Monday, November 30, 2020

নস্টালজিয়া ৬ঃ প্রথম স্কুল


এখনের মত আমাদের যুগে এত ক্লাস ছিল না। নার্সারি, কেজি ওয়ান টু, প্লে গ্রুপ, প্রি স্কুল--এসব শব্দ শুনিওনি তেমন একটা। মায়ের কাছে পড়তাম শুরুতে। তিনিই আমাকে বাংলা ও ইংরেজী লেখা ও পড়া শিখিয়েছেন। তিনিই আমার প্রথম বিদ্যালয়।

এরপর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলাম সদ্য প্রতিষ্ঠিত সৌদি আরবের দাম্মাম শহরের "বাংলাদেশ দূতাবাস স্কুল" এ।

সে স্কুলটি সম্ভবত এখন আর নেই, বা থাকলেও, তার নাম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। সে সময় প্রথম শ্রেনীতে আমরা ৮-১০ জন ছাত্র ছাত্রী ছিলাম মাত্র।

আমাদের প্রিন্সিপাল ছিলেন হাসিখুশী ধরণের একজন ভারতীয় মহিলা। উনার ব্যাপারে তেমন কিছু মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে উনি আমাদের গণিত পড়াতেন। অসম্ভব ফর্সা, গোলগাল চেহারার এই মানুষটি মোটা গোল ফ্রেমের চশমাও পড়তেন।

ক্লাস ওয়ার্ক কিংবা হোমওয়ার্কে ফুল মার্ক্স পেলে তিনি "এক্সিলেন্ট" লিখে নিচে একটি সোনালী তারার স্টিকার লাগিয়ে দিতেন। সেই সোনালী তারা পাওয়ার যে আনন্দ ছিল, সেটা সম্ভবত আজকাল শিশুদের জিপিএ ফাইভ পাবার আনন্দের চেয়েও অনেক, অনেক বেশি ছিল। সব উত্তর সঠিক না হলেও সমস্যা ছিল না, রুপালী তারকা পাওয়া যেত। এভাবে সব ছাত্রকেই কোন না কোন পুরষ্কার পেতে দেখে সেই শৈশবেই সাম্যবাদ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিলাম।

সে সময় আমার বাবা দাম্মাম শহরের একটি কন্সট্রাকশান কোম্পানীতে জ্যেষ্ঠ স্থপতি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উনার অফিস যে দালানে ছিল, সেই একই দালানেরই অন্য একটি তলায় আমরা ছোট একটি এপার্টমেন্টে থাকতাম।

সকাল বেলায় আমাকে স্কুলে নেয়ার জন্য গাড়ী আসতো। স্টেশন ওয়াগন টাইপের একটি গাড়ী ছিল সেটি।

আমাকে সবার আগে নিতে আসতো, আর ড্রপ করতো সবার শেষে। শহরের এক প্রান্তে বাসা হবার কারণে এই যন্ত্রণা পোহাতে হোত।

ড্রাইভার ছিলেন একজন বাঙ্গালী, ধার্মিক ব্যক্তি। উনার গায়ে থাকতো ইসলামী লেবাস, আর মাথায় থাকতো টুপি। তিনি কখনো ট্রাফিক সিগ্নাল ঠিক মত মানতেন না। লাল বাতি দেখলেও গাড়ী চালিয়ে যেতেন, আর সবুজ দেখলে থেমে যেতেন কখনো কখনো। হলুদ বাতির কাজ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না।

আমার সাথে তার বেশ খাতির ছিল। আমি সবার আগে উঠতাম বিধায় সামনের সিটে, তার পাশেই বসে যেতাম প্রতিদিন, এবং যাত্রাপথে টুকটাক আলাপও হোত। তিনি দেশের গল্প করতেন, যার বেশিরভাগই আমার মাথার উপর দিয়ে যেত। যতদূর মনে পড়ে, তিনি তার সন্তানদের খুব মিস করতেন। মাঝে মাঝে পেছনের বাচ্চারা বেশি শব্দ করলে ভ্রকুটি করতেন, কিন্তু কখনো কাউকে বকা দিতেন না।

একদিন ট্রাফিক সিগ্নালের পুরো ব্যাপারটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এবং তিনি খুব অবাক হবার ভান করলেন। পুরোটা সময় জুড়ে তিনি শুধু "তাই নাকি? আমি তো জানতামই না" ধরণের বাক্য বলে বলে ক্লাস ওয়ানের এক মাতব্বর শ্রেণীয় ছাত্রের লেকচারটি (!) হজম করলেন। আমিও বেশ খুশি হলাম এটা ভেবে যে বৃদ্ধ এক ব্যক্তিকে অনেক কিছু শিখিয়ে ফেলতে পেরেছি।

সিগ্নাল অমান্য করার পাশাপাশি অহেতুক স্পিড ওঠানো এবং ওভারটেক করার মত লঘু অপরাধও তিনি নিয়মিত করতেন। বেশি স্পিডে গাড়ী চালালে আমাদের বেশ আমোদ হোত। আমরা হৈহুল্লা করে উনাকে উৎসাহ দিতাম।

সব মিলিয়ে আমরা, গাড়ীর শিশু যাত্রীরা উনাকে পছন্দই করতাম। উনি ছিলেন আমাদের "ইউসুফ আংকেল"।

হঠাত একদিন স্কুল ছুটির সময়ে দেখলাম নতুন, অচেনা একজন ড্রাইভার গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। আমরা খুব অবাক হলাম। সকালে ইউসুফ আংকেলকে চুপচাপ দেখেছিলাম। তবে আমরা আমাদের স্বভাবসুলভ চপলতার সাথেই স্কুলে এসেছি, একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি চুপচাপ আছেন কিংবা তার মন খারাপ, এত কিছু বোঝার মত বয়স আমাদের তখনও হয়নি।

কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনি এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। বলে উঠলেনঃ

"আংকেল, তোমরা ভাল থেক। আমি চললাম"
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম "আপনি কই যাচ্ছেন?"
"চলে যাই । আমার আর এখানে রিজিক নাই"

(রিজিক শব্দের মানে তৎক্ষণাৎ বুঝিনি। পরে জেনেছি)

আমরা অবাক হয়ে উনাকে মাথা নিচু করে চলে যেতে দেখলাম। দেখে মনে হচ্ছিল ডুয়েলে পরাজিত হয়ে একজন কাউবয় সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন; ক্লিন্ট ইস্টউডের সিনেমার মত।

পরে জেনেছিলাম যে উনার নামে একাধিক ছাত্র ছাত্রীর অভিভাবকেরা অভিযোগ এনেছিলেন, যে কারণে স্কুল কতৃপক্ষ তাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুদিন পরে তিনি দেশে ফিরে যান।

নতুন ড্রাইভারের সাথে আমাদের তেমন কোন সখ্যতা হয়নি। উনি গম্ভীর এবং চুপচাপ প্রকৃতির ছিলেন, এবং কিছুক্ষন পরপর বিরক্তিকর ভঙ্গিতে "ফুলাফান, তুমরা চিল্লাফাল্লা করিও না" বলে উঠতেন।

#নস্টালজিয়া
পর্ব ৬ঃ প্রথম স্কুল

No comments: