Friday, August 07, 2020

Excerpt from Sapiens

"তারা কাপড়ের মাকেই জড়িয়ে ধরে রাখতো; এমনকি মুখ বাড়িয়ে ধাতব মায়ের থেকে দুধ পান করার সময়েও তারা কাপড়ের মাকে ছাড়তো না"



[ইউভাল নোয়াহ হারারির বিখ্যাত গ্রন্থ “স্যাপিয়েন্সঃ আ ব্রিফ হিস্টোরি অব হিউম্যানকাইন্ড” এর একটি অনুচ্ছেদ অবলম্বনে। সবাইকে একটু “ফুড ফর থট” প্রদান করার উদ্দেশ্যে অনূদিত ও পরিমার্জিত; কারণ আমিও এটি পড়ে চিন্তার খোরাক পেয়েছি]

গত ২০০ বছরে কৃষিকাজের খুটিনাটিগুলো বাণিজ্যিক উৎপাদন পদ্ধতির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ট্রাক্টরের মত বড় বড় যন্ত্রগুলো এমন সব কাজ করা শুরু করেছে যা আগে মানব পেশীশক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল, কিংবা অকল্পনীয় ছিল। কৃত্তিম সার, বাণিজ্যিক কীটনাশক, হরমোন ও বিবিধ উপকারী ঔষধের সমন্বিত প্রয়োগের কারণে জমি এবং প্রাণীসমূহ আরো অনেক বেশি উৎপাদনশীল হয়ে গিয়েছে । রেফ্রিজারেটর, জাহাজ এবং উড়োজাহাজের কল্যাণে উৎপাদিত খাদ্যশস্যকে মাসের পর মাস ধরে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে, এবং চাইলেই তা খুব দ্রুত এবং কম খরচে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাঠানো যাচ্ছে। ইউরোপীয়রা এখন আর্জেন্টিনার গরুর মাংস এবং জাপানী সুশী সহযোগে রাতের খাবার খেতে পারছে অনায়াসে।


এই বাণিজ্যিক উৎপাদন পদ্ধতির শিকার হয়ে গাছপালা এবং প্রাণীরাও যান্ত্রিক আচরণের শিকার হচ্ছে। যেদিন থেকে মানব জাতি নিজেদেরকে পূজনীয় ভাবা শুরু করেছে, সেদিন থেকে খামারের পশুরা জীবিত এবং সংবেদনশীল প্রাণী হিসেবে তাদের অবস্থান হারিয়েছে; তাদেরকে এখন যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আজকের দিনে এসব প্রাণীদেরকে কারখানায় উৎপাদনের মত করে গণহারে প্রজনন ঘটিয়ে বংশবিস্তার করানো হয়, আর বাণিজ্যিক প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের শারীরিক আকৃতি নির্ধারণ করা হয়।


তাদের সমগ্র জীবন কেটে যায় জন ফোর্ডের এসেম্বলি লাইনের ঘুর্ণায়মান খাঁজকাটা চাকার মত, এবং তাদের জীবনকাল এবং অস্তিত্বের গুণগত মান ওঠা নামা করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লাভ লোকসানের সাথে তাল মিলিয়ে। এমনকি যখন সেই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদেররকে জীবিত রাখায় সচেষ্ট থাকে, তখনও তারা সেই প্রাণীগুলোর সামাজিক এবং মানসিক প্রয়োজনগুলো নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করে না (যদি না এসকল বিষয়গুলো উৎপাদনের উপর কোন সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে)।


উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় যে, ডিম-পাড়া মুরগীদের জীবনে খুব জটিল ধরণের আচরণগত চাহিদা এবং অণুপ্রেরণাদায়ী শক্তির উপস্থিতি রয়েছে। তারা তীব্র ভাবে কামনা করে এমন একটি পরিবেশ, যেখানে তারা ভাল করে ঘুরে দেখতে, খাবারের খোজ করতে, মাটি ঠুকরে বেড়াতে, সামাজিক শ্রেণীবিভাজনের রুপরেখা অনুধাবন করতে, বাসা বানাতে এবং নিজেদের যত্ন নিতে পারবে।


কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ডিমের ফার্মের মালিকরা মুরগীদেরকে ছোট ছোট খুপড়ির ভেতর আটকে রাখে। অনেক সময় একই খাচায় উর্ধ্বে চারটি মুরগীকেও রাখা হয়, যার ফলে প্রতিটি মুরগী ২৫ বাই ২২ সেন্টিমিটারের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জায়গা বরাদ্দ পায়। মুরগীদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য দেয়া হয়, কিন্ত তারা নিজস্ব জায়গা দখল করতে পারে না, এবং বাসা বানানো কিংবা অন্য কোন ধরণের স্বভাবগত আচরণ প্রদর্শন করার সুযোগ পায় না। খাঁচাগুলো এতই ছোট থাকে যে অনেক সময় তারা ঠিকমত ডানা ঝাঁপটাতে কিংবা মাথা উঁচু করেও দাঁড়াতে পারে না।


আটলান্টিক অঞ্চলের দাস ব্যবসা যেমন আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা থেকে তৈরি হয়নি, সেরকম আধুনিক পোল্ট্রি কিংবা ডেয়ারী শিল্পও প্রাণীদের প্রতি সহিংসতা থেকে জন্ম নেয়নি। এটি মূলত উদাসিনতা প্রসূত। বেশিরভাগ মানুষ যারা ডিম, দুধ এবং মাংস উৎপাদনের সাথে জড়িত, তারা প্রায় কখনোই মুরগী, গরু কিংবা ছাগলের মন্দভাগ্য নিয়ে ভাবে না, যাদের দেহাবশেষ তারা বিক্রী ও ভক্ষন করছে। যারা চিন্তা করে, তারাও যুক্তি দেয় যে এসকল প্রাণী যন্ত্র থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়; তাদের নেই কোন ইন্দ্রিয়শক্তি কিংবা আবেগ, এবং তাদের দুঃখবোধ করার সক্ষমতাও নেই। মজার ব্যাপার হলো, যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব থেকে আমরা দুগ্ধ ও ডিম উৎপাদনের কার্যকর যন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি, সেই একই ধারার বিজ্ঞান থেকেই আমরা জানতে পেরেছি যে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের রয়েছে জটিল সংবেদনশীলতা এবং আবেগ। তারা শুধু শারীরিক ব্যথা বেদনাই অনুভব করে না, বড়ং তাদেরও রয়েছে সংবেদনশীল অনুভূতি।


বিবর্তণমূলক মনোবিজ্ঞান বলছে যে খামারের পশুদের আবেগমূলক এবং সামাজিক চাহিদাগুলো বিকশিত হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশে; বন জঙ্গলে, যখন সেগুলো তাদের বেঁচে থাকা এবং বংশবিস্তারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল। উদাহরণস্বরুপ, একটি বন্য বাছুরকে অন্যান্য গরু ও গাভীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে হোত, তার বেঁচে থাকার তাগিদে, এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভেবে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের জন্য বাছুরদের মাঝে কিছু সহজাত প্রবৃত্তি চলে এসেছে বিবর্তনের হাত ধরে--খেলাধুলার মাধ্যমে সামাজিক ব্যবহার শিখে নেয়ার সুতীব্র তাড়না, এবং তারচেয়ে বড় তাড়না তার মায়ের সাথে বন্ধন তৈরি করার, কেননা মায়ের দুগ্ধ এবং যত্ন তার বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যক উপাদান।


এই প্রসঙ্গে ধরে নেই একজন চাষী একটি শিশু বাছুরকে তার মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে খাচায় বন্দী করে রাখলো। কৃষক তাকে যথেষ্ঠ পরিমাণে খাদ্য ও পানীয় প্রদান করলো, সকল রোগশোকের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যথোপযুক্ত টিকা এবং ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করলো, এবং যখন সে উপযুক্তে বয়সে পৌছালো, তখন তাকে ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে (একটি গরুর শুক্রাণূ ব্যবহার করে) অন্তঃস্বত্তা করে তুললো। সাদা চোখে দেখলে মনে হবে যে এই বাছুরটির ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য মায়ের ভালবাসা ও খেলার সাথীদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ভাল করে পর্যবেক্ষন করলে দেখা যাবে যে বাছুরটির মাঝে তার মায়ের সাথে সময় কাটানোর এবং অন্যান্য বাছুরদের সাথে খেলাধুলা করার সুতীব্র বাসনা সুপ্তাবস্থায় রয়েছে। এসকল চাহিদা পূরণ না হলে সে বড় ধরণের দূর্ভোগের শিকার হয়। এটাই বিবর্তনীয় মনস্তত্ত্বের প্রাথমিক শিক্ষা; জঙ্গলে থাকা অবস্থায় শেখা চাহিদাগুলো প্রাণীদের মাঝে থেকেই যায়, বেঁচে থাকা কিংবা বংশবিস্তারের জন্য সেগুলো অত্যাবশ্যকীয় না হলেও। বাণিজ্যিক কৃষিকাজের বড় সমস্যা হল যে এর ফলাফল হিসেবে প্রাণীদের বাহ্যিক চাহিদাগুলো পূরণ করা হয় সুচারূভাবে, কিন্তু তাদের ভেতরে থাকা মনস্তাত্ত্বিক চাহিদাগুলোকে একেবারেই উপেক্ষা করা হয় বেশি উৎপাদনের খাতিরে।


উপরোল্লিখিত রুঢ় সত্যগুলোর ব্যাপারে ১৯৫০ সাল থেকেই আমরা জ্ঞাত আছি। সেসময় মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ হ্যারি হারলো বানরদের ক্রমবিকাশ নিয়ে কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করেন। হারলো কিছু শিশু বানরকে ঐ বাছুরটির মত আলাদা করে ফেলেন, এবং খাচায় আটকে রাখেন। তিনি তাদেরকে “পুতুল মা” এর সাহায্যে বড় করেন। প্রতিটি খাচায়, হারলো দু’টি করে পুতুল-মা সাজিয়ে রাখেন। একটি পুতুল বানানো হয়েছিল ধাতব তার দিয়ে, যেটির মাঝে সংযুক্ত করা ছিল দুধের বোতল, যার থেকে শিশু বানর চুষে চুষে পান করতে পারতো।


আরেকটি কাঠের তৈরি পুতুল রাখা থাকতো খাচায়, যেটি কাপড় দিয়ে আবৃত থাকতো। বেষভুষা এবং আদলের কারণে এটীকে আসল বানর-মা হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু এই পুতুল মা শিশু বানরদের জন্য কোন খাদ্য উপাদান প্রদান করতো না। ধারণা করা হয়েছিল যে বানর-শিশুগুলো তাদেরকে পুষ্টি প্রদান করা ধাতব মায়ের সাথেই বেশি সময় কাটাবে; কাপড়ের তৈরি অকর্মণ্য মায়ের থেকে দূরে থেকে।


কিন্তু হারলোকে অবাক করে দিয়ে শিশু বানরগুলো পরিষ্কারভাবে কাপড়ের তৈরি মা-বানরের প্রতি তাদের অনুরক্ততা প্রকাশ করতে লাগলো; তার সাথেই বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে। যখন দু’টি নকল মা কে কাছাকাছি রাখা হোত খাচার ভেতর, তখন তারা কাপড়ের মাকেই জড়িয়ে ধরে রাখতো; এমনকি মুখ বাড়িয়ে ধাতব মায়ের থেকে দুধ পান করার সময়েও তারা কাপড়ের মাকে ছাড়তো না। হারলো প্রথমে মনে করলেন যে শিশু বানরগুলো ঠান্ডা অনুভব করার জন্য কাপড়ের মায়ের কাছে যাচ্ছে বারবার। তাই তিনি ধাতব তারের তৈরি মা বানরের ভেতর একটি ইলেক্ট্রিক বাল্ব জুড়ে দিলেন, যার থেকে তাপ উদগীরণ হতে থাকলো। একেবারে সদ্যজাত কিছু শিশু ছাড়া বেশিরভাগ বানর তবুও কাপড়ের বানর-মায়ের সাথেই বেশি সময় কাটাতে লাগলো।


পরবর্তী গবেষণায় দেখা যায় যে হারলোর অনাথ শিশু বানরগুলো বড় হয়ে মানসিক বৈকল্যের শিকার হয়; বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরণের পুষ্টি পাওয়া স্বত্ত্বেও। তারা কখনো বানর সমাজে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারেনি, এবং তারা অন্যান্য বানরদের সাথে যোগাযোগস্থাপন করতে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়।

এছাড়াও তারা উচ্চ পর্যায়ের দুঃচিন্তায় আক্রান্ত হয় এবং অতিরিক্ত আক্রমণাত্নক স্বভাবের হয়ে যায়। এসব তথ্য থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে বানরদেরও মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা রয়েছে, যা তাদের শারীরিক ও বাহ্যিক চাহিদা থেকে বেশ ভিন্ন। এই চাহিদাগুলো পূরণ না হলে তাদের বেড়ে ওঠা ঠিকমত হয় না, এবং তারা চরম দুর্দশায় পর্যবসিত হয়। হারলোর অনাথ শিশু বানর কাপড়ের মাকে আকড়ে ধরে বেশি সময় বেশি কাটিয়েছে কারণ সে শুধু দুধ নয়, বড়ং একটি আবেগনির্ভর বন্ধন খুজছিল তার সেই নকল মায়ের কাছে। পরবর্তী দশকগুলোতে অসংখ্য গবেষণা থেকে একই সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া যায় যে এই ব্যাপারটা শুধু বানরদের ক্ষেত্রেই নয়, বড়ং সব ধরণের স্তন্যপায়ী প্রাণী, এবং পাখিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।


এই মুহুর্তে, লাখ লাখ গবাদী পশু হারলোর শিশু বানরের মত অমানবিক পরিবেশে বেঁচে আছে; কারণ তাদের মালিকরা নিয়মিত শিশুদেরকে তাদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে “নিয়ন্ত্রিত” পরিবেশে বড় করছেন।

No comments: