাম। মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে কোন ছবি ছিলই না। আমি হয়তো মনে মনে দৃশ্যটা কল্পনা করে নিয়েছিলাম।
দাদার কংকালের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সন্তানেরা। গায়ের কাপড় আর হাতের ঘড়ি দেখে উনাকে সনাক্ত করতে হয়েছিল, কারণ লাশ পচে গলে গিয়েছিল ততদিনে। ভাইদের মুখে খুব করুণ একটা চাহনি, কিন্তু ছবি তোলা হচ্ছে তাদের, সে ব্যাপারেও তারা সচেতন। সম্ভবত লাশের দায়িত্ব নেয়ার জন্য এই ছবিটা তোলা বাধ্যতামূলক ছিল।
শিশু অবস্থায় এই ছবিটা আমি একদিন দেখে ফেলি। যখন আমি অবাক হয়ে ছবিটা হাতে নিয়ে দেখছিলাম, তখন আমাকে জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। কে সরিয়েছিল, সেটা আমার মনে নেই একদমই। চাচা ফুফুদের কেউই হবেন। দাদী ও হতে পারেন। আবার এই ঘটনাটি আমার শিশুমনের কল্পনাও হতে পারে। আমি এখনো নিশ্চিত নই এ ব্যাপারে।
কিন্তু সেই ছবি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছে চির জীবনের জন্য। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই সেই করুণ চাহনি। আমার বাবা ও তাদের ভাইদের। বাবার কাছেই বিস্তারিত শুনেছিলাম সেদিনের কথা। কিভাবে উনারা দাদাকে ওখান থেকে নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশের কবরস্থানে দাফন করেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবরের পাশেই দাদার কবর।
এরকম কত দূঃখের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেশের মানুষের মাঝে। বাবার জন্য দুঃখ করতে করতে কত সন্তান বড় হয়ে দাদা নানাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাদের এই কষ্টগুলো কখনো চলে যাবে না।
সেরকম, কখনোই মুছে যাবে না এই রাজাকারদের ঘৃণ্য কাজের চিহ্নগুলো। তাদেরকে "শহীদ" বলে ডাকলেও তাদের অপকর্মের ওজন একটুও কমবে না।
ইহজগতে না হলেও পরজগতে তারা ঠিকই তাদের কৃতকর্মের ফল পাবেন।
আজ আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবি ডঃ সিরাজুল হক খান এর প্রয়াণদিবস। আপনারা সবাই দয়া করে উনার আত্মার মাগফিরাতের জন্য দু'আ করবেন। সাথে অন্য সকল শহীদদের জন্যেও।

No comments: