Tuesday, May 05, 2020

What If এর গল্প

What If এর গল্প
আজকে রাতুলের জন্য একটা খারাপ দিন। প্রতি সপ্তাহেই এই দিনটা আসে, আর সকাল থেকেই তার মেজাজটা গরম থাকে। কোন দুঃখে আম্মা যে স্কুলটা চালু করলো!
সপ্তাহে দুইদিন আম্মা আশেপাশের সব বাসার কাজের ছেলে আর মেয়েদের পড়ায়। দুই দুই চার ঘন্টা ক্লাস সপ্তাহে। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী শুরুতে ফ্রি নাস্তার লোভে আসলেও এখন নিজেদের আগ্রহেই আসে। যেসব বাসায় এই বাচ্চারা কাজ করে, তারা প্রথমে একটু গাইগুই করলেও এখন খুশি মনেই ওদেরকে পড়তে পাঠায়।
সবাই এই ব্যবস্থায় সুখী হলেও কপাল পুড়েছে রাতুলের, কারণ বুধ আর শুক্রবারে এই ক্লাশটা নেন মিসেস রহমান। বুধবারে রিতুর ক্লাস থাকে; এলিফ্যান্ট রোডে, জামান স্যারের বাসায়। বাংলামোটর থেকে এলিফ্যান্ট রোড বেশী দূরে না হলেও ছোট বোনকে মা কখনোই একা আসা যাওয়া করতে দেন না। বাকি দিনগুলোতে আম্মা নিজে গেলেও বুধবারে রাতুল কে যেতে হয় তার বোন কে উদ্ধার করে আনার জন্য।
সেদিনও সে গেল। ক্লাস শেষ হবার কথা বিকেল চার টায়, কিন্তু জামান স্যার প্রায়ই ওদেরকে আরো কিছুক্ষণ আটকে রাখেন। আবার কোন কোন দিন আরো আগেই ছেড়ে দেন। তাই রাতুল কে সাড়ে তিনটা থেকেই ওখানে গিয়ে বসে থাকতে হয়।
ঘটনাচক্রে, ঐ সময়ে স্যারের ব্যাচটি ছিল "অল গার্লস", এবং এ কারণেই মূলত রাতুলের বিরক্তি। গলির শেষ মাথার স্যারের বাসা, আর পুরো গলি ভর্তি ছিল আরো কয়েকজনের স্যারের বাসা।
আজকে রিকশা থেকে নেমেই আরেক দফা মেজাজ গরম হলো রাতুলের। মনে হয় সব স্যার আজকে আগে ক্লাশ ছুটি দিয়ে দিয়েছে। দল বেঁধে কিশোরী মেয়েগুলো কিচির মিচির করছে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। আচারওয়ালা মামার আজকে সেইরকম রমরমা ব্যবসা।
সে ব্যাগ থেকে নাইকির "জাস্ট ডু ইট" লেখা এবং টিক চিহ্ন মার্কা দেয়া নীল ক্যাপটা বের করে পড়ে নিল, তারপর অন্যদিনের মত মাথা নিচু করে হনহন করে সামনে আগাতে লাগলো। কিন্তু খুব একটা দ্রুত হাঁটতে পারছিল না সে।
প্রথমে সে থমকে গেল চারজনের একটি দলের কারণে। সে ভেবেছে তাকে দেখে মেয়েগুলো সরে দাঁড়াবে। কিন্তু তারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাতুল অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েগুলোর চোখে ও মুখে আমোদ। মুচকি হেসে একটা মেয়ে বলেই বসলো "হাই হ্যান্ডসাম"। রাগে লাল হতে হতেই পাশের মেয়েটা চোখ টিপে দিল। রাগ ও লজ্জার সাথে লড়াই করতে করতে কোনমতে এই দলের হাত থেকে পালিয়ে বাচলো সে।
আরেকটু আগাতে সে বুঝতে পারলে তার ডানপাশ থেকে আরেকদল মেয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। তারা আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও সে মাথা নিচু করেই এগিয়ে গেল। পেছন থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো "একবারও চোখ তুলেও তাকালো না!"
রাতুলের মনে হলো সে প্রায় দশ বছর ধরে হাটছে। অবশেষে জামান স্যারের বাসার সামনে এসে দাড়াতে পারলো সে। একের পর এক মেয়ে বের হচ্ছে। অনেকেই তাকে রিতুর ভাই হিসেবে চিনে এক চিলতে শ্রদ্ধা(!) মাখানো হাসি দিয়ে যাচ্ছে, আর সে শুধু শুধুই লাল হচ্ছে। অবশেষে তাকে যখন প্রায় রক্ত মানবের মত লাগছে, তখন রিতু বেরিয়ে এল।
"এতক্ষন লাগে বের হইতে? সমস্যা কি তোর?"
"ভাইয়া, বকাঝকা করবা না তো। স্যার আজকে টেস্ট নিয়েছেন"
"টেস্ট কি তোর একার? তুই দেরী করিস, আর এদিকে সব ফাজিল মেয়েগুলা..."
"কোন ফাজিল মেয়ে? কে কে কে? ওই যে, লাল ফিতা গোলাপী জামাওয়ালা রেবেকা?"
"চুপ করবি? বাসায় চল। আমি আর আসতে পারবো না তোকে নিতে"।
এভাবে রাগে গজগজ করতে করতে গলির মুখের কাছাকাছি এসে রাতুল আবার খেয়াল করলো আসলেই লাল ফিতা গোলাপী জামা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখনো। সে বুঝতে পারলো যে এই সেই চোখ টিপ দেয়া মেয়েটি।
তাকে দেখেই রিতুর চোখে মুখে কৌতুক খেলা করতে লাগলো। কিন্তু ভাইকে আর রাগাতে চাইলো না। তার এই বোকাসোকা লাজুক ভাই এর জন্য অনেক মায়া। দুনিয়ার দুষ্টু নারীকূল থেকে তাকে রক্ষা করার এক মহান ইচ্ছা মাঝে মাঝে তার মনে খেলা করলেও সে পুরো ব্যাপারটাকে নির্দোষ কৌতুকের মত করেই দেখে। রেবেকা তার ক্লাশেই পড়ে।
কিছু বোঝার আগেই রেবেকা এসে রাতুলের হাতে একটা চিরকূট দিয়ে গেল। পারফিউমের গন্ধ মাখা কাগজে কি আছে, সেটা না দেখেই ছিড়ে ফেলার এক অদম্য ইচ্ছা তার মনে জাগলেও সে অতটা অভদ্রতা করতে পারলো না।
তবে কাগজটা ভাজ করে তার ব্যাগে রেখে দিল। না পড়েই।
এইটা সাত বছর আগের কাহিনী।
সেদিন রিকশায় করে বাসায় ফেরার সময় জনৈক রসিক মোটরসাইকেল আরোহী টান দিয়ে তার হাত থেকে সেই ব্যাগটি নিয়ে গিয়েছিল। ব্যাগের ভেতর একটা ভারী জ্যাকেট, দুইটা পেন ড্রাইভ আর সেই কাগজ ছাড়া আর কিছু ছিল না।
আজকে রেবেকা আর তার বোনের গ্র্যাজুয়েশনের অনুষ্ঠানে এসে সেদিনের কথা ভাবছিল রাতুল। ঠিক করে রেখেছে এক ফাকে রেবেকা কে জিজ্ঞেস করেই ফেলবে সেই কাগজে কি লেখা ছিল।
এই what if মূলক জীবন আর ভাল্লাগছে না তার।

No comments: