উনার দেড় বছর বয়সী নাতি কোন এক বিচিত্র কারণে ট্যাবলেটের প্যাকেট কে মোবাইল ফোন বানিয়ে খেলতে ভালবাসে। এক প্যাকেট নিয়ে আবার বেশিক্ষন খেলে না। কিছুক্ষন খেলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তাই প্রায়শয়ই নতুন প্যাকেট লাগে তার।
পিতলের গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে একটি তৃপ্তির ঢেকুর তুল্লেন তিনি। যদিও এই তৃপ্তি ওষুধের জন্য না। আজকে বড় ছেলের বউ মুরগীর কোরমা বানিয়েছিল, মজা করে খেতে খেতে একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছেন। স্ত্রীর ভ্রকুটি কিংবা ছেলের উষ্মা প্রকাশকে পাত্তাই দেননি।
অন্যমনষ্কভাবে তিনি সকালের ওষুধগুলো গুছিয়ে রাখলেন। ক্যালসিয়াম ট্যাবলেটের একটা পুরনো, খালি কৌটায় তিনি ওষুধগুলো গুছিয়ে রাখেন। সকালে ওষুধ খুজে খুজে বের করতে কষ্ট বেশি হয় দূর্বল চোখের কারণে।
এই খালি কৌটা নিয়েও অনেক কাহিনী হয়। অন্তত তিনবার ভেতরে ওষুধ থাকা স্বত্ত্বেও খালি মনে করে কাজের বুয়া এই শিশিটি আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। একবার তো তার নাতিও ফেলে দিয়েছিল কৌটা।
কাশেম সাহেব এক ধরণের কোয়ারেন্টাইনে আছেন। উনার মেঝ ছেলের কয়দিন আগে কোভিদ ১৯ ভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়েছে। এরপর থেকে ছেলে মেয়েরা বয়স্ক বাবাকে তার রুমে আটকে ফেলেছে। আগে সকালের নাস্তা খেয়ে তিনি হাটতে বের হতেন। হাঁটা শেষে কামালের দোকানে এক কাপ চা আর সাথে একটা বেনসন লাইটস--
নাহ, সেসব কথা আর ভাবতে চান না কাশেম সাহেব। মাত্র তিন মাস ঘরে আটকা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল ধরে তিনি এক বিরক্তিকর জেলখানায় বন্দী। প্রথম প্রথম "বাসায়" আটক ছিলেন, এখন "ঘরে" আটক। বাসা আর ঘর যে এতবড় পরিবর্তন এনে দেবে তার জীবনে, সেটা কে জানতো?
তিনি মাঝে মাঝে চিন্তা করেন, কিভাবে নেলসন ম্যান্ডেলা এতদিন জেলে বন্দী ছিলেন? তার জীবনটা কেমন ছিল?
কিন্তু এ প্রসঙ্গে তার মনে পড়লো যে জেলখানার কয়েদীদের জন্য সিগারেট তেমন কঠিন কোন ব্যাপার না। সেদিন একটি প্রবন্ধে পড়েছিলেন যে অনেক জেলখানায় সিগারেট হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম। সব কিছুর মূল্য সিগারেট দিয়ে মাপা হয়। যেমন একটি পাউরুটির দাম ৪টি সিগারেট, এক বার সাবানের দাম ১০ সিগারেট, এক প্যাকেট কফির দাম ১০০ সিগারেট আর এক বোতল শ্যাম্পুর দাম ২০০টি সিগারেট, এরকম সব হিসাব প্রচলিত ওখানে।
সে অর্থে তার অবস্থা কয়েদীদের চেয়েও খারাপ। নিকোটিন আর আলো বাতাসের অভাবে নিজেকে নিঃসার লাগে তার। তবে কোয়ারেন্টাইনে থাকলেও তার নাতী নাত্নীদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি তিনি।
দৌড়ে দৌড়ে চলে আসে তারা প্রায়ই। ভেজানো দরজা খুলে চোরের মত ঢুকে পড়ে। তীব্র প্রতিবাদ কে অগ্রাহ্য করে দাদার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুদে শয়তানগুলো। আবার হঠাত করে ভোজবাজীর মত উধাও ও হয়ে যায়, বাবা মায়ের ভয়ে।
এভাবেই চলছিল কাশেম সাহেবের দিনগুলো।
হঠাত সেদিন সকালে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা ওষুধগুলো কেউ খেতে আসলো না। রাতের বেলায় বন্ধ রুমে উনার ক্রমাগত শ্বাসকষ্টজনিত কাশির শব্দ কেউই বাইরে থেকে শুনতে পায়নি।
"আহারে, বাবা মুরগীর কোর্মাটা খুব পছন্দ করে খাচ্ছিল। তোমরা বকা দিয়ে খেতে দিলে না। শেষ খাবারটাও শান্তিমত খেতে পারলো না"।
এম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন, চারপাশে ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত কান্নাকাটির শব্দ আর অসাড়, স্থবির মানুষের দল। শিশুদের অবাক করা প্রশ্ন "ওরা দাদাকে কেন নিয়ে যাচ্ছে? তোমরা কেউ কেন যাচ্ছ না সাথে?"
"হায় অবুঝ, বেকুব, শিক্ষিত ও "বড়" মানুষ, এত কিছুর মাঝে তোমার মাথায় শুধু কোর্মার কথাই আসলো? "
(সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment