Thursday, March 11, 2021

দাদুর জন্য

 

আজকে আমার দাদু সুরাইয়া খানম এর ২১তম মৃত্যু বার্ষিকী।

দাদা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাকে নিজ বাসা থেকে চোখ বেধে নিয়ে যায় রাজাকার আল বদর বাহিনীর দোসররা। সেদিন দাদু, দাদার জন্য ওষুধ বানিয়ে রেখেছিলেন নিজের হাতে। দাদা বলেছিলেন ফিরে এসে খাবেন। সেই ফেরা আর হয়নি।

এরপর, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দাদু তার ছেলেমেয়ে, এবং নাতী নাত্নীদেরকেও বড় করেছেন, মানুষ করেছেন। দাদার অবর্তমানে তিনি ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ের বড় সংসার কে টেনে নিয়েছেন শক্ত হাতে।

দাদা যখন মারা যান, তখন আমার আব্বা (মেঝ ছেলে) ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র এবং বড় চাচা সদ্য বিবাহিত এবং মাত্র চাকরী শুরু করেছেন। বাকি চাচা ফুফুরা অনেক ছোট ছিলেন। পরবর্তীকালে ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে দাদুকে সহায়তা করলেও উনিই ছিলেন নেপথ্যের চালিকাশক্তি। ছোট বড় সংকটে দাদুর কথাই ছিল শেষ কথা।

আমাদের অনেক সৌভাগ্য যে দাদুর আদর পেয়ে বড় হতে পেরেছি। উনি মারা যাওয়ার পরেই কেবল বুঝতে পেরেছি পরিবারে মুরুব্বির ভূমিকা কত বড়। ২১ বছর চলে গিয়েছে, কিন্তু এখনো মনে পড়ে উনার সাথে প্রতিটি কথোপকথন।

দাদুর গল্প লিখে শেষ করতে পারবো না। যেই উনাকে দেখেছেন, চিনেছেন, তিনিই উনাকে মনে রেখেছেন আজ অবধি। দাদুর দু'টি গল্প শুনাই আজকে। আগেও লিখেছি, আবারও লিখছি আজ।

আমাদের বাসায় অনেক ফেরিওয়ালার আনাগোনা ছিল। সব সময় দারোয়ান থাকতো না বাসায়, কারণ নব্বুই এর দশকে ঘরের নিরাপত্তা নিয়ে টেনশান অনেক কম ছিল সবার। দারোয়ান কখনো থাকলেও দেখা যেত তাকে পটিয়ে ফেরিওয়ালারা ঠিকই উপরে চলে এসেছে।

সে যাই হোক, ফেরিওয়ালাদের কাছে দাদু ছিলে প্রিয় মানুষ। কিছু কিনুক বা না কিনুক, উনার সাথে কথা বলে সবাই মজা পেত। দাদুও দিনের একটা সময় বরাদ্দ রাখতেন তাদের সাথে দরদাম করার জন্য।

কেউ হয়তো নিয়ে আসতো ইলিশ, কেউ সব্জী, আবার কেউ আনতো মুরগী--সবার সাথেই দাদু দরদাম করতেন। এমন সব দাম বলতেন যা শুনে ওদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত।

এক মাছওয়ালা একদিন দাদুর বলা দাম শুনে কানে হাত দিয়ে পাতিল মাথায় নিয়ে দৌড় দেয়। আমার নিজের চোখে দেখা সে ঘটনা। সম্ভবত ২০০ টাকা দাম চাওয়া মাছের দাম ২০ টাকার বেশি হবে না ধরণের কিছু একটা বলেছিলেন দাদু।

যাওয়ার সময় সে মাছওয়ালা বলেছিল খেদযুক্ত কন্ঠে " কানে ধরেছি, এই বাসায় মাছ নিয়ে আর আসবো না"। কিন্তু ঠিকই তারা ফিরে আসতো আবার।

কারো দাদী, কারো নানী হয়ে উনি কখনো বেশি দাম দিয়ে আবার কখনো ন্যায্য দামেই কিনতেন নানা পণ্য। বেশিরভাগ সময় জিতে যেত ফেরিওয়ালারাই, সবাই ফিরে যেত হাসি মুখে।

বাসায় বাজার থাকলেও কিনতেন; উনার জন্য এই কাজটি কিছুটা শখ এর মত ছিল, এবং আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতাম যে এটা ছিল উনার এক ধরণের বদান্যতা।

আমাদের তিন তলায় তিনটি ফ্ল্যাটে আমরাই থাকতাম, তাই কমন একটা গেট ছিল। মাঝখানের করিডোরে একটা বড় চেয়ার রাখা থাকতো দাদুর জন্য। সেই চেয়ারের সামনের মেঝেতে ফেরিওয়ালারা বসতো তাদের বেসাতি নিয়ে।

দাদু মারা যাবার পরেও অনেকদিন ধরে ফেরিওয়ালারা আসতো বাসায়; এসেই হাঁকডাক -- "কই দাদী কই? সবচেয়ে ভাল মাছ নিয়ে আসছি আপনার জন্য, একবার খাইলে জীবনে ভুলবেন না"।

তখন আমার আম্মা, কিংবা চাচী খুব কষ্ট নিয়ে দুঃসংবাদ টা দিত। "আম্মা আর নাই"।

একেকজনের প্রতিক্রিয়া হত একেকরকম। কেউ শকড হোত, কেউ বা কান্না শুরু করতো, কেউ অবিশ্বাসে মাথা দুলাতে থাকতো। একজন কোন কথা না বলে দৌড়ে চলে গিয়েছিল নিচে। তার হাউমাউ কান্নার শব্দ এখনো মনে পড়ে; আমার নিজেরও চোখে পানি চলে এসেছিল।

সেই ২০০র জায়গায় ২০টাকা দাম শোনা মাছওয়ালাটি বিশ্বাসই করতে পারেনি দুঃসংবাদটি, হিস্টিরিয়াগ্রস্থ মানুষের মত বারবার বলে যাচ্ছিল "কি কন? কি কন? উনি বাড়ি গেসে? কবে ফিরবেন?"।

দাদু নিজেও জানতেন না কত মানুষ কে উনি প্রভাবিত করেছেন। দাদু মারা যাওয়ার পর প্রায় বছরখানেক একই দৃশ্যের অবতারণা হত। কেউ না কেউ এসে দুঃসংবাদ শুনে দুঃখ করতে করতে চলে যেত।

আরেকদিনের ঘটনা বলি।

আমাদের বাসায় একটি মান্ধাতার আমলের স্টেরিও ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। কোনমতে সেটা দিয়ে ওয়ার্ল্ড মিউজিক (রেডিও) শোনা যেত, আর ক্যাসেট বাজানো যেত।

একদিন আমি জোরালো ভলিউমে "কত কষ্টে আছি" (জেমস এর) গানটি বাজাচ্ছি। গানটা তখন খুব হিট। একবার শুনে আবার বাজালাম। সাইডের প্রথম গান, তাই সহজেই রিওয়াইন্ড করে বারবার বাজানো যাচ্ছিল। তৃতীয় অথবা চতুর্থবার বাজানোর পর দাদু এসে হাজির হলেন।

"তুই ছোড হোলা, তোর এত কষ্ট কিয়ের? আমারে বল"।

নাতীকে নিয়ে দাদুর এই স্নেহমাখা দুঃচিন্তা আর সেটা সমাধান করার তীব্র ইচ্ছা--এরকম করে আর কেউ কি কখনো ভেবেছে?

শ্রদ্ধেয় হামিন আহমেদ আর শাফিন আহমেদ কে দাদু দু'চোখে দেখতে পারতেন না। টিভিতে কখনও উনাদেরকে দেখা গেলেই উনি উষ্মা প্রকাশ করতেন। উনার অভিযোগ ছিল, কেন আমরা "টাইক্কা বুইড়া"দের গান শুনতেসি!

তবে আমার কাছে মনে হয় উনারা চিরতরুণ (কিংবা, চির বুইড়া)। ২০০০ সালে যেরকম ছিলেন, ২১ বছর পরেও সেরকমই আছেন।

মোটামুটি সুস্থ্য অবস্থাতেই দাদু মারা যান। হাসপাতালে গিয়েছিলেন সহজ উপসর্গ নিয়ে। সেখান হঠাত করেই অবস্থার অবনতি এবং মৃত্যু। উনি যে হাসপাতালে, সেই খবরটাই তখনো বৃহত্তর পরিবারে সবাই জানতো না।

আমি তখন আইবিএর ছাত্র। ক্লাস শেষে গিয়েছিলাম দাদুকে দেখতে। আমাকে দেখে বলেছিলেন "তুই কেন আসছিস? তোর না অনেক পড়াশোনা?"। সেটাই দাদুর সাথে আমার শেষ কথা।

দাদা কে কোনদিন দেখি নাই, কিন্তু দাদুর মাঝে দেখেছি একজন বিশুদ্ধ, আত্নত্যাগী ও আদর্শ মানুষ। আল্লাহ উনাকে বেহেস্তবাসী করুন।

সবাই দয়া করে উনার বিদেহী আত্মার জন্য দোয়া করবেন আজকে।

(পুরনো লেখার পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ)।

১১মার্চ, ২০২১।

ছবিটি ১৯৭৪ সালে তোলা। বাগানে, গাছের যত্ন নিচ্ছেন দাদু।

No comments: