Monday, September 02, 2019

জাতীয় কবি

উনার ব্যাপারে আমার প্রাচীনতম স্মৃতি হচ্ছে পেপারে ছবি দেখে চিন্তা "আচ্ছা এই লোক শাড়ী পড়ে ছবি তুলসে কেন? সমস্যা কি?"। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল ভদ্রলোক শাড়ী পরেই সেই কালজয়ী ছবিটি তুলেছিলেন। লেখার সাথে সংযুক্ত ছবি দ্রষ্টব্য।

আমি দাবী করবো না যে আমি বিরাট নজরুল বোদ্ধা। সত্য বলতে গেলে, পাঠ্যবই এর বাইরে উনার লেখা খুব একটা পড়িই নাই। এবং একজনের সাথে তার "উর্দুতে" দেয়া স্ট্যাটাস নিয়ে তর্ক করতে করতে জানতে পেরেছিলাম যে "কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই !" আসলে নজরুল এর একটি কবিতার অংশ বিশেষ। 

আরো মজার ঘটনা আছে। আমাদের কৈশোরে রেনেসাঁ ব্যান্ড একটি চমৎকার এলবাম বের করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই গানগুলো সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছিল, উনারা সেই গানগুলোর আধুনিকায়ন করে রিলিজ করেছিলেন "একাত্তরের রেনেসাঁ"। ক্যাসেটটি দীর্ঘদিন আমার সংগ্রহে ছিল, পরে সিডি রিলিজ হবার পর সিডিটাও কিনেছিলাম। 

সেই এলবামে ছিল "কারার ঐ লৌহ কপাট" গানটি। রেনেসাঁর কল্যাণেই কি না জানি না, গানটা শুনলেই রক্ত গরম হয়ে যেত। মনে হোত এখুনি তালা ভেংগে কাউরে জেল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ঐ ক্যাসেটের এই একটা গানই ছিল একমাত্র নজরুল গীতি(!) যা আমার জানা ছিল। 

অনেক বছর পরের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জাতীয় কবির শেষ বিশ্রামের ঠিকানা। সেই কবর স্থানে তখন সবার অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। ক্লাশের ফাঁকে কোনদিন সময় পেলে কবরস্থানে যেতাম। কবির কবরের অনতিদূরেই আমার দাদার কবর। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। 

কবির কবরের সামনে অনেক বিচিত্র মানুষ দেখতাম। ভক্তকূল। একদিন এক চারণ কবির সাথে দেখা হলো। সে মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে ফেলে, আবার খাতায় লিখে রাখে। লম্বা একটা টুপি পরে ছিল লোকটা, কিছুটা মির্জা গালিবের টুপিটার মত। কাপড় চোপড় শীর্ণ, তবে তাতে হারিয়ে যাওয়া আভিজাত্যের ছাপ রয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আনমনে খাতায় লেখালেখি করার পর চোখ তুলে আমাকে দেখলো সে। বলে উঠলো "ভাতিজা একটা কাব্য শুনবা?" বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ভারিক্কি কন্ঠে শুরু করলো তার সেই বাংলা উর্দু মেশানো বিচিত্র কবিতা। দূর থেকে শুনলে মনে হবে ওয়াজ মাহফিল চলছে কোথাও। আমি কিছু না বুঝলেও মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে থাকলাম। 

তার কাব্য পাঠে বাধ সাধলো এক জোড়া কপোত কপোতী। তাদেরকে দেখেই লোকটি অসম্ভব বিরক্ত হলো, এবং কিছুটা দূরে গিয়ে বসলো। এরপর আরো এক জোড়ার আগমন, তারপর আরো--কিছুক্ষণ পর অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে এই কবরস্থানটি আসলে একটি সুদৃশ্য ডেটিং স্পট! 

পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ সেখানে জনসাধারণের প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে; বর্তমানে পুরো জায়গাটি সারাক্ষণ তালাবদ্ধ থাকে। 

ছোটবেলায় শেখা কবিতাগুলোর মধ্যে কাঠবেড়ালী ও তার পেয়ারা খাওয়া সংক্রান্ত কবিতাটি বিশেষ স্থান দখল করে থাকবে। কারণ, অদ্যবধি ঐটাই আমার পড়া একমাত্র বাংলা কবিতা, যেখানে পেয়ারা ও কাঠবেড়ালী একই সাথে আছে।হিব্রু ভাষার একটি কবিতা পড়েছিলাম, যেখানে একটি ইহুদী খরগোস কে একটা আমেরিকান মানুষ একটি জার্মান পেয়ারা সাধে, কিন্তু সে সেটা খেতে চায় না। পরে একটা আফ্রিকান কাঠবেড়ালী এসে সেই পেয়ারা খেয়ে ফেলে। সে যাই হোক... 

আমার মনে আছে, আমি কবিতাটা শুনে আমার মা কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আচ্ছা মা, যেসব মহিলা বিড়াল কাঠ খায়, তাদেরকে কি কাঠাবেড়ালী বলে?"। এহেন প্রশ্ন শুনে আম্মা হেসেছিল, কেদেছিল, আবেগী হয়ে গেসিল না প্যাদানী দিসিল সেটা অবশ্য মনে নাই। তবে আজো কোথাও ঐ কবিতা শুনলে পিঠের কাছে একটা জায়গায় টনটন করে উঠে, তাই আমার ধারণা শেষ ট্রিটমেন্টটাই সম্ভবত কপালে জুটেছিল!

জাতীয় কবির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমার এই এলেবেলে স্মৃতিচারণ শেষ করলাম। বেচে থাকুক উনার কবিতা ও গান, যুগ যুগ ধরে। 





No comments: