Thursday, October 29, 2020

নস্টালজিয়া ৩ঃ নিউজ পেপার




আমি স্কুলে থাকতে ডে শিফটে পড়তাম। বাসা থেকে বের হতাম ১১ঃ৩০ এর দিকে; আর ক্লাস শুরু হত ১২টায়। 

সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম বাবা পেপার হাতে নিয়ে নাশতা খেতে বসেছেন। এই নিয়মের ব্যাতিক্রম হতে দেখিনি কোনদিন। মাঝে দুই একদিন বাবা ওয়াশরুমে থাকতে থাকতে পেপার দিয়ে যেত পেপারবয়, আর সেদিনগুলো ইদের মত লাগতো। 

অন্য কেউ হাতে নেয়ার আগে, নতুন পেপারের ভাজ খুলে সরাসরি ক্রীড়া পেইজে চলে যাওয়ার যে আনন্দ, সেটি ছিল অতুলনীয়। নিউজপ্রিন্ট কাগজের একটি অন্যরকম গন্ধ ছিল, আর তাকে ছোয়ার অনুভবটাও ছিল অনন্য। 

তবে এ আনন্দ হোত ক্ষণস্থায়ী। বেশিরভাগ সময়ই একটি বা দু'টি সংবাদ পড়তে না পড়তেই বাবা এসে পেপারখানা নিয়ে, অফিসে চলে যেতেন। সন্ধ্যের আগে আর সেই পেপার চোখে দেখা হোত না। 

ইতিমধ্যে দাদুর বাসায়ও পেপার চলে আসতো। আমাদের বাসায় রাখা হোত কিঞ্চিৎ আধুনিক মনষ্ক কোন পত্রিকা (প্রথমে আজকের কাগজ, তারপরে ভোরের কাগজ, এবং শেষাবধি প্রথম আলো), আর দাদু রাখতেন "দৈনিক বাংলা"। 

পেপার হিসেবে দৈনিক বাংলার আকর্ষণ কম ছিল, কিন্তু স্কুলের পথে রওনা হবার আগে একটি সুযোগ থাকতো পেপারটি হাতে নেয়ার। এই পেপারের মূল আকর্ষণ ছিল প্রতিদিন প্রকাশ হওয়া টারজান কার্টুন।  
আমরা পেপার পড়ার জন্য কেন এত উতলা ছিলাম? 

আমার কাছে ভাল লাগতো খেলাধূলার খবর গুলো। মোহামেডান ফুটবল ক্লাবের বিশাল ভক্ত ছিলাম। আব্বা এবং চাচারা সবাই। আমাদের বাসার ছাদে মোহামেডানের ফ্ল্যাগও ঝোলানো হয়েছিল একবার। নানা বাড়ীতে আবার সম্পুর্ণ ভিন্ন চিত্র ছিল--সেখানে আবাহনীর সমর্থক বেশি ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, দাবা,--সবরকম খেলার খবরই পড়তাম। 

একবার আজকের কাগজে (কিংবা ভোরের কাগজে) প্রতিদিন একজন করে রাজাকারের ছবি (কার্টুনিস্ট শিশিরের আঁকা ক্যারিকেচার) এবং তার কুকীর্তির বিবরণ থাকতো। খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম প্রতিদিন--আজ কোন রাজাকারের গল্প আসছে? সেই সিরিজের সর্বশেষ দিনের নিউজে কোন ছবি ছিল না, শুধু ছিল একটি টাইটেল "হ্যা, বিশ্বাস আছেন" এবং কিছু ভাসাভাসা বর্ণনা। সে যুগে, ব্যাপারটা বেশ সাহসিকতামূলক ছিল, তা বলাই বাহুল্য।   

এরপর আস্তে আস্তে সংবাদপত্রের কলেবর বাড়তে লাগলো। আসলো ক্রোড়পত্র, বিশেষ সংখ্যা, ইদ সংখ্যাসহ আরো অনেক কিছু। প্রথম আলোর আলপিন খুব প্রিয় ছিল। মজার মজার ব্যাঙ্গাত্নক লেখাগুলো মিস করি। 

এক পর্যায়ে ইংরেজী শেখার উদ্দেশ্যে বাসায় সপ্তাহে দুইদিন (শুক্র আর শনি) ডেইলি স্টার রাখা শুরু হল। মূল উদ্দেশ্য ছিল "রাইজিং স্টার্স" পড়া। আমার মনে আছে, ইংরেজী পত্রিকা পড়ে আমার শেখা প্রথম শব্দটি ছিল Lucrative।  

ইন্টার্নেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এখন আর সেভাবে পত্রিকা পড়া হয় না। এমনকি অনলাইন এডিশনও নিয়ম করে পড়া হয় না। 

বাসায় এখনো প্রতিদিন পেপার আসে। তরুণ পেপারবয় আজ প্রৌঢ় মালিক--বার্ধ্যক্যজনিত রোগে ঠিকমত হাঁটতে পারেন না, তাও দেখা হলে স্মিত হেসে বলেন "তোমার বাসায় একটা পত্রিকা দেই আগামী মাস থেকে?"। প্রতিবারই বিনম্র শ্রদ্ধায় অপারগতা প্রকাশ করি। 

যুব বয়সে মনে হোত একদিন নিজের বাসা হবে, নিজের মত পেপার রাখবো, আর কাউকে না দিয়ে একা একা পড়বো সারাদিন ধরে। 

কিন্তু এর মাঝে যুগ আর সময় এত পালটে যাবে, তা কে জানতো? 

#নস্টালজিয়া
পর্ব ৩ঃ নিউজপেপার 

No comments: