Friday, April 17, 2020

অবাক সূর্যাস্ত

চারপাশে খালি ধুলা আর ধুলা। মুখে মাস্ক পড়ে থাকলেও কিভাবে কিভাবে জানি ধুলা ঢুকে যায় নাকে মুখে, আর হাঁচতে হাঁচতে এলান এর অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। বাপ মা নাম রেখেছিল হেসুস আলেহান্দ্রো গাইয়ার্দো, কিন্তু সেই নাম বিকৃত হতে হতে জিসাস আলেকজান্ডার গ্যালার্ডো হয়ে গিয়েছে। অগত্যা সে নিজেই নামটাকে সহজ করে নিয়েছে; এলান বললে মোটামুটি দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ সাথে সাথেই বুঝে যায়।

পূর্বপুরুষ আন্দালুসিয়া থেকে আসলেও এলান এখন পুরোদস্তুর মার্কিন নাগরিক। তাকে না দেখে তার ইংরেজী উচ্চারণ শুনলে কেউ টেরও পাবে না যে সে অভিবাসী। সারা জীবন মার্কিন মুল্লুকের ভাল ভাল খাবার আর কান্ট্রিসাইডের বিশুদ্ধ বাতাস খেয়ে বড় হওয়া আলেহান্দ্রোর কাছে ঢাকার বাতাস কে বিষবাষ্প মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

প্রথমে যখন সে ব্যাংলাড্যাশ নামের ক্ষুদ্র, অপরিচিত দেশে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করার প্রস্তাবটি পেল, তখম ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি যে এরকম ভয়াবহ একটা জায়গায় তাকে সত্যি সত্যি যেতে হবে। কিছুক্ষন গুগল ঘেটে সে জানতে পারলো যে ঐ দেশে কোটি কোটি মানুষ আর তারা প্রায় সবাই বেসবলের মত একটা খেলা খুব ভালবাসে।

সে প্রায় সাথে সাথে ইমেইলের উত্তরে প্রস্তাব নাকচ করে দিল। দিন শেষ হতে হতে তার মাথা থেকে বাংলাদেশের কথা পুরাই উড়ে গিয়েছে। স্কান্সকা কর্পোরেশনের আলিশান ভবন থেকে বের হয়ে আনমনে, "কান্ট্রি রোড, টেইক মি হোম" এর সুর ভাজতে ভাজতে বাসার দিকে রওনা দিল এই গল্পের নায়ক আলেহান্দ্রো।

প্রতিদিন একই রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত এলান আজ কি মনে করে পার্কের রাস্তাটা ধরলো। অফিসের কাছের এই পার্কে কালেভদ্রে আসা হয় ওর।

অন্যমনষ্ক অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাত সে টের পেল যে সামনে একটি ডেডএন্ড। এগিয়ে যাওয়ার আর কোন রাস্তা নেই। ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে ফিরতি পথ ধরতে যাবে এলান, আর তৎক্ষণাৎ এক অচেনা কন্ঠের হুশিয়ারী শুনে তার শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের ঠান্ডা অনুভূতি নেমে গেল।

"চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমার কাছে অস্ত্র আছে। কোন শব্দ করার চেষ্টা করলে পস্তাবে"

ভাল করে তাকিয়ে এলান দেখলো এক মেক্সিকান পাংক দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটি জং ধরা ড্যাগার। হাতলটাও ঘুনে ধরা মনে হলো। তাও এলান কোন উচ্চবাচ্য করলো না, দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়।

"ওয়ালেট, ঘড়ি, মোবাইল বের করে এখানে রাখ। কোন উলটাপালটা কিছু চেষ্টা করবে না"।

পকেটে হাত দিয়েই মনে পড়লো এলান এর; সেখানে কোন অর্থ নেই। বাসায় ফেরার পথে এটিএম থেকে ক্যাশ তুলে নেয়ার কথা ছিল। আজ হঠাত অফিসে একজনের বিদায়ী পার্টির জন্য চাঁদা দিতে গিয়ে সব টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে।

আর মিটিং এ যাওয়ার আগে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে ড্রয়ারে রেখেছিল সে, সেটা অফিসেই রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, ছিনতাইকারী কে সন্তুষ্ট করার মত কিছুই নেই তার সাথে। ঘড়িটাও সস্তা রেপ্লিকা।

মেক্সিকান দুর্বৃত্ত ততক্ষনে অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছে। বেশ রুঢ় ভাবে সে এগিয়ে এসে এলানের পকেট সার্চ করা শুরু করলো। ওয়ালেট আর সস্তা ঘড়িখানা হাতে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে বেশ রেগেই গেল সে।

"পোষাক দেখে তো মনে হয় ভাল চাকরী কর। পকেটে টাকা নাই কেন? মোবাইল কই? আর এরকম ফকিন্নি মার্কা ঘড়ি কেন হাতে?"

বলেই সে এক "বন চটকনা" দিল এলানকে। চড় খেয়ে লুটিয়ে পড়লো এলান; মাথা বাড়ি খেল গ্র্যানাইটের রাস্তার সাথে।

(অবশ্যই এই পুরো কথাবার্তা হয়েছিল ইংরেজী আর স্প্যানিশের সংমিশ্রনে, আর তখনো এলান বন চটকনার ধারণার সাথে সুপরিচিত নয়, কিন্তু গল্প বলার সুবিধার্থে এভাবে লেখা হচ্ছে। )

চোখে মুখে তারা দেখতে দেখতে এলান বুঝতে পারলো যে আজ সে প্রচুর মার খাবে। কপাল ভাল থাকলে প্রাণ হাতে নিয়ে ফিরতে পারবে, কিন্তু সেটাও নিশ্চিত না। এবার ছুড়ির বাট দিয়ে মারতে উদ্যত হল সেই মেক্সিকান। চোখ বন্ধ করে জিসাস কে ডাকতে লাগলো এলান। ঠিক সেই মুহুর্তে দরাম করে একটা শব্দ হল।

এক কন্সট্রাকশান কর্মীর বেলচার আঘাতে কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল মেক্সিকান। লোকটাকে ভাল করে দেখার আগেই জ্ঞান হারালো এলান।

এরপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটলো। সেই কর্মী অজ্ঞান এলান কে ট্যাক্সীতে উঠিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল। প্রায় ঘন্টা দুয়েক অচেতন থাকার পর হাসপাতালের বেডে এলানের জ্ঞান ফিরে এলো।

চোখ মেলে গার্লফ্রেন্ড লিন্দার উৎকণ্ঠিত চেহারা দেখে এলানের মন ভাল হয়ে গেল। কিছুক্ষন পরে ডাক্তার এসে জানালো যে সে বাড়ী ফিরে যেতে পারে। সাথে এও জানালো যে তার কপাল বেশ ভাল, মেক্সিকান লোকটি ড্রাগ আসক্ত হওয়ায় বেশ দূর্বল ছিল, খুব বেশী জোরে মারতে পারেনি। কিন্তু আরো দেরী হলে হয়তো জীবন শংকাও দেখা দিতে পারতো।

লিন্দার হাত ধরে বের হয়ে এল সে। বাইরে এক তামাটে রঙের এশিয়ান লোক কে দেখে চেনা চেনা লাগলো তার। একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো এলিন "আপনাকে কি চিনি আমি?"

"স্যার, আপনি ভাল আছেন? আমি রেজা। আপনার সাথে পার্কে দেখা হলো"।

তখন বিদ্যুতবেগে সব মনে পড়ে গেলে এলানের। শাবলের বাড়ি খেয়ে মেক্সিকান ড্রাগ পাপীর কুপোকাত হওয়া আর তার জীবন বেঁচে যাওয়া।

"ভাই আপনি আমার অনেক উপকার করলেন। প্রাণটা বাচলো আজ আপনার সাহসিকতার জন্য।"
"হেহে, কি যে বলেন স্যার। এটা তো আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল।"
"যাই বলেন, আজকাল কেউ কারও জন্য এত রিস্ক নেয় না। অচেনা কারও জন্য তো নয়ই"

এরপর রেজা মিটিমিটি হেসে বল্লোঃ

"স্যার, আমি তাহলে যাই। বাসায় আমার ছেলে অপেক্ষা করছে, ফিরলে একত্রে ডিনার করবো"

এ পর্যায়ে লিন্দা এলানের দিকে চোখটিপ দিয়ে হাতে ১০০ ডলারের একটি নোট গুজে দিল। সেটা সে রেজার দিকে এগিয়ে দিতেই রেজা খুব আহত হবার মত ভঙ্গি করলো।

"এ কি করছেন স্যার। আমার ডলার লাগবে না"
"আমি খুশি হয়ে দিচ্ছি। প্রাণের মূল্য 'শ ডলারের চেয়ে অনেক বেশী।"
"সেটা ব্যাপার না স্যার। আমি অর্থের জন্য আপনাকে সাহায্য করিনি। জোরাজুরি করে লজ্জা দেবেন না"

এরপর এলান আর জোর করলো না। টুকটাক কথায় জানতে পারলো রেজা কাছেই একটা কন্সট্রাকশান সাইটে কাজ করে। কাজ শেষে বাড়ী ফিরছিল, সাথে তার নিজের কাস্টোমাইজড শোভেলটা ছিল। উচ্চতা অনেক কম হওয়াতে তার জন্য আলাদা করে এই বেলচাটি আনিয়ে দিয়েছে লকহার্ট ট্রু ভ্যালু হার্ডওয়্যার স্টোরের ম্যানেজার জেমস হ্যাটফিল্ড। আমেরিকানরা যেগুলো ব্যবহার করে, সেগুলো তার জন্য বেশী লম্বা হয়ে যায়।

রেজার আদি নিবাস বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায়, এটা শুনে বেশ চমকে গেল এলান। এম্নিতে কুসংস্কারে বিশ্বাসী না হলেও তখনই সে বুঝে গেল, তার নিয়তি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষদের সাহায্য করা।

প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে রাজি হয়ে গেল সে সেই কন্সাল্টেন্সির কাজটায় । দুইবার ইমেল আর ফোনের মাধ্যমে পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হল তাকে--যে প্রতিষ্ঠানটি তাকে নিয়োগ দিচ্ছিল, তারা বিশ্বাসই করতে পারে নাই যে স্কান্সকার একজন শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার এত কম সম্মানীতে বাংলাড্যাশ যেতে রাজি হয়ে যাবে।

এই ঘটনার প্রায় তিন মাস পরের কথা।

মেট্রোরেইল প্রজেক্ট চলছে পুরোদমে। প্রতিদিন এলান কে মিরপুর যেতে হয় গাড়ি করে, সাইট পরিদর্শনের জন্য। এই কাজের জন্য তাকে অফিস থেকে মান্ধাতার আমলের একটা সাদা টয়োটা করোলা গাড়ি দিয়েছে। প্রতিদিন ড্রাইভার কুদ্দুসের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে অবশেষে সে গত দুইদিন ধরে গাড়ীতে উঠেই কানে হেডফোন লাগিয়ে বসে থাকে।

আজকেও তেজগাঁয়ের রোডস এন্ড হাইওয়ের অফিস থেকে ঠিক ৪টায় রওনা দিল এলান। হেডফোনে তার প্রিয় ফুটবল দল ডিপোর্তিভো লা করুনার উপর একটি পডকাস্ট শুনছিল; কখন ঝিমুনি এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, টেরই পায় নি।

মিরপুরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে হঠাত ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে কুদ্দুস নেমে গেল গাড়ী থেকে। বনেট উঠিয়ে এটা সেটা নাড়তে লাগলো, কিন্তু কিছুতেই ইঞ্জিন আর স্টার্ট হলো না।

এসি না চলাতে ঘামতে শুরু করলো এলান। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়ী থেকে নেমে গেল এলান। কুদ্দুসের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে প্রচন্ড রেগে গেল সে। গাড়ীর মায়ের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন মূলক একটি অশ্লীল ইংরেজী গালি দিয়ে সে একটা সিগারেট ধরালো, আর কুদ্দুস তড়িঘড়ি করে এডমিনের আলম কে ফোন দিতে ছুটলো।

গাড়ীর গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ানোর পর হঠাত আকাশের দিকে চোখ গেল তার। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে উপভোগ করতে লাগলো সূর্যাস্তের সেই সুমধুর দৃশ্য। একটু দূরে হেঁটে গিয়ে গাড়ী সহ সেই সূর্যাস্তের চমৎকার একটি ছবি তুলে নিলো সে তার মোবাইলে।

ছবিটা লিন্দাকে পাঠিয়ে দিলো সে হোয়াটসএপ এ, সাথে ছোট্ট একটা মেসেজ।

"মিস ইউ আ লট, বেইব। দিস ইজ দ্যা মোস্ট বিউটিফুল কান্ট্রি আই হ্যাভ এভার বিন টু। উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার টু শেয়ার দিস মোমেন্ট"।







No comments: