Tuesday, May 22, 2018

Beirut Diary 7

বৈরুতে বনবাস - পর্ব ৭

বৈরুতে, তথা লেবাননে আমি সাকুল্যে ছিলাম ৬০ দিনের মত। এর মধ্যে ১৬টি উইকেন্ড এর পাশাপাশি আরও ৪ দিনের ঈদের ছুটি কাটিয়েছি। ২০ দিনের মধ্যে ভেবেছিলাম অন্তত ১০ দিন তো ভূমধ্যসাগর দেখতে যাওয়া হবেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমি যেখানে থাকতাম, সেখান থেকে সাগর পাড় বেশ খানিকটা দূরে ছিল, এবং আমি মাত্র দুই বার যেতে পেরেছিলাম।আজকে অবশ্য সে স্মৃতিচারণ করবো না।

বৈরুতে সপ্তাহ খানিক থাকার পর শিফট হলাম হোটেল থেকে একটি এপার্টমেন্টে। এই স্টুডিও এপার্টমেন্টটির সাথে হোটেল এর মূল পার্থক্য হচ্ছে সার্ভিস। হোটেল এর মত প্রতিদিনের রুম সার্ভিস নেই। অর্থাৎ, রুম ময়লা হলে সেটা দৈনিক ভিত্তিতে নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে।লজ্জাজনক হলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি এধরণের কাজের ক্ষেত্রে পুরোপুরি অরকর্মণ্য ছিলাম সেসময়। সুতরাং ঘর কিভাবে পরিষ্কার করবো সে চিন্তার থেকে কিভাবে ময়লা না করে থাকবো সে ব্যাপারে বেশি মনযোগ দিতাম।

এছাড়াও ছিল কমন কাপড় ধোয়ার জায়গা, যেখানে অনেকগুলো ওয়াশিং মেশিন রাখা থাকতো। কাপড় আর ডিটারজেন্ট নিয়ে এসে ধোয়া যেত কাপড় চোপড়।

প্রথমে বেশ দমে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম বারের মত একা থাকার ব্যাপারটা আরো আতংকজনক হয়ে গিয়েছিল। তবে খুব শীঘ্রই নিজেকে মানিয়ে নিলাম।

দুইদিনেই এই এপার্টমেন্টটি হয়ে গেল আমার দ্বিতীয় গৃহ। অফিস থেকে বের হয়েই মনে হত কতক্ষণে পৌছুব ঘরে। হোটেল রুম এর মত বদ্ধ পরিবেশ ছিল না এখানে। রুমের সাথে একটা ছোট বারান্দা আর কিচেনেট ছিল। অর্থাৎ, প্রকৃত রান্নাঘর না থাকলেও সেখানে বেসিন, একটি ওভেন এবং ফ্রিজ ছিল। সুতরাং চাইলে আমি নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে খেতে পারার ব্যবস্থা ছিল। তবে ঐ যে বললাম, আমার মত অকর্মার ঢেকীর জন্য সেটাও অনেক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাড়ালো। রান্না প্রসংগে আরেকদিন লিখবো।

এপার্টমেন্টটি ছিল Dekouna এবং Saloume নামক দুই জায়গার ইন্টারসেকশানে। এপার্টমেন্ট থেকে আমাকে একটা কার্ড দেয়া হয়েছিল, যেখানে ইংরেজী, আরবী ও ফরাসী ভাষায় ঠিকানা লেখা ছিল। সেখানে পরিষ্কার ভাবে বলা ছিল "Dekouna (ডেকোয়ানে)", কিন্তু ট্যাক্সি চালকদের সেই ঠিকানা বললে তারা অন্য জায়গায় নিয়ে যেত! দুইদিন ধরা খাওয়ার পর এক ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে শেখালো তুমি "saloume (সালুমে)" বলবে, তাহলে আমরা বুঝবো।



বৈরুতে শত শত ট্যাক্সি। হাজারের ঘরেও হতে পারে। জনসংখ্যা সে সময় ছিল ১৯ লাখ এর মত। এরকম অবস্থায় একই ট্যাক্সি চালকের সাথে দুইবার দেখা হবার সম্ভাবনা কতটুকু? সম্ভাব্যতা যাচাই করলে তা খুব কম পারসেন্টেজ দেখাবে, কিন্তু তারপরেও সেই উপকারী ট্যাক্সি চালকের সাথে দেখা হয়ে গেল আরেকদিন।

সেদিনও অফিসের সামনে থেকে উঠলাম ট্যাক্সি তে। সবাই তাদের নিজ নিজ গন্তব্য বলার পর আমি বললাম "ডেকোয়ানে", আর বলার সাথে সাথে সে পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখে এক গাল হেসে বল্ল "নো নো দোন্ত সে ডেকোয়ানে, ইউ লিভ ইন সালুমে"। আমার আসলে তার চেহারা মনে ছিল না, কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে সব মনে পড়ে গেল।

এরপর থেকে যতবার ট্যাক্সি তে উঠেছি, সালুমে বললেই সবাই খুশি মনে জায়গা মত নিয়ে যেত।

ট্যাক্সি নিয়ে আরেকদিনের অভিজ্ঞতা বলি। সন্ধ্যার পরে রাস্তায় বেশ ভাল জ্যাম ছিল। সেদিন ছিল শুক্রবার, উইকেন্ড নাইট। আমার ইচ্ছা ছিল তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে আবার বের হব। রাত ১০টার শো তে নতুন একটা মুভি দেখবো, আর ডিনার করে বাসায় ফিরবো।

তখনো আমি হোটেলে থাকি, আর সেখানে পৌছুনোর রাস্তাটি বেশ আঁকা বাঁকা; পাহাড়ী রাস্তার মত। আমি সেদিন ট্যাক্সি ড্রাইভার এর পাশের আসনে বসেছি, আর যথারীতি, আমিই ছিলাম শেষ যাত্রী। ড্রাইভারটিকে বেশ ফূর্তিবাজ মনে হল, ক্ষণে ক্ষণে শিস বাজাতে বাজাতে গাড়ী চালাচ্ছিল।

সে আমাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলো "where you from?". উত্তর দিলাম "বাংলাদেশ"। সাথে সাথে সে খুব খুশী হয়ে গেল। বলতে লাগলো "বাংলাদেশ পিপল ভেরি নাইস। ভেরি অনেস্ট। নেভার ডু ব্যাড থিং। পাকিস্তানি ব্যাড। দে আর থিফ এন্ড লায়ারস।"

দেশের প্রশংসা শুনে যত টা খুশী হলাম, তার চেয়ে ঢের বেশী খুশি লাগলো প্রতিবেশীদের বদনাম শুনে। আমিও বললাম "Yeah, Lebanon people also really nice". এবার উত্তর আসলো "No No, they bad. Women good, men bad. They tell lies and don't pay much".

একথা বলে সে একটা চোখ টিপি দিল। আমি বেশ মজা পেলাম। আরো অনেক গল্প হল। এক পর্যায়ে সামনের গাড়ী হঠাত স্টার্ট বন্ধ করে দিল। বহুদিনের অভ্যাস অনুযায়ী আমি অপেক্ষা করলাম কখন আমার ড্রাইভার এবং আমার পেছনের অগুনতি ড্রাইভার সমূহ কর্কশ সুরে হর্ণ বাজানো শুরু করবে।

কিন্তু ২/৩ মিনিট পরেও যখন কোন হর্ণ শুনলাম না, আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন সে হর্ণ বাজাচ্ছে না। সে বল্ল "কেন অযথা হর্ণ বাজাবো? নিশ্চয়ই কোন ইমার্জেন্সি হয়েছে, বা বিশেষ কোন কারণে সে গাড়ী থামিয়েছে। আমি বললাম "তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে না?"। সে বল্ল, হয়তো হচ্ছে, কিন্তু তারপরেও কাউকে অযথা বিরক্ত করার কোন অধিকার আমার নেই। এসব কথা বলতে বলতেই সাম্নের গাড়ী পুনরায় স্টার্ট নিল, এবং কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না, আর গালীও দিল না। ব্যস্ত সড়কে হঠাত গাড়ী থামিয়ে ২০-৩০ টা গাড়ী কে দেরী করিয়ে দেয়া যেন কোন ঘটনাই না।

বৈরুতের দুই মাসে আমি এই ব্যাপারটাই উপলব্ধি করি--জীবন মানেই নিরন্তর ছোটাছুটি নয়। সারাক্ষণ সবকিছু তে তাড়াহুড়ার ভাব দেখানো মানেই এই না যে আমি অনেক কিছু করে ফেলছি বা আমি অনেক করিতকর্মা মানুষ। কখনো কখনো ছোট ছোট ব্যাপার গুলোকে পাত্তা দিতে হয় না। কুকুর কামড় দিয়েছে, তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যাও, জলাতংক রোগের টিকা নাও। কিন্তু মশা কামড় দিলেও যদি একই কাজ করা লাগে, তাহলে কিন্তু সমস্যা। আমাদের উচিৎ ঘটনা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখানো, প্রতিক্রিয়া আগে ঠিক করে সেটাকে সকল ঘটনার সাথে ফিট করানোর মাঝে আসলে কোন বাহাদুরী নেই।

এপার্টমেন্ট এ থিতু হবার পর বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া শুরু করি। কলিগ দের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করি পরবর্তী সপ্তাহে জেইতা গ্রটো তে যাব। এটি বৈরুত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ভূগর্ভস্থ্য গুহা। চুনাপাথর ও অনান্য পাথরের সমন্বয়ে তৈরি এই গুহার দুইটি অংশ ।নিচের অংশের ভেতর দিয়ে একটি নদী প্রবাহমান, যা শহরের ১০ লক্ষ বাসিন্দার জন্য সুপেয় পানির একমাত্র উৎস।

উপরের অংশের অল্প কিছু জায়গা টুরিস্ট দের জন্য খোলা। জেইতা গ্রটো লেবানন এর শীর্ষস্থানিয় টুরিস্ট আকর্ষণ, এবং এটি "নিউ ৭ ওয়ান্ডারস" এর চূড়ান্ত তালিকায় মনোনয়ন পেয়েছিল।

এটুকু তথ্য উইকিপিডিয়া থেকেই জানতে পেরেছিলাম। বাকিটা স্বচক্ষে দেখার জন্য পরের শনিবার সকাল সকাল রউনা দিলাম। সেদিন সত্যি সত্যি ট্যাক্সি "রিজার্ভ" করেই যেতে হয়েছিল।
(চলবে)

No comments: