Tuesday, May 21, 2019

তোমার বন্ধু রাশেদ পর্ব ২

তোমার বন্ধু রাশেদঃ পর্ব ২

ভাই, আপনি কয়দিন ধরে পাঠাও চালান?
এই তো স্যার, দুই তিন মাস হইলো।
বাইক চালিয়ে মজা পান?

মজার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে একটা হালাল উপার্জনের পথ পাইসি স্যার, এইডাই আসল।
রাস্তা দিয়ে এই যে এত্ত এত্ত মানুষ হেটে যায়, কাউরে দেখলে বাইক দিয়ে চাপা দিতে ইচ্ছা করে না আপনার?

এ পর্যায়ে চমকে উঠে পাঠাও চালক হাসান হার্ড ব্রেক কষলো। রাশেদ প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে শেষ মুহূর্তে সামলে নিলো। আবার ঠিক মত বসে, সে হাসান এর কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বল্লো "আমার তো প্রায়ই রাস্তা ঘাটের বেকুব পথচারী দের চাপা দিতে ইচ্ছা করে। ছাগলের মত দৌড় দেয়, ডান বাম দেখে না। এদের মরাই উচিৎ।"

এ কারণেই আসলে রাশেদ গাড়ী নিয়ে বের হয় না। স্টিয়ারিং হাতে নিলেই মনের পশুটা বন থেকে পালিয়ে শহরে চলে আসে। ইচ্ছে করে গ্র্যান্ড থেফট অটো গেমের মত বেপরোয়া স্টাইলে গাড়ী চালাতে।

হাসান মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়ছে। সে কষ্মিনকালেও ভাবেনি এরকম উদ্ভট এক যাত্রী তার বাইকে চড়বে। আজ প্রায় বছর খানিক হলো সে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে বাইক চালাচ্ছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে কমিয়ে বলে, তাতে অনেকের মায়া হয়, কিছু টাকা বেশি দেয়। তবে আজকে সে শুধু তার প্রাপ্য ন্যুনতম সম্মানী টা পেলেই বর্তে যাবে, আর সাথে পৈত্রিক প্রাণটা অক্ষত থাকলে তো কথাই নেই।

হঠাত রাশেদ তার পিঠ স্পর্শ করলো দুই হাতে। অবশ্যই এটি কোন "অন্যরকম" ছোয়া ছিল না; রাশেদের পক্ষ থেকে এ যেন এক ভ্রাতৃত্ববোধ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান। কিন্তু সেই ছোয়াতেই হাসানের আত্নারাম খাচাছাড়া হয়ে গেলো। ঢোক গিলে সে একবার পেছনে ফিরে তাকালো।

রাশেদের মুখে মিটিমিটি হাসি। যেন বহুদিন ধরে চেনে হাসান কে। মানুষটা কি পাগল? মনে মনে ভাবে হাসান।
"হাসান সাহেব
জ্বী বস! (স্যার কখন বস হয়ে গেলো সেটা হাসান একেবারেই খেয়াল করেনি))
আমার কথা সিরিয়াস্লি নিবা না, বুঝলা? রাস্তাঘাটে সাবধানে চালাবা। পথচারী যত বোকাই হোক না কেন, তাকে সম্মান করবা। মনে রাখবা, একটি পথচারীর গায়ে আঁচড়, পাঠাও ড্রাইভারের সারা জীবনের কান্না। পাব্লিক এমন পিটুনি দেবে যে তুমি তোমার পিতৃদেব এর নাম ভুলে যাবা।
জ্বী জী বস। মনে থাকবে।
কিছুক্ষণ পর ভয়ে ভয়ে সে সুধায়ঃ
বস, একটা কথা জিগাই?
হু, বলো।
আপনি কি কোন পীর ফকির? আমারে একটু দোয়া কইরা দিয়েন। এত পরিশ্রম করি, তাও টাকা পয়সা হয় না।
ধুর পাগলা, আমি পীর হইতে জামু কোন দুঃখে?
না বস, আপনি এক্টূ দোয়া দেন।
আচ্ছা যা, তোর ভালো হবে।

হাসান খুশি মনে বাকি রাস্তা চালিয়ে নিয়ে গেলো। নান্নার বিরানীর পাশে নেমে গেলো রাশেদ। দুইশো টাকার ভাড়া দিতে গিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে দুইটা এক হাজার টাকার নোট দিয়ে চলে যাচ্ছিল ও। হাসান পেছন থেকে জোরে ডাক দিলো "বস, বস। ভাংতি নিয়া যান। আপনি ভুলে ২ হাজার টাকা দিসেন"

রাশেদ শুনেও শুনলো না। দ্রুত পাশের গলিতে ঢুকে গেলো। দূর থেকে তার চলে যাওয়া দেখে হাসান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অন্তত, তার কাছে রাশেদ এর নাম্বারটি রয়েছে। ভাবলো পরে কোন এক সময় টাকাটা তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।

নতুন মডেল এর এলিয়ন গাড়ীটা কিনতে কামাল এর বেশ বড় সড় একটা লোন নিতে হয়েছে। তবে তার মোটা বেতন আর হাঁকডাক দেখে ব্যাংক কর্মকর্তাগণ দ্বিধা করেনি বললেই চলে। লোন স্যাংশান হতেও লাগে মাত্র সপ্তাহখানিক এর মত। ওকে ব্যাংকেও যেতে হয়নি; একজন অফিসার এসে তার অফিস রুমে বসেই সকল ফর্ম পূরণ করে শুধু তার স্বাক্ষর নিয়েছিল বেশ কয়েক জায়গায়। সব কাগুজে কাজ শেষ হবার পর খলিল নামের অফিসারটি একটা প্রস্ন করে ওঠেঃ
"স্যার, গ্যারান্টর কে হবেন?
হাহ?
জ্বী স্যার, একজন গ্যারান্টরের নাম লাগবে, এবং তার পদবী ও স্বাক্ষর।
গ্যারান্টর এর কাজ কি?
হেহে করে মৃদু একটা হাসি দিয়ে খলিল উত্তর দিলো, এটা আসলে কিছু না স্যার। একটি ফর্মালিটি।
না আপনি খোলাসা করে বলুন। ব্যাংকার আর আইনজীবিদের আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করি না।
মানে হল কোন কারণে আপনি যদি লোন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন, তবে ইনি আপনার পক্ষ থেকে সেই লোনের জন্য দায়বদ্ধ হবেন।

হাহাহা করে হেসে উঠলো কামাল। এক্টুও দ্বিধা না করে বল্লো "ঠিক আছে, রাশেদ ভাই হবেন আমার গ্যারান্টর।"
রাশেদ কে এক কথা বলার পর সেও বেশ কিছুক্ষণ হেসেছিলো। বল্লো"কামাল তুই আমাকে কিসে ফাসাচ্ছিস বল তো? না হয় পার্কার কলমটি দেই নি সেদিন, তাই বলে আমাকে এরকম বিপদে ফেলবি?"
এ পর্যায়ে কামাল এর চিন্তার সূত্র ছিন্ন হয় ড্রাইভের গালিগালাজ আর হর্ণ এর তীব্র শব্দে। সামনে নাকি হঠাত করে এক বাইক চালক ব্রেক কষেছে কোন ধরণের সংকেত না দিয়েই। আরেকটু হলেই ঘটে যেতে পারতো মারাত্নক দূর্ঘটনা। মিজান সমানে গালি দিয়েই যাচ্ছে।
কামাল বিরক্ত হয়ে মিজান কে থামতে বল্লো। সে থামলেও গজগজ করতে লাগলো।
সামনে ট্রাফিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য বুক পকেট থেকে মোবাইল ফোনটি বের করলো কামাল। বের করতে গিয়ে বুক পকেটে সেই পার্কার কলমটির অস্তিত্ব টের পেলো । অনেক শখের কলমটি। সেদিন না দিলেও কিছুদিনের মধ্যেই রাশেদ তাকে কলমটি দিয়ে দিয়েছিল। আর সে গ্যারান্টরও হয়েছিল কার লোনের।
ভাবতে ভাবতে আবার উদাস হয়ে গেলো কামাল। আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত উপলদ্ধি করলো যে অনেক সাদা মেঘ দেখা যাচ্ছে। আজকেও মনে হয় ইফতারটা রাস্তায় করা লাগবে।
(চলবে)

No comments: