Wednesday, June 17, 2020

Depressing depression

আমাদের দেশে ডিপ্রেশান বা বিষন্নতা কে খুব হেলাফেলা করা হয়। কেউ বিষন্নতায় আক্রান্ত শুনলে প্রথমেই যে কথাগুলো মানুষ বলে, তা হলোঃ

"এইটা আবার একটা অসুখ নাকি?"
"যত্তসব ঢং"
"দুঃখ বিলাস"
"সুখে থাকতে ভুতে কিলায়"
"সে নিজেকে বিষন্ন দাবী করে? আরে তার বাসায় তো দু'বেলা খাবার জুটে, যে না খেয়ে মরতেসে, তার কি হবে?"

এবং আরো অনেক কিছু। অর্থাৎ, যদি কেউ বাহ্যিক ভাবে সফল, কিংবা স্বচ্ছল থাকে, তাহলে তার বিষন্ন হবার কোন অধিকার নেই। হ্যা, একজন গরীব মানুষ বিষন্ন হতে পারে, কিংবা যার নিকট আত্নীয় বা স্বজন হারানো গিয়েছে, সে বিষন্ন হতে পারে; তার পূর্ণ অধিকার আছে বিষন্নতা কে আঁকড়ে ধরার--মোটামুটি এভাবেই বেশিরভাগ মানুষ চিন্তা করে।

কিন্তু একটি কোম্পানীর সিইও, বা একজন অবস্থাপন্ন ব্যক্তির অষ্টাদশী কন্যা, কিংবা একজন রিটায়ার্ড সেনা সদস্য--এধরণের মানুষগুলোর বিষন্নতা কে কেন জানি অন্যেরা ঠিক মেনে নিতে পারে না।

উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝালে সুবিধা হবে।

কোন এক হারিয়ে যাওয়া সময়ে, কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক করিডরে দুইজন ছাত্র একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে নোটিশ বোর্ডে সেমিস্টারের রেজাল্ট দেয়া। দুই বন্ধুই একাধিক বিষয়ে খারাপ গ্রেড পেয়েছে, এবং যার ফলশ্রুতিতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে থাকাটাই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। তারা চিন্তা করছে, কিভাবে এই বিপদ থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়।

হঠাত দৃশ্যপটে আবির্ভুত হল তাদেরই এক সহপাঠী বান্ধবী। সে ক্লাশের সবচেয়ে ভাল ছাত্রী হিসেবে পরিচিত, এবং আদর্শ ছাত্রীও বটে। তার চুল খোলা অবস্থায় এর আগে কেউ দেখেনি; সে সব সময় "ডিসেন্ট" ভাবে সেজেগুজে ক্লাস করতে আসতো, আর তার মুখ থেকে কেউ কখনও খারাপ কোন কথা শুনেনি।

কিন্তু সেদিনের ঘটনা ভিন্ন। উশকো খুশকো চুল নিয়ে, প্রায় বাসার জামা কাপড় ও বাটা কোম্পানীর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পড়া অবস্থায় সে দৌড়ে নোটিশ বোর্ডের সামনে চলে এলো। শোকাহত দুই ভদ্রলোক কে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে নিজের রেজাল্ট দেখলো সে। দেখেই জুড়ে দিল "মরা কান্না"।

ঐ দুই ভদ্রলোক ধরেই নিলেন যে তাদের বান্ধবী সকল বিষয়ে ফেল করে এরকম কান্নাকাটি করছে। যদিও, মিড টার্মের মার্ক এবং তার অতীত ইতিহাস বিচারে এই বান্ধবীর এহেন ফল পাওয়া যে খুবই একটি ব্যাপার, সেটাও ওরা বুঝছিল।

প্রায় পাচ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় বান্ধবীর আগমন। তাকে দেখে প্রথম বান্ধবী কিছুটা প্রকৃতস্থ হয়ে তাকে আলিঙ্গন করলো (অবশ্যই শরিয়ত সম্মত ভাবে) এবং জানালো যে সে এক বিষয়ে বি প্লাস পেয়েছে, আর বাকি সব গুলোতে এ পেয়েছে। সাথে এটাও জানালো যে, গরুর দুধে যেমন এক ফোটা সামথিং পড়লে পুরো দুধটাই নষ্ট হয়ে যায়, সেরকম গ্রেডে একটা বি প্লাসও অনুরুপ বিপর্যয়ে ঘটায়।

এই গল্পটি যদি সত্য হোত, তবে ততক্ষনে সেই প্রায় ফেল করা দুই ব্যক্তি যারপরনাই বিরক্ত, কিংবা রাগান্বিতও হয়ে যেতে পারতো। তাদের দৃষ্টিতে বান্ধবীর এই হৃদয়হীন আচরণ খুবই অসমীচিন মনে হতো, এবং তারা বান্ধবী কে অর্বাচিন পাষন্ড টাইপ (বাই দ্যা ওয়ে, পাষন্ড শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ কি? পাষন্ডী?) কিছু বলে গটগট করে হেঁটে দৃশ্যপট থেকে সরে যেত।

কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা একটি ভুল করতো । সেটা হচ্ছে, দুঃখ, কিংবা আমাদের আলোচ্য বিষয় ডিপ্রেশানের ব্যাপারটা তুলনামূলক না। যার যার সংগ্রাম তার নিজের কাছে। পৃথিবীতে সব সময়ই এমন একজন মানুষ থাকবে, যে আমাদের থেকে সুখী, এবং আরেকজন পাওয়া যাবে যে আমাদের চেয়ে দুঃখী। ডিপ্রেশানের ক্ষেত্রে আরেকজনের সাথে তুলনা করলে ব্যাপারটা ভুলই হবে কেবল। একই শোক দুইজন মানুষকে দুই ভাবে প্রভাবিত করে।

"অমুকের টেবিলে খাবার নাই, আর তুমি প্রতিদিন ফেসবুকে খাবারের ছবি দাও? ধিক তোমাকে"--এটা যেমন হাস্যকর যুক্তি, সেরকম "আমি তোমার চেয়ে বেশি দুঃখে আছি তাই তোমার দুঃখ পাবার অধিকার নেই", এটাও হাস্যকর।

আচ্ছা, লেখায় দুঃখ আর বিষন্নতা একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তা দোষের না, কারণ দুইটি মানসিক অবস্থাই খুব কাছাকাছি ধরনের।

আজকে একজন তরুণ ভারতীয় নায়কের ডিপ্রেশান প্রসূত আত্মহত্যা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমরা কেউ কি আসলে জানি তার মনের মধ্যে কি চলছিল?

তার ছিল অপার সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার, সুন্দর চেহারা, অগুনতি ভক্ত অনুগ্রাহী, বন্ধু বান্ধব, সুন্দরী বান্ধবী, আর অনেক শুভাকাঙ্খী। তারপরেও গলায় দড়ি দিয়ে সে দুনিয়াকে বাই বাই দিয়ে দিল এক মুহুর্তের নোটিশে।

বাইরে থেকে দেখে মনে হবে তার জীবনে কোন দুঃখ দূর্দশা থাকা সম্ভব না, আর সে কারণে তার জীবনে বিষন্নতার বীজ কে কখন, কিভাবে বপন করেছে, সেটাও নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছে না। অল্প কিছু ভাসাভাসা থিওরী শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কোনটাই খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।

হয়তো বা করোনা ভাইরাসের লকডাউনের কারণে তার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একাকিত্ব ও বিষন্নতার চিন্তাগুলো বারবার ঘুরে ফিরে হানা দিচ্ছিল। হয়তো সে দীর্ঘদিন ধরেই এ অবস্থায় কাটাচ্ছিল, কিন্তু এক্টিভ থাকার কারণে নেগেটিভ চিন্তাগুলো সামনে আসতে পারতো না।

ডিপ্রেশান ইজ রিয়েল। এই কথাটা মানতে হবে সবার আগে। একজন মানুষ, যার সব আছে (অন্তত অন্যদের দৃষ্টিতে), সেও যেকোন সময় গুরুতর বিষন্নতায় আক্রান্ত হতে পারে।

আমরা আমাদের চারপাশে খেয়াল রাখি, বন্ধু বান্ধব, আত্নীয় স্বজন কাউকে দেখে যদি মনে হয় সে আস্তে আস্তে জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে, তাহলে তার যত্ন নেই, তাকে একটু অতিরিক্ত সময় দেই, তার সাথে কথা বলি।

বিষন্নতার কারাগার থেকে একজন মানুষ কে আরেকজন মানুষই পারে মুক্তি দিতে।
ছবিঃ গুগল
#ishtiaq_radical

No comments: