Tuesday, October 13, 2020

সেলফিজ

 সেলফিজ

(বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে)






#৭৩৩

শেষ কয়েকটা ছবির মধ্যে একটায় আমাকে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে। আমি রাস্তার মধ্য দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি, আর চারপাশে আধার নেমে এসেছে। রাস্তার ল্যাম্পগুলো নিভু নিভু, আর সেগুলো থেকে এক ধরণের অশুভ, হলদেটে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমার হৃদপিন্ড এত জোরে ধুকপুক করছে যেন মনে হচ্ছে ফেটেই যাবে যেকোন মুহুর্তে। আমি মুখে এক ধরণের তেতো, বিচ্ছিরি স্বাদ পাচ্ছি। আমি প্রাণপনে ছুটছি; আমাকে এখান থেকে পালাতেই হবে—যে কোন উপায়ে।

আকাশে ইদের মত বাকানো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের মুখমন্ডল ব্রণের দাগে ভর্তি। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে; দেখে মনে হচ্ছে যেন বিকৃত ছুরিটি মাথার উপরে দাঁড়ানো। তারা আমার পিছে পিছে দৌড়ে আসছে, আর আমাদের মাঝে দূরত্বটা কমে আসছে। এর জন্য তাদেরকে খুব বেশি কষ্টও করতে হচ্ছে না। তারা আমার চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে; আমার দৌড়ানোর গতির সাথে নিজেদের গতিকে একাত্ম করে ফেলেছে তারা, অনায়াসেই। তারা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে নাম ধরে ডাকছে “রিতা, রিতা”। একটু দুরেই আমাদের পুরনো খেলার মাঠের জং ধরা লোহার গেইট। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন সেখানে দোলনায় দুলতাম। তারা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। আমি জানি না বাচ্চারা এখনো দোলনাগুলো ব্যবহার করে কি না। আমি গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেলাম, কিন্তু তবুও কোনমতে খেলার মাঠে ঢুকে গেলাম। আমার এখন দৌড়ে পালানোর কথা, কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে গিয়ে একটি ছবি তুল্লাম । নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না; একটা ছবি নিলাম যেটাতে শুধু আমি, গেইট এবং বাকানো চাঁদ দেখা যাচ্ছে। আমার পেছনে আর কেউ নেই।

রিতার সহপাঠীদের আলাপ

“আমি একটা ঘটনা শুনলাম একটা মেয়ের ব্যাপারে, যে কয়েক মাস আগে পাগল হয়ে গিয়েছিল”।
“কোন মেয়ে?”
“তার নাম ছিল রিতা, আর সে আমার সাথে একই ক্লাসে পড়তো। একই ক্লাশে থাকা স্বত্তেও তার সাথে আমার খুব একটা দেখা সাক্ষাত হয়নি কখনোই। একদিন তারা তাকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পায় পুরনো খেলার মাঠের পাশের রাস্তায়। রাতের বেলায়। এটা কয়েক মাস আগের ঘটনা।
“আমি খুবই দুঃখিত।“
“ব্যাপার না। আমি আসলে তাকে খুব বেশি ভাল করে চিনতাম না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি তাকে যখন দেখি, তার কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই তারা বডি ব্যাগের চেইন আটকে দেয়, আর লাশ নিয়ে চলে যায়। সেই মুহুর্তে, তার চেহারাটা ছিল আমার দেখা সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য। দেখ, ঠিক চেইন আটকে দেয়ার আগমুহুর্তে, আমি একটা ছবি তুলেছিলাম। এটাই সেটা”।
“… কি জঘন্য!” (ছবি দেখে)
“আমি এই ছবি ফেসবুক বা অন্য কোথাও দেইনি”
“এগুলা কি চোখ?”
(নিরবতা)
“তার মুখ এরকম হয়ে আছে কেন?”
“আমার ধারণা সে চিৎকার করছিল। পুলিশ তাকে যখন খুঁজে পেয়, তখনো সে তার ফোনটি আকড়ে ধরে রেখেছিল, যদিও তার পুরো শরীর দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। আমার চাচাতো ভাই আজমল ফরেনসিক ল্যাবে কাজ করে। সে বলেছে যে মেয়েটার ফোনে হাজার হাজার ছবি পাওয়া গিয়েছে। ভাবতে পারো! হাজার হাজার ছবি!”
(নিরবতা)
“আজমল বল্লো যে পুলিশ তার শেষ কয়েক মাসের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেকেই পুনর্বিন্যস্ত করতে পেরেছে সেসব ছবিকে অনুসরণ করে।। বেশিরভাগই ছিল সেলফি। তবে কিছু ছবি খুবই বিচিত্র ধরণের। আজমলের ধারণা হয়তো কেউ সেগুলোকে ফটোশপ দিয়ে এডিট করেছিল। শেষের দিকের কিছু ছবির কোন আগামাথা নেই”।
“এসবে কি তার মৃত্যু রহস্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে কোন লাভ হবে?“
“মনে হয় নয়া”
(নিরবতা)
“সবচেয়ে উদ্ভট ব্যাপারটা কি ছিল, জানো?”
“কি?”

“এই ঘটনার কয়েকদিন পরে আমি আগোরা সুপারশপে গিয়েছিলাম। হঠাত মনে হলো, আমি রিতাকে দেখলাম। সে আটা ময়দার শেলফগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, আর ফোনে কথা বলছিল। তার হাতে এক প্যাকেট কুড়কুড়ে চিপস ছিল। আমি তাকে দেখে অসুস্থ বোধ করলাম। মানে, এটা তো সম্ভব না, তাই না? তারপর মনে হলো, সে জানে যে আমি তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। সে হঠাত ঘুরে আমার দিকে তাকালো, আর একটা হাসি দিল। তার সাদা দাঁতগুলো কেমন জানি এবড়োথেবড়ো দেখাচ্ছিল, আর তার চুলগুলো জট বাধা ছিল। সে দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। কিন্তু যখন সে আমার দিকে সরাসরি তাকালো, তার চোখগুলো দেখে একদম ডিমের খোসার মত লাগলো। চোখের মণিও দেখা যাচ্ছিল না, আর তার চোখে কোন পাপড়ীও ছিল না। চোখের জায়গাটা ছিল ধবধবে সাদা রঙের এবং চ্যাপ্টা, আর সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল”।


“তুমি এই পুরা গল্পটা বানিয়ে বলছো। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য”।
“আমার হাতে কোকের ক্যান ছিল। সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ফেটে গিয়েছিল, আর চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে গিয়ে একটা বিশাল গ্যাঞ্জাম তৈরি হয়েছিল। আমি নিচু হয়ে বসে ক্যানটা তুলতে গেলাম। এরপরে উপরে তাকিয়ে দেখি সে উধাও।

“কোকের দাম দিয়েছিলে?”
“হ্যা, স্ন্যাকস এর এরিয়া থেকে নগদ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। কোক খেতে খেতেই শপিং করছিলাম। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে রিতাকে কবর দেয়া হয়েছিল। আমি সেখানে যাইনি। কারণ, ঐ যে বললাম, আমি তাকে খুব ভাল করে চিনতাম না।“

#১
ঠিক ফোন কেনার পরের ঘটনা এটা। আমি সেটা কিনেছিলাম ইস্টার্ন প্লাজার একটি দোকান থেকে। আজকাল কেউ সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল খুব একটা কেনে না, আর ইস্টার্ন প্লাজাতেও খুব বেশি মানুষ যায় না। অনেক নতুন নতুন, বড় বড় মার্কেট খুলেছে—কে যাবে এই পুরনো মার্কেটে? সে যাই হোক, আমি মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে হঠাত এই দোকানটা খুঁজে পেলাম। এটা ছিল গ্রাউন্ড ফ্লোরের একদম শেষ মাথায়। এ জায়গায় এর আগে কখনো এরকম কোন দোকান চোখে পড়েনি। এ পাশটায় এসেছিও কম। দোকানের বাইরের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ছিল “পূর্বে ব্যবহৃত পণ্যের সম্ভার”।

একদম শেষ মাথার এই দোকানগুলো ধুলোয় ধূসরিত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। পাশেই একটা শিশুদের কাপড়চোপড়ের দোকানে, যেখানে কোন শিশুর পা পড়েনি বহু বছর ধরে। আরেকটা দোকান দেখলাম যেখানে নিরামিষাশীদের জন্য বিভিন্ন রকমের খাদ্য উপাদান বিক্রী হচ্ছে, এবং অবশেষে, একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকান যেটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমি দোকানটিতে ঢুকে থমকে গেলাম। সেখানে ছিল বিভিন্ন ধরণের অদ্ভুত জিনিসপত্র; যেমন ঘড়ির কাটা সম্বলিত যন্ত্রপাতি, শিহরণ জাগানিয়া ভুডু পুতুল ও বিকৃত এবং বিকলাঙ্গ পশুদের চেহারা সম্বলিত পেইন্টিং, যা দেখলে রুপকথার বইয়ের রাক্ষসদের কথা মনে পড়ে যায়। প্রথমে দোকানে কাউকে চোখে পড়লো না, কিন্তু আমি কাশির শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলাম কাউন্টারের পেছনে একজন অদ্ভুত, বুড়ো মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সে যেন হঠাত ভোজবাজির মত উদয় হলো। তার চেহারাটি ছিল কিছুটা ঘোড়ার মত, লম্বাটে ধরণের, আর তার চোখগুলো ছিল ঢুলু ঢুলু। হঠাত করে তাকে দেখে মনে হলো যেন তাকে ছায়া থেকে ধার করে এনে মানুষের মত রুপ দিয়ে দাঁড়া করিয়ে দেয়া হয়েছে—এখানে তার আসলে থাকার কথা না। সে আবারও গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো “কি লাগবে আপা?”

আমি বললাম “এইতো, দেখছি একটূ”, আর সাথে সাথে তার চেহারায় একটা রাগের ছাপ ফুটে উঠলো। আমি খানিকটা বিব্রত হলাম।
“আপনি অনেক সুন্দর”, সে হঠাত বলে উঠলো, আর আমার গালদু’টো পাকা টমেটোর মত লাল হয়ে উঠলো। আমি বোকার মত মাথা নাড়ালাম দুইপাশে। সে আবার বলে উঠলো “না, আসলেই”।
“ধন্যবাদ”, আমি বললাম।

“এই নিন”, সে বল্লো। কাউন্টারের পেছন থেকে সে একটা জিনিস বের করে আনলো, যেটা দোকানের আর সব পণ্যের মাঝে পুরোই বেমানান; এটি ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন মোবাইল ফোন।
সে বল্লো “আপনার আছে এটা?”
“কি? ফোন?”
“এটার মত একটা ফোন”।
“না, না”, আমি বললাম। “আমার পুরনো মডেলের একটি আছে”, বলে তাকে আমার পুরনো স্যামসাং ফ্লিপ ফোনটা দেখালাম।
“তাহলে এটা নিয়ে যান। আমার তরফ থেকে”।
“কি বলছেন। আপনি আমাকে এটা ফ্রি তে দিচ্ছেন?”
“না”, সে বিরক্তি সহকারে বলে উঠলো, আর আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি একটা গন্ডমূর্খ। “অবশ্যই ফ্রি না, আমি এখানে দানছত্র খুলে বসি নাই”।
“ইয়ে মানে…”
“তবে খুব স্বস্তায় ছেড়ে দেব”, এটা বলে সে ফোনটা আমার দিকে ঠেলে দিল।
“নিয়ে নিন। এই সুযোগ আর পাবেন না”।

টাচ স্ক্রিণের উপর সোয়াইপ করলাম, আর আইকনগুলো আমার দিকে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে রইলো। আমি সেই ভয়ানক লোকটির কথা আর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম না; সে একটা দাম বল্লো, আর আমি ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে দিলাম। সে আবার বল্লো যে আমি দেখতে অনেক সুন্দর, কিন্তু আমি নিজেকে কখনো সুন্দরী ভাবিনি। মানে, আমি আসলে এই ব্যাপারটা নিয়ে কখনো তেমন একটা ভাবিইনি। আমি দোকান থেকে বের হয়ে এলাম, আর হঠাত আমার চারপাশে অনেক আলো দেখতে পারলাম। জোরালো বাতাস বইতে শুরু করলো। আমার আঙ্গুলগুলো চুলকাচ্ছিল। আমি ফোনটা আমার সামনে ধরে ক্যামেরা বাটনে চাপ দিলাম, আর মনে হল যেন কোন কিছু আমার ভেতরে প্রথমবারের মত জেগে উঠলো, আর কোন কিছুর মৃত্যু ঘটলো—আমি আসলে ব্যাপারটাকে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারছি না। সেটার দরকারও নেই। আমি বাটনে প্রেস করলাম, আর ছবি উঠলো। সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

#৭৩৬
শেষ ছবিতে আমি মৃত।

#১১২
মজার ব্যাপার হলো, আমি সেই একই জায়গায় ফিরে গেলাম কয়েকদিন পর, আর দেখলাম সেখানে কোন দোকানের চিহ্নই নেই। সেই চিরাচরিত ফুচকা চটপটির দোকানটিই আছে সেখানে, এবং কাউন্টারের মামা আমার দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার পাগলামি দেখছে। ছবিতে আমি জিভ কামড়ে ধরে আছি, আর আমাকে দেখে দুঃচিন্তাগ্রস্থ মনে হচ্ছে। আমি ছবি তুলেই যাচ্ছিলাম। আমাকে ছবি তুলতেই হবে, কিন্তু ছবিগুলো আসতে আসতে মিথ্যা বলা শুরু করেছিল।

#৪৪৭
“ব্যাপারটা অসাধারণ ছিল, রিতা!”, সজীব বলে উঠলো। তাকে দেখে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছিল। সে আমার দিকে দন্ত বিকশিত হাসি দিল।
আমি বললাম “কি নিয়ে কথা বলছো?”
আমি একটা ছবি তুল্লাম। আমি ওর রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে, চেহারায় বিরক্তির ছাপ। তার জানালার পাশে জারবেরা ফুল রাখা। ফুলগুলোর উপরে যেভাবে আলো পড়েছে, তা দেখতে ভাল লাগছেনা। কেমন যেন একটি অসুস্থ ভাব, আর রোদটাও কেমন জানি বিবর্ণ।
“গতকাল রাতে! তুমি অসাধারণ ছিলে!”, সজীব বলতে লাগলো। “আমি এর আগে কখনো…”, বলে সে লজ্জা পেল। “তুমি কোথায় শিখলে এসব?”, সে ফিসফিস করে বল্লো। বলে সে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি তার গায়ের তীব্র গন্ধ পেলাম; ঘাম ও যৌনতায় ভরা। আমি তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলাম। আমার চোখ আদ্র হয়ে যাচ্ছিল, যদিও আমি কাদতে চাইছিলাম না। আমি বলে উঠলাম “কিন্তু আমি তো গতকাল এখানে ছিলাম না, সজীব। তোমার মনে নেই? আমি শেলীর সাথে সিনেমা দেখতে গেলাম সিনেপ্লেক্সে, আর তারপর রাতে ওর বাসায় থাকলাম।“এর উত্তরে সে বলে উঠলো “তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো?”, আর আমি কাদতে লাগলাম। তখন সে আবার আমার দিকে এগিয়ে এল, আর আমি তাকে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে তার বেডরুমের দিকে চলে গেলাম। সেখানে এবড়োথেবড়ো বেডশিট দেখতে পেলাম, আর আয়নায় স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো একটা ছবি দেখতে পেলাম—সেটি সম্ভবত গতকাল রাতে তোলা, এবং সদ্য প্রিন্ট করা। সেখানে আমি ক্যামেরার জন্য পোজ দিয়েছি, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়, এবং আমার একটি হাত উরুতে আর আরেকটি হাত কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অন্য হাতটি ছবিতে নেই, কিন্তু স্পষ্টতই তা সেলফি তোলার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ছবিতে আমি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছি, আর আমার দাঁতগুলো হিংস্র শ্বাপদের মত লাগছে। আমার চোখগুলো যেখানে থাকার কথা, সেখানে কিছুই নেই। আমি আয়না থেকে ছবিটা টান দিয়ে নামালাম, আর ছিড়ে টুকরো টুকরো করলাম। ছেড়া টুকরোগুলো আমার পায়ের কাছে পড়ে রইলো।

#৭৩
বাবা, মা আর সজীবের সাথে ডিনার করছি। আমরা সবাই হাসছি। সজীবের হাত আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, আর সে বোকার মত একটা হাসি দিচ্ছে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, আর আমিও একইভাবেই হাসছি। আমার মনে হচ্ছে আমার মধ্যে যেন এক ধরণের আগুন; যা আমাকে ভেতরে আর বাইরে থেকে পোড়াচ্ছে। ফিল্মের নেগেটিভের উপর আলো পড়লে যেরকম হয়, সেরকম একটা অনুভূতি; আর তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, সব কিছুকে ছুয়ে দিচ্ছে আলো দিয়ে।

#৫০১
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কিন্তু ছবিটার সব কিছুই ভুল। এটা আমি সজীবের বাসা থেকে বের হয়ে নিজের বাসায় যাওয়ার পরে তোলা। আমি ক্যামেরার বাটনে চাপ দেয়ার সময় কাদছিলাম, কিন্তু ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমি হাসছি।

#২১০
ছবিটা একটু ঘোলা, কারণ আমি দৌড়াচ্ছি। আমি রাস্তায়, এবং একটা মানুষ আমাকে তাড়া করছে।

#২০৯
ঘোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমি লোকটার দিকে পিঠ দিয়ে তাকিয়ে আছি অন্যদিকে, কিন্তু সে তখনো কথা বলে যাচ্ছে।

#২০৮
তার গলার স্বর অস্থির এবং উত্তেজিত, এবং সে চিৎকার করে করে আমার ফোনটির ব্যাপারে কথা বলছে। আমাদের দুইজনকেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, আর এক মুহুর্তের জন্য তার চেহারায় একই সাথে কামাতুর ভাব এবং প্রচন্ড ভীতি দেখা যাচ্ছে।

#২০৭
একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছে রাস্তায়, কিন্তু সে ছবিতে নেই। সে আমার ফোনটি কিনতে চায়। আমি তার কথা বুঝতে পারছি না একদমই। সে চিকন, এবং লম্বা, আর তার একটি অগোছালো দাড়ি আছে। তার গা থেকে এমন বাজে গন্ধ আসছে যে মনে হচ্ছে যেন সে দীর্ঘদিন ধরে গোসল করেনা। সে বলেছে তার নাম সিকদার, আর সে একজন সংগ্রাহক। সে বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি ফোনটি কোথায় পেয়েছি, আর আমি কি জানি কি না, যে সেটা আসলে কি। আমি বলছিলাম যে এটি শুধুই একটি ফোন, কিন্তু সে আমার কথায় কর্ণপাত করছিল না। সে বলে যাচ্ছিল যে এটা অন্য জিনিসের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে, এর মাঝে রয়েছে পরজীবী প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য, আর এটি অন্য বস্তুদের মত চেহারাও ধারণ করতে পারে।

সে বলে যাচ্ছে “অন্ধকার প্রকোষ্ঠ, অন্ধকার প্রকোষ্ঠ, এটি একটি ক্যামেরা অবস্কিউরা”। আমি জানি না এসবের মানে কি। আমি তার থেকে ঘুরে দাড়াই। মনে হলো আমি আমার চোখের কোণা দিয়ে আমার নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সেখানে কোন আয়না ছিল না।

#৬০০

আমার বাসার বাইরের স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি ভয়ে তাকাতে পারছি না।
চারপাশে অনেক বেশি নিরবতা। পরিবেশটা একদম শুনশান এবং কোন কিছুই নড়ছে না। যদিও কিছু নড়ছে না, তাও আমি জানি ওটা ওখানে আছে। মনে হচ্ছে যেন নিরবতারও নিজস্ব জীবন আছে, অথবা সে জীবন্ত প্রাণীর প্রতিধ্বনির মত। এটা আমার রুমের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের মত, আর একমাত্র আলোর উৎসটি ঘরের বাইরে। আলো এসে আমার পর্দার উপর আছড়ে পড়ছে।
ল্যাম্পের নিচে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি পর্দার এক কোণায় সরে যাই। আমি বাইরে তাকাই না, কিন্তু একটি ছবি তুলি।
ছবিতে কিছু একটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, অবিকল আমার চেহারা নিয়ে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর হাসছে।

#৩৪২
কেউ একজন রাতের বেলায় আমার দরজার নিচে দিয়ে একটি খাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেটার ভেতরে আমি বই থেকে ছিড়ে নেয়া এক টুকরো কাগজ পেলাম। আমি সেটা আমার মুখের পাশে ধরে রেখেছি। আমার চোখগুলো ঢুলুঢুলু। সেলফিতে কোন মতে কাগজের লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে। সেখানে লেখাঃ
“ম্যাড জেসুইট” নামে পরিচিত ফাদার আলফনসো তার ষোড়শ শতাব্দীর পান্ডুলিপি “উমব্রা আউটেম এক্স টেম্পোরে” তে প্রথম উল্লেখ করেন এক বিশেষ ধরণের আলোর ব্যাপারে, যেটি কিছুটা ছায়া, কিংবা ছায়া সমূহের মত। তবে এই অনুবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তার লেখা পান্ডুলিপিটি স্কটল্যান্ডের একটি মঠের পাঠাগারে লুকানো ছিল অনেক বছর ধরে, যেখানে তাকে ব্লাসফেমীর জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছিল।

এই পান্ডূলিপিতে সে এমন একটি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে, যা একধরণের অণুবিক্ষন যন্ত্র, বা ক্যামেরা অবস্কিউরা। এর অন্য নাম “অন্ধকার প্রকোষ্ঠ”, যা এরকম ছায়া আলোকে ধারণ করার কাজে ব্যবহার করা হোত। কিছু অনুবাদে ছায়ার বদলে এটিকে আত্মা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে; যেমন ১৬৫৩ সালে লিপিবদ্ধ ফরাসী; গেরোউ পান্ডুলিপিতে।

ম্যাড জেসুইট আত্মহত্যা করেছিলেন, অথবা তাকে হত্যা করা হয়েছিল। এ সংক্রান্ত নথি খুব একটা পরিষ্কার না। মঠের ছাদ থেকে তিনি নিচের চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছিলেন। কিভাবে তিনি জেলখানার কুঠুরী থেকে বের হয়ে খাড়া দেয়াল বেয়ে ছাদে উঠেছিলেন, সেটার কোন কুলকিনারা কেউ করতে পারেননি। তার কারাকক্ষে, কিংবা মৃতদেহের সাথেও কোন ধরণের কোন যন্ত্র পাওয়া যায়নি। কিভাবে তিনি নিঃশব্দে, এবং সবার অগোচরে সেখান থেকে বের হয়েছিলেন, সে রহস্যও অমিমাংসিত থেকে যায়। তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, এবং তাকে কবরও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এরপরেও, বেশ কয়েক মাস ধরে এলাকাবীরা অভিযোগ করেন যে হুবহু আলফনসোর চেহারার বর্ণনার সাথে মিলে যায় এরকম একজন ব্যক্তিকে কখনো কখনো গভীর রাতে, এবং কখনো পরিষ্কার দিনের আলোতে হেঁটে যেতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তার সাথে কেউ কখনো কোন কথা বলতে পারেনি, কিংবা বল্লেও, সেটার কোন বর্ণনা কারও কাছে নেই।

আমি জানি না এসবের অর্থ কি। এসব কিছুই আমার কাছে হজবরল।

#৬৫৫
ছবিটা ঘোলাটে, কেননা আমার হাতগুলো অনেক বেশি কাঁপছিল, এবং এ কারণেই তুমি কিছু বুঝতে পারছিলে না।

#৪১৫
সিকদার আবার এসেছে। আমি তার দিকে ফোন তাক করার সাথে সাথে সে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালালো, তাই আমি তার ছবি তুলতে পারলাম না। তাই বদলী হিসেবে নিজের একটা তুল্লাম।

#৪১৬
আরও একটা

#৪১৭
আরেকটা

#৪১৮
এবং আরও একটি, আর প্রতিটি ছবির সাথে সাথে আমার আরও ভাল লাগতে থাকে, এবং একই সাথে খারাপও লাগতে থাকে। মনে হচ্ছে যেন আমাকে কেউ কেটে ছোট ছোট টুকরা করে ফেলছে, আরে প্রতিটি টুকরার সাথে সাথে কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে আমার থেকে, আর চারপাশে খালি আমি, আমি আর আমি এবং আরও একটি আমি।

#১২
আমি আমার নতুন ফোন নিয়ে পার্কে দাঁড়িয়ে আছি সূর্যের আলোতে, আর আমি খুব খুশী! সব কিছু ভাল যাচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ ।

#৪৬৯
আমি, কান্না কান্না চেহারায়। আর চোখ দু’টো গণগণে লাল হয়ে আছে, আর চোখের নিচে কালি। এখন রাত, আর এইমাত্র আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সিকদার বাইরে থেকে চিৎকার করছে। সে ইকিরির কথা বলছে। একটি অভিশাপের কারণে আত্মা থেকে অংশবিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রেতাত্মা তৈরি হয়, যাকে ইকিরি বলা হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে সে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে।
কিছু কিছু সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করা হয় যে প্রতিটি ছবি মানুষের আত্মা থেকে একটু করে অংশ কেড়ে নেয়।
“আমি তোমাকে যেকোন মূল্য দিতে রাজি আছি”, বলে উঠলো সিকদার। আমি একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনলাম। “আমাকে ওটা দিয়ে দাও!”। তার গলার স্বরে একাকীত্বের সুর, এবং মরিয়া ভাব। তখন হঠাত কুকুরের ডাক বন্ধ হয়ে গেল, আর আমি সিকদারের রক্ত হিম করা আর্তচিতকার শুনতে পেলাম। বাইরে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম সে কি দেখেছে।


#৬৫২
আগোরা সুপারস্টোরের বাইরে

#৬৫৩
আমি সুপারশপের ভেতরে যেতে না যেতেই আরেকজনের কাস্টোমারের সাথে ঢাক্কা খেলাম, আর “সরি” বললাম। আর যখন আমি এক মুহুর্তের জন্য তার দিকে তাকালাম, সে ঘুরলো, আর সম্পূর্ণ আমার চেহারায়, আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিল।

#৬৫৪
আমার হাত কাঁপছে। এই সেলফিটা সুপারস্টোরের শেলফের পাশে দাঁড়ানো অবস্থায়। ক্রেতারা ট্রলি ভর্তি আটা ময়দা আর অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একে একে তারা থেমে যাচ্ছে, আর মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। সবার চেহারা অবিকল আমার মত, এবং সবাই হাসছে। তাদের কারও চোখ নেই।
কেউ একজন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে আমার নাম বলছেঃ রিতা, রিতা
আমি দৌড় দিলাম

#৭২৯
এটা আমার দৌড়ানোর শেষ কয়েকটি ছবির মাঝে একটি। আমার সামনে বিস্তৃত পথ এবং শহরতলীর ঘুমন্ত বাসাগুলো। রাস্তার পিচের মধ্যে চাঁদের আলো লেপ্টে আছে। আমি দৌড়াচ্ছি, শুধুমাত্র হার্টবিটের দুম দুম শব্দ পাচ্ছি। বাতাসে বেলী ফুলের গন্ধ। সামনে পুরনো খেলার মাঠ। আমি পেছনে না তাকিয়েই ছবিটা তুল্লাম, কিন্তু আমি জানি তারা সেখানে আছে।

#ishtiaq_radical

No comments: