Monday, November 30, 2020

আপনি আরবে কাজ করে কতটা সন্তুষ্ট?

মূল পোস্টঃ 

https://bn.quora.com/apani-arabe-kaja-kare-katata-santusta-o-khusi 


আপনি আরবে কাজ করে কতটা সন্তুষ্ট? 

এই প্রশ্নের উত্তরে নিচের লেখাটি লিখেছিলাম কোরা তে। কোরা হচ্ছে একটি প্রশ্নোত্তর সংক্রান্ত জনপ্রিয় ওয়েবসাইট। 


 চ্যাপটার ১

আমার আব্বা সৌদি আরবে চাকুরী করতেন। একটা আর্কিটেকচারাল কন্সাল্টেন্সী ফার্মে। প্রায় আট বছর কাজ করেছেন ওখানে। জায়গাটা ছিল দাম্মাম নামক একটি ছোট শহরে।

উনার কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে যে আরব দেশে চাকুরী করার অভিজ্ঞতাগুলো অম্ল মধুর ছিল। আয় রোজগার ভালো ছিল, কিন্তু বসদের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান ও ভালো ব্যবহার সব সময় পেতেন না। কোম্পানীর মালিকেরাই ছিলেন বস।

তাদের মধ্যে শিক্ষা দীক্ষা এবং যথোপযুক্ত কর্পোরেট কালচারের অভাব ছিল। তারা রুমে বসে সারাদিন খাওয়াদাওয়া করতো এবং আড্ডা মারতো নিজেদের মধ্যে। হঠাত হঠাত তাদের বেগমদের আগমন ঘটতো অফিসে, সাথে কখনো কখনো আন্ডা বাচ্চাও নিয়ে আসতো। তখন বদ্ধ রুমের ভেতর থেকে হাউ কাউ শোনা যেত। বস, বসের পুত্র, তার পুত্র—এরা সকলেই বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন। সে কারণে বাসায় তাদের খাওয়া দাওয়ার উপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপিত থাকতো। সেই বিধিনিষেধ গুলো কে কাচকলা দেখিয়ে উনারা অফিসে খাওয়া দাওয়া করতেন, আর সেই উৎসবে বাগড়া দিতে আসতেন বেগমগণ। বেগমগণ বলছি কারণ অনেকেই ইসলাম ধর্মের চার বিয়ে করার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেন।

সব মিলিয়ে অফিসে একটি এলোমেলো পরিবেশ বিরাজ করতো প্রায় সময়ই। ভাবছেন আমি, আমার শৈশবে এত কিছু কিভাবে জানতাম? ঐ অফিসে কাজ করার একটি ভালো দিক ছিল যে একটি বহুতম ভবনের দুইটি তলা নিয়ে ছিল অফিসটি, আর অন্যান্য বিভিন্ন তলায়, কর্মীদের পরিবারসহ বিনা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা ছিল।

এ কারণে আমি ৬/৭ বছরের শিশু হওয়া স্বত্তেও অফিসের অনেক ঘটনা নিজের চোখেও দেখেছি। বাবার মুখে শুনেছি বাকিগুলো। আমাকে বলতেন না, কিন্তু মা কে বলতেন। আর আমি শুনে ফেলতাম!

এত অব্যবস্থাপনার পরেও দক্ষ কর্মীদের কল্যাণে কাজগুলো হয়ে যেত। বেশিরভাগ কর্মীই ছিলেন বিদেশী—কেউ ভারতীয়, কেউ পাকিস্তানী, আর অল্প কয়েকজন বাংলাদেশের। এই বিভিন্ন দেশী সহকর্মীরাই নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগাভাগি করে নিয়ে সুচারু ভাবে প্রতিটি প্রজেক্ট নামিয়ে দিতেন—এসব কাজে আরব বস দের অবদান খুব কমই থাকতো। সময় মত বেতন দিয়ে আর কালেভদ্রে রুমে ডেকে নিয়ে দু'কথা শোনানো ছাড়া তারা তেমন কিছু করতেন না বলেই জেনেছি সর্বদা।

তবে মাঝে মধ্যে ভোজের আয়োজন হোত। সে এক আলিশান ব্যাপার। আস্ত উট জবাই করে, মুরগীর ও ভেড়ার রোস্ট সহযোগে, পুরাই সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমানের মত করে খাবার পরিবেশ করা হোত। এত এত খাবার দেখে যখন মুখ শুকিয়ে যেত, তখন কেউ একজন ঠিকই বলতো "চিন্তা নেই, আরো আছে!"

ভালো খারাপ মিলিয়ে আট বছর পার করার পর বাবা সিদ্ধান্ত নেন যে "আর নয়, এবার নিজের দেশে ফিরে নতুন ভাবে জীবনটা শুরু করবো"। সেই আশির দশকের শেষের দিকের কথা। দেশে ফিরে এলাম আমর।

চ্যাপটার ২

প্রায় ১১ বছর টেলিকমে চাকুরী করার পর আমার একটা সুযোগ আসে, তিন মাসের একটি স্বল্পকালীন প্রজেক্টে যাওয়ার। প্রজেক্টটি লেবাননের প্রধাণ টেলিকম অপারেটর "আলফা টেলিকম" এর সাথে, থ্রিজি এবং কর্পোরেট মার্কেট সংক্রান্ত কনসাল্টেন্সি।

আমি সুযোগটি লুফে নেই, এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই বেশ বড়সড় একটি স্যুটকেস সমেত বৈরুত এর রফিক হারিরি বিমান বন্দরে অবতরণ করি।

তিন মাসের প্রোজেক্ট দু'মাসেই শেষ হয়ে যায়। প্রথম দিন থেকেই আমি একটি বিরুপ পরিবেশ দেখতে পাই অফিসে। সেখানকার আরব কর্মীগণ বাংলাদেশ থেকে আসা কনসাল্ট্যান্ট কে কেন জানি সহ্যই করতে পারছিলেন না।

প্রথমেই আমি ভাষাগত বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। সে দেশের প্রধাণ ভাষা আরবী এবং ফরাসী। এরপর তৃতীয় ভাষা ইংরেজী। ট্যাক্সি চালক থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট এর বেয়ারা, শপিং মলের কর্মী, পথচারী, এবং কোন কোন কলিগও ইংরেজী ব্যবহারে চরম ভাবে অনিচ্ছুক ছিল।

আমরা, বাংলাদেশে, বিদেশী কোন সহকর্মী পেলে তাদের সামনে কখনো মাতৃভাষায় কথা বলি না। এটা এক ধরণের অভদ্রতা। আর যদিও বলতে হয়, তাহলে অনুমতি নিয়ে বলি। কিন্তু লেবাননের লোকজন এই ব্যাপারটাকে একদমই পাত্তা দিতো না।

আমাকে সাথে নিয়ে যেত লাঞ্চ করার সময়, কিন্তু আরবীতে কিচির মিচির করতে থাকতো সহকর্মীরা। আমি এক বর্ণও বুঝতাম না। এক আধ দিন আমাকে দুই একজন আরবীতেই প্রশ্ন করে ফেলতো কিছু না কিছু। আমি না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম, কিছু বলতাম না। তখন অন্য কেউ আমাকে উদ্ধার করতো।

আর আমি যখনই কোন পরিকল্পনা তাদের সাথে শেয়ার করতাম, তারা সেটা তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দিত। ব্যাপারটা ছিল এরকম যে "এই বাঙ্গালী যাই বলুক না কেন, আমরা শুনবো না। ও কি জানে?"

স্বভাবতই, আমার প্রজেক্টটি খুব একটা সুবিধাজনক ভাবে এগুচ্ছিল না। এক পর্যায়ে আমিও বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। আমি আমার কাজ সুচারু ভাবেই শেষ করলাম; আমার সকল সুপারিশ গুলো গুছিয়ে, সুন্দর করে প্রেজেন্টেশান বানিয়ে তাদের সকল বসদের পাঠিয়ে দিলাম।

যদিও আমার প্রজেক্ট তিন মাসের ছিল, দু'মাসের মাথায় ওদের মানব সম্পদ অধিদপ্তর থেকে আমাকে জানানো হলো যে তারা আমাকে আরও এক মাসের জন্য রাখতে চায় না। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাচলাম। দ্রুতই দেশে ফিরে এলাম।

এই হল আমার এবং আমার বাবার আরব দেশে কাজ করার অম্লমধুর অভিজ্ঞতা।

No comments: