Sunday, August 02, 2020

সৌদি আরবে ভাইরাস মহামারীর মাঝে একটি খুবই ব্যতিক্রমধর্মী হাজ্জ্ব

সৌদি আরবে ভাইরাস মহামারীর মাঝে একটি খুবই ব্যতিক্রমধর্মী হাজ্জ্ব


মুজদালিফা থেকে আরাফাতের ময়দানের দিকে যাচ্ছেন হাজীরা 


মুসলমান হজ্জ্বযাত্রীরা দীর্ঘদিন আইসোলেশানে থেকে, মুখে মাস্ক পরে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাদের জন্য পবিত্রতম স্থান মক্কায় এসে পৌছান গত বুধবারে এক ঐতিহাসিক, সীমিত আকারের হাজ্জ্বে অংশ নেয়ার জন্য, যা করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ভিন্ন আকার ধারণ করেছে।


হাজ্জ্ব হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মূল ভিত্তির মাঝে অন্যতম, যা সামর্থ্যবান সবাইকে জীবনে অন্তত একবার পালন করতে হয়। হাজ্জ্বযাত্রীরা এমন একটি পথ অনুসরণ করেন, যে পথটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রায় ১,৪০০ বছর আগে হেঁটে পার হয়েছেন, এবং যা একইসাথে নবী হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এবং হজরত ঈসমাইল (আঃ) এর পদক্ষেপকেও অনুসরণ করে।


হাজ্জ্ব মানুষের শারীরিক ও আত্মিক সক্ষমতার পরীক্ষা নেয়। হাজ্জ্বের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদেরকে বিনয়ী ও নিরহংকার করে তোলা, এবং সাথে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধকে আরও সুসংহত করা।


অন্যান্য বছরের মত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষের জনসমুদ্রে, কাধে কাধ মিলিয়ে নামাজ না পড়ে হাজ্জ্বে অংশগ্রহণকারীরা এবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হাজ্জ্ব পালন করেছে—তারা দূরে দূরে দাড়িয়েছে, আর বিশ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চলাফেরা করেছে যাতে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়।


হাজ্জ্ব এমন একটি যাত্রা যা মুসলমানরা সাধারণত তাদের আত্মীয়দের সাথে মিলে সম্পন্ন করে। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে খুবই সাধারণ একটি চিত্র ছিল এটি যে লোকজন তাদের বয়স্ক পিতা-মাতার হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে তাদেরকে হজ্জ সম্পন্ন করায় সহায়তা করছে, অথবা পিতা মাতা তাদের বাচ্চাদের পিঠে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ যেন আড়াই মিলিয়ন শিয়া, সুন্নী এবং অন্যান্য ছোট বড় মুসলিম গোষ্ঠীদের এক অনন্য সংহতি। এক সাথে নামাজ পড়া, খাওয়া এবং সৃষ্টিকর্তার দরবারে দুই হাত তুলে পূর্বে করা সকল পাপ কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা—এসব কিছুই দীর্ঘদিন ধরে হাজ্জ্বের অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবেই বিবেচিত, যার কারণে হাজ্বকে প্রায় সবাই অনবদ্য এবং জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনমূলক একটি অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন।


কিন্তু এ বছর হাজীদেরকে তাদের হোটেলরুমে বসে আগে থেকে প্যাকেট করা খাবার খেতে হচ্ছে, আর একজন আরেকজনের থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় নামাজ পড়ছে। সৌদি সরকার এ বছর সকল হাজীদের খাওয়াদাওয়া, যাতায়াত, বাসস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত খরচ বহন করছে।


যদিও এবারের অভিজ্ঞতাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, তবুও এটি হাজীদের জন্য আগের সকল পাপকে ধুয়ে মুছে ফেলার এবং নিজেদের বিশ্বাসকে আরো শক্ত করে তোলার একটি বড় সুযোগ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।


আম্মার খালেদ, একজন ২৯ বছর বয়সী ভারতীয় হাজী, যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে, বলেছেন যে “যদিও আমি একাই এসেছি হাজ্ব্ব করতে, তাও আমি আমার নিকটজনদের জন্য দোয়া করছি”। তিনি আরও বলেন “আমি নিজেকে অশেষ সৌভাগ্যবান মনে করছি। তারা সকল ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে, এবং আমরা খুবই সুসংহতভাবে হাজ্জ্ব পালন করতে পারছি”।


ইতিহাসে প্রথমবারের মত, সৌদি সরকার এবার বিদেশ থেকে কাউকে হাজ্জ্ব করার জন্য তাদের দেশের আসার অনুমতি দেয়নি করোনা ভাইরাস এর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশংকায়।

তার পরিবর্তে, শুধুমাত্র সৌদি আরবে বসবাসরত ১,০০০ মানুষ কে নির্বাচণ করা হয়েছে হাজ্জ্বে অংশ নেয়ার জন্য, যাদের দুই তৃতীয়াংশ বিদেশী, এবং তারাই প্রতি বছর ১৬০টি ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজ্জ্ব প্রত্যাশিদের প্রতিনিধি হিসেবে এবার হাজ্জ্ব করার সুযোগ পাচ্ছেন । বাকি এক তৃতীয়াংশ মানুষ সৌদী নিরাপত্তা কর্মী এবং মেডিক্যাল স্টাফ। এই এক হাজার মানুষের প্রত্যেকেই সৌদি আরবে থাকছেন দীর্ঘদিন ধরে।


হজ্জ প্রত্যাশীদের বলা হয়েছিল একটি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করার জন্য। পুর্বশর্ত ছিল যে তাদের বয়স হতে হবে বিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝে, তাদের কোন দূরারোগ্য ব্যাধি থাকতে পারবে না কিংবা তাদের মাঝে করোনা ভাইরাসের কোন লক্ষণও থাকতে পারবে না। যারা পুর্বে হজ্জ করেনি, তাদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে নির্বাচণের সময়।


হাজীদের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করা হয়, এবং তাদেরকে একটি করে রিস্টব্যান্ড দেয়া হয়েছিল, যা তাদের ফোনের সাথে সংযুক্ত থেকে তাদের চলাফেরার উপর নজর রেখেছে। তাদেরকে বাসায় এবং মক্কার হোটেল রুমগুলোতে কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় থাকতে হয়েছে বুধবারে হজ্জ শুরু হবার আগ পর্যন্ত। রবিবারে হজ্জ সমাপ্ত হবার পরেও তাদেরকে এক সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।

মক্কা কে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল হজ্জের আগে দিয়ে, এবং বছরজুড়ে সম্পাদিত ছোট ছোট উমরা-যাত্রা গুলো এই বছরের শুরুতেই বন্ধ করে করে দেয়া হয়েছিল। যারা তখন উমরা করার উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছিলেন, তাদেরকে দ্রুত তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিমানযোগে।


২০২০ সালের আগ পর্যন্ত হাজ্জ্ব বলতে এই ধাপগুলো সম্পন্ন করাকেই বোঝানো হোত 


মক্কা থেকে এ বছরের হজ্জকে কভার করার জন্য কোন আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে অনুমতি দেয়া হয়নি। তার পরিবর্তে, সৌদি সরকার মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে বুধবারে লাইভ কভারেজ প্রদান করেছে, যেখানে স্বল্প পরিমাণ হাজীদের দেখা যায় বেশ কয়েক ফুট দূরে দূরে থেকে কাবা শরীফ কে প্রদক্ষিণ করতে।

কাবা শরীফ আল্লাহর ঘর হিসেবে উল্লিখিত, এবং এটি ইসলামের একেশ্বরবাদের প্রমাণস্বরূপ। সারা বিশ্বের মানুষ কাবা শরীফের দিকে মুখ করে তাদের দৈনিক নামাজ আদায় করে থাকেন।

হাজ্জ্বের সময় মহিলারা সকল ধরণের প্রসাধনী ও সুগন্ধী পরিহার করে, মাথায় কাপড় দেয় এবং ঢিলেঢালা পোষাক পরিধান করে, আত্ম-অন্বেষনের উদ্দেশ্যে। সকল পুরুষগণ সেলাইবিহীন সাদা পোষাক পরিধান করে, যা ধনী গরীবের মাঝে পার্থক্য ঘুচিয়ে দেয় এবং “সকল মুসলমান এক”—ইসলামের এই মূলনীতিকে সুন্দর করে প্রকাশ করে।


হাজ্জ্বের প্রথম রীতি হিসেবে মুসলমানগণ কাবা শরীফকে ঘড়ির কাটার উল্টোদিকে হেঁটে সাতবার প্রদক্ষিণ করেন দোয়া পড়তে পড়তে, আর তারপর দু’টি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যান, যেখানে হজরত ইবরাহিম (আঃ) এর স্ত্রী হাজেরা তার মৃত্যুপথযাত্রী পুত্রের জন্য পানির খোঁজে দৌড়েছিলেন। আল্লাহ তখন শিশুটির জীবন বাঁচানোর জন্য জমজম কূপ বানিয়ে দেন সেখানে, যেটি এখনো রয়েছে।

এ বছর, হাজীগণ শুধু প্লাস্টিকের বোতলে সংরক্ষণ করা জমজম কূপের পানি খাওয়ার সুযোগ পাবেন। শয়তানের গায়ে নিক্ষেপ করার জন্য হাজীদেরকের পাথরের টুকরো কুড়াতে হয়, কিন্তু এবার তার পরিবর্তে হাজীদেরকে ব্যাগভর্তি “জীবাণুমুক্ত” পাথর দেয়া হয়েছে আগেভাগে।


হাজীদেরকে তাদের নিজ নিজ জায়নামাজ দেয়া হয়েছে, এবং পরিধানের জন্য বিশেষ সিলভার ন্যানো প্রযুক্তি সমৃদ্ধ পোষাক দেয়া হয়েছে, যা সৌদী কতৃপক্ষের ভাষ্যমতে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সক্ষম, এবং তা একই সাথে পানি নিরোধী। তাদেরকে আরো দেয়া হয়েছে প্রখর রোদের হাত থেকে বাচার জন্য ছাতা, গামছা, সাবান, স্যানিটাইজার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এছাড়াও, বিভিন্ন ভাষায় অনলাইন সেশানের আয়োজন করা হয়েছে তাদের জন্য, যেখানে হাজ্জ্বের বিভিন্ন খুটিনাটি ব্যাপারগুলো সহজ ভাবে ব্যাখা করা হয়েছে।


প্রতি বছর কাবা শরীফে পচিশ লাখ মুসলমানের সমাগম ঘটতো হাজ্জ্বের উদ্দেশ্যে


“সৌদি আরবের উচিত হবে এসকল প্রতিরোধক ব্যবস্থার সুচারূভাবে প্রচলন করা যাতে আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারি”, বলেছেন সৌদি সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা ডাঃ হানান বালখি ।


হানান আরো বলেন যে “সৌদি রাজতন্ত্র এবং পুরো বিশ্ব একত্রে শিখতে পারবে কিভাবে করোনার মত ছোয়াচে রোগের সংক্রমণকে হাজ্জ্বের মত বড় আকারের মানবসমাবেশের সময় নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখা যায়”। হানান WHO এর জেনেভায় অবস্থিত প্রধাণ শাখায় এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিস্টেন্স ডিভিশানের এসিসটেন্ট ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে হাজ্জ্ব মিশনের সাথে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে।


(ইন্টার্নেটে প্রাপ্ত তথ্য অবলম্বনে)

No comments: