Tuesday, January 26, 2021

দেরী

 [এটি একটি জীবনের priority আবিষ্কার মূলক গল্প। এটি লিখেছিলাম ২০১৮ সালে, কিন্তু কোন এক কারণে নিজের প্রোফাইলে শেয়ার করা হয়নি। আজকে পুরনো লেখার পরিমার্জিত সংস্করণটি পোস্ট করলাম।


এখানে আগাথা ক্রিস্টির ভুতের গল্পের প্রভাব, নিজের দীর্ঘ কর্পোরেট চাকুরী জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং পরিশেষে, কল্পনা শক্তির প্রভাব রয়েছে। গল্পটি দীর্ঘ, ভূমিকাও ছোট না। আশা করে পড়ে ভাল লাগবে সবার]।

"দেরী"




রহমান সাহেব কাজ করছেন। নিবিড় মনে। অফিসে উনার সমসাময়িক প্রায় সবাই ল্যাপটপ পেলেও উনি এখনো কাজ করেন পুরনো ডেস্কটপ পিসিতে।

অফিসের জ্যেষ্ঠতম নয় বলে শুধু, অনেক সততা এবং কর্মদক্ষতার কারণেই সবার শ্রদ্ধার পাত্র উনি। সকালে সবার আগে আসেন অফিসে, বের হন সবার শেষে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ ঘন্টার মত অফিস করেন উনি।

বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দু'দিন বন্ধ থাকলেও প্রায় শনিবারেই উনি হাজির হয়ে যান পরের সপ্তাহের কাজ এগিয়ে রাখার জন্য। বস্তুতঃ পুরো এক সপ্তাহের ৭২ ঘন্টাই তার অফিসে কাটে।

লাঞ্চটা টিফিন কেরিয়ারে করে দিয়ে যায় "মায়ের হাতের খাবার" নামের ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে। খাবার আসে ঠিক দুপুর ১ টায় এবং উনি ১৫ মিনিটে খাওয়া শেষ করে নামাজে দাড়ান। নামাজ সেরেই আবার কম্পিউটার এর সামনে বসে যান, আর শুরু হয় কিবোর্ডের খটাস খটাস আর মাউস এর ক্লিক ক্লিক শব্দ। এক্সেল ফাইলে প্রবেশ করান হাজার হাজার সংখ্যা আর হতে থাকে কোটি কোটি টাকার হিসাব।

প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, কেউ কোনদিন এই রুটিনের ব্যতিক্রম দেখেনি। শুধু একবার এক ডেলিভারী বয় অফিসে খাবার নিয়ে আসার পথে গাড়ী চাপা পড়েছিল দেখে সেদিনের খাবার আসেনি। রহমান সাহেব অগ্নি মূর্তির মত কিছুক্ষন ঘড়ির দিকে চেয়ে থেকে আবার কাজে ফিরে যান। পরের সপ্তাহ থেকে নতুন একটি ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে খাবার আসা শুরু করে।

সেদিন ছিল খুব ঝামেলাপূর্ণ একটি দিন। সকাল থেকেই একটি হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছিলেন রহমান সাহেন। প্রায় ২০ লাখ টাকার হিসেবে গড়মিল। দেখা যাচ্ছে, এমডির সাক্ষরের মাধ্যমেই এই টাকাটা তোলা হয়েছে, কিন্তু সেটার স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরুপ ওয়ার্ক অর্ডারটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে এমডির কাছে যাওয়ার আগে উনার নিজের হাত ধরেই যায় এই নির্দেশগুলো। তিনি সিস্টেমে দেখলেন যে তার এপ্রুভাল এর পরেই টাকাটা উত্তোলিত হয়েছে, কিন্তু সেটার নিয়মতান্ত্রিক কোন রেকর্ড নেই।

হঠাত ডেস্ক ফোনে কল এল। রিসিভ করেই এমডি জাহাংগীর সাহেব এর বাজখাই কন্ঠ শুনতে পেলেন তিনিঃ
"রহমান সাহেব, জলদী আমার রুমে আসেন"।

তারপরের ঘটনা আর স্পষ্ট মনে নেই। বয়সে ছোট হয়েও বস হয়ে যাওয়া জাহাংগীর সাহেব এর কাছে যখন মুহুর্মুহু বকা ও অভিসম্পাত শুনতে থাকলেন, তখন তার মনে হল চারপাশের দেয়াল থেকে পাথর খসে খসে পড়ছে মাথায়।

একটা সময়ের পর আর কিছু শুনতে পেলেন না তিনি। আনমোনা হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন শেষ হবে এই অত্যাচার। হঠাত টের পেলেন তার ঘাড় ধরে ঝাকাচ্ছেন এমডি সাহেব।

"শুনেন, আপনি পুরনো কর্মচারী। লোকাল কোম্পানীতে কাজ নিয়েছিলেন, তখন কেউ এত খুঁটিনাটি হিসাব করতো না। কিন্তু বহুজাতিক হবার পর এখন আর আপনার মত ট্র্যাডিশনাল এমপ্লয়িদের উপর ভরসা করা যায় না। তাও আমরা আপনার উপর আস্থা রেখেছি আগের দিনের কথা ভেবে। সামান্য কয়টা টাকার জন্য আপনি এরকম করবেন, এটা কষ্মিনকালেও ভাবিনি! আপনি হয় হিসেবটা মিলিয়ে দেন, অথবা টাকাগুলো ফেরত দিয়ে যান। আমার হাতে হাতে দিবেন, কেউ জানবে না কিছু। আপনি আপনার চাকরীও রক্ষা করতে পারবেন, সম্মানও অটুট থাকবে। আর যদি মনে করেন টাকা ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, তাহলে আর রবিবার থেকে আসার দরকার নেই অফিসে। আমরা বিভাগীয় তদন্ত করে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব"।

বাকিটা সন্ধ্যা কাটলো ঘোরের মধ্যে। রহমান সাহেব নিজের ডেস্কে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। সেদিন ছিল সপ্তাহের শেষ দিন। একে একে কর্মচারীরা সবাই বিদায় নিল। ততক্ষণে অফিসে সবাই জেনে গিয়েছে কাহিনী। যাওয়ার পথে অনেকেই উনার দিকে কটাক্ষমূলক দৃষ্টিতে তাকালেন, চল্লো কানাঘুষা, আর অল্প দুই একজন, যারা পুরনো কর্মী, তারা উনার দিকে কিঞ্চিত করুণার দৃষ্টিতেও তাকালেন।

এক পর্যায়ে রহমান সাহেবের মনে হল উনি পারবেন। চালু করলেন আবার কম্পিউটার। এক ফাইল থেকে আরেক ফাইলে উড়ে যেতে লাগলেন তিনি। উনার দৃঢ় বিশ্বাস, কোথাও কোন ভুল হয়েছে। নাওয়া খাওয়া ভুলে কাজ করতে লাগলেন। চারপাশে নিভে যেতে লাগলো এক এক করে বাতি, উনার হুশ নেই।

"ইউরেকা! পেয়েছি এবার!"

ফাইল সার্ভারের এক কোণায় পড়ে থাকা একটি গোপন ফাইল খুঁজে পেলেন রহমান সাহেব। খুলতে গিয়ে দেখলেন পাসওয়ার্ড দেয়া। "iamtheboss" টাইপ করতেই খুলে গেল ফাইলটি। পড়তে পড়তে রহমান সাহেব এর মুখে ফুটে উঠলো অনাবিল হাসি।

"পেয়েছি এবার বেটাকে! আমার সাথে মামদোবাজি! এই জিনিস হেডকোয়ার্টারে পাঠালে তো তোরই চাকরী থাকবে না। অতি উৎসাহের সাথে প্রিন্ট দিলেন উনি ফাইলটির গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশগুলোর। উদ্দেশ্য, প্রিন্ট আউটে চোখ বুলিয়ে আরেকবার নিশ্চিত হওয়া।

সব ঠিকঠাক থাকলে রাতেই উনি এই ফাইলগুলো রিজিওনাল হেড কে পাঠিয়ে দিবেন। বসকে সিসি তে রাখবেন কি না ভাবতে ভাবতে এগুলেন প্রিন্টার এর দিকে।

প্রিন্টারটা রুমের একদম শেষ মাথায়। হেটে যেতে যেতে খেয়াল করলেন পুরো অফিস গমগম করছে মানুষে। কাউকেই কেন জানি চিনতে পারলেন না। বুঝে পেলেন না কোন দিক দিয়ে সকাল হয়েছে।

কিন্তু...শুক্রবারে তো অফিসে এত লোক থাকে না। কেউ তাকে লক্ষ্যও করছে না। এ তো খুবই অবাক ব্যাপার!

যেখানে প্রিন্টার থাকার কথা, সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করলেন একটি উচু টেবিল রাখা, আর তার উপর প্রিন্টারের পরিবর্তে একটি কালো রঙের অচেনা মেশিন রাখা। সেখান থেকে প্লাস্টিকের কাপে ঢেলে ঢেলে কি জানি পান করছে ৩-৪ জন। উনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন।

রহমান সাহেব বলে উঠলেনঃ

"এই যে ভাই, প্রিন্টারটা কোথায় সরিয়েছে বলেন তো? আমি খুব জরুরী কিছু ডকুমেন্ট প্রিন্ট দিয়েছি!"

কেউ তার কথা শুনতে পেল না। এবার প্রথম বারের মত তিনি উদ্বিগ্ন হলেন। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফিরে গেলেন নিজের ডেস্কে। চেয়ারে বসতে গিয়ে হোচট খেলেন।

উনার ডেস্কটির চারপাশে কর্ডন দেয়া। এক ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলেন উনার সেই চিরপরিচিত চেয়ারটি রয়েছে, এবং পিসিটিও রয়েছে অক্ষত। পাশে একটি ছোট কাগজে অনেক কিছু লেখা। উনার নেম প্লেট টিও আছে অক্ষত "এম এম রহমান, সিনিয়ার একাউন্টস অফিসার"। দড়ির নিচ দিয়ে ভেতরে গেলেন তিনি।

কাগজে লেখাঃ

"এম এম রহমান (জন্ম ২১/২/১৯৬২, মৃত্যু ১/৬/২০১৮)"

রহমান সাহেব ছিলেন একবিংশ শতাব্দীতে এই কোম্পানীর একমাত্র, এবং সর্বশেষ ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহারকারী। আমাদের অত্যন্ত সৎ এবং নিষ্ঠাবান, চিরকুমার এই মিষ্টভাষী কলিগটি কাজ করতে করতেই, নিজ ডেস্কে বসা অবস্থায় মৃত্যমুখে পতিত হন। রবিবার সকালে এসে সহকর্মীরা তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে অফিসে।

ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা যায় যে অতিরিক্ত কাজের চাপজনিত টেনশান থেকে উনার স্ট্রোক হয়, এবং তাতেই উনি মারা যান।

উনি মারা যাওয়ার পর বহুদিন পর্যন্ত এই ডেস্কে কেউ কাজ করতে পারেনি। সবাই বলতো তারা কিবোর্ড এর খটাশ খটাশ শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সারাক্ষণ, আর কেউ কেউ প্রিন্ট হওয়া কিছু কাগজও দেখতে পায় ডেস্কের উপর ছড়ানো, কিন্তু কাগজ ধরতে গেলেই সেগুলো উধাও হয়ে যেত।

আমরা একটি প্রগতিশীল বহুজাতিক সংগঠন হিসেবে আদিভৌতিক কোন ব্যাপার কে অবশ্যই প্রমোট করতে চাই না, তবে রহমান সাহেবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক এবং তাকে নিয়ে চালু ভুতের গল্প গুলোকে অফিসের চিত্তাকর্ষক ঘটনা হিসেবে চিরস্থায়ী করার জন্য উনার ওয়ার্কস্পেস কে যাদুঘর এর মর্যাদা দেয়া হল।"

রহমান সাহেব এর পুরো দুনিয়া টলে উঠলো। লেখাগুলো আবার পড়লেন উনি। কোন রহমান এইটা? কি কাহিনী? একই নামে আরেকজন? আমি কি ভুল অফিসে চলে এসেছি?

এরকম আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে হঠাত তার চোখ গেল ক্যালেন্ডারের পাতায়। সেদিনের তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০৩০।

১২ বছর লাগলো বস এর চুরি ধরতে? একটু বেশিই দেরী হয়ে গেল মনে হয়।

মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন রহমান সাহেব। শরীরে কোন বোধ নেই।

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে লাগলো U2 band এর Stuck In a Moment গানটি। আস্তে আস্তে লিরিক্স শুনা যাচ্ছেঃ

You've got to get yourself together
You've got stuck in a moment
And now you can't get out of it
Don't say that later will be better
Now you're stuck in a moment
And you can't get out of it)

রহমান সাহেব এর মনে পড়ে গেল সব। উনার নিথর দেহ নিয়ে মর্গের ডাক্তার দের টানাটানি, নির্মম ছুরি প্রয়োগ, কবরে নামিয়ে দেয়ার সময়ের দুঃসহ স্মৃতি, লাশের চা এর কটু গন্ধ। মোনাজাত এর সময় বস এর মেকি কান্না, কয়েকজন কলিগের সত্যিকারের অশ্রু, আর তেমন কিছু না।
সারা জীবন কাজের পেছনে ছুটে গেলেন, কি পেলেন জীবনে? একটি মুহুর্তের মাঝেই আটকে রইলো জীবন টা।

#ishtiaq_radical

ছবিঃ গুগল।

No comments: