Saturday, May 30, 2020

Beirut Diary 11

দেশের বাইরে প্রথম জন্মদিনের মত প্রথম ঈদও পালন করলাম সেবার বৈরুতে। ঈদ উল আযহা। 

আলফা টেলিকমের মার্কেট অপারেশানস ডিপার্ট্মেন্টে কোন মুসলমান ছিল না। এই ব্যাপারটা আমাকে খুব একটা প্রভাবিত করেনি, কিন্তু শুক্রবারে জুম্মার নামাজের সময়ে অফিস করার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগতো।

অফিসের আশেপাশে কোন মসজিদ ছিল না। জুম্মা পড়তে হলে ট্যাক্সি নিয়ে বেশ খানিকটা দূরের একটি জায়গায় যেতে হোত। বলাই বাহুল্য, অফিসে কোন নামাজের কক্ষ ছিল না। 

ঈদের দিনে আমি ছিলাম পুরাই একাকী। আগেই বলেছি, কলিগদের মধ্যে কেউ ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, এবং সেই দেশের কোন মুসলমানের সাথে আমার সেভাবে পরিচয়ও ছিল না।

প্রতিবারের মত সেবারও দেশে গরু ও খাসী কুরবানী দেয়া হচ্ছে, জানতাম। গরুর ছবিও পাঠানো হলো আমাকে। কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে! প্রচন্ড মিস করছিলাম চাচাদের সাথে ঘুরে ঘুরে হাট থেকে গরু কেনা, গভীর রাতে সেই গরুকে হাটিয়ে হাটিয়ে বাসায় নিয়ে আসা সহ ঈদের সকল আয়োজন কে।

ভেবেছিলাম সকালে উঠে নামাজে যাব। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে আর জামাত ধরা হলো না। দেখি ১১ঃ৩০ বেজে গিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে মনে পড়লো, আজ অফিস নেই। ধীরে সুস্থেই বিছানা ছেড়ে উঠলাম।

শুধু সেদিন নয়, এরপর আরও তিন দিন ছুটি পেয়েছিলাম। এটাই ছিল লেবানন থাকাকালীন আমার সব চেয়ে বড় ছুটি। ঈদের সাথে সাথে তাদের জাতীয় কোন একটি দিবসও পড়ে গিয়েছিল, যে কারণে এত লম্বা ছুটি।

উদ্যমের অভাবে বৈরুত ছেড়ে কোথাও যাওয়া হয়নি, কিন্ত এখন মনে পড়লে আফসোস হয়--চাইলেই আমি ঘুরে আসতে পারতাম পার্শ্ববর্তী কোন নতুন শহরে, কিংবা বৈরুতের অজানা কোন এলাকাতেও ঢুঁ মারা যেত সহজেই। কিন্তু মনটা আসলে বেশ খারাপই ছিল; নতুন কোন এডভেঞ্চারের দিকে না গিয়ে বড়ং চিরপরিচিত "আশরাফিয়েহ" এলাকায় চলে গেলাম ট্যাক্সী নিয়ে। 

বৈরুতে থাকার সময়টায় এই জায়গাটাই আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল, কারণ এখানে এক সাথে অনেক কিছু পেয়ে যেতাম। ABC Mall নামের একটি বড় শপিং মল ছিল সেখানে, যেখানে উইন্ডো শপিং এর জন্য বড় বড় ও সুদৃশ্য দোকানপাট , খাওয়া দাওয়া করার জন্য অসংখ্য সুলভ রেস্তোরাঁ, সুবিশাল থ্রিডি সিনেমা হল, হাঁটাহাঁটি করার জন্য মনোরম পরিবেশ এবং সর্বোপরি স্টারবাকস এর একটি বড়সড় শাখা-ছিল। 




অফিস থেকে যে দৈনিক ভাতা পেতাম, সেটা দিয়েই মোটামুটি খাওয়ার খরচ হয়ে আরো বেশ খানিকটা বেঁচে যেত। সেই বাড়তি অর্থ থেকেই সময় কাটানোর জন্য এসব বিনোদন মূলক কাজে কিছু খরচ করতাম। তাও খুব বেশী না। দু'মাসের সফরে কেনাকাটা তেমন কিছুই করিনি। শুধু জীবনে প্রথমবারের মত কয়েকটি অরিজিনাল সিডি কিনেছিলাম; সদ্য রিলিজ হওয়া আইরন মেইডেনের এলবাম "ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার", স্যান্টানার "গিটার হেভেন" এবং শাকিরার "সালে এল সোল"। 


 

উইকেন্ডের বাঁধা রুটিন ছিল এটি। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ১১-১২ টার দিকে চলে আসতাম এখানে। কিছুক্ষণ দোকানপাট ঘুরে লাঞ্চ সারতাম। তারপর পরপর দু'টি মুভি দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে আসতো। এরপর আরো খানিক্ষণ ঘুরে ডিনার করতে যেতাম। একেক সপ্তাহে একেক রেস্তোরাঁতে, এবং একেক ধরণের খাবার। 

যারা আমাকে ভাল চেনেন, তারা সবাই জানেন আমি কফি প্রচন্ডরকম ভালোবাসি। জীবনে প্রথম স্টারবাকস এর কফি খেয়েছিলাম মালয়েশিয়া গিয়ে। সেই কফি পান করে মনে হচ্ছিল অমৃত সূধা পান করছি। পরবর্তীতে অন্যান্য দোকানে আরও ভাল কফি খাওয়ার সুযোগও হয়েছে, কিন্তু সেই প্রথম কাপের কথা আজও মনে পড়ে।

এবিসি মল এর বাইরে ছিল সব চেয়ে বড় স্টারবাকসটি। সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ভীড়ের কমতি থাকতো না। উইকেন্ডে বেশী ভীড় হোত। দোকানের বাইরে আর ভেতরে, দু'খানেই বসার সুন্দর বন্দোবস্ত ছিল। এক পাশে হয়তো স্যুট টাই পরে দুই তিন জন্য ব্যক্তি বিজনেস মিটিং সারছেন, আবার অন্য পাশে ৪-৫ জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রী মিলে গ্রুপ এসাইনমেন্ট শেষ করছে, আবার আরেক মাথায় টুলে বসে কপোত কপোতী মধুর দৃষ্টি বিনিময় করছে। এই দৃশ্যগুলো খুবই সাধারণ ছিল। 

সবাই কথা বলছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত ভাবে। শোরগোল নেই একদমই । কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না, এবং কেউ কারও ব্যাপারে বাড়তি উৎসাহ দেখাচ্ছে না। 

সবার হাতে সাদার উপর সবুজ রঙে আঁকা মৎস্যকণ্যা সম্বলিত কফির কাপ, আর তা থেকে ধোয়া ওঠা কফির সুঘ্রাণে পুরো দোকানটা ভরে যেত।  কফিশপের ১০০ গজ দূর থেকেই সেই মন মাতানো গন্ধে মাথা খারাপ হবার জোগাড় হোত। এক অমোঘ টানে ঢুকে যেতাম দোকানে, আর অর্ডার দিতাম হ্যাজেলনাট লাটে, পিপারমিন্ট মোকা, কিংবা ক্যারামেল্লো সহ আরও বিবিধ স্বাদের কফিগুলো। লেবাননে থাকাকালীন কফির বিলই ছিল আমার সবচেয়ে বড় বিলাসিতা। 

কপাল গুণে, লেবাননে খাবারের দাম বেশ আয়ত্তের মধ্যে ছিল। ঢাকা শহরে সে যুগেও বড় দোকানে, মোটামুটি মানসম্মত ডিনার করতে অন্তত হাজার খানিক টাকা বের হয়ে যেত, বিশেষ করে বিফ স্টেইক খেতে গেলে। কিন্তু লেবাননে তিনশো চারশো টাকাতেই বেশ ভাল মানের স্টেক পাওয়া যেত। 

কিন্তু সেদিন আমি এবিসি মলের ঐদিকে বেশিক্ষন না থেকে ডাউনটাউনের দিকে চলে এলাম, কারণ সেখানে রয়েছে সুদৃশ্য কিছু মসজিদ এবং প্রাচীন আমলের কিছু স্থাপত্য কীর্তি।

কিন্তু মসজিদের কাছে গিয়ে বেশ হতাশ হলাম। ঈদ উৎসবের কোন ধরণের চিহ্নই সেখানে দেখলাম না। পরে জানতে পেরেছিলাম, যে অন্য অনেক দেশের মত লেবাননেও প্রকাশ্যস্থানে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক আগেই এবং সকল কুরবানী সম্পন্ন হয় সরকার কতৃক নির্ধারিত জবাইখানায়।

কিছুক্ষন মসজিদ এলাকায় ঘোরাঘুরি করে মনটা আবার খারাপ হলো। জন্মদিনে যেরকম আশা করেছিলাম যে দেশ থেকে অনেক ফোন পাব, এবার আর সেরকম ভাবিনি। আসলেও, ইংরেজী তে একটা কথা আছে না, আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড--অর্থাৎ, চোখের আড়াল মানেই মনের আড়াল, সেটা যে সত্য তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম সেবার। তবে এর মানে এই না যে আমাকে সবাই ভুলে গিয়েছিল; শুধু সামনে না থাকায় অত বেশী খোজ করেনি কেউ, এই আর কি।

অফিসের বৈরি পরিবেশের কথা ভেবে আরও বিরক্ত লাগছিল। ছুটির আগে দিয়ে এইচ আর এর সাথে একটা ছোটখাট বচসা হয়েছিল। আমাকে অন্য কর্মীদের মত ব্যাংক একাউন্টে টাকা দিত না ওরা; ব্যাংকে গিয়ে ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিলে খামে ভরে ডলার দেয়া হোত। আমি যেহেতু টুরিস্ট ভিসায় ওদের ওখানে ছিলাম, ওরা আমাকে চাইলেও সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে বেতন দিতে পারতো না।

সেবার ঈদের মাসে আমাকে অর্ধেক মাসের বেতন দেয়া হলো। অর্থাৎ তৃতীয় মাসের বেতন পুরোটা না দিয়ে শুধু প্রথম ১৫ দিনেরটা দেয়া হলো।

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না এরকম কেন করা হলো আমার সাথে। ব্যাপারটা নিয়ে এইচ আর এর একজন এক্সিকিউটিভ এর সাথে কথা বলতে গেলাম, সে ঠিক করে বলতে পারলো না কারণটা। আমাকে হেড অফ এইচ আর এর সাথে দেখা করতে বলে সে দায় সারলো।

হেড অফ এইচ আর ভদ্রমহিলার নাম ছিল পাওলা। অত্যন্ত চৌকস, স্মার্ট মহিলাটির ডেস্কে ছিল বেশ বড়সড় একটা ছবি--সুন্দর করে ফ্রেমিং করা। দুই কন্যা ও স্বামী সহ পারিবারিক ছবিটি বেশ সুন্দর ছিল। পরে জেনেছিলাম, ছুটি কাটাতে বিচে গিয়েছিল ওরা, তখন এই ছবিটা তোলা।

এর আগেও পাওলার সাথে যতবার কথা হয়েছে, সে খুবই আন্তরিক আচরণ করেছে।

সেদিন আমাকে সে ঠান্ডা মাথায় দুঃসংবাদ দিল। জানালো, আমার ভিসা রিনিউ করা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। হয়তো আমাকে সময়ের আগেই ফিরে যেতে হবে। সেজন্য আমাকে পুরো মাসের বেতন না দিয়ে শুধু অর্ধেক মাসেরটা দেয়া হয়েছে। তবে তারা চেষ্টা করছে ভিসা রিনিউ করার এবং হয়তো ছুটির পরেই আমি একটা আপডেট পেয়ে যাব।

এই দোটানা ভাব নিয়ে ছুটিতে গেলাম, যার রেশ পুরো চারদিনই টানতে হয়েছে আমাকে।

(চলবে) 

No comments: