Monday, July 20, 2020

ইমেইল বিভ্রাট





আজকাল মোটামুটি সকল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানেই কাজের একটি বড় অংশ সংঘটিত হয় ইমেইলের মাধ্যমে। মুরুব্বী কিছিমের বাঙ্গালী ভাষা বিশেষজ্ঞরা ইন্টার্নেট, এসএমএস ও মোবাইল ফোনের রোমহর্ষক বাংলা প্রতিশব্দ (তথ্যজালিকা, ক্ষুদে বার্তা ও মুঠো ফোন) বের করতে পারলেও কোন এক বিচিত্র কারণে ইমেইল কে তড়িৎ পত্র কিংবা বিদ্যুৎ চিঠি ডাকার দুঃসাহস(!) দেখাননি--ইমেইল, ইমেলই থেকে গিয়েছে।

পাশ্চাত্যে ইমেইল এতই জনপ্রিয় যে এটাকেই এখন সবাই মেইল ডাকে। আমরা অনেকেই "You've got mail" ছবিটি দেখেছি, যেখানে মেইল বলতে মেগ রায়ান ও টম হ্যাংক্স এর মাঝে আদান প্রদান হওয়া বৈদ্যুতিক চিঠিকেই বোঝানো হয়েছে।

সে যাই হোক, যেহেতু ইমেইল হচ্ছে নতুন মেইল, তাই পুরনো, প্রথাগত মেইল বা হাতে লেখা চিঠিকে তারা নাম দিয়েছে "স্নেইল মেইল"। অর্থাৎ যে পত্র ডাক বিভাগের মাধ্যমে শামুকের মত ধীর গতিতে প্রাপকের কাছে পৌছায়, তাহারই নাম স্নেইল মেইল।

এই প্রসঙ্গে এক মিনিট সময় নিয়ে আমরা ভাবি, "শেষ কবে, কাকে এবং কখন হাতে লিখে চিঠি পাঠিয়েছি? উহার বিষয়বস্তু কি ছিল?" । চাইলে ভাবনাগুলি কমেন্টে লিখে দিতে পারেন।

আমার বাসায় প্রথম যখন ইন্টার্নেট কানেকশান আসে, তখন এক "ইঞ্জিনিয়ার" এসেছিলেন সবকিছু বুঝিয়ে দিতে। উনি প্রথমেই "ইউডোরা প্রো" নামের একটি সফটওয়্যার ইন্সটল করে তাতে আমার নতুন প্রাপ্ত "আইএসপি" মেইল খানা কনফিগার করে দিলেন। অমুক @ আইএসপি ডট কম নামের ইমেইল এড্রেসগুলোর একটি ভাব ছিল, যা হালের জিমেইল বা অন্য কোন ফ্রি ইমেইল থেকে পাওয়া সম্ভব না।

খুব কম সময়ই শিখে নিলাম কিভাবে মানুষকে মেইল পাঠাতে হয়, এবং সেদিন থেকে জীবনে এক নতুন আগ্রাসনের শুরু হলো। এর আগে সারা জীবনে যে কয়টি চিঠি লিখেছিলাম, সেটা হয়তো দুই হাতের আঙ্গুলের সাহায্যেই গুণে ফেলা সম্ভব হোত, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি ইমেইল আমি এক মাসের মাঝেই পাঠিয়ে ফেললাম, এবং অদ্যবধি সেই ধারা বজায় রয়েছে।

ইউডোরা থেকে আপগ্রেড হয়ে আউটলুক এক্সপ্রেসে পৌছে গেলাম চাকুরী জীবনের শুরুতে এসে। ততদিনে,কার্বন কপি, ব্লাইন্ড কার্বন কপি, রিপ্লাই অল, রিপ্লাই, এটাচমেন্ট ইত্যাদি জটিল জটিল সব শব্দ ও মতবাদের সাথে বেশ ভালভাবেই পরিচয় হয়ে গিয়েছে।

ইমেইল একটি আধুনিক জিনিস। এটার যথেচ্ছ ব্যবহার কাম্য নয়। সেরকম, কখন "রিপ্লাই" দিতে হবে, আর কখন "রিপ্লাই অল" দিতে হবে; এই ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে তারপর ইমেইলের উত্তর দেয়া উচিত।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। একটি অফিশিয়াল ইমেইল চেইনের মাঝে আমাকে "লুপ" করা হলো। অর্থাৎ, কেউ একজন সবাইকে উত্তর দেয়ার সময় আমার ইমেইল এড্রেসটি "সিসি" হিশেবে যোগ করে দিয়েছে।

দুই ডিপার্টমেন্টের মাঝে উত্তপ্ত ইমেল বিনিময় চলছে। এ বলে ওর দোষ, ও বলে তার দোষ, এই ধরণের হাউকাউ (ইংরেজীতে ব্লেইম গেম) চলছে অবিরাম। মাঝে আমি সহ আরো কিছু নীরব দর্শক "চায়া চায়া দেখতেসি"।

সহসা এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার একটি বিচিত্র মেইল দেখলাম। মেইলের ভাষাটি এরকম ছিলঃ

"প্রিয় আলম, কেন ওরা এরকম গর্ধভের মত ইমেইল পাঠাচ্ছে? ওদের সাথে দেখা কর, প্রয়োজনে মাথায় পাগলের তেল মালিশ করে দিয়ে আসো, কিন্তু আর আমার মেইল বক্স কে আস্তাবলের মত দুর্গন্ধযুক্ত বানিয়ো না। এ সকল ইমেইল আসা বন্ধ কর"।

ব্যাস, আর যায় কোথায়! অপর ডিপার্টমেন্টের সবাই রেগে লাল হয়ে "প্রিয় আলম" এর বসের মুন্ডুপাত করতে বসলো। ততক্ষনে আমরা সবাই একটি মেসেজ পেলাম ইনবক্সে "অমুক হ্যাজ ট্রাইড টু রিকল দিস ইমেইল", কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গিয়েছে। "মেসেজ রিকল" অপশনের মাধ্যমে কিছু মেইল কেউ পড়ার আগেই মুছে ফেলা যায়। কিন্তু একবার মেইল ওপেন করে ফেলা হলে আর রিকল (প্রত্যাহার) করার উপায় নাই।

ঘটনার পিছের ঘটনা হচ্ছে আলমের বস তাকে "ওয়ান টু ওয়ান" ইমেইল পাঠাতে গিয়ে ভুলে "রিপ্লাই টু অল" এ ক্লিক করে ফেলেছিল। অর্থাৎ, একজনের চিঠি বহুজনের হাতে চলে গিয়েছিল।

উনি নাহয় ভুলে এই কাজ করেছিলেন, কিন্তু অনেকেই এই রিপ্লাই অল, কিংবা "মেইল গ্রুপ" এর ধারণাটি মাথায় নিতে চান না। রিপ্লাই টু অল বলতে কেউ কেউ নাকি "সম্পূর্ণ মেইলের উত্তর" ভেবে থাকে! অর্থাৎ শুধু রিপ্লাই দিলে পুরা ইমেল যাবে না, এরকম নাকি ব্যাপারটা!

আরেকবার আরো মজার একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের অফিসের আইটি ডিপার্টমেন্টের বস ছিলেন একজন সাদা চামড়ার ব্যক্তি। আইটি ক্যারিয়ারে আসার আগে তিনি তার দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিলেন। এহেন জাঁদরেল ব্যক্তি একদিন সকালে ইমেইল পেলেনঃ

"আমার একটি নতুন ইঁদুর দরকার। এখনেরটা আর আগের মত জোরে দৌড়াচ্ছে না। দয়া করে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করুন"।

তিনি তার বাঙ্গালী ডেপুটি কে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে জাগালেন।

বাজখাই গলায় চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ "এসব কি হচ্ছে?"

আমতা আমতা করে ডেপুটি উত্তর দিল, এই লোক সেলস এ কাজ করে। তার মাউস নষ্ট হয়ে গিয়েছে, সেটার রিকুয়েস্ট করতে গিয়ে তিনি "অল ইউজারস" এবং "আইটি" ডিভিশনের মেইল গ্রুপে মেইল করেছেন, যার কারণে সিইও সহ পুরো কোম্পানি এখন তার ধীর গতির মাউস সমস্যা সম্পর্কে জ্ঞাত।

মাথায় হাত দিতে দিতে ভদ্রলোক ফোন ডিসকানেক্ট করলেন।

আরেকদিনের কাহিনী বলি। সারা সকাল উইকলি মিটিং এর ঝড়ের পর লাঞ্চ করে সবাই একটু ঝিমাচ্ছে। বসরা চলে গিয়েছে হেড অফ ডিপার্টমেন্টদের মিটিং এ, তাই সবাই একটু রিলাক্সড। সহসা ডিপার্টমেন্ট কোঅর্ডিনেটরের কাছ থেকে একটি মেইল এলোঃ

"আজ বিকালে সাপ পাওয়া যাবে"।

সবাই অবাক মেইলের সাব্জেক্ট দেখে। ভাল করে পড়ে বোঝা গেল যে ছোকরা স্ন্যাক্স কে স্নেইকস লিখে রেখেছে, যার কারণে এই বিভ্রাট। সেই মেইল নিয়ে বেশ মজা হলো। প্রচুর হাসি ঠাট্টা মূলক "রিপ্লাই অল" মেইল এল। একজন তো বড়সড় একটি র্যাটেল স্নেইকের ছবি পাঠিয়ে দিল, যা দেখে আবার আমাদেরই এক কোমলমতি সহকর্মী ভয়ে মূর্ছা গিয়েছিল। কিন্তু সেটি আরেক গল্প...

সর্বশেষে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা বলি। এক কালে আমি বড় বড় ইমেইল লিখতে ভালবাসতাম। আমার সাহিত্যিক(!) লেখনীর স্বল্প ক্ষমতা ব্যবহার করে "পেচিয়ে পেচিয়ে" লম্বা লম্বা মেইল লিখতাম। একবার এক ভদ্রলোক এবং তার বস কে আমি একটি মেইল করেছিলাম একটি বিষয় জানাতে।

উনি ছিলেন কাস্টোমার কেয়ারে কর্মরত। সাধারণত নতুন কোন প্রোডাক্ট লঞ্চের আগে কাস্টোমার কেয়ার কে ট্রেনিং দিতে হয় এবং সব তথ্যাদি মেইলের মাধ্যমে পাঠিয়ে রাখতে হয়। হঠাত করে বসদের নির্দেশে তড়িঘড়ি করে একটি নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে হয়েছিল বিধায় এই কাজটি সেবার করা হয়নি। যথারীতি নতুন বিজ্ঞাপন দেখে কাস্টোমার কেয়ারে প্রচুর কল এসেছিল, এবং উনাদের বেশ ঝামেলাও হয়েছিল।

আমার মেইলটি ছিল এই বিভ্রাট তৈরি করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা মূলক। যেহেতু বসদের নির্দেশে এই লঞ্চ, আমি আসলে এই মেইলটি দিতে বাধ্য ছিলাম না--ভদ্রতা করেই দিয়েছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোক আমার মেইল পেয়ে হাতে জাদুর কাঠি পাবার মত একটি কাজ করলেন। উনি এক বিশাল পত্রের মাধ্যমে উষ্মা প্রকাশ করে জানালেন "এই মার্কেটিং এর লোকজন সব সময় এইসব উলটা পাল্টা কাজ করে, ক্যাম্পেইন নামে, ট্রেনিং হয় না, ট্রেনিং হয়, ক্যাম্পেইন নামে না--ইত্যাদি ইত্যাদি"। এটুকু হজম করে নিতে আমার কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম সুযোগ বুঝে ভদ্রলোক পুরো মার্কেটিং টিমকে এড করে দিয়েছেন ইমেইলে!

চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম পুরো ফ্লোরে সবাই বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা এরকম যে, আমি কেন সরি বলতে গেলাম? এমনকি হেড অফ মার্কেটিংও এসে "ঠান্ডা ঘাড়" দেখিয়ে গেলেন আমাকে।

তখন বয়স কম ছিল, রক্ত গরম ছিল, তাই আমিও এক সুবিশাল, সারকাজম সমৃদ্ধ ইমেল লিখলাম সেই ভদ্রলোককে। সেই ইমেইলের পরিণতি ছিল পুরোই অন্য রকম। মেইলটি পেয়ে কাস্টোমার কেয়ারের ভাই যুগপৎ দুঃখিত ও অপমানিত হয়, এবং সে রিজাইন লেটার টাইপ করে তার বসের কাছে (ইনিও বিদেশী) নিয়ে যায়।

এরপর সেই বিদেশী ভদ্রলোক আমাকে ডেকে পাঠান। উনাকে আমি বেশ ভয় পেতাম, আবার শ্রদ্ধাও করতাম তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার কারণে। উনি আমাকে ডেকে বললেন, এই যে ইমেইল লেখক! তোমার সাহিত্য পড়ে তো আমার টিমের এই ছেলে চাকরী ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। কাজটা কি ঠিক হয়েছে? আমি ব্যাখা দিতে গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের চোখে মুখে হাসি। পরে আমাদের দুইজনকেই অনেক্ষন ধরে বুঝালেন। আমি পাঁচ তলায় বসতাম, আর কাস্টোমার কেয়ার ছিল দোতালায়। উনি বললেন, এরপর এরকম কোন আলাপ থাকলে ইমেইল না করে নিজেরা দেখা করে কথা বলবে। লম্বা লম্বা ইমেইল কেউ পড়ে না, এগুলো সময় নষ্ট করার হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই না।

সেদিন আমার একটি মনস্তাত্বিক পরিবর্তন এসেছিল। এরপর প্রতিটি ইমেইল পাঠানোর আগে চিন্তা করেছি, আচ্ছা, এই সমস্যাটি কি একটি ফোন কল কিংবা পাঁচ মিনিটের সাক্ষাতে সমাধানযোগ্য? যদি উত্তর হ্যা হয়, তাহলে ইমেইলটা আর না পাঠাই।

অনেক সময় কাজ শেষ করে রেকর্ড রাখার জন্য শুধু একটি মেইল পাঠিয়ে রাখতাম, কিন্তু তা কাজের শেষে।

জীবনে কোন কিছুরই অতিরিক্ত ব্যবহার ভাল নয়। ইমেইলও তার ব্যতিক্রম নয়।

(ধরে নিচ্ছি এই লেখার পাঠকদের মধ্যে আমার কোন কোন সাবেক সহকর্মীগণ থাকবেন। দয়া করে কোনটা কে সেটা নিয়ে কোন প্রশ্ন করবেন না :D ঘটনাগুলোতে প্রচুর রঙ চড়ানো হয়েছে সাহিত্যগত কারণে)।

No comments: