Thursday, November 19, 2020

নস্টালজিয়া ৫ঃ কুক্কু ঘড়ি

আমার দাদুর বাসায় একটি সুদৃশ্য দেয়াল ঘড়ি ছিল। ঘন্টার কাটাটি একবার পুরো ঘুরে আসলেই ঘড়ির উপরের দিকে একটি দরজা খুলে যেত, আর সেখান থেকে একটি পাখি বের হয়ে এসে "কুক্কু কুক্কু" ধরণের একটি শব্দ করতো। যতটা বেজেছে, ঠিক ততবার এই কুহু ধ্বনি করে, তারপর পাখিটি পুনরায় তার স্বীয় প্রকোষ্ঠে ফিরে যেত। এ ছাড়াও, প্রতি আধ ঘন্টা পরপর সে তার বাসা থেকে বের হয়ে এসে একটিবার কুহু ধ্বনি তুলে আবার জায়গামত ফিরে যেত। 







সে সময় বয়স কম ছিল, মনে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা আসতো। ভাবতাম, ঘড়ির ভেতরে পাখির জন্য অসীম শস্যদানা রাখা আছে। ঘন্টার কাটা আবর্তনের মাঝের সময়টিতে সে হয় ঘুমাচ্ছে, আর না হলে শস্য দানা মুখে পুরছে একের পর এক। ব্যাপারটা কল্পনা করে মজা লাগতো। কল্পনার পাখি একদিন বিরাট বড় ডানা মেলেছিল; সেদিন ভেবেছিলাম "আহা, ঘড়ির পাখি হিসেবে জন্ম নিলে খুব একটা খারাপ হোত না। অন্তত খাওয়া দাওয়ার চিন্তা থাকতো না"। 

"কাক্কু/কুক্কু ক্লক" নামের এই ঘড়িটি কোথায় প্রথম নির্মিত হয়েছিল, তা আজ আর জানা যায় না। তবে এটির বেশিভাগ উন্নয়ন, এবং বর্তমান রূপটি এসেছে জার্মানীর ব্ল্যাকফরেস্ট নামক স্থানে। ১৮শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই ঘড়িগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখনো খুজলে এনটিক হিসেবে পাওয়া যায়, আর হালের এমাজন জাতীয় অনলাইন স্টোরে নতুনও পাওয়া যায়। 

এই ঘড়িগুলোতে প্রতিদিন দম দিতে হয়। একবার দম দিলে ঘড়ি চব্বিশ ঘন্টা চলে। এই ব্যাপারটা এখনো অবিকল রয়েছে। 

আমাদের বাসার ঘড়িটি আমার সেঝো চাচা তার বিয়েতে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন, এবং পরবর্তীতে তিনি তা দাদুকে দিয়ে দিয়েছিলেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে, আমার দাদা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডঃ সিরাজুল হক খানের বাসভবনের বৈঠকখানায় সেই ঘড়িটি রাখা ছিল আমার জন্মের আগে থেকেই। 

জন্মের অল্পদিন পরেই আমরা সৌদি আরবে চলে গিয়েছিলাম; আব্বা সেখানে স্থপতি হিসেবে কাজ করতেন একটি প্রতিষ্ঠানে। সম্ভবত ১৯৮৫ সালের দিকে, ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিলাম আমরা, এবং তখনই প্রথম দেখেছিলাম এই ঘড়িটি। তবে সে সময়ের তেমন কোন স্মৃতি নেই। আবছা আবছা মনে পড়ে পাখিটির কথা।  

তারপর ১৯৮৯ তে পাকাপাকি ভাবে আমরা দেশে ফিরে আসার পর থেকে সেই ঘড়ি নিয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি। সে সময় আমাদের কারো হাতঘড়ি কেনার কিংবা ব্যবহার করার অনুমতি ছিল না, এবং পুরো বাসায় সেটিই ছিল একমাত্র, উল্লেখযোগ্য ঘড়ি। দূর থেকে কুক্কু ধ্বনি শুনে বুঝতে পারতাম কয়টা বেজেছে, আর ঘন্টার কাটাটি একবার ঘুরে আসার সময়টায় প্রিয় কাজ ছিল লিভিং রুমে গিয়ে পাখির ডাক শোনা।  কালের পরিক্রমায় ঘড়িটি ফুলার রোড থেকে খিলগাঁয়ে চলে আসে। 

এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সেসময়ের দৃশ্যগুলো। কান পাতলে শুনতে পাই শব্দগুলো। 

পবিত্রতা, ভরসা ও আস্থার প্রতীক হয়ে দাদু সাদা শাড়ী পড়ে বসে আছেন উনার আরামকেদারায়। চোখে চশমা, হাতে দৈনিক বাংলার ফ্রেশ কপি। মগ্ন হয়ে পড়ছেন পেপার। তবে খুবই সজাগ। পাশে দিয়ে বিড়াল হেঁটে গেলেও তার চোখ এড়ায় না। 

এরই মাঝে পেছনের দেয়ালে সেই পাখির ডাক ডাকা ঘড়ির টিক টক চলছে নিরন্তর। পাশে একটি শোকেসে রবীন্দ্রনাথের কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মূর্তি, কক্সবাজারের শামুক ঝিনুকের খেলনা, এবং আরো অনেক কিছু। পাশের বুক শেলফে দাদার সব ইংরেজী বই; আইভানহো, ডক্টর জিভাগো। সামনে একটি পুরনো ফিলিপ্স টিভি আর এনালগ টেলিফোন। 

কবে, কিভাবে, কোথায় যেন সেই ঘড়িটি হারিয়ে গিয়েছে। 

দাদু আমাদের মাঝে নেই অনেক বছর হয়েছে। উনার সাথে সমার্থক, স্মৃতি বিজড়িত বস্তুগুলোও একে একে হারিয়ে গিয়েছে আমাদের জীবন থেকে। খুজলে হয়তো অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে শৈশবের সেই স্মৃতি আর কখনোই ফিরে আসবে না। 

#নস্টালজিয়া

পর্ব ৫ঃ কুক্কু ঘড়ি 

[এই পোস্টের সাথে দেয়া ছবিগুলো ঘড়িটির প্রকৃত ছবি নয়, তবে সেটির ডিজাইন অনেকটা এরকমই ছিল] 

No comments: